#প্রাণেশ্বরী #Writer_Asfiya_Islam_Jannat #পর্ব-০৮

#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-০৮

“চোখে দেখেন না আপনি? কিভাবে হাঁটছিলেন এতক্ষণ? আরেকটু হলেই তো চ্যাপ্টার ক্লোস হয়ে যেত আপনার।”

প্রাণ ঘটনা কিছু বুঝতে না পেরে মুখ তুলে ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায় শ্যাম পুরুষটির দিকে। তখন মানবটির তু’খো’ড় দৃষ্টিও তার উপর থাকায় সং’ঘ’র্ষ হয় দুই দৃষ্টির। প্রাণ দৃষ্টি না সরিয়ে নিষ্পলক ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে, যা মুহূর্তেই মানবটিকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। এতদিন সে জানতো কোন নারী সহজতর সেকেন্ডের বেশি কোন পুরুষের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, অথচ এই মেয়েকে দেখো? কেমন গোলগোল চোখে তাকিয়েই আছে। লোকলজ্জায় এবার নিজেই দৃষ্টি নামিয়ে পাশে তাকিয়ে গলা খেঁকিয়ে বলে উঠে মানবটি, “একবারও কি খেয়াল করেছেন কোনদিকে হেঁটে চলেছিলেন আপনি? আর এক কদম এদিক-সেদিক হলেই তো সোজা পানিতে গিয়ে পড়তেন আপনি। আশপাশ যেই নির্জন, কেউ বাঁচাতেও আসতো না তখন।”

প্রাণ মানবটির দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকালো, কয়েক কদম দূরেই তার সুইমিংপুল যার গভীরতা প্রায় আট ফিটের কাছাকাছি। তখন প্রাণ আপন খেয়ালে এতটাই বিভোর ছিল যে কখন এদিকটায় চলে এসেছিল বুঝতেই পারেনি। আরেকটু হলেই যে সোজা পানিতে গিয়ে পড়তো তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই তার। উপরন্তু, সাঁতার জানে না সে, একবার পানিতে পড়লে হয়তো আসলেই বাঁচার সম্ভাবনা থাকতো না। কিন্তু তবুও এসব নিয়ে প্রাণের মাঝে তেমন একটা ভাবান্তর দেখা দিল না, সে ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যাম পুরুষটিকে উদ্দেশ্য করে মন্থর কন্ঠে বলল, “পড়লে পড়তাম। বড়জোড় কি হতো? ডু’বে মা’রা যেতাম, রেহাই পেতাম সবকিছু থেকে।”

প্রাণের এমন ভাবলেশহীন আচরণে মানবটির ভ্রু কুটি কুঞ্চিত হয়ে আসে। প্র’খ’র কন্ঠে বলে, “জীবন কতটা দামী তার কোন আন্দাজ আছে আপনার? জীবনোচ্ছ্বাসের সুন্দর সব অনুভূতি, নির্মল প্রকৃতি, আপনজনদের রেখে ম’রে যেতে চাওয়াটা সবচেয়ে বড় বো’কা’মি।”

প্রাণ ধাতস্থ কন্ঠে বলে, “সুন্দর জীবন দামী, বি’ষা’ক্ত জীবন নয়। আর মানুষের পরিস্থিতি ঠিক করে কোনটা বো’কা’মি, কোনটা নয়। এখানে সবটা উপলব্ধির বিষয়।”

মানবটি ভ্রু কুটি উঁচিয়ে বলে, ” মৃ’ত্যু’ এবং মানুষ যখন মুখোমুখি হয় ঠিক তখনই উপলব্ধিটা হয়, জীবনের মায়া,মর্ম বুঝতে পারে একজন। এর আগে না।”

প্রাণ হেসে বলে, “তাই নাকি?”

