#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ১০
-“কি শর্ত মা?” ইতি জানতে চায় শাশুড়ির কাছে।
-“তুমি শুকনো মরিচ সহ সব মসলা পাটায় বেটে দিবা।” বলেন নাজমা বেগম।
-“কেন মা? গুঁড়ো মসলা তো আছেই সব, কি দরকার পাটায় বাটার?” অবাক ইতি জানতে চায়।
-“বাটা মসলা ছাড়া রান্না ভালো হয়না। গুঁড়ো মসলা দিয়ে রান্না করলে তুমি কর। আজ আমার ছেলে শখ করে একটা জিনিস খেতে চাইছে সেখানেও তোমার সমস্যা।” কান্নাভেজা গলায় বলেন নাজমা বেগম। এদিকে মনে মনে বলছেন – আমাকে দিয়ে রান্না করাবি? দেখ তোর কি হাল করি।
নাজমা বেগমের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল দেখে মনে মনে রেগে গেলেও কিছু বলেনা ইতি। চুপচাপ মশলা বেটে দেয়। শুকনো মরিচ বাটার পর থেকে ইতির হাত লাল হয়ে ফুলে যায়, জ্বলতে থাকে। হাত জ্বলুনির চোটে চোখ দিয়ে পানি চলে আসে। অনেক কষ্টে চোখের পানি ঠেকিয়ে রাখতেই নাজমা বেগম আরেক বায়না করেন -“কাঁচামরিচ গুলো ফালি করে দাও।”
ইতি ভাবল একবার বলে তার হাত জ্বলছে কিন্তু সে ভালো করেই জানে ওর হাত জ্বলায় নির্দয় এই মহিলার কিছুই হবে না উল্টো সে কষ্ট পাচ্ছে ভেবে আনন্দিত হবে। চুপচাপ কাঁচামরিচ ফালি করে দিয়ে কিচেনের অন্যান্য কাজ এগিয়ে দিয়ে নিজের রুমে যায় ইতি, মায়ের কাছে শুনেছে নারিকেল তেল দিলে জ্বলা কমে। সেটাই প্রয়োগ করতে লাগল।
নাজমা বেগম রান্না শেষ করে ইতিকে ডাক দেন পরিবেশন করার জন্য। ইতি রুম থেকে বের হয়ে দেখে নাঈম মুরাদকে নিয়ে ড্রইংরুমে গল্প করছে। খাবার বাড়ার সময় গরম লেগে হাতের জ্বলুনি আরো বেড়ে যায় ইতির। খাবার বাড়া হলে সবাইকে টেবিলে ডাকে ইতি। ওর শ্বশুর ও নাঈম বসার পরে সে নাঈমের পাশে বসে পড়ে। নাজমা বেগম চাচ্ছিলেন ইতি যেন সবার পরে খায় কিন্তু নাঈমের সামনে বেশি কিছু বলতে পারেননা শুধু বলেন -“তুমিও বসে পড়লা? এটা সেটা লাগলে কে এগিয়ে দিবে? বাড়ির বউদের সবার শেষে খেতে বসতে হয়।”
শাশুড়ির কথা শুনে ইতি উঠতে নিতেই নাঈম ওর হাত ধরে বসিয়ে দেয়, মাকে বলে -“মা পুরনো নিয়ম বাদ দাও তো। দুদিন পরে তুলির বিয়ে দিলে ওকেও যদি শেষে খেতে বলে তোমার ভালো লাগবে?”
-“খারাপ লাগার কি আছে? যা নিয়ম তা মানতেই হবে।” উষ্মার সাথে বললেন নাজমা বেগম।
নাঈম কথা না বাড়িয়ে ইতির প্লেটে খাবার তুলে দেয়। ইতি গরম খাবারে হাত দিয়েই হাতের জ্বলুনিতে মুখ বিকৃত করে ফেলে। নাঈম তা দেখে চমকে উঠে -“কি হল ইতি? কোন সমস্যা?”
