#সুপ্ত_অনুরাগে-২৪,২৫
#প্রভা_আফরিন
[২৪]
অপুর গালে নোনা জলের শুকনো ছাপ। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদার ফলে মুখ চিটচিটে হয়ে গেছে। নাক টানছে ঘন ঘন। সুপ্ত মনোযোগ দিয়ে সেই নাক টানার শব্দ শোনে। দুপাশ কণ্ঠস্বরের নীরবতায় আচ্ছাদিত বহু সময় ধরে। অপু নিজেকে সামলে নিয়েছে। সুপ্তের আচরণের এহেন আকস্মিক পরিবর্তন তাকে বিস্ময়ের চুড়ান্ত দ্বারে নিয়ে গেছে। ভাবনার গতিপথ বদলে দিয়েছে মুহূর্তেই। অপু দৃঢ় গলায় বলল,
“আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
“কেন?”
“জানি না কিন্তু দেখা করতে চাই।”
“আমার সময় নেই।”
অপু অবাক গলায় বলল,
“আশ্চর্য! এযাবতকাল আমার পেছনে অযথা সময় নষ্ট করে এখন আপনার সময় নেই? বাজে বকার যায়গা পাচ্ছেন না?”
“বাজে বকেছি বলেই এখন ভালো বকছি। তুমি আমার ভাইয়ের বউ হতে চলেছো। আমাদের উচিৎ একে অপরকে এভোয়েড করা।”
“বলতে পারলেন এই কথা?”
“বলছি তো।”
সুপ্তের প্রতিটা নির্লিপ্ত, ছাড়া ছাড়া উত্তরে অপুর ভেতর ক্ষোভ জমতে থাকতে লাগল। এতটা উপেক্ষা! অপুর কী আদৌ এতটা উপেক্ষা প্রাপ্য? নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে? অপু বলল,
“হতে চলেছি আর হয়েছি এর মাঝে পার্থক্য আছে। হয়তো তার আগে আমি ম’রেই গেলাম…”
“এবার তুমি বাজে বকছো।”
“মৃ’ত্যু কোনো বাজে বকা নয়। বরং অবধারিত ভবিষ্যত ও অকাট্য সত্যি। যা আমরা প্রতি ক্ষণে সঙ্গে নিয়ে ঘুরি।”
“হুম, সঙ্গে নিয়ে ঘুরেও ধরতে পারি না।”
“আপনার কী হয়েছে বলুন না? এভাবে কেন কথা বলছেন আমার সঙ্গে?”
“তুমি তো চাইতে আমি এভাবেই কথা বলি। তাহলে আজ তোমার কী হলো?”
“জানি না।”
“না জেনেই এমন অস্থির হয়ে যাচ্ছো? এটা তো তোমার সঙ্গে যায় না, অপরাজিতা।”
“দাউ দাউ করে দা’বা’নল ছড়ানো অ’গ্নিশিখা হুট করে মোমের ন্যায় মিটমিট করে জ্ব’লাটাও ঠিক মানায় না। এই স্বভাবও আপনার সঙ্গে যায় না, সুপ্ত।”
সুপ্ত ফিচেল হাসল। এতসব গম্ভীর কথোপকথনের মাঝেও অপু যে তাকে নাম ধরে সম্বোধন করছে তা কর্ণগোচর হওয়া এড়ালো না। সুপ্তের তো এতে আশকারা পাওয়ার কথা। অথচ সে নিজেকে গুটিয়ে ফেলছে। রাতের গায়ে ভারী নিশ্বাসের বি’ষাক্ত বায়ু ছেড়ে সুপ্ত উদাসী গলায় বলল,
“আমি নিভে গেছি অপরাজিতা। নিভে গেছি। চাঁদ হয়ে যে আলো আমি ধারণ করেছি, অহং’কারে অকাতরে বিলিয়েছি, এতদিনে বুঝেছি সেই আলো আমার নয়। সূর্যের থেকে ধার করা। আমি এক আলোহীন প্রস্তরখন্ড। আমার জীবনের চারপাশে ঘুটঘুটে আঁধার। আর তুমি এক জীবন্ত ফুল। তোমার সৌন্দর্য সূর্যের আলোয় প্রস্ফুটিত হয়। আমার আঁধার তোমার জন্য নয় অপরাজিতা।”
অপু সেসব কথার মর্থার্থ উদ্ধারে ব্যর্থ। শুধু বুঝল মানুষটা কোনোভাবে দুঃখ পেয়েছে যা সহ্য করতে পারেনি। ঠিক তখনই অপুর খেয়াল হলো সে সুপ্তের সম্পর্কে কিছুই জানে না। কিছুই না। শুধু জানে সুপ্তের মাঝে এক চরম দুষ্টু, খেয়ালি, জেদি সত্তা বাস করে। তার মাঝে সরলতা, কমনীয়তা আছে। আছে উত্তাল প্রেমের ঢেউ, যা শুধু তার অপরাজিতার জন্যই বরাদ্দ। এখন কী করে ভাটা পড়ল? ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে অপুর অস্বস্তি হয়। প্রবল কৌতুহল ও কিছুটা দোনোমনা নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কিছু মনে করবেন না, আপনার কী মা নেই?”
