#সুপ্ত_অনুরাগে,১৪,১৫
#প্রভা_আফরিন
[১৪]
তন্ময় বৈশাখীর চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। সম্পর্কে সুপ্তের মামাতো ভাই। বাংলাদেশে জন্ম হলেও তার বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, চাকরি সব আমেরিকায়। তন্ময়ের বাবা-মা দুজনই ওয়ার্কিং পারসন ছিলেন। ছেলে-মেয়েকে খুব একটা সময় তারা দিতে পারেনি। বলা চলে বৈশাখীর হাতেই তন্ময় ও তার ছোটো বোন তিথী মানুষ হয়েছে। তাই তারা বৈশাখীকে মামনি বলে ডাকে। দেশে এবার সপরিবারে আগমন ঘটেছে তাদের। কিন্তু বরাবরের মতো বৈশাখী দেশে ফিরলে রফিক সাহেবের বাড়িতেই ওঠে। এ বাড়িতে উনার অঘোষিত, অনুপস্থিত কর্তৃত্ব সর্বদাই বিরাজমান। মামনির দেখাদেখি তন্ময়ও বাবা-মায়ের সঙ্গে পৈত্রিক বাড়িতে না গিয়ে সুপ্তের বাড়িতে এসেছে। কিন্তু সুপ্ত তাকে সহ্য করতে পারে না। না পারার কারণ বৈশাখীর তন্ময়ের প্রতি ভালোবাসা। ছোটো থেকে সে মায়ের থেকে যা পায়নি তন্ময় পেয়েছে। সেটা হলো সময়, সান্নিধ্য। চাপা হিং’সে সুপ্তের মনে ছোটোবেলা থেকেই বিরাজমান। আর তাকেই এখন নিজ বিছানায় দেখে সুপ্তের ব্রহ্মতালু অবধি জ্ব’লে উঠল। সে তন্ময়ের পায়ে লা’থি বসিয়ে দিলো। তন্ময় ব্যথায় কুকড়ে ওঠে,
“আহ ভাই! হোয়াই আর ইউ হিটিং মি? ঘুমাতেও দিবি না?”
সুপ্ত হিসহিসিয়ে বলল,
“বিদেশী ফার্মের মুরগী, ঘুমানোর জন্য তোর আমার বিছানাটাই চোখে পড়ল?”
“ইয়াহ! জানিস না তোর সবকিছুতেই আমি কম্ফোর্টেবল?”
“জানব না কেন? আমার সবকিছুতে ভাগ বসানোই তো তোর স্বভাব। আর শুরুটা আমার মাকে দিয়েই করেছিস।”
তন্ময়ের পাতলা ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে গেল। চাদর টেনে নিজেকে আবারো জড়িয়ে নিয়ে কৌতুক করে বলল,
“ভেবেছিলাম তোর বউটাকেও নিয়ে নেব। কিন্তু তুই তো বিয়েই করলি না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকেই আগে করতে হচ্ছে।”
“হা’রা’ম’জা’দা!”
সুপ্ত তন্ময়ের কোমড়ে কনুইয়ের প্রহার বসালো। তন্ময় ব্যথায় লাফিয়ে উঠল,
“ইট হার্ট’স ভাই!”
“জাহান্নামে যা তুই।”
সুপ্ত বিছানা ছেড়ে নেমে গেল। মা এসেছে, সংবাদটা নিউরনে নিউরনে ছড়িয়ে পড়েছে। ছুটে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলায় সে। মায়ের ওপর তার তীব্র অভিমান।
বৈশাখী সকাল সকাল রান্না শেষ করে, ফ্রেশ হয়ে একটা সুতি শাড়ি পরে নিলেন। এরপর সুপ্তের রুমে গিয়ে ওকে পাওয়া গেল না। সুপ্তকে পাওয়া গেল ছাদে। সকালের নির্মল হাওয়ায় দোলনায় পা তুলে ঘুমাচ্ছে ছেলেটা। ঘুমন্ত, নিষ্পাপ মুখশ্রী দর্শন মাত্রই বৈশাখীর চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে। তিনি আলতো পায়ে সুপ্তের মাথার কাছে গিয়ে মেঝেতে হাটু মুড়ে বসলেন। চুলে আঙুল ডোবাতেই সুপ্ত আরেকটু জুবুথুবু হয়ে গেল। কিছুক্ষণ বাদেই লাফিয়ে উঠল। সদ্য ঘুম ভেঙে চোখের সামনে মাকে দেখে সুপ্ত কিছুটা সময় হতবিহ্বল হয়ে রইল। ধীরে ধীরে সবটা মনে পড়তেই সে দৃষ্টি সরিয়ে দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বৈশাখী দাঁড়িয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন।
“মায়ের সাথে কথা বলবি না?”
