#প্রাণেশ্বরী #Writer_Asfiya_Islam_Jannat #পর্ব-৩৭

#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩৭

সায়াহ্নের প্রহর। প্রগাঢ় নীল নভস্থল জুড়ে রঙ্গিন মেঘের অহর্নিশ আনাগোনা৷ গোলাপি আভা ছড়াচ্ছে যেন। বাতাসে বইছে ভিনদেশি কোলাহল। মাতৃভূমির সেই চিরচেনা সুগন্ধি অপরাগ। আলো বিলীন হচ্ছে পশ্চিমাকাশে। জ্বলে উঠছে নিয়ন বাতি৷ বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই প্রাণের চোখে পড়লো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা লন্ডন আই-এর দিকে। শয়নকক্ষের লাগোয়া অলিন্দ থেকে স্পষ্ট দেখা যায় সে-টা। বৃহৎ গোলাকৃতি চাকাটির গা বাহারি দ্যুতিতে আবৃত। ধীর গতিতে ঘুরছে যেন। নিচ থেকে ভেসে আসছে থামাস স্রোতোবহার সুমধুর ধ্বনি। প্রাণ সরু রেলিং-এর উপর দুই হাত ভর দিয়ে তাকিয়ে থাকলো সেদিকেই। একমনে, এক দৃষ্টিতে। কর্ণকুহরে এসে বারি খাচ্ছে দরজার সাথে ঝুলিয়ে রাখা উইন্ড চিমের টিংটিং শব্দ। যৎসামান্য সময় অতিবাহিত হতেই ছন্দ পিছন থেকে কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো, “আ..পনি এ..খানে ক..কি করছেন?”

প্রাণ ভড়কালো না। শান্ত ভঙ্গিতেই পিছন ফিরে তাকালো। ছন্দ পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, “কি করছেন?”

প্রাণের নিশ্চুপ কন্ঠ ধ্বনিত হলো, “কিছু না।”

ছন্দ দ্রুত কয়েক পা চালিয়ে প্রাণের এক বাহু ধরে তাকে নিজের সন্নিকটে নিয়ে আসলো। এক নজর খোলা বারান্দার বাহিরে তাকালো। রেলিং আছে তবে কোমর পর্যন্ত। ছন্দ এবার প্রাণের দিক তাকিয়ে বলল, “আমার অনুপস্থিতি আপনি কখনো বারান্দায় আসবেন না। বুঝেছেন?”

প্রাণ নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকালো। ছন্দ তটস্থ কন্ঠে বললো, “আপনি ভিতরে যান এখন। ফারিনাজ খোঁজ করছিল আপনার।”

প্রাণ কিয়ৎক্ষণ ছন্দের দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেল ভিতরে। প্রাণ যেতেই ছন্দ পিছনের দেয়ালে পিঠ ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো৷ আঁখি দুটির কপাট বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো কয়েকবার। এরপর এক পলক তাকালো এগারো তালার নিচে। বিকেলের দিকে সে প্রাণকে নিদ্রাবিষ্ট অবস্থায় রেখে বেরিয়েছিল ফারহাজের সাজেস্ট করা সাইকিয়াট্রিস্ট ইলানের সাথে দেখা করতে। প্রাণের চিকিৎসা সে যতদ্রুত সম্ভব শুরু করতে চাচ্ছিল বলে তার যত মেডিক্যাল হিস্ট্রি আছে সব কাছে জমা দিয়ে আসে৷ ডা. ইলান সব রিপোর্ট দেখে তাকে জানাবে বলেছেন। বাসায় এসে ছন্দ প্রথমে প্রাণকে খুঁজে, রুমে তাকে না দেখে বারান্দার দিক যায়। তবে তখন প্রাণকে সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে থাকতে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য শ্বাস আটকে যায় তার। অপ্রীতিকর ভাবনা হানা দেয় মনোরাজ্যে। হিম শিহরণ বয়ে যায় রন্ধ্রে। তাই তো সেসময় অদ্ভুত আচরণ করে বসেছিল সে।
ছন্দ আনমনে বলে উঠলো, “আপনার ঠিক হওয়াটা এখন ভীষণ জরুরি প্রাণ। ভীষণ জরুরি।”