মানবটি তাচ্ছিল্যের সহিত বলে, “সন্দেহ আছে কোন? চাইলে এখনই প্রমাণ করে দিতে পারি৷ অনুমতি দিন শুধু।”

প্রাণ কাঠ কাঠ কন্ঠে বলে উঠে, “সিউর! গো আ…”

প্রাণ সম্পূর্ণ বাক্য শেষ করার পূর্বেই আগন্তুকটি প্রাণের এক হাত ধরে তাকে ধাক্কা দিয়ে পিছনের দিকে হেলিয়ে দেয়। মুহূর্তেই হাওয়াতে ভাসতে থাকে প্রাণ, দুই ইঞ্চি নিচেই তার জ্বলজ্বল করছে স্রোতহীন নীলাভ পানি। এই মুহূর্তে আগন্তুকটি তার হাত ছেড়ে দিলেই সে সোজা গিয়ে পড়বে পানিতে, এরপর হয়তো ডু’বেও যাবে। সবটা জেনে,বুঝেও তার চেহেরায় কোন দুশ্চিন্তা বা ভীতির বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। সে নির্বিকার তাকিয়ে আছে মানবটির দিকে। ছোট এই জীবনের প্রতিটি মোড়ে এত বিশ্রীভাবে প্র’তা’রি’ত হয়েছে যে সকল অনুভূতি এখন তার ভোঁ’তা হয়ে এসেছে। শান্ত-নির্বিরোধ মানুষটির সচ্ছল হৃদয় হয়ে উঠেছে বিষাদপূর্ণ,বিরাগী। এদিকে প্রাণের এমন অভিব্যক্তি দেখে মানবটি আশ্চর্যান্বিত না-হয়ে পারলো না। তার বিস্ময় দ্বিগুণ বাড়াতে প্রাণ বলে উঠল,”কি ফেলে দিচ্ছেন না যে? কারো প্রাণ নেওয়ার সাহস নেই?”

মানবটি নিজেকে ধাতস্থ করে প্রাণকে টেনে দাঁড় করালো। এক ধ্যাণে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। প্রাণের গভীর কালো মনিজোড়ার দিকে দৃষ্টি তাক করে বলল, “আছে! তবে আপনারটা নেওয়ার নেই।”

প্রাণ দূর্লভ হাসলো। মানবটি কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার মনে কি ভয়-ডোর বলে কিছু নেই?”

প্রাণ ম্রিয়মাণ কন্ঠে বলে, “উত্তর জানা নেই।”

মানুষটি বিরবির করে উঠলো, “অদ্ভুত!”

প্রাণ কথাটি শুনতে পেয়েও দ্বিরুক্তি করল না। তার মন তখন অন্য এক ভাবনায় আবদ্ধ। কিছু একটার হিসেব কষতে ব্যস্ত। মানবটি কিছু বলতে যাবে তার আগেই চারপাশ কাঁপিয়ে তার মুঠোফোনটি বেজে উঠে। সে পকেট থেকে মুঠোফোনটা বের করে স্ক্রিনে একবার নজর বুলিয়ে প্রাণের দিকে তাকালো সে। অতঃপর অন্য কিনারে গিয়ে ফোনটা ধরলো। মিনিটের মাঝে কথা বলা শেষ করে পিছনে ফিরতেই সেই মেয়েটিকে আর কোথাও দেখতে পেল না সে। চারদিক চোখ বুলিয়েও যখন কাউকে পেল না সে তখন ভ্রু কুঁচকে এলো তার। মুহূর্তেই মেয়েটা কোথায় গায়েব হলো গেল? আজিব তো!