বৈশাখী জিজ্ঞেস করলেন। সুপ্ত মুখ ঘুরিয়ে রইল। আলাদা কোনো অভিব্যক্তি ঠাঁই পায়নি চেহারায়। বৈশাখী কেঁদে ফেললেন,
“এত রা’গ কেন তোর? একটাবারও ফোন ধরলি না। জানিস কতটা ছটফট করেছি তোর গলা শুনতে?”
সুপ্ত এবারও কথা বলল না। বৈশাখী ওর কপালের কাটা দাগটায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“কতটা কেটেছিল আমার বাচ্চাটার! আমি দেখতে আসতে পারিনি। সেবা করতে পারিনি। তুই তারই শা’স্তি দিচ্ছিস আমায়?”
কান্না জিনিসটা সুপ্তের কাছে বিরক্তিকর অনুভূতি। সে হোক আপন কিংবা পরের। বলল,
“ছাড়ো, ফ্রেশ হবো।”
বৈশাখী ব্যথিত হলেও ছাড়লেন কিছুক্ষণের জন্য। সুপ্ত ফ্রেশ হয়ে বেরুতেই আবারো তাকে ধরে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসালেন। নিজের হাতে খাইয়ে দিতে চাইলে সুপ্ত মানা করতে গেল। কিন্তু আবারো কান্নার শব্দ উঠতেই সোনামুখ করে মায়ের হাতে খেয়ে নিল। এরপর বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার অস্থায়ী গিন্নি তার বিদেশী ছেলেপুলে নিয়ে এবার কতদিন থাকবে?”
রফিক সাহেব বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন। আচমকা ছেলের প্রশ্ন শুনে থমকে গেলেন কিছুক্ষণের জন্য। এরপর ধমকে উঠলেন,
“এসব কী ভাষা? ও তোর মা হয় সুপ্ত।”
সুপ্ত কাঁধ ঝাকাল। রফিক সাহেব হতাশ হয়ে বললেন,
“তোর মা, তোর জন্য এসেছে, তুই-ই জিজ্ঞেস কর গিয়ে।”
“আমার মা হওয়ার আগে তোমার বউ ছিল। তুমি জানবে না কেন?”
“ইচ্ছে করে ঝগড়া বাধাতে এসেছিস মনে হচ্ছে?”
সুপ্ত দমে গেল। রফিক সাহেব নিরবে তাকে পর্যবেক্ষণ করেন। ছেলের মন কতটা নরম তিনি জানেন। ফোনে কপটতা দেখালেও সামনাসামনি মায়ের সঙ্গে রাগ করে সে থাকতেই পারবে না। রফিক সাহেব বললেন,
“তবুও মান ভাঙবি না? এত অবুঝপনা কেন করছিস? মা তো আসতেই চেয়েছে। কাগজপত্রের ঝামেলার জন্যই আটকে গেছিল।”
“বুঝলাম। তাহলে তন্ময় কেন আমার রুমে?”
“কারণ সে বিয়ে করতে এসেছে। তোর মতো বেকার ঘুরে বেড়ায় না।”
“ওই ছেলের সঙ্গে তুলনা করে তুমি আমাকে খোটা দিচ্ছো?”
