স্বপ্নচারিণী,পর্ব_১৫
সামান্তা সিমি
একসপ্তাহ ধরে পরীক্ষা চলছে যূথীর।আজ লাস্ট পরীক্ষা। ফুরফুরা মেজাজে হল থেকে বের হলো যূথী।কয়েকদিন কি যে ঝড় গেছে তাঁর উপর দিয়ে।ঠিকমতো পড়াশুনা না করার ফলে পরীক্ষার আগের রাতগুলোতে চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছিল।আজ আর সেই প্যারা নেই।বাড়িতে গিয়েই আগে ফেসবুক আইডি অ্যাক্টিভেট করে নিবে।এখন তো আর নিশান ভাইয়া কিছু বলতে পারবে না তাঁকে।তবুও ওই লোকের কথা কিছু বলা যায় না।সাবধানে রাখতে হবে মোবাইলটা।
এসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে মনীষা ও নীলিমা’র হলের সামনে গেল যূথী।
এখন বাজছে বারটা।সকালে দুটো পরোটা খেয়ে বের হয়েছিল কিন্তু এখনই খিদের জ্বালায় পেটে আগুন জ্বলছে। বাড়ি যেতে যেতে তো একটা বাজবে।মনীষা এবং নীলিমা’র পরীক্ষা এখনো শেষ হয় নি।যূথী বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে বারবার ঘড়ি দেখছে।
“—তুমি যূথিকা জাহান? ”
পেছন থেকে নিজের নাম শুনতে পেয়ে সেদিকে তাকাল যূথী।একটা মেয়ে পরীক্ষার ফাইল হাতে তাঁরই দিকে তাকিয়ে।কিন্তু সে মেয়েটাকে চেনে না।ক্লাসেও তো দেখেনি।হয়তোবা অন্য ডিপার্টমেন্টের।
“—হ্যাঁ আমিই যূথিকা।কোনো দরকার?”
“—মুশতাক স্যার ডেকেছে তোমায়।যাও দেখা করে এসো।”
“—আমাকে কেনো ডেকেছে?”
“—এটাতো জানি না।”
“—আচ্ছা যাচ্ছি।”
যূথী একবার নীলিমা এবং মনীষা’র দিকে তাকিয়ে ডান দিকে হাঁটা দিল।ওরা পরীক্ষা শেষ করে বের হওয়ার আগেই স্যারের সাথে দেখা করে আসা যাবে।কেনো ডেকেছে কে জানে!
“—স্যার আসবো?”
মুশতাক রহমান হালকা হেসে বললেন,
“—হ্যাঁ এসো।তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম।এখানে চেয়ারটায় বসো।”
মুশতাক রহমানের মুখে এখনো মৃদু হাসি ঝুলছে।যূথী ঠিক বুঝতে পারছে না তাঁকে কেনো ডাকা হয়েছে।আজ যেন স্যারের হাসিটাও অন্যরকম।
“—কোনো দরকার ছিল স্যার?”
“—দরকার? হ্যাঁ… দরকার ছিল বলেই তো ডেকেছি।একটু অপেক্ষা করো।”
মুশতাক রহমান মোবাইলে কিছু খুঁজে যাচ্ছেন। যূথী কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে।ওর কাছে স্যারের হাবভাব কেমন যেন ঠেকছে।
মোবাইলে একটা ভিডিও চালিয়ে মুশতাক রহমান যূথীর দিকে বাড়িয়ে বললেন,
“—এর জন্যই ডেকেছিলাম।একটু ভালোভাবে দেখো।”
যূথী মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল।শরীরের স্নায়ুশক্তি যেন দুর্বল হয়ে আসছে।চারপাশের কোনোকিছু তাঁর বোধগম্য হচ্ছে না।এসব কি দেখছে সে?