“আছে আবার নেই।”
“মানে?”
“ও কিছু না। রাখি।”
সুপ্ত উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোন কাটল। সেই মুহূর্তে অপুর চোখ ছলছল করাটা আবারো ফেরত আসতে শুরু করল।
_____________
ফোন কাটা মাত্রই বাবার তারস্বরে চ্যাচানোর শব্দ শুনতে পেল সুপ্ত। সহসাই ভ্রু কুচকে এলো। করিডরে এসে দেখল ডাইনিং টেবিলে মিষ্টির প্যাকেট শোভা পাচ্ছে। রফিক সাহেব ফারিহাকে নির্দেশ দিলেন,
“সবাইকে মিষ্টিমুখ করা, ফারিহা। আমার ছেলের চাকরির জয়েনিং লেটার এসেছে। তাও আবার দুই দুইটা! আমার ছেলে কর্মজীবী হতে চলেছে। আমি ঠিক করে রেখেছি সুপ্ত প্রথম স্যালারি পেলে সমপরিমাণ অর্থ আমি দান করব।”
ফারিহা ভাইজানের উচ্ছাস দেখে হাসল। বলল,
“ওকে আলাদা কোম্পানিতে কেন জয়েন করতে দিচ্ছেন ভাইজান? আপনার অফিসের ভবিষ্যত তো ওই। সেখানেই হাতেখড়ি হতো নাহয়।”
“বাবার অফিসে চাকরি, বাবার ব্যবসার হাল ধরা অনেকটা টেকেন ফর গ্রান্টেড ফারিহা। তাতে কখনো কখনো নিষ্ঠার অভাব দেখা দেয়। নিজের যোগ্যতার সম্বন্ধে জ্ঞান হয় না। আমি চাই সুপ্ত আগে অভিজ্ঞতা অর্জন করুক। কর্মক্ষেত্রে পারিবারিক ইমোশন চলে না।”
“সুপ্ত কোথায় জয়েন করবে বলেছে?”