“দিচ্ছি, লজ্জা-শরম থাকলে গায়ে মাখ।”
“মাখলাম না।”
সুপ্ত উঠে চলে গেল। বৈশাখী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে করুণ চোখে তাকান। রফিক সাহেব আশ্বাস দিয়ে বললেন,
“চিন্তা কোরো না৷ ওর জেদ পড়ে গেছে৷ কিন্তু প্রকাশ করতে ইগোতে বাধছে বলেই পালাচ্ছে।”
________________
অপু গতরাতে ঘুমাতে পারেনি। শত উল্টোপাল্টা ভাবনা ওর শান্ত মস্তিষ্ক উত্তাল করে রেখেছে। সুপ্তের পাগলামি ও বাবার সিদ্ধান্তের মাঝে পড়ে সে যেন খাবি খাওয়া মাছের মতো ডুবছে ভাসছে ক্ষণে ক্ষণে। তাই অপু ঠিক করেছে আজ সুপ্তের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলবে। কিন্তু সকাল সকাল ভার্সিটির সামনে এসে থমকে দাঁড়াতে হলো তাকে। চোখের অভ্যাসে এদিক ওদিক তাকিয়েও যখন সেই বিরক্ত করা মুখটা দেখতে পেল না অপু যারপরনাই অবাক হলো। সুপ্ত আসেনি! গত তিনটে মাসে এই প্রথম অপু ভার্সিটি এলো অথচ সুপ্তের মুখদর্শন হলো না। অথচ সে কত কায়দাকানুন করত লোকটার নজর এড়াতে। কিছুতেই সফল হতে পারত না। ভূতের মতো ঠিকই আবির্ভাব হয়ে তাকে পাকড়াও করে ফেলত। আর আজ অপু তার সঙ্গে স্বেচ্ছায় দেখা করবে বলে মনস্থির করেও পেল না! অপুর মনে আষাঢ়ে মেঘেরা ঘন হতে লাগল। ভাবল হয়তো বাড়ি ফেরার পথে দেখা হবে। কিন্তু তেমন কিছুও হলো না। অপু অদ্ভুত শূন্যতা আঁকড়ে বাসায় ফিরল। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই বেলী এসে ব্যস্ত গলায় বলল,
“তোর ফোনটা দে তো অপু। আমার ফোনের স্ক্রিন ফেটে গেছে। তাই তোর দুলাভাইকে বদলাতে পাঠিয়েছি। এখন মনে পড়ল আমার হেলথ্ ড্রিংকটা শেষ হয়ে গেছে। আনাতে হবে। তোর দুলাভাইকে একটা কল দেব।”
অপু ভ্রু কুচকে বলল,
“মায়ের ফোন নাও গিয়ে।”
“মায়ের ফোনে ব্যালেন্স শেষ।”
“বিকাশে রিচার্জ করে দিচ্ছি।”
বেলী রেগে গেল,
“সামান্য দুমিনিটের জন্য ফোন চাইলাম বলে এখন তোর রিচার্জ করে মায়ের ফোনই দিতে হবে? লাগল না তোর ফোন। যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখ।”
বেলী চলে যেতে নিলে অপু হাত টেনে ধরল,
“আরে রাগছো কেন? মায়ের ফোন তো আমিই রিচার্জ করি। তুমি বরং আগে কথা বলে দাও। পরে করছি।”
অপু নিজেই দুলাভাইয়ের নম্বর ডায়াল করে দিলো। বেলী ফোন কানে দিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। অপু আর সেদিকে পাত্তা দিলো না।
বেলী ফোনটা নিয়ে সরাসরি নিজের রুমে ঢুকে গেল৷ আজিজের ফোন কেটে আগে ডায়ালের নম্বরগুলোতে চোখ বুলালো। খেয়াল করল একটা আনসেইভ নম্বর থেকে গত তিনদিনে প্রচুর মিসড কল জমা হয়েছে। এবং তারও দুদিন আগে দুমিনিট কথাও হয়েছে। বেলী ডায়াল লিস্ট থেকে বেরিয়েই কল রেকর্ড খুঁজল। কিন্তু হতাশ হয়ে ব্যাক করতে হলো। অপুর ফোনে কল রেকর্ড অফ কিনা। তবে ইনবক্স বেলীর সমস্ত বাসনা পুরণ করে দিলো নিমিষেই। একই আনসেইভ নম্বর থেকে পর পর ম্যাসেজগুলো দেখে বেলী চাপা চিৎকার করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। অপুর ছোটো একটা রিপ্লাই ব্যতীত আর কোনো রিপ্লাই অবশ্য সে পেল না। তবে বেলী এতেই সন্তুষ্ট। সে বিয়ে করে বাবার থেকে নির্বাসিত হয়েছে। অথচ তার বোন চোখের সামনেই প্রেমলীলা করে রাত-বিরেতে বাইরে থেকে ফিরছে! ভাবখানা যেন ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানে না। বেলী ক্রুর হাসে। এবার অপুর জারিজুরির সমস্ত প্রমাণ তার হাতের মুঠোয়।
_______________
ঝলমলে বিকেল। কাজু শিমুলকে পড়তে বসিয়েছে। একটা ইংলিশ রাইম গতকাল থেকে মুখস্ত করাতে চেষ্টা করেও কাজু ব্যর্থ। শিমুল বারবার ভুলে যাচ্ছে। কাজু বিরক্তিতে মুখ খি’চিয়ে বলল,
“তোর মাথায় যে গোবর আছে তা তো জানতামই। এখন দেখি তা জৈব সার না, এক সপ্তাহের পচা গু। তাই তো বলি এত সাধনা করে মাথায় ফুল ফোটাতে চাইছি অথচ ফুলের সৌরভ না বেরিয়ে বেরোচ্ছে পচা দুর্গন্ধ! ছি ছি ছি!”