সেদিন কমনরুমে তাঁর শাড়ি পাল্টানোর সম্পূর্ণ দৃশ্য মোবাইলে দেখা যাচ্ছে।
দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল যূথী। চোখের কোনা দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। চোখ তুলে সামনে তাকানোর শক্তিও নেই।শরীরের প্রতিটি লোমকূপ থেকে যেন গরম ভাপ বের হচ্ছে।
“—কি ব্যপার যূথীকা! বেশ ঘাবড়ে গেলে মনে হচ্ছে? ”
মুশতাক রহমান টান মেরে যূথীর হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিল।
যূথী এখনো পাথরের মূর্তির ন্যায় চেয়ারের হাতল শক্ত করে চেপে বসে আছে।পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে নিচের দিকে।মাথায় শুধু ওইদিনের মেয়েটার বলা কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। সেদিন মেয়েটার কথা সে বিশ্বাস করেনি।
যূথী কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল,
“—শিক্ষক হয়ে এ…এটা আপনি কিভাবে করতে পারলেন সা..স্যার?”
যূথীর সামনে বসা ভালো মানুষের মুখোশ পরা লোকটি হু হা করে হেসে উঠল।এমন ক্রুর হাসি শুনে যূথীর মন অজানা আতঙ্কে কেপে উঠছে বারবার।তাঁর সাথে কি খারাপ কিছু হতে চলেছে?
“—ভয় পেয়ো না যূথীকা।এটা কেউ দেখবে না।শুধু আমাকে একটু খুশি করে দিও তাহলেই হবে।আশা করি আমার কথা বুঝতে পারছো।অতটাও বোকা নয় তুমি তাই না?”
স্যারের বলা কথাগুলো যূথীর কানে অগ্নিবর্ষণের মত প্রবেশ করতে লাগল।কোনো শিক্ষক যে তাঁর মেয়ের বয়সী ছাত্রীর সাথে এমন জঘন্য কাজ করতে পারে এটা ভাবতেই যেন তাঁর মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।এতদিন পর্যন্ত যাকে একজন আদর্শ শিক্ষক বলে জেনে এসেছে সেই মানুষটার মুখ থেকে কখনো এমন কুরুচিপূর্ণ কথা শুনতে হবে এটা সে কল্পনাও করেনি।
যূথী চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলল,
“—আপনি একজন অসুস্থ মানুষ স্যার।চিকিৎসা দরকার আপনার।তারপর না হয় কলেজে ছেলেমেয়েদের পড়াতে আসবেন।”
মুশতাক রহমান যূথীর কথা গায়ে মাখলেন না।সামান্য হাসলেন তিনি।সমস্ত ব্যপারটাতেই যেন খুব মজা পাচ্ছেন।
যূথী চলে যেতে নিলেই তিনি বলে উঠলেন,
“—যদি এই ভিডিওটা সকলকে দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয় তাহলে কেমন হবে?ছেলেরা লুটেপুটে দেখবে তাই না?”
থেমে গেল যূথী।পিছনে ফিরে ওই মানুষটার দিকে ফিরে তাকাতেও ঘেন্না লাগছে তাঁর।বুক ফেটে কান্না আসছে।এ কোথায় ফেঁসে গেল সে?তাঁর জীবনটা এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে!