“কোথায় আবার, ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার দরকার নেই। রাজশাহীরটা ছেড়ে দেবে।”
রফিক সাহেব কথা শেষ করতেই সুপ্তের দিকে নজর গেল। এগিয়ে গিয়ে বুকে জড়িয়ে বললেন,
“তোর জন্য নতুন স্যুট বানাতে দিয়েছি। এখন থেকে রোজ সকালে টিপটপ হয়ে বাপ-ব্যাটা অফিসে বেরোবো।”
সুপ্ত বাবার বাধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল। এই যে তার সামান্য একটা চাকরিতে বাড়িতে খুশির আড়ং বসেছে অথচ তার হৃদয়ে পড়ছে বিষাদের ঘন ছায়া। বাবার মুখের দিকে তাকালে সুপ্তের বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। সংজ্ঞাহীন, ব্যাখ্যাহীন শব্দগুচ্ছ অনাদরে পড়ে থাকে পাজর ঘেঁষে। সে জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“আমি ঢাকার চাকরিটা করব না বাবা। রাজশাহীতে জয়েন করব।”
রফিক সাহেব অবাক হলেন। অবাক হলেন বৈশাখী এবং ফারিহাও। বৈশাখী বললেন,
“কেন? সুযোগ-সুবিধা সব এখানেই বেশি। রাজশাহীরটায় বেতনের পাশাপাশি খাটুনিটাও বেশি যাবে। শুরুতেই প্রেশার নেওয়া ঠিক হবে না। ধীরে ধীরে নাহয় শ্রমের মাত্রা বাড়বে।”
সুপ্ত বলল,
“আমি ব্যস্ত থাকতে চাই মা। তাছাড়া একঘেয়ে জীবনের থেকে একটু রিলিফ পেতে জায়গা বদল হওয়া দরকার।”
রফিক সাহেব অসন্তুষ্ট হলেন ছেলের কথায়। বলাবাহুল্য উত্তেজনায় ভাটা পড়েছে। বললেন,
“ছোটো করে একটা ট্যুরে যা নাহয়। রিফ্রেশমেন্ট হয়ে যাবে। এরজন্য বাড়ি কেন ছাড়তে হবে? কোনোদিন বাড়ি থেকে দূরে থাকিসনি তো। এডজাস্ট করতে কষ্ট হবে।”
“মানিয়ে নেব।” সুপ্ত নির্লিপ্ত স্বরে বলল। বোঝা গেল সে নিজ সিদ্ধান্তে অটল। বৈশাখী ছেলেকে নিয়ে চিন্তিত হলেন। এগিয়ে এসে মুখে হাত বুলিয়ে বললেন,
“কী হয়েছে তোর? মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে। খাওয়া-দাওয়া কমে গেছে৷ বাইরেও যাস না ইদানীং। মেয়েটার সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে? আমাকে ঠিকানা দে তো দেখে আসি কে আমার ভোলাভালা ছেলেটার মন নিয়ে খেলছে।”
সুপ্ত মায়ের হাত সরিয়ে দিলো। বিরক্ত স্বরে বলল,
“কোনো ঝামেলা নেই মা। আমি রাজশাহী যাচ্ছি ফাইনাল।”
“অহেতুক অবাধ্যতা কেন করছিস? জানিস না তুই ছাড়া বাবার কেউ নেই। বাবাকে একা ফেলে যাবি?”
বৈশাখীর কথায় সুপ্ত রফিক সাহেবের দিকে কটাক্ষপাত করল,
“যে নিজের সর্বনাশ করতে ভালোবাসে তার একা থাকাই উচিৎ। অতিরিক্ত উদার মানুষ আমার একদম অপছন্দ।”
রফিক সাহেব স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন। বৈশাখী ধমক দিলেন,
“সুপ্ত! এ কেমন আচরণ তোর? আমার ছেলে তো এমন অবাধ্য নয়!”
সুপ্ত ক্লান্ত দেহে প্রস্থান করার আগে যেন নিজের ওপরই তাচ্ছিল্য করে বলল,
“ছেলে কী আদৌ ছিলাম?”