শিমুল বলল, “এহহ মামা, আমাদের হেড স্যার বলেছেন ভালো ছাত্র হতে হলে ভালো শিক্ষকও প্রয়োজন। কারণ স্যারেরা তাদের মাথার জ্ঞান আমাদের বিলিয়ে দেয়। তুমি ফুল না বিলিয়ে গু বিলি করে আমার দোষ দিচ্ছো কেন?”
কাজু ভাগ্নের কথায় হতভম্ব হয়ে গেলেন। শাসিয়ে বললেন,
“কত্ত বড়ো সাহস! আমার শিক্ষায় আঙুল তুলিস? তোর হেডস্যার এটা বলেনি যে শিক্ষককে অসম্মান করা ছাত্ররা জীবনেও উন্নতি করতে পারে না?”
“তাহলে তুমি আমায় বকছো কেন? মা বলে এক হাতে কখনো তালি বাজে না।”
“কে বলেছে বাজে না? নমুনা দেখাই?” কাজু ঝট করে শিমুলের গালে একটা চ’ড় বসিয়ে দিলো। পুনরায় বলল,
“কী? বেজেছে এক হাতে তালি?”
শিমুল গালে হাত চেপে ধরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল। জাহেদা বেগম রান্নাঘর ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে এসে পালটা চ’ড় বসালেন কাজুর গালে। কাজু অসহায় চোখে তাকাল বুবুর দিকে।
“তুই! তুই আমাকে মা’রতে পারলি বুবু? এতিম, অসহায়ের ওপর আ’ঘা’ত করতে তোর হাত কাঁপল না পা’ষাণী?”
জাহেদা বেগম খে’কিয়ে উঠলেন,
“চুপ বে’য়া’দব। পিঠে খুন্তি পো’ড়া লাগিয়ে দেব বলে দিলাম। তোকে আমি কু’চুটে মহিলাদের মতো ঝ’গড়া করতে রেখেছি নাকি পড়াতে রেখেছি? পড়ানো ছাড়া বাকিবসব কাজেই তুমি মহা ওস্তাদ। শিমুলের রেজাল্ট যদি ভালো না হয়, তোর বেতন কা’টা যাবে।”
“আ’ঘা’ত করে এখন আবার এতিমের হক মা’রতে চাইছিস? জা’লিম, অ’ত্যা’চারী, ব’র্ব’র নারী! আমার এক টাকা মে’রে খেলে পথের ফকির বনে যাবে তোর টাকলা জামাই।”
জাহেদা বেগম ঠোঁট বেঁকিয়ে বিদ্রুপ করেন,
“তাহলে তুইও যে না খেয়ে ম’রবি এতে কোনো সন্দেহ আছে?”
কাজু চুপসে গেল। অপুর বিষন্ন বিকেল মুখরিত হয়ে গেল মা, মামার ঝ’গড়া দেখে। তখনই বাইকের হর্ন কর্ণগোচর হলো তার৷ অপু ছুটে গিয়ে জানালা আটকে দিলো। এখন করুক শত আর্জি। সেও দেখা দেবে না। নিজের এহেন ভাবনায় খানিক বাদেই অপু চমকে উঠল। সে কী অভিমান করছে লোকটার ওপর?