-“কিছু না” বলে খেতে লাগে ইতি। কিন্তু গরম খাবারে লেগে হাতের কষ্ট লুকাতে পারেনা।
নাঈম তখন সবাইকে উপেক্ষা করে ইতির হাত টেনে নিয়ে দেখে চমকে যায়। হাতে ফোস্কা পড়ে লাল হয়ে ফুলে গেছে।
-“বিকালেই দেখলাম তোমার হাত ঠিক আছে, এইটুকু সময়ের মধ্যে কি হল? কি হইছে হাতে এক্ষুনি বল আমাকে।” চিৎকার দিয়ে উঠে নাঈম। ইতি ঝরঝর করে কেঁদে দেয়।
-“বাপের জন্মে দেখিনি এমন আদিখ্যেতা, এমন ঢং। মসলা বাটলে কি হয় টা কি? আমরা বাটিনি কোনদিন? তাই বলে এমন বাইরের মানুষের সামনে নাটক করছি নাকি? ঢং দেখে বাঁচিনা। মায়ে কোন কাজ না শিখায়াই পাঠায়া দিছে পরের ঘরে। খালি শিখাইছে কিভাবে স্বামীর সাথে রঙ ঢং করতে হয়।” গর্জে উঠেন নাজমা বেগম। মুরাদ খাওয়া ছেড়ে নাজমা বেগম কেই দেখে যাচ্ছে বারবার।
হঠাৎ গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠে -“খালাম্মা খালু নাঈম, আমি একটা কথা বলতে চাই। যদিও কথাটা বলার এটা উপযুক্ত সময় বা জায়গা না তাও বলা দরকার কথাটা। খালু আপনি অনুমতি দিলে আমি তুলিকে বিয়ে করতে চাই। ছোট থেকে ওকে দেখে আসছি। খালাম্মার নিজ হাতে গড়া মেয়ে তুলি। আশাকরি অন্য অনেকের চেয়ে ভালো হবে তুলি আচরণগত দিক থেকে। খালু আপনি রাজি থাকলে তবে আমি আমার পরিবারে কথা বলব ইনশাআল্লাহ।”
মুরাদের কথা শুনে সবাই থ হয়ে যায়। সবচেয়ে অবাক হয় তুলি নিজে। ভালোবাসার বুদ্ধি হবার পর থেকেই মুরাদকে ভালোবাসে সে, কিন্তু মুরাদের কাছে সে বরাবরই দূর ছাই টাইপ ব্যবহার পেয়ে এসেছে। আজ মুরাদ ওকে বিয়ে করতে চায় শুনে ও আনন্দে হতবাক হয়ে যায়। লজ্জাও পেয়ে যায় এভাবে হুট করে বিয়ের কথা শুনে। কোনমতে খাওয়া শেষ করে দৌড়ে চলে যায়।
মুরাদ নাঈমের দিকে তাকিয়ে বলে -“তুই ভাবিকে নিয়ে ঘরে যা। ভাবিকে হাতে ড্রেসিং করে দিয়ে খাইয়ে দে। আমি খালাম্মা খালুর সাথে কথা বলি। আর হ্যাঁ বিয়ের ব্যাপারে কিন্তু আমি সিরিয়াস।”
নাঈম কথা না বাড়িয়ে ইতিকে নিয়ে ঘরে গিয়ে খাইয়ে দেয়। ইতি মুরাদের কথায় বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনা। সে মুরাদের সাথে যতটুকু কথা বলেছে তাতে বুঝে গেছে মুরাদ তুলিকে একদমই পছন্দ করে না। কিন্তু তাই বলে এভাবে ওর ইমোশন নিয়ে খেলা করা উচিৎ না। একটা মেয়ে বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে। ইতি খেতে খেতে আনমনা হয়ে যায়। ওর অন্যমনস্কতা দেখে নাঈম জানতে চায় কি হয়েছে।
-“আমি না মুরাদ ভাইয়ের কথার কোন তল খুঁজে পাচ্ছিনা। আচমকা এভাবে তুলিকে বিয়ের কথা বললেন আমি অবাক হয়ে গেছি। বুঝতে পারছি না উনার মনে কি চলছে। উনার কথায় কখনো প্রকাশ পায়নি উনি তুলিকে ভালোবাসেন। আমি আসলে বুঝতে পারছিনা নাঈম।” ইতি নাঈমকে বলে।
-“চিন্তায় আমিও পড়েছি ইতি। মুরাদ আমার বন্ধু কিন্তু ওর মন এখন আমি পড়তে পারছিনা।” নাঈম চিন্তিত স্বরে বলে। “কিন্তু তোমার হাতের এই অবস্থা কেন বলত?”
