#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ৫
কান্না সামলে ইতি নাঈমকে বলে “এক্ষুনি বাসায় চল। আমি আর এক মুহূর্ত তোমার সাথে বাইরে থাকবোনা।”
-“কি হইছে? বাসায় কারো কিছু হইছে? কে কল করেছিল?” উদ্বিগ্ন নাঈমের জিজ্ঞাসা।
-“আম্মু কল করেছিল। তোমার রিকশা না দেখে তোমার সাইকো বোন তোমাকে কল দিয়েছিল। তোমার ফোন বন্ধ পেয়ে সোজা চলে গেছে আমাদের বাসায়। গিয়ে আব্বু আম্মুকে যা তা অপমান করে আসছে। উনারা নাকি তোমার পরিবার থেকে তোমাকে কেড়ে নিতে আমাকে কুবুদ্ধি দিয়ে পাঠাইছেন। তুমি কোনদিন তোমার মা বোনের সাথে ধোঁকা বাজি করনি, কিন্তু আজ আমার কুবুদ্ধিতে এটা করেছ। এসব কি নাঈম? আমি ঘুরতে আসতে চেয়েছিলাম তোমার সাথে? বিয়ের পরে যখন টের পাইছি তোমার বোন সাইকো তখন থেকেই ধরে নিয়েছি আমার কপালে স্বামীসঙ্গ নাই। এতোগুলো বয়স হয়ে গেল কখনো শুনিনি নতুন বিবাহিত ভাইয়ের ঘরে মাঝরাতে বোন গিয়ে চেক করে আসবে আর তারজন্য দরজা খুলে রাখতে হবে। এতো যদি ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা তাহলে ভাইকে বিয়ে দিল কেন? এতো যদি ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা তাহলে তার ভাই মাঝরাত পর্যন্ত তার বিয়ের টাকা যোগাড়ের জন্য পরিশ্রম করে বাসায় ফিরলে একা বসে খেতে হবে কেন? বোন খাবার আগলে বসে থাকতে পারে না? যাই হোক, আর না। গত একটা মাস কি যন্ত্রণা ভোগ করতেছি সেটা আমিই জানি। বান্ধবীদের কাছে শুনেছি নতুন বিয়ের পরে স্বামীর কাছে কত ভালোবাসা পায়, কত আদর পায়, প্রায়োরিটি পায় আর আমি পাইছি বুয়ার দায়িত্ব। আর পারবোনা আমি তোমাদের বাসায় বুয়ার দায়িত্ব পালন করতে। আমাকে আমাদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে তুমি যাও। যে স্বামীর সাথে সময় কাটানোর জন্য আমার বাবা-মাকে অপমান হতে হয় নাইবা করলাম সেই স্বামীর ঘর। সত্যিই আমার আর রুচি নাই তোমাদের সংসারে ফিরে যাওয়ার।” বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠে ইতি।
ইতির কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় নাঈম। তুলির আচরণ নিয়ে কয়েকজন ওকে আগেও বলেছে ও সাইকো, আজ ইতিও বলল। তুলি ওর কাছে সন্তানের মতো। তাই তুলির কথা, আচরণ ওর কাছে ছেলেমানুষী মনে হয় কিন্তু সেই কথা ও আচরণ ইতির মন এভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে ও বুঝেনি। কিন্তু আজ তুলি সত্যিই বাড়াবাড়ি করেছে, ইতির মা-বাবাকে অপমান করে। এটা ঠিক করেনি, ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে। কিন্তু তাই বলে ইতি সংসার করবে না এটা কেমন কথা? মাথা গুলিয়ে যায় নাঈমের।
খাবার আর খাওয়া হয়না। বিল মিটিয়ে দুজন রিকশায় উঠে পড়ে। রিকশাওয়ালা কোথায় যাবে জানতে চাইলে ইতি ওদের বাসার কথা বলে আর নাঈম ওদের বাসার কথা বলে। রিকশাওয়ালা কনফিউজড হয়ে যায়। ইতি রিকশা থেকে নামতে গেলে নাঈম ওকে থামিয়ে রিকশাওয়ালাকে ইতিদের এলাকার নাম বলে যেতে বলে। মনে মনে ভাবতে থাকে ইতির মায়ের কাছে আগে সব শুনবে তারপর ইতিকে বুঝিয়ে বাসায় নিয়ে যাবে।
