#একাল_সেকাল
#মনিয়া_মুজিব
|২|
কথাগুলো বলে খানিক দম নিলাম। মেয়ের বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মুখে ফুটে আছে নিরপরাধ ভাব। আমি জানি তার কোনো দোষ নেই। কিন্তু আমিও বা আর কত পারি। সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে সবকিছু। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আজ আমার। ডেলিভারি রুমে মা আর বাচ্চার জীবন সংকটে আমি আমার বাচ্চাকে বাঁচাতে বলেছিলাম। যদিও আল্লাহর অসীম দয়ায় মা মেয়ে দুজনেই বেঁচে ফিরেছিলাম। কিন্তু নিজের জীবন বাজি রেখে যে মেয়েকে জন্ম দিলাম সে যদি কোনোদিন আমাকে ঐ বিশ্রী গালিগুলো দেয়, আমি নির্ঘাত মারা যাব। মেয়ের বাবা এবার আমার হাত দুটি ধরেছেন। কিছু একটা বলতে চাইছেন, কিন্তু বলতে পারছেন না। অপরাধবোধে হয়তো! বেশ কিছুক্ষণ পর তার নরম স্বর কর্ণগোচর হলো আমার।
“প্রীতি প্লিজ, এসব বলো না তুমি। আমার মেয়ে কখনো এমন করবে না দেখে নিও।”
“বাবা মায়ের সন্তানের প্রতি এই অন্ধবিশ্বাস ই সন্তানকে নষ্ট করে দেয়। এবার একটু সচেতন হও প্লিজ। আমি জানি, আমাদের মেয়ের অধঃপতন ঘটলে আমার থেকেও ঢের বেশি কষ্ট তুমি পাবে। কারণ সাফাকে আমার থেকে বেশি ভালো তুমি বাসো। দয়া করো এবার, মেয়েকে বোঝাও একটু। ও আমার থেকে বেশি মানে তোমাকে। তোমার সব কথা শোনে।”
এবার আমি কেঁদে দিলাম সাফার বাবার হাত ধরে। আমার নিঃশ্বাস ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসছে।
“আমি মেয়েকে মোবাইল কিনে দেবো না প্রীতি। আর এখন থেকে যেটুকু টাকা তার প্রয়োজন শুধু সেটুকুই দেবো। চল, আজ আমি সাফার সাথে কথা বলব। তোমার কিছুই বলার দরকার নেই ওকে আর। তুমি ওকে বেশি শাসন কর। তাই তোমার কথা শুনতে চায় না। কিন্তু ও কোনো ভাবেই আমার থেকে কম ভালো তোমাকে বাসে না। সারাদিন ওর জন্য খাটাখাটি কর। ও যা খেতে চায় তাই বানিয়ে দাও। যা পড়তে চায় তাই কিনে দাও। কিন্তু এতকিছুর পরেও ও তোমার সাথে খুব একটা মিশে না তোমার অল্প একটু শাসন এর জন্য। আমি চাই না তোমাদের দুজনের মাঝে দূরত্ব বাড়ুক। তাই আজ থেকে ওকে যা বোঝানোর, যা বলার আমি বোঝাব, আমি বলব। প্লিজ এসো আমার সাথে।”
সাফার বাবা আমাকে রুমে নিয়ে গেলেন। আমাকে বিছানার এককোণে বসিয়ে তিনি মেয়ের কাছে গিয়ে বসলেন। মেয়ে আমার শুয়ে শুয়ে বহাল তবিয়তে মোবাইল গুতোচ্ছে। আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। শুনতে পেলাম বাবা মেয়ের সাথে আদুরে স্বরে কত কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, মেয়ে তার বাবার সব কথাতেই সায় জানাচ্ছে। বাবার হ্যাঁ তে হ্যাঁ আর না তে না মিলাচ্ছে। অথচ বাবা তার সাথে বিন্দুমাত্র উচ্চবাচ্যও করছে না। আমি রীতিমতো অবাক তাদের আচরণে। বাবারা চাইলে কি না পারেন! তাদের এহেন কর্মকাণ্ডে আমার ছোটবেলার আরও একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল।
আমি যেহেতু মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলাম, তাই চেয়েও নিজের অনেক সাধ ও আহ্লাদ পূরণ করতে পারি নি। কথায় বলে অভাবে স্বভাব নষ্ট। আমারও হয়েছিল তাই। একদিন মা আমাকে আমার কাকার দোকানে পাঠিয়েছিলেন একটা সাবান কিনে আনতে। আমি পঁয়ত্রিশ টাকা দরের লাক্স সাবান কিনে বাড়িতে এসে বলেছিলাম সাবানের দাম ছত্রিশ টাকা। কারণ এক টাকা দিয়ে আমি চারটা চকলেট খেয়ে নিয়েছিলাম। ভয়ে ভয়ে ছিলাম সারাটাদিন মা বুঝে গেল কিনা। বাবা হয়তো সাবানের দাম জানতো কিন্তু আমাকে তা নিয়ে কিছুই বলেনি। শুধু মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন,
“কখনো মিথ্যে বলতে হয় না, মা।”
আমি বুঝে গেছিলাম বাবা আমার কারসাজি টের পেয়ে গেছেন। আমার দু’চোখ অশ্রুতে টলমল করছিল। কিন্তু বাবা আমাকে বুঝিয়েছিলেন খুবই কোমলভাবে। আমাকে বিভিন্ন উপায়ে বাবা বুঝিয়েছিলেন, মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। শুনিয়েছিলেন রাখাল ও নেকড়ের সেই বিখ্যাত গল্পটি। যা শুনে আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। মনে মনে পণ করেছিলাম আর কোনোদিন মিথ্যার ধারে কাছেও ঘেঁষবো না। শখ করে নেকড়ের পেটে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। সে যাত্রায় কোনোমতে মায়ের হাতের মার থেকে বেঁচে গিয়ে কান ধরেছিলাম এমন কাজ আর জীবনেও করব না। জীবনেও না। নৈব নৈব চ!
