#বন্ধু
#ধারাবাহিক_গল্প
রাত দশটা বাজে অরুনের মোবাইলে অপরিচিত নম্বর থেকে একটা কল এসেছে, অরুণ বিরক্ত হয়ে কলটা রিসিভ করবে কিনা ভাবতে, ভাবতে কলটা কেটে গেছে,একটু আগে তার বউ তৃষ্ণা তার সাথে সামান্য একটা বিষয় নিয়ে খাওয়ার টেবিলে তাকে যথেষ্ট পরিমানে কথা শুনিয়েছে, তখন থেকে মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। আবার রিং বাজছে এবার অরুণ কলটা রিসিভ করলো,
-হ্যালো কে বলছেন?
– নীচে আয়, আমি তোর বাসার নীচে দাঁড়িয়ে আছি
অরুন হতভম্ব হয়ে গেছে, কে কথা বলল? কে নীচে দাঁড়িয়ে আছে? অরুনের গলা কেঁপে উঠলো কথা বলার সময়,
– শাহিন?
অপর প্রান্ত থেকে উত্তর এলো
– হু, আমি, কি চলে যাবো?
– আমি নামছি
তরুনের পেছনে কখন তৃষ্ণা এসে দাড়িয়ে অরুন খেয়াল করে নাই। তৃষ্ণা অরুনেকে দরজার দিকে যেতে দেখে বলল,
-কোথায় যাও এত রাতে?
অরুন কোন রকমে বলল,
নীচে আমার এক বন্ধু এসেছে।
অরুন নীচে গিয়ে দেখে সত্যি, সত্যি শাহীন দাড়িয়ে আছে। শাহীনকে দেখে তার হতভম্ব ভাব আরো বেশি বেড়ে গেছে। শাহিন যথেষ্ট পরিমানে মোটা হয়ে গেছে, আগের সেই তালপাতার সেপাই ভাবটা কেটে গেছে, কিন্তু একি শাহিনের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে কেন? নাকের কাছে ধরে রাখা টিস্যুটা রক্তে ভেজা,
– তোর কি হয়েছে? এত বছর পরে কোথা থেকে এলি? আমার ঠিকানা কোথায় পেলি?
– এ সব কথা পরে হবে, আগে বল তোর বাসায় আমাকে নিয়ে গেলে কোন সমস্যা হবে? আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।
অরুণ মনেমনে বলল,সমস্যা হবে না আবার, তুমুলযুদ্ধ হবে, হয়তো তৃষ্ণার সাথে শাহিনকে কেন্দ্র করে ওকে বসা থেকে বের করে দিতেও পারে তৃষ্ণা , কিন্তু সেই কথা শাহিনকে বলা যাবে না কোন ভাবেই, তা হলে ও হয়তো এখনই চলে যাবে।
অরুন মনে মনে বলল,যা হবার হবে, আর তৃষ্ণা যদি একটুও বাড়াবাড়ি করে শাহিনকে দেখে তবে সে শাহিনকে নিয়ে সোজা বের হয়ে আসবে বাসা থেকে।
– কোন সমস্যা নাই।চল উপরে চল উপরে গিয়ে আগে ফ্রেস হবি তারপর তোর সব কথা শোনব।
শাহিন লিফটে উঠে বলল,
-তোর কাছে, জিয়া,রিফাত আর বাবুর নম্বর আছে?
– আছে
– ওদের কল দিয়ে বলবি, আমি তোর এখানে এসেছি। ওদের কি আমাকে মনে আছে?
– না, সবাই তোকে ভুলে গেছে? সবাই কি তোর মতো সেলফিশ নাকি?
ডোর বেল বাজাতেই তৃষ্ণা দরজা খুলে দিলো,তৃষ্ণা শাহিনকে দেখে হতভম্ব হয়ে মনে হচ্ছে।
অরুন কোন রকমে তৃষ্ণাকে বলল,
– তৃষা,ও আমার বন্ধু শাহীন
তৃষ্ণা অবাক হয়ে দেখছে তার হাসবেন্ড অরুনের সাথে একজন মহিলা,যাকে সে এর আগে কখনো দেখে নাই। এবং মহিলাটা বিধস্ত। তৃষ্ণা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অরুন তৃষ্ণাকে বলল,
-তৃষ্ণা, শাহিনের একটু সমস্যা হয়েছে, আজ রাতে ও আমাদের এখানে থাকবে।
এত রাতে একজন নাক ফাটা মহিলাকে সাথে করে নিয়ে এসে অরুন তাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে তার সাথে! আবার বলছে বন্ধু! এই কথা হজম করাই তার জন্য যথেষ্ট কঠিন, তার উপরে কি অবলীলায় বলে বসলো এই মহিলা আজ রাতে এখানে থাকবে! আল্লাহ্ জানে এই মহিলা কি অঘটন ঘটেয়ে এসেছে, অরুনকে দেখে তো মনে হচ্ছে না সে কোন রকম চিন্তিত।
অরুনের সাহস দেখে তৃষ্ণা অবাক হয়ে গেছে।
কে এই মহিলা? যাকে বাসায় আনার জন্য তৃষ্ণার অনুমতির প্রয়োজনও অনুভব করে নাই অরুন, এতটা ডেস্পারেট হওয়ার মতো সাহস কোথায় পেলো?
