#সুপ্ত_অনুরাগে-০৮,০৯
#প্রভা_আফরিন
[৮]
সুপ্ত রুমে বসে পিসিতে গেইম খেলছিল। গেমিংয়ের প্রতি এক সময় ওর তীব্র নে’শা ছিল। একবার শুরু করলে খাওয়া, ঘুম সব ভুলে যেত। এখন সেটা সহনীয় পর্যায়ে৷ বোরিং লাগলেই পিসি ওপেন করে বসে। রফিক সাহেব অফিস থেকে ফিরেই ছেলের রুমে এলেন। হাতে চায়ের কাপ। দেখলেন আদরের দুলাল এসি অন রেখে জানালা আটকাতে ভুলে গেছে। তিনি চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে নিজেই জানালা বন্ধ করলেন। খাটে বসে চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
“আজকাল নাকি তোকে কোন এক টঙের দোকানে দেখা যায়?”
সুপ্তের মনোযোগ বিঘ্নিত হলো। কপাল কুচকে বলল,
“তোমার সোর্স যেহেতু বলেছে, আমিও সন্দেহ করব না।”
রফিক সাহেব চোখ ছোটো করলেন। থমথমে মুখে জিজ্ঞেস করলেন,
“ঘন ঘন চা খাওয়ার এই অভ্যাস কবে থেকে?”
“কেন? তোমার সোর্স খুঁজে বের করতে পারেনি?”
“বে’য়া’দবি করবি না সুপ্ত। এক্সিডেন্টের পর এত বা’জে স্বভাব কী করে গ্রো করল তোর মাঝে? আগে তো এমন ছিলি না।”
সুপ্ত নিঃশব্দে হাসল। কোনো জবাব দিলো না। দেওয়ার মতো হয়তো খুঁজেও পেল না। রফিক সাহেব মনোযোগ দিয়ে ছেলের অভিব্যক্তি খেয়াল করছেন। একলা বেড়ে ওঠা এই ছেলেটিকে নিয়ে একটু বেশিই চিন্তা উনার। অফিস সামলে যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন তাকে সময় দিতে। ছেলের জীবনে উনি এবং উনার জীবনে ছেলে ছাড়া বিশেষ কেউ ঠাঁই পায়নি বলে তাদের সম্পর্কটাও হয়ে উঠেছে অনেকটা বন্ধুর মতো। তবুও গ্যাপ কিছুটা রয়েই যায়। মায়ের অপূর্ণতা কী বাবার পক্ষে বোঝা সম্ভব যে তিনি পূরণ করবেন? তাহলে বাবা আর মায়ের পার্থক্যটাই কেন? বরং বাবার অপূর্ণতা যেন কখনও সুপ্তকে পেয়ে না বসে সেই চেষ্টাই করে গেছেন প্রাণান্ত। একটু অবাধ্য, একটু জে’দি হলেও ছেলের মনটা নরম। কিছুটা ছন্নছাড়া হলেও খারাপ সঙ্গ পেয়ে ব’খে যায়নি, এই বা কম কীসে? কিন্তু ইদানীং সুপ্তের আচার-আচরণের লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে৷ আর তা যে অকারণে নয় এটুকু রফিক সাহেবের অভিজ্ঞ চোখ ঠিকই টের পেয়েছেন। তিনি শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“মেয়েটা কে?”
“কোন মেয়েটা? যাদের তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে ম্যাগাজিনে দেখো? নাকি দাদুন যাদের ছবি দেখিয়ে আমার সৎ মা আনতে চেয়েছিল?” সুপ্ত মিটিমিটি হাসছে। রফিক সাহেব ধমক দিলেন,
“সুপ্ত! ফাজলামি করতে নিষেধ করেছি।”
“তুমিই বা কেন ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে কথা বলছো?”
“যার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা টংয়ের দোকানে বসে থাকিস সেই মেয়েটা কে? নাম কী?”