_______

সপ্তাহ খানেক হতো চললো প্রাণের চিকিৎসা শুরু হয়েছে। দু’দিন অন্তর তার সেশন চলছে আর চারবেলা মেডিসিন। ডা. ইলান বেশ নাজুক হাতে প্রাণকে সামলাচ্ছেন। বিশেষভাবে খেয়াল রাখছেন। কেন না পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি বুঝেছেন যে, প্রাণ আচরণগত দিক দিয়ে শক্ত হলেও মানসিক দিক দিয়ে প্রচন্ড দূর্বল৷ এতদিন মেডিসিনের প্রকোপে সে স্বাভাবিক ছিল, মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত নার্ভগুলো শান্ত ছিল৷ তবে এখন অবস্থা বিগড়ে গিয়েছে অনেকখানি। মানসিক চাপ এত নিয়ে ফেলেছে যে র*ক্ত চলাচল অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল তার। উপরন্তু, হাই ব্লাড প্রেশার তার আগে থেকেই ছিল। যদিও তার চিকিৎসা আরও আগে করানো উচিৎ ছিল তবুও একবারে দেরি হয়ে যায়নি। হাতের নাগালেই আছে সব। আশা করা যায় ভালো কিছুর।
প্রথমদিকে ডা. ইলান প্রাণের অবস্থা দেখে কিছুটা ভয়ে ছিলেন। যেরকম মানসিক অবস্থা প্রাণ ছিল ব্রেনে ক্লট হওয়ার সম্ভাবনা ছিল শতভাগ। আর ব্রেন ক্লট হলে প্রাণের জীবন নিয়ে ঝুঁ*কি ছিল। তবে তেমন কিছু রিপোর্টে ধরা পড়েনি বলে স্বস্তি।

প্রাণ একবারে স্বাভাবিক না হলেও কিঞ্চিৎ পরিমাণ হয়েছে বলা যায়। আগে তার কণ্ঠলগ্ন দিয়ে দুটো শব্দ বেরুতে না চাইলেও এখন বেরোয়। শত কথার বিপরীতে তিন-চারটের বেশি কথা বলে। যদিও এর পিছনে সম্পূর্ণ অবদান ফারিনাজ আর নাফিসার। বাসায় অবস্থানরত অবস্থা তারা একমুহূর্তের জন্য প্রাণকে নিঃসঙ্গ থাকতে দেন না। এটা-সেটার মাঝে ব্যস্ত রাখে তাকে। আরশাদ নিজেও চেষ্টা করেন উইকেন্ডে সবাইকে বাহিরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার। আর ছন্দ তো সর্বক্ষণ আছেই ছায়ার মতো পাশে। সব মিলিয়ে প্রাণের অবস্থায় উন্নতিই দেখা দিচ্ছে বলা যায়।

ফারিনাজের আবদার রাখতে ছন্দ সকলের জন্য স্টারবাগ’স থেকে ফ্র্যাপুচিনো ও সিনামেন রোলস নিয়ে আসে। বাসায় ঢুকতেই সে দেখতে পায় ফারিনাজ সোফায় বসে প্রাণের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। ফারিনাজ স্বভাবগত প্রাণোচ্ছল ও একটু বাঁচাল প্রকৃতির। একবার কথা বলার শুরু করলে থামাথামির নাম নেই। ছন্দ এগিয়ে এসে বলল, “কত কথা বলিস? এবার তো একটু অফ যা। আর তোর বলা জিনিস নিয়ে এসেছি, খা।”

ফারিনাজ মুখ ফুলিয়ে বলল, “আমি ভাবির সাথে কথা বললে তোর এত জ্বলে কেন?”

ছন্দ বিরবির করে উঠল, “বরের বদলে বউ যদি সারাক্ষণ ননদের সাথে চিপকে থাকে তাহলে কার না জ্বলবে?”