________________
অপুর দিনরাত কাটছে অস্থিরতায়। এখন তার সময় কাটানোর অতি প্রিয় স্থানে পরিনত হয়েছে জানালার ধার ও রেলিং ঘেঁষা ছাদ। উদাসীন দৃষ্টি সর্বদা নিন্মমুখী। রেইনট্রি গাছের তলা, ফরিদ মিয়ার টংয়ের দোকান, পিচঢালা সরু পথ, সেদিকেই তার একনিষ্ঠ মন পড়ে থাকে। হুট করে বাইকের শব্দ শুনলে ছুটে যায় জানালার কাছে। কিন্তু প্রতিবারই নিরাশ মনে ফিরতে হয়। সংগোপনে যাকে চাইছে সে নেই। এদিকে তন্ময়ের বাড়ির সঙ্গে অপুর বাড়ির নিত্য যোগাযোগ। সকাল বিকাল ফোনে দুই পরিবার আলাপে মেতে উঠছে। কথা হচ্ছে বিয়ের যাবতীয় বিষয়ের সুব্যবস্থা নিয়ে। অপু দাঁতে দাঁত চেপে সেসব শোনে। তন্ময় হুটহাট ফোন করে দু-চারটে কথা বলে। অপু হু হা করে। বিপরীতের নির্লিপ্ততায় তন্ময়েরও এগোনো হয় না। অপু তন্ময়কে অপছন্দ করে না। নিঃসন্দেহে মানুষটা ভালো। দেখতেও, কথাবার্তায়ও। কিন্তু স্বামী কিংবা ভালোবাসার মানুষ হিসেবে ভাবনায় ঠাঁই পায় না। কিংবা অপুই দেয় না।
দুদিন বিস্তর ভেবেচিন্তে অপু নিজের জীবনে একটি বড়ো সিদ্ধান্ত নিল। পুনরায় মনের মাঝে যুক্তিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার আগে তন্ময়কে ফোন করে বলল,
“আপনার সাথে দেখা করতে চাই তন্ময়।”
তন্ময় কিছুটা চমকিত। এই প্রথম অপু নিজে থেকে তাকে কল করেছে। শুধু কল করেই ক্ষান্ত হয়নি দেখাও করতে চাইছে! তন্ময়ের সে কথা বোধগম্য হতে খানিকটা সময় লাগল। অপুর কণ্ঠস্বর কিছুটা ফ্যাকাসে। যেন জল থেকে সদ্য তোলা হয়েছে সে স্বর। ফোনে তন্ময়ের কাছে তাই মনে হলো। শান্ত সুরে বলল,
“এনি প্রবলেম, ফুল? তুমি ঠিক আছো?”
“আছি। ঠিক আছি বলেই সজ্ঞানে, স্বইচ্ছায় ও স্বমতে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।”
“এনিথিং সিরিয়াস?”
“মোর দ্যান সিরিয়াস।”
চলবে…
#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[২৫]
ধানমন্ডি লেকের পাশে নিমগ্ন চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে তন্ময়। মাথার ওপর বিশাল বিশালদেহী গাছও বিনয়ী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। লেকের দিক থেকে তিরতির করে বাতাস এসে লাগছে গায়ে। সবুজ পানির ধার ঘেঁষে ভাসছে শুকনো পাতা, চিপসের প্যাকেট, খালি বোতল, খোসাসহ নানান আবর্জনা। টলটলে জলে তাকালে যে স্নিগ্ধতা জেকে বসে মনে তা যেন সেসকল আবর্জনা ম্লান করে দিলো। পানি হতে একটা কটূ গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা দিচ্ছে। পরিবেশটা যতটা মনোরম দেখতে, গন্ধটা ততটাই হতাশাজনক। এখন সময় বিকেল চারটে। অপু এই সময়টাই দেখা করত চেয়েছে তার সঙ্গে। তন্ময়ের কপালে চিন্তার ঘন ভাজ। মেয়েটা কাল থেকে সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা বলছে। বিষয়টার গুরুত্ব সে যেন না জেনেও স্পষ্ট টের পাচ্ছে।
অপু এলো তন্ময় পৌঁছানোর ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায়। তার চোখেমুখে একটা চাপা অস্থিরতা। মুখের রঙ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। অপুর নিভন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তন্ময় জিজ্ঞেস করল,
“আর ইউ অলরাইট?”
“হুম।” অপু মাথা নাড়ল।
“আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। পানি খাবে? কোক?”
অপু মানা করল না। তৃষ্ণায় তার জিভ, গলা শুকিয়ে গেছে। তন্ময় ছুটে গিয়ে ফিরে এলো মিনিট দুয়েকের মাঝেই। ক্যাপ খুলে বোতলটা অপুর হাতে বাড়িয়ে দিতেই অপু ঢকঢক করে গলা ভেজাল। গলা ভেজাল তন্ময়ও।
“বেটার ফিল করছো?”
“জি।”
তন্ময় এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“যে কথা জানাতে এত অস্বস্তি, দ্বিধা, অস্থিরতা তা কি এবার শুরু করবে?”