চলবে…
#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[১৫]
হেমন্তের গা থেকে ভারী হাওয়া নেমে যাচ্ছে। আবহাওয়া হালকা হচ্ছে মৃদু লয়ে। ধূসর আকাশ পরম মমতায় চাঁদের গায়ে পলকা মেঘের চাদর জড়িয়ে দিচ্ছে। মেঘেদের ফাঁক ফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ঝিকিমিকি তারা। অপেক্ষমান রাত উজ্জ্বল নক্ষত্রদের দেখা পেয়েছে, সুপ্ত তার নক্ষত্রের সাক্ষাৎ পায়নি। দীর্ঘ অপেক্ষা, ছন্নছাড়া মন নিয়ে আজ তার ফিরতেও দেরি হলো। ফরিদ মিয়ার কপালেও বখশিশ জুটল না। ফরিদ শেষ সিগারেটটা এগিয়ে দেওয়ার সময় অনেকটা কাচুমাচু হয়ে বলেছিল,
“আপনে ভাবীর বাড়িত বিয়ার প্রস্তাব পাঠান ভাইজান। বড়ো ভাইয়েরা বিয়া না করলে তো আমরাও আগাইতে পারি না।”
সুপ্ত পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ফরিদের দিকে। সদ্য কৈশোর পেরোনো ছেলেটির গালে ও থুতনিতে অবিন্যস্ত দাড়ি। হাফ হাতা ময়লা শার্ট ও লুঙ্গিতে এক হাটু মুড়ে বসে গরম পানিতে চায়ের কাপ ধুয়ে নিচ্ছে। সুপ্ত ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
“তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে ফরিদ মিয়া?”
ফরিদ একটু অপ্রতিভ হয়ে ওঠে। দৃষ্টি ঝুকিয়েই উত্তর দেয়,
“কি যে কন ভাই? ঠিক বয়সে বিয়া করলে এক বাচ্চার বাপ হইয়া যাইতাম।”
“বলো কী? তাহলে আমি কি হতাম?”
“আপনেরা বড়োলোক মানুষ। টেকাপয়সা আছে। বয়স দিয়া কী আহে যায়। আমাগো মতোন মানুষের চেহারা ভারী হইলেই শইল ভাইঙ্গা যায়।”
“টাকা থাকলে বয়সে কিছু আসে যায়না বলছো?”
“না।”
“এমন মনে হওয়ার কারণ?”
“আদুরীর আগে আমার আরেক জনের লগে লাইন আছিল। কিন্তু ছেড়িডারে হের বাপ-মায় ধইরা এক পয়সাওয়ালা বুড়া ব্যাডার লগে বিয়া দিয়া দিলো। আমি যহন চাচিরে জিগাইলাম ছুডু মাইয়াডারে ক্যান বুড়ার কাছে দিলো তহন কইল,
‘পয়সা আছে, বয়সে কী আহে-যায়? মাইয়া সুখে থাকব।’
তয় টেকার লগে সুখে থাকব নাকি ব্যাডার লগে হেইডা আইজও বুঝলাম না।”
সুপ্ত দীর্ঘক্ষন চুপ রইল। উঠে যাওয়ার আগে বলল,
“সুখ বড়োই জটিল জিনিস ফরিদ মিয়া। তোমার চা বেচে সুখ, আমার সেই চা খেয়ে কারো অপেক্ষা করায় সুখ। আবার কারো সুখ নিজেকে আড়াল করায়। তবে আমার বিয়ে আগে হোক বা পরে, বিয়েতে তোমার একটা পানের দোকান রাখব মাস্ট।”
সুপ্ত বাড়ি ফিরল ভারাক্রান্ত মনে। ঘড়ির কাটা তখন নয়টার ঘরে উঁকি দিয়েছে। সুপ্ত সরাসরি মায়ের রুমে ঢুকে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। বৈশাখী যেন সারাদিন এই মুহূর্তটার জন্যই তপ্ত মনে অপেক্ষা করছিলেন। অশ্রুসিক্ত লোচনে তিনি সুপ্তের কপালে অজস্র চুমু খেলেন। সুপ্ত অভিমানী গলায় বলল,
“আমাকে কেউ ভালোবাসে না কেন, মা?”