ইতি চুপ থাকে। কিন্তু নাঈম ওকে চুপ থাকতে দেয়না, বারবার জিজ্ঞেস করে শুনে নেয়। ওর মায়ের আচরণ জেনে মনে মনে ছোট হয়ে যায় নাঈম। ইতির খাওয়া শেষ হলে প্লেট তুলে বাইরে যায় নাঈম। গিয়ে দেখে তুলি কিচেনে বাসন মাজছে আর ড্রইংরুমে মুরাদের সাথে কথা বলছে ওর বাবা মা। হাত ধুয়ে নাঈমও গিয়ে যোগ দেয় ওদের সাথে। গিয়েই মুরাদকে জিজ্ঞেস করে -“তুই একটু আগে যা বলেছিস তাতে তুই সিরিয়াস?”
-“কেন তোর কি সন্দেহ আছে?” উল্টো নাঈমকে জিজ্ঞেস করে মুরাদ।
-“না সন্দেহ নাই কিন্তু তুলি আমার একমাত্র বোন তাই আমি চাইনা তোর ক্ষনিকের ভুলে বলা কোন কথা নিয়ে তুলি মানসিক ভাবে আপসেট থাকুক।” বলে নাঈম।
-“হ্যাঁ আমি সত্যিই তুলিকে বিয়ে করতে চাই নাঈম, যদি খালু খালাম্মা রাজি থাকেন।” আবারও বলে মুরাদ।
নাজমা বেগম বলেন -“অরাজি হবার কি আছে?”
উনাকে থামিয়ে দিয়ে নাঈমের বাবা বলেন -“বিয়ে শাদীর ব্যাপার বাবা। এভাবে হুট করে মতামত দেয়া যায়? কয়দিন সময় দাও, চিন্তাভাবনা করে জানাই।”
-“ঠিক আছে খালু আপনি প্লিজ তাড়াতাড়িই জানান।” বলে মুরাদ উনাকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে যায়।
-“বাবা, আমি চাইনা মুরাদের সাথে তুলিকে বিয়ে দিতে তুমি রাজি হও। মুরাদ আমার বন্ধু, একদম ছোট থেকে একটাই বন্ধু আমার। কিন্তু ও যদি তুলিকে ভালোবাসে সেটা আমি কিছু হলেও টের পেতাম। মুরাদকে আমি বরাবরই দেখে আসছি তুলিকে নিয়ে বিরক্তিপ্রকাশ করতে। তুমি রাজি হইওনা বাবা প্লিজ।” বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে নাঈম।
-“কেন রাজি হবেনা? কেন রাজি হবেনা বল? তুই জানিস না তুলি ছোট থেকে মুরাদকে কত ভালোবাসে? সেই মুরাদ এখন নিজের থেকে তুলিকে বিয়ে করতে চাইছে। কেন রাজি হবেনা?” রেগে যান নাজমা বেগম।
-“রাজি হবেনা তার আসল কারণ শুনলে তুমি সহ্য করতে পারবেনা। সুতরাং তোমার শুনে কাজ নেই মা। আমি শুধু বলছি তোমরা রাজি হইওনা প্লিজ।” মরিয়া হয়ে বলে নাঈম।
-“আমাকে কারণ বলতেই হবে। আমি তুলির মা।” নাজমা বেগম বলেন।
-“ঠিক আছে শুন।” বলতে থাকে নাঈম।
কি বলে নাঈম মা কে? জানতে চান? সামনের পর্বে ইনশাআল্লাহ।
©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