সুপ্ত চমকালো না। স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলো,
“আছে এক কাঠবিড়ালি।”
রফিক সাহেব ভ্রু কুঞ্চিত করে ঝুকে এসে বলেন,
“আর ইউ ইন আ রিলেশনশিপ উইথ কাঠবিড়ালি?”
বাবার বলার ধরন শুনে সুপ্ত শব্দ করে হেসে উঠল। মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল,
“নট এট অল।”
“তাহলে? তুই মেয়েটিকে ফলো করছিস?”
সুপ্ত উত্তর দিলো না। রফিক সাহেব বিরক্ত হোন। যা শুনেছেন তা সত্যিই! উনার ছেলে এক মেয়ের পেছনে ঘুরঘুর করছে। প্রথমে একটু রা’গ হলেও পরে ঠান্ডা মাথায় ভেবেছেন। সুপ্ত বয়স সাতাশের যুবা পুরুষ। বিয়ের বয়স হয়েছে। বয়স হয়েছে এবার সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার। অল্প বয়সে দায়িত্ব-কর্তব্যের বোঝা কাঁধে তুলে দিতে চাননি বলে অফিসের জন্যও জোরাজুরি করেননি এযাবতকাল। এবার সময় ঘনিয়ে আসছে ভবিষ্যত গুছিয়ে নেওয়ার। উনার মতো একটা ছন্নছাড়া জীবন সুপ্তের হোক তা দুঃস্বপ্নেও কামনা করেন না৷ বরং শেষ বয়সে একটা ভরা সংসার দেখার ইচ্ছে বুকের ভেতর ফুলেফেঁপে উঠছে। তিনি এতক্ষণ ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে আসলে যে কথা বলতে চেয়েছিলেন সেই কথায় গেলেন।
“বৈশাখী টিকিট কেটে ফেলেছে। সামনের সপ্তাহে ফ্লাইট। আমার কথাটা মন দিয়ে শোন। এবার অভিমান ঝেরে ফেল। মায়ের সঙ্গে প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ কর। বৈশাখী তোকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। ওর সঙ্গে তন্ময়রাও আসবে। তন্ময়ের বিয়ে দেবে এবার। কাঠবিড়ালির ডিটেইলসটা আমাকে দে। তোর মা থাকতে থাকতে এই সিজনে তোর বিয়েটাও সেড়ে ফেলব।”
সুপ্ত তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। মনটা বিষাদে ভরে যায়। অবজ্ঞার সুরে বলে,
“মা তার আদরের তন্ময়ের বিয়ে দিতেই আসছে বাবা। এর মাঝে আমার বিয়ের চাপ উনাকে না দিলেও চলবে। তাছাড়া কাঠবিড়ালিকে খা’চায় ভরে পোষ মানাতে চাই না আমি। পোষ মানিয়ে খা’চায় আনতে চাই।”
“আর যদি পোষ না মানে?”
“বেধে রাখব না অন্তত। এর পরিনাম তো সামনেই।”
রফিক সাহেব চুপ করে গেলেন। খানিক বাদে আবারো হালকা স্বরে বললেন,
“তো এখন কী করবি?”
“জ্বা’লাব। যেন আমার কথা ওর চিন্তা দখল করে রাখে।”
“তুই কী ব’খা’টের মতো মেয়েটিকে টিজ করতে চাইছিস? এ কী অধঃপতন!”
“প্রেম আর যু’দ্ধে সবই জায়েজ, ডিয়ার বাডি। মাঝখানে একদম নাক গলাবে না বলে দিলাম।”
সুপ্ত চোখ টিপে চলে গেল। রফিক সাহেব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বৈশাখীকে জিজ্ঞেস করতে হবে ছেলেটা আসলেই তার কিনা!
