#প্রাণেশ্বরী #Writer_Asfiya_Islam_Jannat #পর্ব-১০

#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-১০

“আরেহ! আপনি মিস. ল্যাভেন্ডার না? ওইদিন আমার সাথে সুইমিংপুলের পাশে ছিলেন যে?”

প্রাণ নজর তুলে তাকায়, সম্মুখে সেদিনের শ্যাম পুরুষটি। লম্বাটে চেহেরায় সরু নাকটি উঁচু হয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে মিহি হাসির রেখা। প্রাণ মানবটিকে চিনতে পেরে দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো। স্মিত কন্ঠে বলে, “তাই তো মনে হয়।”

প্রাণের বাঁকা উত্তরে মানবটি ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে তাকায়। এই মেয়েটা কি কখনো সোজা,সাবলীল ভাষায় উত্তর দিতে জানে না? পেটে প্যাঁচ নাকি মাথায় কে জানে। সে থমথম মুখে বলে, “ইউ আর টু মাচ কমপ্লিকেটেড। স্বাভাবিকতা বোধহয় আপনার রক্তেই নেই মিস. ল্যাভেন্ডার।”

প্রাণ বুঝলো সেদিন সে ল্যাভেন্ডার কালারের ড্রেস পড়েছিল বিধায় তাকে সেই নামে ডাকছে মানবটি৷ বিষয়টা পছন্দ না হওয়ায় সে স্ক্রিপ্টের দিকে নজর বুলাতে বুলাতে বলে, “আ’ম নট এনি মিস. ল্যাভেন্ডার। নাম আছে আমার একটা।”

মানবটি ইচ্ছে করে ত্যাড়া উত্তর দিয়ে বলল, “নামটা বুঝি আমার জানার কথা?”

প্রাণ নয়নযুগল তুলে তাকায়, “নুসাইবা আরা প্রাণ, রিমেম্বার ইট।”

মানবটি টেনে একবার প্রাণের নাম উচ্চারণ করে ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলে, “নাম প্রাণ অথচ কথাবার্তা এক্কেবারে নিষ্প্রাণ।”

কথাটা প্রাণ কর্ণগোচর হলো ঠিক কিন্তু সে কোনপ্রকার অভিব্যক্তি দেখালো না। মানবটি কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই সেখানে দীপক সরকার এসে হাজির হন। তিনি মূলত এই অ্যাডভার্টাইজমেন্টের ডিরেক্টর। কোনপ্রকার ভূমিকা ছাড়াই তিনি বলে উঠেন, “বাহ! তোমরা দেখছি সময়ের আগেই চলে এসেছ। আই লাইকড দ্যা স্পিরিট। তা তোমরা নিশ্চয়ই একে অপরকে চিনে থাকবে কিন্তু তবুও আমি একবার তোমাদের পরিচয় দিচ্ছি। প্রাণ ও হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন ফায়াজ তুরহান ছন্দ, আর ছন্দ ও হচ্ছে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পী নুসাইবা আরা প্রাণ। এই অ্যাডভার্টাইজমেন্টে তোমরা একসাথে কাজ করবে।”

প্রাণ প্রথমে কোন প্রকার প্রত্যুত্তর না করে শীতল দৃষ্টিতে একবার ছন্দের দিকে তাকালো, অতঃপর ঠোঁটের কোণে সৌজন্যমূলক হাসি ঝুলিয়ে বলল, “নাইস টু মিট ইউ মি. ছন্দ।”

ছন্দও বলে উঠে, “সেম হিয়ার মিস. প্রাণ।”

তাদের দুইজনের কথা শেষ হওয়া মাত্র দীপক বলে উঠেন, “তোমরা দুইজন স্ক্রিপ্ট পড়ে নিয়েছ না? সেট কি রেডি করতে বলল?”

প্রাণ প্রত্যুত্তরে বলে, “করতে পারেন, আমার কোন সমস্যা নেই।”

ছন্দ প্রাণের কথায় সমর্থন জানিয়ে বলে, “আমারও না।”

দীপক হেসে বলবেন, “বেশ! তাহলে দুইজন প্রস্তুতি নিয়ে নাও, কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা শুট শুরু করছি।”

কথাটা বলেই দীপক সরকার জায়গাটি প্রস্থান করলেন। ছন্দ আড়চোখে একবার প্রাণের দিক তাকিয়ে গ্রিনরুমের দিকে চলে যায়। তার আরেকবার স্ক্রিপ্টটা দেখা প্রয়োজন।