অনেকগুলো দিন পরে মা ডাক শুনে বৈশাখীর বুভুক্ষু হৃদয়ে হিমঝরা বিকেলের শীতল বাতাস বয়ে গেল।
“আমার ছেলেকে ভালো না বেসে কেউ থাকতে পারে বুঝি? কার এমন পাষাণ মন?”
“আছে আছে।”
“সামওয়ান স্পেশাল?”
সুপ্ত উত্তরে হাসল। এই হলো মা, না বলতেও কী করে যেন সব বুঝে যায়। বলল,
“তোমাকে একদিন অপরাজিতা ফুলের চা খাওয়াব। তাহলেই পাষাণের নমুনা পেয়ে যাবে।”
“মানে?”
বৈশাখী ছেলের হেয়ালিপনায় আরো উৎসুক হলেন। রফিক সাহেব দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
“তোমার ছেলে আজকাল তুখোড় চা-খোর হয়ে গেছে, সে খবর জানো? ঘন্টার পর ঘন্টা টঙের দোকানে বসে থাকে। স্পেশাল গুড়ের চা খায়।”
বলে তিনি চোখ টিপলেন। বৈশাখী দুষ্টু হেসে উঠলেন,
“আচ্ছা, তাই নাকি? টেস্ট করতে হচ্ছে তো!”
সুপ্ত কোল থেকে মাথা উঠিয়ে বলল,
“তোমাদের দুজনকেই নিয়ে যাব একদিন।”
“একদিন গেলে হচ্ছে না। বৈশাখী, এবার বাড়িটাকে সংসার বানিয়ে এরপর যাবে বলে দিলাম। তোমার বেকার ছেলেকে বলে দিয়ো আমাকে যেন সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়।”
রফিক সাহেবের ইঙ্গিতে বৈশাখী হাসলেন। বিছানা থেকে নামতে নামতে বললেন,
“হ্যাঁ, এবার হেস্তনেস্ত একটা করতেই হবে দেখছি। বসো তোমরা। আমি রাতের খাবার টেবিলে দিচ্ছি।”
রফিক সাহেব বাধা দিলেন,
“তোমাকে কষ্ট করে যেতে হবে না। হাটুর ব্যথাটা নিশ্চয়ই আছে? এতবার সিড়ি বেয়ে ওঠানামা করলে আবার বাড়বে। আমি কাউকে বলে দিচ্ছি নাহয়।”
“উহুম, আমার ছেলেকে নিজের হাতে না খাওয়াতে পারলে মন ভরবে না। সারাবছর তো পারি না। এইটুকু অধিকার কেড়ে নিয়ো না।”
বৈশাখী চলে গেলেন। সুপ্ত নীরব দৃষ্টিতে বাবা-মায়ের সুক্ষ্ম যত্নগুলো অবলোকন করে। সময়ের বহমানতাও তাতে ধুলো জমাতে পারেনি। রফিক সাহেব বললেন,
“তন্ময় বাবা-মায়ের কাছে গেছে। কাল তাদের দাওয়াত আছে। তিথী ফোন করেছিল। তোর খোঁজ করল কয়েকবার।”
“পরে কথা বলে নেব।”
সুপ্ত বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। চারিদিকে মা মা সুবাস বইছে। মন ভালো করে দেওয়া সুবাস। স্তিমিত কণ্ঠে বলল,
“মাকে কেন যেতে দিলে বাবা? আরেকটু ধৈর্য কেন ধরলে না? তোমাদের দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না আমি ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বড়ো হয়েছি।”
রফিক সাহেব করুণ দৃষ্টিতে তাকান। খানিকটা চুপ থেকে বলেন,
“বয়সের দোষ। সময়ের সাথে মনের দূরত্ব মিটলেও দেহের দূরত্ব আর মেটেনি। মাকে কখনো ভুল বুঝিস না। আমার তুই আছিস, তার কেউ নেই।”
সুপ্ত বাবার কণ্ঠের আদ্রতা টের পেয়ে তাড়া দিয়ে বলল,
“এখন চলো, মা খাবার বেড়ে অপেক্ষা করবে আমাদের জন্য।”