_________

জিহানের সোর্স ভালো থাকায়, তার আমন্ত্রণে পার্টিতে আজ এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির প্রায় সকল নামি-দামি মানুষই হাজির হয়েছে। তাদের আগমনে পরিবেশ জৌলুসে পরিপূর্ণ। পাশ্চাত্য গানের সুর চলছে বাদ্যযন্ত্রে। অনেকেই এখানে সুযোগের সৎ ব্যবহার করে প্রডিউসার, ডিরেক্টরদের নজরে পড়ে প্রয়াস চালাচ্ছে। কেউ বা পূর্ব পরিচিত মানুষদের সাক্ষাৎ পেয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে। নিজ নিজ স্বার্থ অনুযায়ী সকলেই মশগুল। কারো সময় নেই নিঃস্বার্থভাবে কাউকে সময় দেওয়ার। সকলেই এখানে ভালোমানুষির মুখোশ পড়া, মতলববাজ, ছলনায় পরিপূর্ণ৷
কিছুক্ষণ পার্টি থেকেই বিতৃষ্ণায় অভিব্যক্তি রিক্ত হয়ে আসলো প্রাণের। এভাবেই তার মন মেজাজ ভালো না, তার উপর সকলের মাত্রাতিরিক্ত ভালোমানুষি তার সহ্য হচ্ছে না। একটু পর পরই কেউ না কেউ এসে সেধে কথা বলছে, তার সাথে ভাব জমানোর নিছক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে অথচ এদের উদ্দেশ্য প্রাণের নিকট স্পষ্ট। ঠিক এই কারণগুলোর জন্যই সে কোন পার্টি বা সোশ্যাল গ্যাদারিং-এ আসতে চায় না। আজ এসেছিল এক বিশেষ কারণে, সে-টা আপাতত হয়ে গিয়েছে। এখন থেকে যাওয়ার মানে দেখছে না সে। এমনেও অসহ্য লাগছে সব, তাই এবার সে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। বিদায় নেওয়ার উদ্দেশ্যে জিহানের খোঁজ করতে থাকার এক পর্যায়ে নেহাল শিকদারের মুখোমুখি হয়ে যায় সে। যদিও বা নেহাল শিকদার প্রাণকে দেখে বেশ চমকালেন, সে মোটেও এখানে প্রাণকে আশা করেননি। তার জানা মতে প্রাণ এসব পার্টি পছন্দ করে না, তাহলে আজ? প্রশ্নটা তার মাথায় হানা দেওয়ামাত্র তিনি খুশি হওয়ার ভাণ করে বলে উঠেন, “প্রাণ! হোয়াট এ প্লিজেন্ট সারপ্রাইজ।”

নেহালের ডাক শুনে প্রাণ পিছন ঘুরে তাকায়৷ নেহালের বিস্ময়কর দৃষ্টি দেখে প্রাণ কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে স্বল্প পরিসরে হেসে ঠেস দিয়ে বলে, “তাই না-কি!”

কথাটা বলে প্রাণ তার পাশে তাকায়। এদিকে স্বামীর মুখে প্রাণের নাম শুনে মেহরিমা শিকদারও সামনে তাকান। প্রাণের দিকে দৃষ্টি যেতেই দুইজনের চোখাচোখি হয়ে যায়, মুহূর্তেই তার ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা হাসি মিইয়ে যায়। আঁখিপল্লবের আনাচে-কানাচে ছেঁয়ে যায় রা’গ’দ্বে’ষ। প্রাণ সেটা লক্ষ্য করে তাচ্ছিল্যের সহিত বলে, “কেমন আছেন মিসেস. শিকদার? শরীর ভালো তো?”

মেহরিমা শিকদার কোনরকম প্রত্যুত্তর না করে নেহালকে চুপিসারে কিছু একটা বলে অন্যদিকে চলে গেলেন। নেহাল প্রাণের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই প্রাণ বলে উঠে, “কাজ আছে আমার আসছি। এন্ড সরি ফর ডিস্টার্বিং ইউ গাইস।”

প্রাণ নেহাল শিকদারকে কিছু বলতে না দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে সেখানে থেকে চলে আসে। নেহাল প্রাণের যাওয়ার পাণে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন।

মিনিট খানেক ঘুরার পর জিহানের দেখা পেল প্রাণ। স্বস্তি মিললো যেন তখনই। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল জিহানের দিকে, বলল, “জিহান শুনো!”

জিহান তখনও মোবাইলে কি যেন করছিল প্রাণের কন্ঠ শুনে মাথা তুলে মিষ্টি হেসে বলে, “হ্যাঁ বল।”

এখান থেকে বেরুনোর জন্য প্রাণ বলে উঠে, “আমার না হুট করে একটা কাজ পড়ে গিয়েছে, এখনই বের হতে হবে। তুমি কিছু মনে কর না প্লিজ।”

জিহান চিন্তিত কন্ঠে বলে, “এখনই যেতে হবে? ইজ এভ্রিথিং ফাইন? খাবার পর্যন্ত খেলে না তুমি।”

প্রাণ আশ্বস্ত সুরে বলে, “সব ঠিক আছে, চিন্তার কোন বিষয় নেই। তবে আমার যাওয়াটা জরুরি।”