অপুর দৃষ্টি নত। দ্বিধাগ্রস্ত গলায় টেনে টেনে বলল,
“আসলে তন্ময়…”
“আমাকে নিয়ে সংকোচ কোরোনা, ফুল। তোমার যেকোনো সিদ্ধান্ত নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতে রাজি আমি।”
অপু চোখ তুলে চাইল৷ তন্ময়ের ঠোঁটের কোণে ভরসার একটি হাসি ঝুলে আছে। যা অপুকে জড়তা কাটাতে সাহায্য করল। তন্ময় পুনরায় বলল,
“চলো বসে কথা বলি।”
ওরা পাশাপাশি বসল সিমেন্টের ওপর। অপু গলা ঝেড়ে বলল,
“আমার কথা শোনার পর হয়তো আপনি অবাক হবেন। খারাপও লাগতে পারে। কিন্তু না জানালে নিজেকে অ’প’রাধী মনে হবে।”
“তুমি বলো, শুনছি।”
অপু মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে। এখানে এসে আবারো এলোমেলো হয়ে পড়েছে। সুপ্ত তন্ময়ের ভাই, অস্বস্তিটা এখানেই। সে বলল,
“কথাটা সুপ্তের ব্যাপারে।”
“সুপ্ত?”
“হ্যাঁ, আপনি জানেন আমরা পূর্ব পরিচিত।”
“তা জানি। বলেছিলে সেদিন।”
“হুম, তবে পরিচয়ের সূত্রপাত সত্যি হলেও ধারাবাহিকতা ভিন্ন।”
তন্ময় রহস্যসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে উৎসাহিত কণ্ঠে বলল,
“বুঝলাম না। ভেঙে বলো।”
“আপনি দেশে আসার আগে থেকেই সুপ্ত আমার প্রতি ফল করেছে।”
“ইউ মিন লাভ? সুপ্তের তোমার প্রতি ফিলিং আছে?”
অপু একটু অপ্রতিভ হলো। তন্ময়ের কথায় কোনো জড়তা নেই। তাদের বাসস্থানে এসব খুবই সাধারণ ব্যাপার। তাই হয়তো বলতেও সংকোচ লাগে না। অপু বাঙালি জিভটাই যা সংকোচে বুদ হয়ে আছে। মাথা নেড়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,
“হুম।”
“এন্ড হোয়াট এবাউট ইউ?”
তন্ময়ের ভাবান্তরহীন গলা। অপু ভেবেছিল তন্ময় বিস্মিত হবে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। তেমন কিছুই এখানে ঘটল না অবশ্য। অপু মাথা নত করে উত্তর দিলো,
“আই থিংক, আই হ্যাভ অলসো ফিলিং ফর হিম।”
তন্ময়ের চোখে অদ্ভুত এক বিদ্যুৎ খেলে গেল। অপু তড়িঘড়ি করে বলল,
“না না, আমরা কোনো রিলেশনশিপে নেই। ছিলামও না। আসলে সুপ্ত চাইলেও আমি ইগনোর করে গেছি। প্রতি পদে অবহেলা করেছি, অবজ্ঞা করেছি। তবুও পিছু ছাড়েননি। আমার বিয়ের কথা সুপ্তের রিলেটিভের সঙ্গে হচ্ছে সেটা উনি বা আমি কেউই জানতাম না বিশ্বাস করুন। যখন জানলাম আমি এক প্রকার নিশ্চিত ছিলাম এই বিয়ে হবে না। উনি কিছু একটা করে বিয়েটা থামাবেই। কিন্তু…”
অপু আবারো কথার গতি রোধ করে। তার কেমন কান্না কান্না পাচ্ছে। গলার কাছটায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। তন্ময় বাকি কথা পূর্ণ করল,
“কিন্তু বিয়েটা আটকায়নি, তাইতো?”