ছন্দ নিজের সাথে বলতে দেখে ফারিনাজ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কি বলছো, জোরে বল। শুনি না তো কিছু।”

ছন্দ বিমর্ষ কন্ঠে বলল, “তোর এত বড়দের কথা শুনে লাভ নেই। বাচ্চা মানুষ, বাচ্চার মত থাক।”

এই কথার বিপরীতে ফারিনাজ ফট করে বলে উঠল, “তাইলে তুমিও তো ভাবির সামনে বাচ্চা।”

কথাটা শোনামাত্র ছন্দ তী*র্য*ক দৃষ্টিতে তাকালো। ফারহাজ বয়সের বিষয়টা গোপন রেখেছিল সকলের নিকট হতে। তবে ফারিনাজ কিভাবে যেন জেনে যায় আর এরপর থেকে সুযোগ পেলে ছন্দকে খোঁ*চা*তে ভুলে না। যদিও আরশাদ-নাফিসার সামনে সে কখনো মুখ খুলে না। ছন্দ দাঁতের পৃষ্ঠে দাঁত পি*ষে বলল, “ফারুর বাচ্চা, থা*প্প*ড়-টা*প্প*ড় খাওয়ার আগে চোখের সামনে থেকে দূর হো।”

“তোর চাকর নাকি আমি যে তুই বলবি আর আমি চলে যাব? আমার চেহারা দেখতে মন না চাইলে নিজে যা রুমে।”

কথাটা বলে ফারিনাজ ব্যাগ থেকে দুইটা ফ্র্যাপুচিনো বের করে নিল। একটা কাপ প্রাণকে দিয়ে আরেকটা নিজে খেতে থাকলো। প্রাণ তখনও সোফার রুমেই ছিল বিধায় ছন্দ গেল না। ব্যাগ থেকে আইস টি-র কাপটা বের করে সামনের দিকে রুষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে সোফায় বসে রইলো। ফারিনাজ খাচ্ছে আর নিচুস্বরে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে। প্রাণ তা নীরবে মনোনিবেশ দিয়ে শুনছে। মাঝে মধ্যে স্মিত হাসছে। প্রাণের এই সামান্যটুকু হাসি ছন্দের খরানি হৃদয়ে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে নামলো যেন। প্রশান্ত হাওয়া প্রবাহিত হলো চারদিকে। এর মাঝে নাফিসা এসে যোগ দিলেন তাদের মাঝে। ছন্দ তাই আর সেখানে বেশিক্ষণ থাকলো না। নিভৃতে উঠে চলে আসলো রুমে।

_____

আজ ডা. ইলানের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ শেষে ছন্দ প্রাণকে নিয়ে বের হলো ঘুরতে। গন্তব্য কিংস ক্রস স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ৯, ৩/৪। মূলত হ্যারি পটার সিরিজে হগওয়ার্টস স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য যে স্টেশন মূখ্য ছিল সেখানে। চৈতির কাছে জেনেছে সে, কিশোরীকালে প্রাণ হ্যারি পটার সিরিজের হিউজ ফ্যান ছিল৷ সেকালে মুভির ক্যাসেড থেকে শুরু করে বইয়ের ফুল কালেকশন সংগ্রহ করেছিল সে। এতটাই পা*গ*ল ছিল হ্যারি পটারের জন্য। বাসায় এখনো সেসব যত্নে রাখা আছে। তাই প্রাণকে পুরোনো দিনের মিষ্ট স্মৃতিতে ডু*ব দেওয়াতে ছন্দ এই জায়গা নির্ধারণ করেছে। একটা ভ্রমণ নাহয় হয়ে যাক হ্যারি পটারের কল্পনার রাজ্যে।

আন্ডারগ্রাউন্ড বুলেট ট্রেনে চড়ে তারা চলে আসে কিংস ক্রস স্টেশনে। কাঙ্ক্ষিত প্ল্যাটফর্মে আসতেই প্রাণ বিস্ময় দৃষ্টিতে চারদিক দেখতে থাকলো। অভিব্যক্তি স্পষ্ট বোঝা না গেলেও প্রাণ যে খুশি তা বুঝতে পারলো ছন্দ। এ নিয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেল সে। অতঃপর প্রাণকে নিয়ে চারদিকে দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ভ্যানেশিং ওয়াল দেখা শেষ পাশের একটা দোকানে ঢুকলো ছন্দ। সেখানের পুরোটাই হ্যারি পটারের জিনিসপত্র দিয়ে ভরপুর ছিল। প্রাণ কিছু নিতে চায় কি-না দেখার জন্যই দোকানটায় ঢুকা। তবে মানুষের উপচে পড়া ভিড় থাকায় ছন্দ ও প্রাণ বার বার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। হাত ধরেও কাজ হচ্ছিল না বিধায় সে বাধ্য হয়ে এক হাতে প্রাণের কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে আসে৷ প্রাণ এতে কিছুটা শিউরে উঠলেও বলল না কিছু, আস্তে আস্তে হাটতে থাকলো ছন্দের সাথে। এর ফাঁকে ছন্দ প্রাণকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি নিবেন না কিছু?”