জিহান মন ক্ষুণ্ণ করে বলে, “কেক কাটার আগ পর্যন্ত নাহয় একটু থাকো। আমি আমার বেস্টফ্রেন্ডের জন্য ওয়েট করছিলাম, ওর আসামাত্র কেকটা কেটে ফেলব আমি। বাহিরেই আছে, কথা বলছে ফোনে। চলে আসবে এক্ষুনি।”

প্রাণ বলল, “বুঝতে পারছি কিন্তু সম্ভব না৷ প্লিজ মন খারাপ কর না, ইটস আর্জেন্ট ফর মি।”

জিহান উপায়ন্তর না পেয়ে অগত্যা প্রাণকে যেতে রাজি হয়ে বলল, “চল তোমায় গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি৷”

“প্রয়োজন নেই, আমি যেতে পারবো। এন্ড এগেইন সরি ফর টুডে, নেক্সট টাইম আই উইল সিউরলি মেক্যাপ টু ইউ দিস, ইটস আ প্রমিস।”

জিহান এই প্রসঙ্গ না বাড়িয়ে প্রাণকে যেতে দিল। প্রাণ চৈতিকে গাড়ির সামনে আসার মেসেজ দিয়ে লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে আসার সময় নয়নের মুখোমুখি হয়। নয়ন এবং জেসিকা দুইজনই কথা বলতে বলতে ভিতরে আসছিল অকস্মাৎ জেসিকাকে দেখে তারা দুইজন হকচকিয়ে উঠে। নয়ন তৎক্ষনাৎ তটস্থ কন্ঠে বলে উঠে, “তুমি এখানে?”

প্রাণ হেসে বলে, “হ্যাঁ এখানে। কেন কি হয়েছে?”

নয়ন একবার জেসিকার দিকে তাকিয়ে কিছুটা সরে প্রাণের সন্নিকটে এসে দাঁড়ায়। আমতা-আমতা করে বলে, “না! কিছু না। তুমি তো কখনো এসব ব্যাংকুয়েটে আসো না তাই তোমায় দেখে অবাক হলাম। আমাকে তো একবার জানালে না তুমি আসছো, দিন দিন কেমন জানি হয়ে যাচ্ছ তুমি। কিছুই জানাও না এখন তুমি আমাকে।”

প্রাণ দূরত্ব বুজিয়ে রেখে বলে, “সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম তোমায়, কিন্তু এখানে আসার পর তোমার কোন খোঁজই পেলাম না। জেসিকারও না। ছিলে কই তোমরা দুইজন এতক্ষণ? একসাথে ছিলে না-কি?”

নয়ন ঘাবড়ে গিয়ে কিছু একটা বলার আগেই জেসিকা বলে, “আমি তো মাত্রই আসলাম। নয়ন কোন এক কাজে পার্কিং-এ গিয়েছিল বোধহয়, সেখানেই ওর সাথে দেখা হয়। দুইজনই ভিতরেই আসব বলে একসাথে আসছিলাম। আর তুই বলছিস এতক্ষণ নাকি আমরা সাথে ছিলাম। নাইস জোক!”

নয়নও জেসিকার কথায় সম্মতি জানালো। প্রাণ জেসিকার পাণে শ্লেষাত্মক চাহনি নিক্ষেপ করে, দুটো মানুষই যে আপাদমস্তক মিথ্যের চাদরে মুড়ানো তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই তার। নি’কৃ’ষ্ট তো নয়, এর চেয়েও অ’ধ’ম তারা। নিজের মনোভাব চাপা দিয়ে প্রাণ বলে, “আমি তো এমনেই জিজ্ঞেস করলাম। সে যাই হোক, ইউ গাইস ইঞ্জয় দ্যা পার্টি আ’ম গোয়িং নাও।”

নয়ন প্রাণের হাত মুঠোয় পুরে বলে, “চলে যাচ্ছ মানে কি?”