_
সাফা তার রুটিন অনুযায়ী এখন দাদা দাদীর সাথে গল্প করতে গেছে। একটু পরই ফোনে তার নানা নানীর সাথে গল্প করবে। রুটিনমাফিক ক্লাসের পড়া রেডি করে কিছুক্ষণ খেলা করবে। বাবা বাসায় ফিরলে বাবার সাথে বসে একটু টিভি আর মোবাইলে কার্টুন দেখবে। খাবার দাবারেও যথেষ্ট নিয়মিত হয়েছে এখন সে। আর এই সবকিছুর ক্রেডিট একজনেরই। সাফার বাবা, আমার শহীদ সাহেবের। লোকটা বরাবরই আমাকে বোল্ট আউট করে আসছেন। আর আজও মেয়েকে সামলাতে তিনি সফল। আসলে একটা অকাট্য সত্যি কথা হলো, বাবারা যেমন মেয়েদের কাছে গলে জল হয়ে যায়, মেয়েরাও তেমনি বাবাদের কাছে একদম বাচ্চাটি হয়ে পড়ে। হোক সেটা একাল কিংবা সেকাল, বাবারা মেয়েদের ক্ষেত্রে খুব বেশি ধৈর্য্যশীল হয়। সেটা আমি আমার বাবা আর স্বামীকে দেখে বুঝতে পেরেছি। ঠিক এই একটা কারণেই মায়েরা শত বুঝিয়েও যে কাজ মেয়েদের দিয়ে করাতে পারেন না, বাবারা তা অনায়াসেই করে ফেলেন। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও অহরহ ঘটছে, কিন্তু সেসব মায়েরা অবশ্যই আমার চেয়ে ঢের বেশি ধৈর্য্যশীল। আর এই বিষয়টি আমার চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়েছেন স্বয়ং শহীদ সাহেব। তিনি আমাকে বলেছিলেন, বাচ্চারা যত ভুলই করুক না কেন তাদের আদর দিয়ে সব বোঝাতে হবে, রাগ করে বা ধমক দিয়ে নয়। আমিও তার সাথে সম্পূর্ণ একমত। দিনে দিনে মেয়ের সাথে অনেক বেশি খিটখিটে হয়ে গিয়েছিলাম আমি। মেয়ের বাবা আমাকে সঠিক সময় সঠিক শিক্ষা না দিলে হয়তো কখনো মেয়ের দ্বিতীয় বন্ধু হয়ে উঠতে পারতাম না । জীবনে দুজন মানুষের প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। আমার সেকাল কে সুন্দর করার জন্য প্রিয় বাবার প্রতি, আর একাল কে সমৃদ্ধ করার জন্য আমার প্রিয় স্বামীর প্রতি। আর সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞতা জানাই আমার সৃষ্টিকর্তা কে। যে করুণাময় আমাকে উপহার দিয়েছেন জীবনের প্রিয় দুজন পুরুষকে।
ক্রমাগত ধেয়ে আসা কলিং বেলের আওয়াজে ধ্যান ভাঙলো আমার। বুঝতে পারলাম শহীদ সাহেব বাসায় ফিরেছেন। রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে গেলাম দরজা খুলতে। কিন্তু আমার আগেই মেয়ে দরজা খুলে বাবা বাইরে থেকে যা যা এনেছে সব নিয়ে নিয়েছে। আমি একপলক আমার স্বামীর দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে রান্নাঘরে চলে এলাম। তিনিও এলেন পিছু পিছু। গলাটা হালকা ঝেড়ে বলে উঠলেন,
“তুমি দিনদিন খুব হিংসুটে হয়ে যাচ্ছ প্রীতি। শেষপর্যন্ত কিনা নিজের মেয়েকেই হিংসে করছ আজকাল। এবার তোমাকে হিংসা বর্জনের শিক্ষা দিতে হবে দেখছি। হা হা হা!”
আমি কি কম যাই নাকি। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
“চায়ে চিনি কম আর রান্নায় লবণ বেশি পড়লেই এই হা হা! হি হি! সব গায়েব হয়ে যাবে। হুহ্, আমার সাথে লাগতে আসে। খাবার বন্ধ আজ থেকে বাবা-মেয়ের।”
আমার এসব ঠুনকো ধমকি ধামকিতে মেয়ের বাবা ভয় তো পেলেন ই না উল্টো ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন এবার। আর এদিকে আমার গা, হাত, পা জ্বলে যাচ্ছে তার হাসির দমকে। তবুও দিনশেষে পরম করুণাময়ের কাছে আমার একটাই চাওয়া, কেবল একটাই।
“এরকম গা জ্বালানো সুখে আমাকে সদা তলিয়ে রেখো, হে আল্লাহ! আর কিচ্ছুটি চাই না আমি, কিচ্ছুটি চাই না।”
~সমাপ্ত~