_______

ইতিমধ্যে শুট শুরু হয়ে গিয়েছে৷ একজন প্রোফেশনাল আর্টিস্ট হওয়া সুবাদে প্রাণ চট করে নিজেকে সবকিছুর সাথে খাপ খায়িয়ে নিয়ে নিজের অভিনয় খুব নিপুণভাবে প্রদর্শন করল। তবে বাঁধা প্রাপ্ত হলো ছন্দ৷ এমন নয় যে সে এসবের সাথে পূর্বপরিচিত না বা অভিনয়ে অদক্ষ৷ আগে সে বেশ কয়েকটা সলো অ্যাডভার্টাইজমেন্ট করেছে। তবে এবার তার সমস্যা মূলত প্রাণ, কেন যেন প্রাণের সাথে স্বাভাবিক হতে পারছে না সে। যতবারই সে প্রাণের সামনে যাচ্ছে দ্বিধা,সংশয় কাজ করছে। গলা শুকিয়ে আসছে। এর একটি কারণ সেদিন রাতের ঘটনা, আরেকটি আগে কখনো কোন নারী চলচ্চিত্র শিল্পীর সংস্পর্শে কাজ না করার অভিজ্ঞতা। তার জন্য জিনিসটা বেশ জটিল মনে হচ্ছে। এদিকে দীপক সরকারও কোনভাবেই পার্ফেক্ট শর্ট পাচ্ছেন না, বার বার রি-টেক নিয়েই চলেছেন। এক সময় ত্যক্ত হয়ে তিনি ছন্দকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ছন্দ তুমি এত নার্ভাস হচ্ছ কেন? এটা নরমাল একটা শুট। আমি টি-ব্রেক দিচ্ছি, তুমি নিজেকে ততক্ষণে শান্ত করে ঠিকঠাক মত প্রস্তুত করে নাও।”

ছন্দ মাথা দুলালো৷ এগিয়ে গিয়ে বসলো নিজের চেয়ারে৷ পাশে রাখা বোতলটা হাতে নিয়ে এক নিমিষেই সবটুকু পানি পান করে নিল। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে হাতে স্ক্রিপ্ট ধরে নিজের লাইনগুলো আনমনে বার বার আওড়াতে থাকলো। সে বুঝে না বাকিরা কিভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে নায়িকার সাথে সকল দৃশ্য ফটাফট করে ফেলে। এদিকে সে তো সাধারণ চার-পাঁচ লাইনেই ঠিক মত বলতে পারছে না, কি এক অবস্থা। তার মনে হলো, এই অভিনয় জিনিসটার চেয়ে ঢেড় গুণ সহজ হাতে ব্যাট উঠিয়ে মাঠে নেমে একের পর এক সেঞ্চুরির রেকর্ড করা। এই জীবনে আর সে অভিনয় করার মত পাপ করছে না। এই লাস্ট! নিজের ভাবনায় যখন ছন্দ মশগুল তখন তার পাশে চেয়ার টেনে বসলো প্রাণ। মন্থর কন্ঠে বলল, “আমার জন্য কি আপনার সমস্যা হচ্ছে? হলে বলব জড়তা কাটিয়ে উঠুন নাহলে নিজের বেস্টটা প্রেজেন্ট করতে পারবেন না আপনি।”

ছন্দ পাশে তাকিয়ে প্রাণকে দেখতে পেয়ে মনে মনে খানিকটা অবাক হলেও , অভিব্যক্তি স্বাভাবিক রেখে এক গাল হেসে বলল, “থ্যাংকস ফর দ্যা ক্যারেজ। আমি চেষ্টা করছি খাপ খায়িয়ে নেওয়ার। বাট…”

প্রাণ জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই ছন্দ বলে উঠে, “সরি ফর দ্যাট নাইট। আমার ওভাবে আপনাকে ধাক্কা দেওয়া ঠিক হয়নি।”

“সেখানে আমার সম্মতি ছিল, তাই গিল্ট ফিল করার কোন কারণ নেই৷ বি ইজি এন্ড ফিল ফ্রি৷”

ছন্দ মাথা নাড়িয়ে বলে, “আচ্ছা।”

প্রাণ আর কিছু সময় কথা বলে চলে গেল। ছন্দ সেদিক তাকিয়ে বিরবির করে উঠল, “যতটা অ্যারোগান্ট ভেবেছিলাম ততটাও নন আপনি।”
.
অতঃপর পুনরায় শুটিং চালু হতেই পরপর তিন টেক-এ ছন্দ আর প্রাণ মিলে পুরো অ্যাডভারটাইজমেন্টটা কমপ্লিট করে ফেললো। শুট শেষে প্যাক আপ হতেই ছন্দ প্রাণের সামনে এসে বলে, “আবারও ধন্যবাদ। তখন আপনার জন্যই কমফোর্টেবল হতে পেরেছিলাম আমি।”

প্রাণ এক ঝলক তার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, “ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই, এটা আমার দায়িত্ব ছিল।”