অপু হু হু করে কেঁদে ফেলল। একটা মানুষকে সে ভালোবাসে কিনা বোঝার আগেই চোখ বুজে বিশ্বাস করতে পেরেছিল। ভরসা করতে পেরেছিল। তাইতো রাতের আঁধারে নির্জন ছাদে দেখা করতে তার ভয় করেনি। সর্বদা কেউ একজন তাকে দূর থেকে সঙ্গ দিয়েছে। দেখে রেখেছে। মিষ্টি ভাষায় দুষ্টু কথা বলে অতিষ্ট করে তুলেছে। বিরক্তির চরম পর্যায়ে নিয়ে মনের মাঝে নতুন ঝড় তুলেছে। একসময় না চাইতেও তা অভ্যাসে পরিনত হলো। বিরক্তির গাঢ় ভাজে উঁকি দিলো ক্ষীণ সোনালি রোদ। শুধু জটিল মনের অবোধ ভাবনায় তাতে এক পর্দা পড়ে ছিল। সেই পর্দায় ক্রমাগত ছেদ ঘটছিল তন্ময়ের পরোক্ষ হস্তক্ষেপ ও বিগত কতগুলো দিন নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়ায়। এবং পুরোপুরি ছিন্ন হলো সুপ্তের আকস্মিক শূন্যতায়। যা তার মাঝে শোকের ছায়া ফেলে দিলো। শোক থেকে এলো নিশ্চয়তা। বিগত কিছু দিনের শূন্যতা তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সে মনেপ্রাণে লোকটার প্রতি কতটা দুর্বল। ওই চূড়ান্ত অসহ্য লোকটার শূন্যতা আরো অসহনীয় যন্ত্রণার। তখনই বিয়ের সিদ্ধান্ত তাকে নিজের কাছে পর্যদুস্ত করে দিলো। সরিয়ে দিলো সকল সংশয়ের পর্দা। তার তন্ময়কে নয়, সুপ্তকেই চাই। অসহ্য লোকটাকেই মনেপ্রাণে এবং বাস্তবেও চাই। অথচ মানুষটা তাকে হেলা করছে! কি এমন হয়েছে তার? উত্তরটা তন্ময়ই দিতে পারবে। একইসাথে সম্পূর্ণ বিষয়টা পরিষ্কারভাবে জানানো যাবে। তাই ছুটে আসা।
সূর্য তখন ম্রিয়মাণ। অপুর মুখে পড়েছে ক্লান্ত রোদের কমলাটে আভা। তিরতির করে কাঁপছে কানের পাশে গোজা চুলের গাছি। চোখের ঘন পল্লব ভেজা। তন্ময় তা দেখে ঠোঁট ছড়িয়ে, দাঁত দেখিয়ে হাসল। অপু থমকে গেল।
“আপনি হাসছেন?”
“হাসছি।”
“আপনার খারাপ লাগছে না?”
“যদি আগেভাগেই বিষয়টা সম্পর্কে আঁচ না পেতাম তবে এমন চমৎকার রমণীর মন না পাওয়ার সংবাদে ভীষণ দুঃখ পেতাম বৈকি।”
অপু বাক্যহারা হয়ে তাকিয়ে রইল। তন্ময় তা দেখে হাসি বজায় রেখেই বলল,
“অবাক হচ্ছো?”
অপু মাথা নাড়ে শুধু। তন্ময় বলে চলে,
“আমিও অবাক।”
“কী করে জানলেন? সুপ্ত বলেছে?”
“উহুম, কান্ডটা তোমার বাড়ির কেউই ঘটিয়েছে। তোমার সাথে ফার্স্ট মিটের দিনই রাতে ওয়াটসঅ্যাপ-এ একটা ফাইল পাই। তোমার ও সুপ্তের কথোপকথন দেখে অবাক হই। অবশ্য তখনও পুরোপুরি বিষয়টা নিশ্চিত ছিলাম না। তার জন্য অন্যায়ভাবে সুপ্তের ফোনটা দেখতে হয়েছে। খোঁজ নিতে হয়েছে।”
অপুর মাথা ভনভন করে। তার ও সুপ্তের কথোপকথন তন্ময়ের ওয়াটসঅ্যাপ-এ কে পাঠাল? ভাবনা এগোনোর আগেই পর পর আরো প্রশ্ন মস্তিষ্কে গেঁথে গেল। বলল,
“তাহলে আপনি বিয়ের কথা কেন এগোতে দিচ্ছেন?”