“—সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে জানিও যূথীকা।অপেক্ষা করব আমি।”
যূথী আর এক মুহূর্তও এখানে দাঁড়ালো না।চোখের জলে সামনের সবকিছু ঝাপসা দেখাচ্ছে।কিচ্ছু চিন্তা ভাবনা করার শক্তি নেই।মাথা ফাঁকা হয়ে আছে।
চারপাশের ছেলেমেয়ে গুলো অদ্ভুত চোখে দেখছে তাঁকে।কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে তোমার। কিন্তু কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত অবস্থায় সে নেই।এলোমেলো পা ফেলে বাড়ির দিকে রওনা হলো যূথী।
‘
‘
‘
দুপুরের আগে চৌধুরী ম্যানশন কিছুটা নীরব থাকে।বাড়ির মহিলারা নিজেদের ঘরোয়া কাজে ব্যস্ত এবং পুরুষরা যার যার কর্মস্থলে থাকে।আজও তার ব্যতিক্রম নয়।
মনীষা,নীলিমা এবং যূথী কলেজে।বিদীষা গেছে প্রাইভেটে।বিথী চৌধুরী সাফাকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছেন।
আশা চৌধুরী দুপুরের রান্নাবান্না শেষ করে ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে রাখছেন।পাশেই নীলুফা চৌধুরী মেজো জা’কে তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন। এখনই মেয়েগুলো কলেজ থেকে বাড়ি আসবে।
সেই সকালে খেয়ে বেরিয়েছে এখন নিশ্চয়ই প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে ফিরবে।
মেইন ডোর দিয়ে কারো প্রবেশ করার আওয়াজ পেতেই দুইজন সেদিকে তাকালেন।আঁতকে উঠল তাঁরা।
কান্নাভেজা মুখে যূথী দৌড়ে আসছে।মেয়েটার চোখমুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
যূথী কোনোদিকে না তাকিয়ে সিড়ি দিয়ে উপরে চলে গেল।নীলুফা চৌধুরী তাঁকে পিছু ডাকছেন কিন্তু যূথী সেই ডাক কানে তুলে নি।
যূথীর রুমের সামনে গিয়ে আশা চৌধুরী এবং নীলুফা চৌধুরী এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন।
যূথী ফ্লোরে বসে হিচকি তুলে কান্না করছে।চুল সব এলোমেলো। পরীক্ষার ফাইলটাও পায়ের কাছে পরে আছে।দুইজন অনেকটা ঘাবড়ে গেলেন।
নীলুফা চৌধুরী দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন যূথীকে।
“—এভাবে কান্না করছিস কেনো যূথী?কি হয়েছে আমাকে বল!”
যূথীর কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেল।নীলুফা চৌধুরী চিন্তিত গলায় বললেন,
“— এখন কি করব আশা? নিশ্চয়ই খারাপ কিছু ঘটেছে মেয়েটার সাথে।বাড়িতে কেউ নেই কাকে ডাকব এখন?”
আশা চৌধুরী’র কপালেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ।যূথীর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“—এভাবে কেঁদো না যূথী।সব খুলে বলো আমাদের।না বললে তোমার সমস্যাটা কি করে বুঝবো?”
যূথী আগের মতই হিচকি তুলে কাঁদছে।আশেপাশের কোনো কিছুই যেন তাঁর মাথায় ঢুকছে না।কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ শুকিয়ে গেছে।
“—আপা নিশানকে খবর দাও।সে পারবে যূথী থেকে কথা বের করতে।”
জা’য়ের কথায় অনেকটাই ভরসা পেলেন নীলুফা চৌধুরী।তাঁর ছেলেই একমাত্র এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে।
“—ঠিক বলেছিস আশা।আমি এখনই ফোন করছি।”
* হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে যূথী।চোখ বন্ধ করতেই মোবাইলের সেই ভিডিওটা ভেসে উঠছে।একটা মানুষ এত খারাপ কিভাবে হতে পারে! মেয়েদের কাছে তাঁর সম্মানের থেকে বড় কিছু নেই।কার কাছে সাহায্য চাইবে সে?কাউকে জানাতে গেলে হাজারটা লোক জানবে ঘটনাটা।তখন বাইরের মানুষদের সামনে কি করে মুখ দেখাবে।কলেজের ছেলেমেয়েগুলো তাঁকে দেখলেই প্রশ্ন ছুড়ে মারবে।
কোনো উপায় ঠাওর করতে না পেরে দুইহাতে মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের চুল চেপে ধরছে যূথী।ঠোঁট টিপে কান্না থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
“—যূথী! ”
অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটার ভারী গলার আওয়াজ শুনেই ঝট করে মাথা তুলল যূথী।নিশান ভাইয়া করুণ চোখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।চাউনিতে হাজারো প্রশ্ন।
যূথীর চোখে জল দেখে নিশানের বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। চোখের পাতায় জলের বিন্দুগুলো চিকচিক করে উঠছে।নিশানের ইচ্ছে করছে একটানে যূথীকে বুকের মাঝে নিয়ে নেয়।
“—কাঁদছো কেনো যূথী? আমাকে বলো কি হয়েছে?”