কথাটা শুনে ছন্দের কপালে ভাঁজ পড়ে। আবার সেই প্যাঁচানো কথা? আর কিসের দায়িত্ব? মানে কি? ছন্দ কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই পাশ থেকে চৈতি উৎসাহ ভরা কন্ঠে বলে উঠে, “ছন্দ স্যার! আমাকে আপনার একটা অটোগ্রাফ দিবেন প্লিজ? আমার ছোট ভাই আপনার অনেক বড় ফ্যান, আপনাকে আইডল মানে সে। ও আপনার অটোগ্রাফ পেলে খুব খুশি হবে।”

ছন্দ মিষ্টি করে হাসতেই মুহূর্তে তার গালে গর্তের আবির্ভাব হলো। আকর্ষণ যেন বৃদ্ধি পেল কয়েক গুণ। সে খুব বিনয়ী কন্ঠে বলল, “অবশ্যই দিব। বলুন কোথায় অটোগ্রাফ দিতে হবে?”

চৈতি দ্রুত তার হাতে থাকা নোটপ্যাড আর কলম এগিয়ে দিয়ে বলল, “এখানে দিলেই হবে।”

ছন্দ হেসে নোটপ্যাডটা হাতে নিয়ে অটোগ্রাফ দিয়ে দিল। চৈতি পুনরায় একটা সেলফির জন্য রিকুয়েষ্ট করলে ছন্দ সেটাও তুললো। ছবি তোলা শেষে ছন্দ প্রাণের দিকে তাকালো। প্রাণ তার দিকে না তাকিয়ে চৈতিকে তাড়া দিল বের হওয়ার জন্য। চৈতি প্রাণের কথা অনুযায়ী দ্রুত সব গুছিয়ে নেওয়ামাত্র প্রাণ কোনদিক না তাকিয়ে নিশ্চুপ পায়ে হেঁটে বেড়িয়ে গেল। চৈতি ছন্দকে একবার ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে ছুটলো প্রাণের পিছু পিছু। ছন্দ প্রাণের যাওয়ার পাণে তাকিয়ে থাকলো। সে না কোন বিদায় জানালো, না কোন সৌজন্যতা দেখাল। মানে সে ভেবে পায় না এই মেয়েটা এমন কেন? সে কি এমনই অ্যারোগান্ট নাকি এটা তার স্বভাবই? কে জানে। তবে এই নারীকে বোঝা দূলর্ভ ব্যতীত কিছুই মনে হলো ছন্দের। সে বিরবির করে বলে, “আমি আমার আগের ভাবনা ফেরত নিলাম। আপনি মোটেও সুবিধার না মিস. ল্যাভেন্ডার।”

__________

পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে অরুণসারথি। আঁধারের সাথে শীতলতা মিশতেই স্বেদাক্ত নগরী শুষ্কতার আস্তরণে বন্দী হলো। হিম বাতাসের ছোঁয়া পেয়ে গুঞ্জন তুললো দোলায়মান গাছ-গাছালিরা। সুবাস ছড়ালো বেলি ফুলেরা। অজস্র নক্ষত্র টিমটিম করে জ্বলতে থাকলো কৃষ্ণবর্ণ অম্বরে। প্রাণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজকের পরিবেশ উপভোগ করতে থাকলো। সে সাথে ভাবতে থাকলো নিজের পরবর্তী পদক্ষেপের কথা। হঠাৎ তার ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠতে মনোযোগ সেদিক চলে গেল। মুঠোফোন হাতে নিয়ে মেসেজ চেক করতেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা দিল। সবকিছু নিজের পরিকল্পনা মাফিক চলতে দেখে আলাদা শান্তি অনুভব করল অন্তঃকরণ জুড়ে৷ সে কিছুটা সময় নিয়ে ফোন লাগালো জেসিকাকে। কয়েকবার রিং হতেই জেসিকা ফোন তুললো। কুশল বিনিময় পর্ব শেষ হতেই প্রাণ বলে উঠল, “কাল ফ্রি আছিস কখন?”

জেসিকা ভেবে বলল, “দুপুরে আর সন্ধ্যার পরে৷ কেন?”

প্রাণ বলে, “তাহলে সন্ধ্যার পর পুরো টাইমটা আমার জন্য বুক করে রাখ। তুই কাল আমার সাথে শপিংয়ে যাচ্ছিস।”

জেসিকা জিজ্ঞেস করে, “হঠাৎ? দরকারী কিছু আছে নাকি সামনে?”

“আছে তো। কাল আয় আগে তারপর জানতে পারবি।”

জেসিকা ভেবে বলে, “আচ্ছা।”

প্রাণ আর কথা না বাড়িয়ে ফোনটা রেখে দেয়। অতঃপর প্রকৃতির অপার্থিব সৌন্দর্যের মাঝে আবার ডু’ব দিয়ে গুণগুণ করে গান গাইতে থাকে। অপেক্ষা এখন কালকের, কালদিনটা বেশ যাবে তার।

#চলবে

[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here