“তোমাকে বুঝতে।”
অপু না বুঝে দিশেহারা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তন্ময় বলল,
“তোমাকে রিড করতে খুব বেশি কষ্ট হয়নি আমার। তোমার পরিবার নির্ভরশীলতা ও বাবার প্রতি তুখোর আনুগত্যই তোমাকে সুপ্তের কাছাকাছি যেতে বাধা দিয়েছে। শুনেছি তোমার বড়ো বোন পালিয়ে বিয়ে করেছিল। তা থেকেই আঙ্কেলের মাইনর অ্যাট্যাক হয়। হসপিটালাইজড হন। তিনি মুষড়ে পড়েন এবং তোমাদের প্রতি আরো রক্ষণশীল হয়ে ওঠেন। বাবার আকস্মিক ভেঙে পড়া তুমি মানতে পারোনি। তাই প্রেমের প্রতি আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। বাবার মনে দুঃখ দেওয়ার, ভরসা হারানোর ভয় হয়। বিয়ের সিদ্ধান্ত চুপচাপ মেনে নেওয়ার পেছনেও একই কারণ। এবং আমি এও জানি এখন যদি আমি বলি, যাই হয়ে যাক বিয়েটা আমি তোমাকেই করছি, তুমি গিয়ে সরাসরি বাবাকে নিজের অমত জানাতে পারবে না।”
শেষ কথাটা শুনে অপুর মুখটা র’ক্তশূণ্য হয়ে গেল। তন্ময় কাষ্ঠ হাসি হেসে বলল,
“ভয় পেয়ো না। তা আমি করব না, ফুল। তোমার বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসে। তুমি উনার সঙ্গে একবার কথা বলেই দেখতে। নিজের মতামত স্পষ্ট করে জানাতে। বিয়ের ব্যাপারে তোমার মতামত উনাকে অবগত করলে নিশ্চয়ই উনি অমতে এত বড়ো মেয়েকে বিয়ে দিতেন না।”
শেষ বিকেলের রোদ লেকের পানিতে বিসর্জন যাচ্ছে। অপুর অশ্রু বিসর্জন যাচ্ছে নিজের বোকামোতে। সম্মুখের মানুষটাকে এতদিন তার আপদ, অযাচিত ছাড়া কিছুই মনে হতো না। অথচ তিনিই অপুর মনে প্রথম ভাবনার কীট প্রবেশ করিয়েছিলেন। অপুর মনে তখনও সুপ্তের জন্য উৎকন্ঠা। জানতে চাইল,
“সুপ্তের কী হয়েছে বলতে পারবেন? উনি আমাকে ইগনোর করছে। কথাবার্তা স্বাভাবিক লাগছে না। কিছু কী ঘটেছে?”
“সুপ্তের মাকে দেখেছো তো তুমি। আমার একমাত্র ফুপি। যাকে আমি মামনি ডাকি।”
অপু অবাক হলো। মহিলাটি তাদের বাড়ি এসেছে। অপুর সঙ্গে বেশ সুন্দর করে কথা বলেছে। তিনিই সুপ্তের মা! তাহলে লোকটা ওমন রহস্য করেন কেন মাকে নিয়ে? তন্ময় বলতে থাকে,
“তুমি এটাও জানো না সুপ্ত ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বড়ো হয়েছে। মানে ওর বাবা-মা ডিভোর্সড। যদিও ওর পারিবারিক বিষয়গুলো আমি তাদের অনুমতি ছাড়া তোমায় বলতে পারব না। চাইছিও না। শুধু জেনে রাখো ছেলেটা ভালো নেই। মানসিক য’ন্ত্রণা ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তোমার প্রতি অনুরোধ থাকবে, সব ধরনের পরিস্থিতিতে যদি তাকে মেনে নিতে পারো, ওর পাশে শক্ত ভীত হয়ে দাঁড়াতে পারো তাহলেই ভাইকে তুমি গ্রহণ করো। যদি নিজের ওপর সংশয় থাকে তা তুমি পারবে না তাহলে ওকে কষ্ট দিতে এগিয়ো না। ছেলেটা বড্ড ভালোবাসার কাঙাল। আমার ও সুপ্তের একটা অদ্ভুত মিল হলো আমাদের দুজনের পছন্দ এক। আর ভাগ্যের পরিহাসে সারাজীবন আমি অজান্তেই সুপ্তের জিনিসে ভাগ বসিয়েছি। সুপ্ত তাই ভাবত। ছোটোবেলা থেকে মামনি আমাদের সঙ্গে থাকে বলে সুপ্তের ধারণা ছিল ওর মায়ের সমস্ত ভালোবাসা কেড়ে নিয়ে আমি একা ভোগ করি। হিং’সে করত আমায়। এখনো করে। কিন্তু এবার সেই ধারণা সত্যি হতে দেব না। বলতে পারো আমার ছোট্টো প্রয়াস ছিল তোমাদের নিয়ে একটু খেলা করা। সেখানে আমি কিঞ্চিৎ হলেও সফল। তুমি অন্তত আমার কথায় প্রভাবিত হয়েছ। ভাইকে কখনো বলিনি কতটা ভালোবাসি। এই অপার্থিব ফুলটা দিয়েই সে উত্তরটা দিতে চাই। ফুলটা কী আমার ভাইয়ের বাগানের রানী হতে প্রস্তুত?”