নিশান এগিয়ে এসে যূথীর পাশে ফাঁকা জায়গাটা দখল করে নিল।নীলুফা চৌধুরী এবং আশা চৌধুরী দরজার সামনে উৎকন্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
নিশান যূথীকে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে।কিন্তু যূথীর কোনো হেলদুল নেই।
বাধ্য হয়ে নিশান তাঁর গান বের করে যূথীর মাথায় ঠেকিয়ে ধমকিয়ে বলল,
“—কানে কথা যাচ্ছে না?লাস্ট বার জিজ্ঞেস করছি কি হয়েছে বলো।নাহলে একদম মাথায় সুট করে দিব।চেনো না আমায়।”
নিশানের হাতের অস্ত্র দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেল যূথী।একবার নিশানের দিকে আরেকবার বড়মা’র দিকে ভীত চোখে তাকাচ্ছে। কিন্তু ওঁরা সবাই একই ভঙ্গিতে চেয়ে আছে তাঁর দিকে।
গায়ের উড়নাটার কোনাটা শক্ত করে চেপে ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে একে একে সব ঘটনা বলে দিল।
রুমে পিন পতন নীরবতা।কেউ কোনো কথা বলছে না।দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা দুই জা আতঙ্কে একে অপরের হাত জড়িয়ে ধরছেন।নীলুফা চৌধুরী চোখের কোনা দিয়ে একবার ছেলেকে দেখে নিলেন।
দেয়ালে টাঙানো বড় পেইন্টিংটায় নিশানের স্থির চোখের দৃষ্টি আবদ্ধ।নীলুফা চৌধুরী ভয়াবহ কোনো ঝড়ের আভাস পাচ্ছেন।নিশানের এমন শান্ত হয়ে থাকা কোনো ভাল লক্ষণ নয়।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে যূথীকে একটান দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল নিশান।তাঁর চোখে রক্তিম আভা দেখা যাচ্ছে। যূথী কিছু বলার সুযোগই পেল না।নিশান তাঁর হাত ধরে টানতে টানতে নিচে নিয়ে যাচ্ছে।রুমের নীরবতার মাঝে এ যেন হঠাৎ বিস্ফোরণ। নীলুফা চৌধুরী পেছন থেকে নিশানকে ডেকে চলেছে।কিন্তু সে ফিরেও তাকাচ্ছে না।
________________
নিজের কেবিনে চেয়ারে বসে আছেন মুশতাক রহমান।মনের সুখে পান চিবিয়ে যাচ্ছেন। চেহারায় এক ধরনের প্রশান্তির আভাস।কিছু একটা ভেবে ক্ষণে ক্ষণে মুখে হাসি ফুটে উঠছে।তিনি নিশ্চিত যূথীকা নামের মেয়েটা অবশ্যই তাঁর কাছে আসবে।এবারের প্ল্যানটা একদম সুপরিকল্পিত ছিল।আর এই মেয়েটাই সেই ফাঁদে পা দিয়েছে।তবে তিনি বেশ আনন্দিত।গ্রামের মেয়েরা এমনিতেও কিছুটা ভীতু প্রকৃতির হয়।একে নিয়ে কোনো ঝামেলা হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে রেকর্ড করা ভিডিওটা চালু করে দিলেন।এ পর্যন্ত কয়েকবারই দেখা হয়ে গেছে কিন্তু এরপরও তাঁর দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে।
প্রচন্ড শব্দে দরজা খোলার আওয়াজ পেতেই মুশতাক রহমান ভয় পেয়ে গেলেন।হাত থেকে মোবাইলটা টেবিলের একপ্রান্তে ছিটকে পরল।দরজার দিকে তাকাতে নিজের অজান্তেই বিড়বিড় করে বলে উঠলেন,
“—নাফিস ইমতিয়াজ নিশান! ”
চলবে………..