ইতির ছোট ভাই ইমন ওদের ড্রইংরুমে সিসিটিভি লাগিয়ে ছিল বেশ আগে। নাঈম যখন জানতে চায় কি হয়েছে তখন সে সিসিটিভি রেকর্ডিং চালিয়ে দেয়। রেকর্ডিং দেখতে গিয়ে নাঈমের মনে হয় মাটিকে ফাঁক হলে সে লুকিয়ে যেত। তুলি ঘরে ঢুকেই উন্মত্তের মতো ইতির মায়ের হাত ধরে টেনে তুলে হাত নাচিয়ে শাসিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। নাঈমের মা নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে, মেয়ের এতো বড় বেয়াদবি দেখেও তাকে কিছুই বলছেন না। ইতির বাবা তুলির মাথায় হাত দিতেই ও ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দিতে গেলে তাল সামলাতে না পেরে সোফার উপর পড়ে যান। তুলি আংগুল তুলে শাসাতে শাসাতে চলে যায়। ইতির মা ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। এই পর্যন্ত দেখে উঠে দাঁড়ায় নাঈম, হাত জোর করে ক্ষমা চায় শ্বশুর শাশুড়ীর কাছে।
ইতির মা ইস্মত আরা নাঈমকে বলেন “বাবা তুমি তো কোন অন্যায় করনি। তুমি ক্ষমা চাচ্ছ কেন? ক্ষমা চাইতে হবে না, আমরা মেয়ের মা বাবা, আমাদের সম্মানের কি দাম বল? কিন্তু আমার মেয়েটা তোমাদের বাড়ির বউ, তোমাদের মান সম্মান ওর সাথে জড়িত। অন্তত ওর সম্মানের দিকটা দেখিও। তোমরা ভালো থাকলেই আমাদের ভালো থাকা বাবা। তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও, তোমার বোন অস্থির হয়ে পড়েছে।”
নাঈম তাকিয়ে দেখে ইতি আশেপাশে কোথাও নাই। ইস্মত আরা বলেন “আজ ইতি থাক আমাদের এখানে, কাল স্কুল করে যাবেনি।”
-“না প্লিজ। আজ আমি ইতিকে নিয়ে যাই। ও নাহয় কাল পরশু এসে থেকে যাবেনি দুই এক দিন। প্লিজ ওকে ডেকে দিন।” বলে নাঈম।
-“আমি যাবোনা তোমার বাসায় নাঈম। ইনফ্যাক্ট তোমার সাথে সংসার করারই আর ইচ্ছে নাই। যে পরিবারের সাইকো সদস্য এসে আমার বাবার গায়ে হাত তুলে সেই পরিবারের মেরুদন্ডহীন সদস্যের সাথে সংসার করার কোন ইচ্ছেই আমার নাই। তুমি যাও তোমার লাডলি সাইকো বোনের কাছে। আমার আর কিছু বলার নাই।” ইতি ঘর থেকে বের হয়ে এসে বলে।
-“প্লিজ ইতি এমন করিওনা। তুলি ছোট মানুষ একটা ভুল করে ফেলছে, আমি ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি তো।” অসহায়ের মতো বলে নাঈম।
-“ছোট মানুষ? কে ছোট মানুষ নাঈম? তোমার বোন আমার দুই বছর আগে এসএসসি পাস করেছে। তাহলে কে ছোট বল?” ক্ষোভের সাথে বলে ইতি।
-“আমি ওর পক্ষ থেকে সরি বলছি ইতি। প্লিজ বাসায় চল। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা ইতি।” ব্যাকুল হয়ে বলে নাঈম।