অপুর সেই মুহূর্তে আরো একটি বিষয় খেয়াল হলো। সে যখন সুপ্তকে জিজ্ঞেস করেছিল এ’ক্সি’ডেন্ট-এ সাহায্য করার মতো সামান্য কারণে কী করে এক মেয়ের প্রেমে পড়ে গেল, তখন সুপ্ত উত্তর দেয়নি। এখন উত্তরটা অপুর কাছে স্বচ্ছ কাচের মতো। ওই ভালোবাসার কাঙাল মানুষটা নিজের দুরবস্থায় একটা ভরসার হাত পেয়ে আঁকড়ে ধরেছিল। অপুর ক্ষণিকের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ভরসা ও মমতা তাকে নরম করে দিয়েছিল। তাই বোধহয় অপুর হাত সে ছাড়তে চায়নি। খুঁজেছে মমতা। প্রগাঢ় ভরসাময় ভালোবাসা। অপুর বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। সুপ্তের জন্য তার হৃদয়ে কানায় কানায় মমতা জেগে উঠল। ঠিক তখনই সে সিদ্ধান্ত নিল ওই মানুষটার হাত সে ছাড়বে না। কক্ষনো না, কোনোদিনও না। দৃঢ় গলায় উত্তর দিলো,
“প্রস্তুত।”
তন্ময় সফলতার হাসি হেসে বলল,
“তোমার মুখে এই কথাটা শুনতেই এই দীর্ঘ অপেক্ষা। আমার ওপর ক্ষোভ রেখো না।”
এরপর নিস্তব্ধতা নেমে এলো দুজনের মাঝে। দিনের আলো ফিকে হয়ে আসছে। শীতের সময়ে এমনিতেই দিন ছোটো হয়। তন্ময়ের পূর্ণ মনোযোগী দৃষ্টি অপুর দিকে। অপুর চোখ শুকিয়েছে। ঠোঁটের পাশে জলের শুকনো ছাপ। শেষ বিকেলের মেদুর হাওয়ায় কিছুটা কুকড়ে আছে মেয়েটা। তন্ময়ের হাসিখুশি দৃষ্টির ভাজে এক পলকের জন্য এক চোরা বিষাদ খেলে আবার লুকিয়ে গেল। মনে মনে ভাবল, সুপ্ত ও তার পছন্দ কেন এক হলো? হতে কী পারত না একটু আলাদা? অনেকটা সময় বয়ে যাওয়ার পর তন্ময় গাঢ় স্বরে বলল,
“তোমার হাতটা ধরি?”
অপু নির্দ্বিধায় হাত বাড়িয়ে দিলো। তন্ময় অপুর হাতের উল্টোপিঠে চুমু খেয়ে বলল,
“তুমি খুব সুখী হবে অপরাজিতা।”
তন্ময় আর দাঁড়াল না। কোনো কথা বলল না। শুকনো পথের ধুলো উড়িয়ে সে নীরবে চলে গেল। এক পলকের জন্য তন্ময়ের টলটলে চোখ অপুর দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। কিছুটা শিশির হয়তো অপুর চোখেও জমেছিল। সে জানে আর কখনো তন্ময় তার সামনে আসবে না। কিছু কিছু মানুষ ভালোবাসা ছাড়াই কেমন অন্তরে গেঁথে যায়।
চলবে…