প্রাণ সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলে, “কাজ আছে কিছু। আর এভাবে মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছে, বিশ্রাম দরকার এখন আমার।”

নয়ন চিন্তিত হয়ে বলে, “তুমি আগে বলবে না? আচ্ছা চল আমি দিয়ে আসছি তোমায়।”

প্রাণ নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “দরকার নেই। ড্রাইভার আছে সাথে। আর এমনেও আমার সাথে তুমি এখন বেরিয়ে গেলে নানান কথা উঠবে, বাহিরে অনেক রিপোর্টারসই ঘোরাফেরা করছে। আপাতত কোন কন্ট্রোভার্সি চাই না আমি।”

নয়ন এবার কথা না বাড়িয়ে বলে, “আচ্ছা ঠিক আছে। সাবধানে যেও আর বাসায় গিয়ে আমাকে একটা টেক্সট দিও৷ লাভ ইউ!”

নয়নের শেষ উক্তি শুনে প্রাণের বি’দী’র্ণ হিয়া জ’ল’সে গেল৷ সে কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে আলগোছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো৷

____________

ধূসর-কালো মেঘাচ্ছন্ন অন্তরিক্ষ গর্জে উঠছে বারংবার। ঝড়ো হাওয়া বইছে, পাতারা সব ঝরে উড়ে-বেড়াচ্ছে এদিক-সেদিক। রাস্তার ধারে সবসময় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া নুয়ে পড়ছে যেন। উত্তপ্ত প্রকৃতি বৃষ্টিস্নাতে মাতলামো করার অপেক্ষায়। বিদ্যুৎ চলে গিয়ে নিস্পন্দ, নিস্তব্ধ পরিবেশকে তলিয়ে দিল নিকষকালো আঁধারে। আকস্মিক কারো কান্নার ধ্বনি ঝং’কা’র তুললো। কেঁপে উঠলো চারদেয়াল। আশা বেগম প্রাণের রুমের দিকে যাচ্ছিলেন, কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে দৌড়ে গেলেন সেদিক। অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষে প্রাণকে খোঁজার চেষ্টা চালালেন, অতঃপর প্রাণকে বিছানার পাশে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করলেন। দ্রুত এগিয়ে গেলেন তার নিকট। উৎকন্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে মামণি আমার? কাঁদছিস কেন তুই? বল না কি হয়েছে?”

প্রাণের কথা বলে না। ফুঁপিয়ে যায় শুধু। আশা বেগম পুনরায় জিজ্ঞেস করতেই মাথা তুলে শূন্য হাতের দিকে তাকিয়ে আধভাঙ্গা কন্ঠে বলে উঠে প্রাণ, “মায়ের শেষ স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছি আমি আশামা। হারিয়ে ফেলেছি আমি।”

সেই সাত বছর বয়স থেকে প্রাণের কাছে ছিল ঘড়িটা। মায়ের শেষ স্মৃতি হিসাবে খুব যত্নসহকারে রেখেছিল ঘড়িটা সে। বিশেষ কোন ফাংশন বাদে সে ওই ঘড়িটা পড়তো না। আজ কি যেন মনে করে পার্টিতে পড়ে গিয়েছিল ঘড়িটা। কিন্তু কখন যে ঘড়িটা খুলে পড়ে যায় তার খেয়াল হয় না। বাসায় এসে শূণ্য হাত দেখেই পা’গ’লপ্রা’য় হয়ে উঠে সে। রুম জুড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে কিন্তু পায় না। অতঃপর ভেঙে পড়ে কান্নায়। এদিকে প্রাণের কথা শুনে আশা বেগম চমকে উঠে বলেন, “মানে তুই কি ওই ঘড়িটার কথা বলছিস?”

প্রাণ মুখ ঝাঁকিয়ে বলে, “হ্যাঁ! মেয়ে হিসাবে আজ আমি সত্যি কার অর্থেই কু’লা’ঙ্গা’র হয়ে গেলাম আশামা। মায়ের শেষ স্মৃতিটুকুও আগলে রাখতে পারলাম না আমি। ছিঃ! ম’রে যাওয়া উচিৎ আমার। ম’রে যাওয়া উচিৎ!”