অরুন শাহিনের জন্য ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে, একটা পাতলা রুমালে জড়িয়ে শাহিনের হাতে দিয়ে বলল,
-নে নাকে রুমালটা ধর, রক্ত পড়া বন্ধ হবে। আমি তোর জন্য টেবিলে খাবার দিচ্ছি তুই খেতে খেতে,আমি সবাইকে কল দিচ্ছি।
তরুনের বউ তৃষ্ণা ওদের আশপাশেরই ছিলো, তৃষ্ণার মাথায় আসতেছে না এই মহিলা আসলে কে? আর অরুনকে সে একবার ইশারায় তাদের রুমে আসতে বলেছিলো, কিন্তু অরুন ভাব করেছে সে তৃষ্ণার ইশারা বুঝতে পারে নাই। এবার আর তৃষ্ণা সহ্য করতে না পেরে বলল,
-অরুন তুমি রুমে যাও আমি ওনাকে খাবার গরম করে দিচ্ছি।
– তৃষ্ণা, তুমি তো এই সময়ে টি ভি দেখো, তুমি তোমার সিরিয়াল দেখো কোন সমস্যা নাই, শাহিন কিছু মনে করবে না, আর শাহিন বেশি কিছু খায় না আমি ওর জন্য একটু বিফ গরম করে দিবো, আর ভাত, একটু ডাল থাকলে ভালো হতো শাহিন গরুর মাংস ডাল দিয়ে খেতে পছন্দ করে, কিন্তু তুমি তো আজ ডাল রান্না করো নাই।
তৃষ্ণার মুখে চলে এসেছিলো, আমি তো জানতাম না আজ শাহিন নামের তোমার একজন মহিলা বন্ধু এত রাতে আমার বাসায় পদধূলি দিবে, তা হলে তার জন্য অবশ্যই ডাল রান্না করে রাখতাম। তৃষ্ণা আগুন চোখে অরুনের দিকে তাকালো এর অর্থ হলো এই মহিলা বিদায় হউক, তোমাকে আমি খুন করে ফেলবো।
তৃষ্ণা নিজেকে কন্ট্রোল করলো আর শাহিনের দিকে না তাকিয়েই বলল,
-আপনি খান, আমি একটু রুমে যাচ্ছি।
– না,না,তুমি বিশ্রাম করো অরুন তো আছেই, আমি এত রাতে এসে তোমাদের সমস্যায় ফেলে দিলাম,
অরুন শাহিনের জন্য সব খাবার ওভেনে গরম করে টেবিলে দিলো। তারপর বলল,
– আরাম করে খা। কিছু লাগলে আমাকে ডাক দিস,
এখানে নেটওয়ার্ক ভালো না, আমি আমার বেড রুমে গিয়ে ওদের কল করছি।
শাহিন বুঝতে পারছে অরুন ওর সামনে বসে কাউকে কল দিতে চাচ্ছে না। শাহিন অরুনকে কিছু বলল না শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল তারপর খেতে লাগলো ওর প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে।
তরুন ওর বেড রুমে গিয়ে প্রথমে কল দিলো জিয়াকে,
জিয়া কল রিসিভ করে প্রথমেই বলল,
-কিরে কেমন আছিস? এত রাতে কল দিলি কি বিষয়।
– জিয়া, আমার বাসায় শাহিন এসেছে
– কোন, শাহিন?
– আমাদের শাহিন
– মানে, কি? ও কোথা থেকে আসবে? এত রাতে?
– আমি কিছু জানি না, তবে গুরুতর কিছু হয়েছে, শাহিনের নাক থেকে রক্ত পড়ছিলো।
– তোকে কিছু বলে নাই
– না, তোদেরকে কল দিতে বলেছে, সবাইকে এক সাথে বলবে। আর আমি কিছু এখনো জিজ্ঞেস করি নাই। তুই আসতে পারবি?