-“হাসালে নাঈম। আর কি কি ছাড়া তুমি থাকতে পারোনা? আমাদের বিয়ের পর থেকে একটা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি তোমাদের বাসায়, কেন? কারণ তোমার সাইকো বোন নাকি বিবাহিত ভাইয়ের ঘরের দরজা খুলে রাতে এসে চেক করে যায়। ছিহ। বাবামায়ের সামনে আজ আমাকে একথাও বলতে হল? একটা দিন দুপুরে এসে আমি খাবার পাইনা, কারণ আমি সকালে রান্না করে রেখে যেতে পারিনা তাই আমার জন্য খাবার রাখেনা। দিনের পর দিন দুপুরে আমি না খেয়ে থাকি। স্কুল থেকে প্রচন্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফিরে আমি কি খাই? শুকনো মুড়ি আর পানি। যে হাসবেন্ডের বউকে ভাত দেবার ক্ষমতা নেই, যে বউয়ের রাতের ঘুম নিশ্চিত করতে পারেনা, যে বউকে নিয়ে ঘুরতে বের হলে তার বাবা-মাকে অকথ্য ভাষায় অপমান করা হয় সে ছেলের সাথে আর যেই হোক আমি সংসার করব না। তুমি যেতে পারো নাঈম। তোমার দেরি দেখে তোমার বোন আবারও চলে আসতে পারে আমার মা-বাবাকে অপমান করতে।” ক্রোধে চিৎকার করে বলতে থাকে ইতি।
-“কি বল তুমি? তুমি দুপুরে খাওনা?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে নাঈম।
-“হা হা হা নাঈম, তুমি জানোই না তোমার বউ তোমার বাসায় দিনের পর দিন না খেয়ে থাকে। একটা দিন আমি স্কুল থেকে ফেরার পর কল দিয়ে জানতে চেয়েছ আমি খেয়েছি কিনা? চাওনি, কারণ আমি খাই না খাই তোমার তাতে কোনো কিছু যায় আসেনা। আজ তুমি যাও নাঈম। তুমি এখনো নাবালক, যেদিন তুমি সাবালক পুরুষ হবে, যেদিন তুমি স্ত্রীকে যোগ্য সম্মান দিতে পারবে সেদিন আসিও।” ইতি বলে।
ইতির কথা শুনে ওর বাবামাও অবাক হয়ে যায়। ওর মা তো কেঁদেই ফেলে এই ভেবে যে, ওদের যে মেয়ে কখনও ক্ষুধা সহ্য করতে পারত না সেই মেয়ে দিনের পর দিন ক্ষুধায় কষ্ট পেয়েছে আর ওরা কিছুই জানত না। এবার আর থাকতে পারে না ইতির মা, এবার মুখ খুলেন। আস্তে অথচ দৃঢ় কন্ঠে বলেন “বাবা নাঈম, তুমি যাও। আমাদের মেয়েকে ভাতের অভাবে তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে পাঠাইনি তোমাদের বাসার বুয়া হিসেবে। আমাদের মেয়েকে আমরা কখনো ক্ষুধার কষ্ট পেতে দেইনি। আগে যদি জানতাম দিনের পর দিন তোমরা ওকে না খাইয়ে রাখছ তাহলে আগেই ওকে আমরা নিয়ে আসতাম। এইজন্যই আমি দুপুরে ওকে ফোন দিয়ে কথা বলতে চাইলে ও ফোন ধরত না। আমি ভাবতেও পারছিনা আমি প্রতিদিন দুপুরে ভরাপেট খেয়ে ঘুমাইতাম আর আমার সন্তান ক্ষুধার্ত পেটে না খেয়ে ঘুমাতো। না বাবা নাঈম আমি আমার মেয়েকে আর পাঠাবোনা। আমার মেয়ে আমার বোঝা না। সে আমার সম্পদ, তাকে কেউ না খাইয়ে কষ্ট দিবে আমি ভাবতেই পারছিনা বাবা। তুমি যাও প্লিজ।” বলে কাঁদতে কাঁদতে দরজা খুলে দাঁড়ান ইতির মা।
নাঈম আর কোন কথা খুঁজে না পেয়ে বের হয়ে যায়। তার মা বোনের আচরণে সে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিল। একটা রিকশা নিয়ে সে চলে আসে তাদের বাসায়। এসে দেখে……. (চলবে)
©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ
পর্ব ৩ ও ৪: https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1907132822982996&id=100010588903193&mibextid=Nif5oz