প্রাণকে প্যানিক করতে দেখে আশা বেগম আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তৎক্ষনাৎ বুকে জড়িয়ে নিলেন ছোট প্রাণকে তিনি। পাঁচ বছরের শিশুকে বুঝ দেওয়ার মত বুঝ দিতে থাকলেন, এতে প্রাণের দোষ নেই, অনিচ্ছাকৃতভাবেই হয়েছে সব, পার্টিতে কোথাও পড়ে গিয়েছে হয়তো, সেখানে গিয়ে খুঁজলে নিশ্চয়ই পেয়ে যাবে সে। কিন্তু প্রাণ কি আর তা বুঝার মানুষ? কাঁদতে থাকলো বাচ্চাদের মত। আজ তার মন-মস্তিক সম্পূর্ণরূপে বি’দী’র্ণ, চূ’র্ণ’বি’চূ’র্ণ। হারানোর মত আর কিছু নেই তার কাছে। নিঃস্ব সে। না আছে কোন আপনজন, না আছে কোন টান-ভালোবাসা, না আছে কোন স্মৃতি। যা আছে সব প্রবঞ্চনা। মন হয়তো এবার তার পাথর হয়ে গেল।

________

সময়ের স্রোত বহমান। বহমান প্রবাহের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে মাঝ দিয়ে কেটে গেল দুটি দিন। প্রাণ নিজেকে সামলে নিয়েছে, সকল ঘটনা পেরিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিয়েছে। এভাবে থেমে থাকলে যে তার কিছুই হবে না, ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বেশি সময় নেই। আর তো দুই সপ্তাহ। এর আগেই কিছু জিনিস গুছিয়ে নিতে হবে, হাতে হাত রেখে বসে থাকলে চলবে না-কি? সারাদিন নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার পর সন্ধ্যায় যখন অবসর মিললো তখন প্রাণ চৈতিকে ছুটি দিয়ে ড্রাইভারকে বলল নয়নের বাসায় যেতে। ড্রাইভার কোনপ্রকার দ্বিরুক্তি না করে প্রাণের কথা অনুযায়ী তাকে নয়নের বাড়ির সামনে নিয়ে আসলো। বড় গেটের সামনে এসে ড্রাইভার হর্ণ বাজাতে চাইলে প্রাণ তাকে নিষেধ করল। অতঃপর নিজে নেমে এসে এগিয়ে গেল রহিমের দিকে। আকস্মিক প্রাণকে দেখে রহিম ভড়কে উঠলেন, “প্রাণ মা আফনি এহানে?”

প্রাণ হেসে বলে, “চাচা একটু কষ্ট করে বলুন তো নয়ন বাসায় কি একা নাকি কেউ আছে?”

রহিম লজ্জায় মাথা নুয়ে ফেলে বলে, “একলা না।”

প্রাণ রহস্যময় হেসে বলে, “জেসিকা এসেছে?”

রহিম কোনমতে মাথা নেড়ে বলে, “হো।”

প্রাণ যেন এটাই শুনতে চাইছিল। সে খুশি হয়ে বলল,
“যাক ভালোই। এখন চাচা আপনাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে।”

রহিম দৃষ্টি তুলে কৌতহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কি কাম করোন লাগবো?”

“আপনি এখন গিয়ে বাড়ির পিছনের যেই গেটটা আছে না? ওইটায় তালা ঝুলিয়ে আসবেন। এরপর এখানে নয়নকে ফোন করে জানাবেন আমি এসেছি, দরজার বাহিরে গাড়ি নিয়ে আছি৷ এরপর ফোন রেখে এই লোহার দরজাটা খুলে দিবেন আপনি। বুঝেছেন?”

কথাগুলো বলে প্রাণ একটা তালা আর চাবি এগিয়ে দিল। রহিম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “মানেহ? এসব করোন লাগবো কেল্লা? আফনি এহনি বিত্তরে ডুকলে তাগো রে হাতে-নাতে ধরবার পারবেন। তাইলে ফোন কইরা সাবধান করবার লাগছেন কেল্লা?”

“আহা চাচা বেশি প্রশ্ন করবেন না। যা বলছি তা করুন।”

রহিম নিজের কৌতূহল দমিয়ে রেখে দিগবিদিক না ভেবে প্রাণের কথা অনুযায়ী কাজ করে। তা দেখে প্রাণ আনমনে বিরবির করে উঠে, “দ্যা গেম ইজ অন নাও মি নয়ন মেহরাব।”

#চলবে

[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here