– আমি আসতে পারবো মানে কি? আমি একক্ষনি রওনা দিচ্ছি, আর বাবুকে তোর কল দিতে হবে না, আমি ওকে সরাসরি তুলে নিবো। তুই রিফাতকে কল দিয়ে বল।
তৃষ্ণা কান পেতে ছিলো তরুনের কথা শোনার জন্য। তৃষ্ণা এইটুকু বুঝতে পারছে যে শাহিন নামের মহিলাটার সাথে তরুনদের সব ক’জন বন্ধুর পরিচয় আছে, তা না হলে অরুন ওর ক্লোজ সব বন্ধুদের কেন এত রাতে কল দিচ্ছে? আবার তাদের আসতে বলছে, অরুন নিজে তো তার হাতে ধোলাই খাবেই সেই সাথে তার অন্য বন্ধুদের অবস্থাও খারাপ করবে। জিয়া ভাইয়ের বউ নেহা ভাবি তো সাংঘাতিক মেয়ে তার ধারণা তার হাসবেন্ডকে দেখলে সব মেয়েরা তার প্রেমে পড়ে যায়, যে কোন পার্টিতে জিয়া ভাই কোন মেয়ের সাথে কথা বললে নেহা তিনদিন জিয়া ভাইয়ের সাথে কথা বন্ধ রাখে, সেই মেয়ে যখন শুনবে তার হাসবেন্ড রাত এগারোটার সময় তার বন্ধুর বাসায় শুধু মাত্র একজন শাহিন নামের মেয়ের কথা শুনে চলে এসেছে তখন কি হবে?
অরুন এখন তাদের সব চাইতে কুল বন্ধু রিফাতকে কল দিয়ে, শাহিনের কথা বলল,
রিফাত শাহিনের কথা শুনে প্রথমে যে কথাটা বলল,তা হলো,
আমি শাহিন নামের নামে কাউকে চিনি না, আমার শাহিন নামের কারো সাথে কোনদিন পরিচয় ছিলো না।
– শাহিন মনে হয় কোন বিপদে পড়েছে, ওর নাক থেকে রক্ত পড়ছিলো, মনে হয় মারাত্মক কিছু হয়েছে।
– তা হলে তোর বাসায় নিয়ে না যেয়ে কোন হসপিটালে নিয়ে যেতি, তুই কি ডাক্তার?
– না, তুই তো ডাক্তার, তাই তোকে কল দিলাম, মনে কর রুগী দেখার জন্য তোকে কল দিয়েছি। চলে আর শাহিন তোকে কল দিতে বলেছে।
– শাহিনের ইনজুরি কেমন? নাকে বরফ দে, আমি আসতেছি।
অরুন কল কাটতে কাটতে মনে মনে বলল,তোর আর ডাক্তারি ফলাতে হবে না আমরাও এগুলো জানি।
এদিকে রিফাত, বাবু আর জিয়া সবাই সবার বাসায় তরুনের বাসায় তাদের শাহিন নামের এক বন্ধু এসেছে খুবই জরুরি বিষয়, তাই তাদের রাতেই যেতে হবে বলে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছে। কেউ আর তাদের স্ত্রীদের বলে নাই শাহিন নামের বন্ধুটা আসলে একজন মেয়ে বন্ধু। কে চায় বাসার মধ্যে অহেতুক ঝামেলা। আগে অরুনের বাসায় গিয়ে দেখা যাক পনেরো বছর পরে কোথা থেকে উদয় হলো শাহিন।
এদিকে খাওয়া-দাওয়ার পরে শাহিনের শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করেছে, মনে হচ্ছে অরুনকে বলে অরুন আমাকে একটা বিছানা করে দে, তা না হলে একটা চাদর এনে দে, আমি বসার ঘরে সোফায় শুয়েই ঘুমাতে পারবো,আমি একটু নিশ্চিত মনে ঘুমাতে চাই,আমি বহু বছর রাতে ঘুমাতে পারি নাই আতংকে।
অরুন ডাইনিং টেবিলে এসে দেখে শাহিনের খাওয়া শেষ। তখন সে শাহিনকে বলল,
– চা খাবি না কফি?
তুই বসার ঘরে গিয়ে বস, আমি কফি বানিয়ে নিয়ে আসতেছি।
– তুই ওদের কল দিয়েছিস?
– হ্যা, আমি কফি বানাতে বানাতে হয়তো ওরা চলে আসবে।
– থাক তা হলে ওরা আসলে এক সাথে কফি খাওয়া যাবে।
চলবে
#লেখাঃসুরাইয়া_শারমিন