__________________
আনিসুল সাহেবের বন্ধু ও তার পরিবার এলো পরদিন দুপুরে। দেখতে আসা যেমন হয় ঠিক তেমনটা নয়। মেহমানদের আপ্যায়নের মতোই আয়োজন হলো। অপু আলাদা করে শাড়ি পরা বা সাজার মতো কিছু না করলেও মায়ের নির্দেশে পরিপাটি হয়ে রইল। তবে মুখের আদলে হাসিখুশি, লজ্জা বা কোনো ইতিবাচক চিহ্ন ফুটে উঠল না। একদম ঘরোয়াভাবে দুই পরিবার মিশল। কথা উঠল পুরোনো সময় নিয়ে।
মেহমান এসেছে পাঁচজন। ইমদাদুল সাহেব, উনার স্ত্রী, বোন ও দুই ছেলেমেয়ে। মেয়েটা অপুর সমবয়সী। নাম তিথী। দেখতেও বেশ মিষ্টি। তার ভাইয়ের নামটা কী যেন বলল? অপু মনোযোগ হারানোয় আর খেয়াল করতে পারেনি। দেহের গড়ন, উচ্চতা সব বিদেশীদের মতোই। চোখের মনিটাও ঘোলাটে। প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হওয়ার মতো। তাকে দেখেই ছেলেটা হাত বাড়িয়ে দিলো,
“অপরাজিতা, ফুলের নামে নাম। একটু বড়ো নাম কিন্তু সুন্দর!”
অপু হাত মিলিয়ে অনিচ্ছায় হাসল।
“ধন্যবাদ!” ছোটো করে উত্তর দিয়ে সেখান থেকে সরে এলো।
মেহমান বিদায় নিল বিকেল বেলা। বিয়ে নিয়ে বিস্তারিত আলাপে কেউই গেল না। কিন্তু বোঝা গেল অপুকে তাদের ভীষণ পছন্দ। এদিকে ছেলেকেও সবার মনে ধরল। তিথী যাওয়ার আগে মনে করে অপুর সোস্যাল একাউন্ট জেনে গেল। কাজু খেয়ে-দেয়ে আরাম করে বসে বলল,
“যাক ফুলের বাগানে সবজির চাষ হতে চলেছে।”
অপু বুঝতে না পেরে বলল,
“মানে?”
“মানে তোরা সবাই ফুল। আর পাত্র হলো মূলা। এক্কেবারে সাদা মূলা। তো হলো না সবজি!”
অপু মামার রসিকতায় আগ্রহ পেল না উত্তর দেওয়ার। রাতে হুট করেই তার ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ এলো,
“তোমাদের ফ্যামিলিতে ফুল বেশি পছন্দ তাইনা?”
কোনোরূপ কুশল বিনিময় কিংবা সম্বোধনবিহীন ম্যাসেজে অপু অবাক হলো। আইডি ঘুরে চিনতে পারল সেই দুপুরের লোকটা, নাম তন্ময় চৌধুরী। অপুও উত্তরে কুশল ছাড়া লিখল,
“এমন মনে হওয়ার কারণ?”
“সবার নাম ফুলের, তাই ভাবলাম।”
“সবার না। আমাদের তিন ভাইবোনের। বাবা রেখেছেন।”
“তোমার সাথে তো কথাই হলো না তেমন। আচ্ছা, আমি কি তোমায় শুধু ফুল বলে ডাকতে পারি? আসলে ঝগড়া করার সময় এত বড়ো নাম ধরে ডাকতে গেলে পয়েন্ট ভুলে যাব।”
অপু ম্যাসেজটা সীন করে স্তব্ধ হয়ে গেল। ছেলেটা কী তাকে ইঙ্গিতে পছন্দের কথা বোঝাতে চাইল? অপু আর রিপ্লাই করল না। ওদিক থেকেও কোনো সাড়া এলো না। ঘুমাতে যাওয়ার আগে অভ্যাসবশত ইনবক্স চেক করতে গিয়ে দেখল সুপ্তের নম্বর থেকে নতুন বার্তা এসেছে,
“শুনছো অপরাজিতা, তুমি আমার অভ্যাসে পরিনত হয়ে যাচ্ছো। শত বাজে অভ্যাসের মাঝে একটা ভালো অভ্যাস।”
চলবে…