প্রাণ চারদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে হিম কন্ঠে বলল, “পছন্দ হলে নিব।”

ছন্দ কথা বাড়ালো না। প্রাণ আরও কিছুক্ষণ ঘুরে দুই-একটা জিনিস কিনলো। অতঃপর দুইজনে সেখান থেকে বের হয়ে সামনের একটি বেঞ্চে বসলো। প্রাণকে বসিয়ে দিয়ে ছন্দ গেল কিছু কিনে আনতে। কিয়ৎক্ষণের মাঝেই সে ফেরত আসলো কিছু খাবার ও কোমল পানীয় নিয়ে। প্রাণ প্রথমে পানীয়টা নিল, তার তেষ্টা পেয়েছিল অনেকক্ষণ ধরেই।
এই ফাঁকে ছন্দ জিজ্ঞেস করলো, “এখানে এসে ভালো লেগেছে? প্রিয় চরিত্রগুলো উপলব্ধি করতে পেরেছেন?”

প্রাণ মৃদু হেসে বলল, “হ্যাঁ!”

বিপরীতে ছন্দও হাসলো। কয়েকদিন ধরে প্রাণ হাসতে শিখেছে। এর চেয়ে বেশি ছন্দের আর কি লাগে? সে এখন মনে প্রাণে দোয়া করছে প্রাণ যেন আগের মত হয়ে উঠে। ভালোবাসুক আর না বাসুক, এট লিস্ট ঝগড়া করুক তার সাথে। প্রাণবন্ত হয়ে উঠুক।
ছন্দ খাওয়ার জন্য স্যান্ডউইচ এনেছিল। প্রাণ সে-টা খাওয়ার সময় কিছুটা মেয়োনিজ মুখে লাগিয়ে ফেলে। ছন্দ তা দেখতে পেয়ে প্রাণের দিক খানিকটা ঝুঁকে ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে তা মুছে দিল। ঠিক এই মুহূর্তে একজন অজানা ফটোগ্রাফার এসে তাদের ছবি তুলে ফেললো। এতে প্রাণ ও ছন্দ দুইজনই বিব্রতবোধ করলো। ছন্দ ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকাতেই লোকটা হাস্যজ্বল মুখে তাদের সামনে এসে ইংরেজিতে বলল, “দুঃখিত! এভাবে আপনাদের অনুমতি ছাড়া ছবি তোলার জন্য। কিন্তু এত মিষ্টি একটা দৃশ্য হাতছাড়া করতে চাচ্ছিলাম না তাই এভাবে ছবিটা তোলা। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।”

ছন্দ বলল, “ইটস ওকে।”

লোকটা নিজ থেকেই পরিচয় দিল আর জানালো তারা চাইলে ছবিটা সে ইমেইল করে দিবে। ছন্দও আপত্তি জানালো না এতে। কিন্তু শর্ত দিল তাদের ছবি যাতে বাহিরে কোথাও না যায়। ফটোগ্রাফারটা রাজি হলো এতে এবং দুইজন নিজেদের ইমেইল আইডি নিয়ে নিল। যাওয়ার আগে ফটোগ্রাফারটা প্রাণের দিকে তাকিয়ে বলল, “ইউর আর সাচ আ প্রিটি। আর ইউ গাইজ আ কাপল?”

প্রাণ প্রত্যুত্তর করলো না। তার পরিবর্তে ছন্দ বলে উঠলো, “ইয়েস উই আর। আ’ম হার হাসবেন্ড।”

ফটোগ্রাফারটা বলল, “অহ! দেটস গ্রেট। উইশিং ইউ গাইজ আ হ্যাপি ম্যারিড লাইফ।”

কথাটা সে চলে গেল। ছন্দ এবার প্রাণের দিকে কিছুটা অসন্তুষ্ট কন্ঠে বলল, “আমি বর হিসাবে এতটাও খারাপ না। আমাকে আপনার বর বললে মানুষ মুখ ফিরায় নিবে না।”

#চলবে
[কপি করা নিষেধ।]
[রি-চেক করা হয়নি।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here