__________________
আশ্বিনের তপ্ত দুপুর। বেলীর ঘাম হচ্ছে ভীষণ। সে গরম সহ্য করতে পারে না। ফ্যানের বাতাসেও শান্তি পাচ্ছে না। বাড়িতে দুটো রুমে এসি আছে৷ একটা বাবা-মায়ের ঘরে, আরেকটা অপুর। শিমুল অবশ্য অপুর সাথেই থাকে। বড়ো হওয়ার পরেও আলাদা ঘরে একা রাত কাটানোর সাহস তার হয়নি। বিয়ের আগে অবশ্য এ রুমে বেলীই থাকত। এখন সে স্বামীর সঙ্গে নন-এসি রুমে আছে। প্রেগ্ন্যাসির পুরোটা সময় বাপের বাড়িই থাকবে। বেলী নতুন এসি চাইতে পারবে না। বাবার সঙ্গে এমনিতেই তার কোল্ড ও’য়া’র চলছে। তবে কৌশলে রুমটা বদল করানো যেতে পারে। এক্ষেত্রে মা তার ভরসা। সে জাহেদা বেগমের কাছে গিয়ে বলল,
“যা গরম পড়েছে! বাবু পেটে আসার পর আমার অল্পতেই ভীষণ হাঁ’সফাঁ’স লাগে, মা। সারাক্ষণ ঘাম হয়।”
জাহেদা বেগম সে কথা শুনেই ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জুস বের করে দিলেন।
“তোর রুমের ফ্যানটা অনেকদিন বন্ধ পড়েছিল তো, তাই বোধহয় পাখা ঠিকমতো ঘুরছে না।”
বেলী উৎসাহ পেয়ে আরেকটু বলল,
“হ্যাঁ, গুটুরমুটুর শব্দও হয় ফ্যানে। রাতে ভালো ঘুম হয় না। তুমি তো জানো সামান্য শব্দতেও আমার ঘুম পাতলা হয়ে যায়৷ আর এ সময় সাউন্ড স্লিপ ভীষণ দরকারী। এমন চলতে থাকলে আমি অসুস্থ হয়ে যাব। তাতে বাবুরও ক্ষতি।”
জাহেদা চিন্তায় পড়লেন। এমন পরিস্থিতিতে উনার মাথায়ও এসি কেনার কথা এলো। কিন্তু বেলীর বাবাকে এখন এ কথা বলা মানে আরেকটু উষ্কে দেওয়া। তিনি চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
“তোর বাবাকে তো বলা যাবে না।”
বেলী তড়িঘড়ি করে বলল,
“বাবাকে বোলো না। পরে আবার আমাদের অ’প’মান করবে। তারচেয়ে আমার রুমটা চেঞ্জ করে দাও।”
জাহেদা বেগম ভ্রু কুচকালেন। বেলী সঙ্গে যোগ করল,
“কয়েকটা মাসের জন্যই তো থাকব। অপুকে রুমটা ছেড়ে দিতে বলো। কয়েকটা মাস নাহয় অন্য রুমে থাকুক। তাছাড়া ওর রুমের এসি তো সারাদিনই বন্ধ থাকে দেখি।”
‘আচ্ছা বলে দেখি।” জাহেদা দ্বিধান্বিত কণ্ঠে উত্তর দিতেই বেলীর ঠোঁটে চোখা হাসি ফুটে ওঠে।
অপুকে বললে সে বিনাবাক্যে রুম ছাড়তে রাজি হলো। তবে সন্ধ্যায় সে কথা শিমুলের মাধ্যমে আনিসুল সাহেবের কানে যেতেই তিনি স্পষ্ট খো’চা দিয়ে বললেন,
“বিয়ের পর তিনি কোন এসির বাতাসে ঘুমিয়েছে যে এখন নিজের ছোটো ভাই-বোনকে ঘরছাড়া করতে বাধছে না?”
জাহেদা বললেন, “তুমি এভাবে কেন বলছো? অপু, শিমুলের তো সমস্যা নেই৷ বেলীর এ সময় অসুখ, বিসুখ লেগেই থাকে। কয়েকটা মাসই তো থাকবে। ওকে ভালো রাখার দায়িত্ব এখন আমাদেরই। অন্যের বাড়িতে কেমন ছিল সেটা দেখে বর্তমানে কেমন থাকবে ঠিক করব…”
আনিসুল সাহেব র’ক্তচক্ষুতে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললেন,
“মেয়ে আসার পর গলায় ভালোই জোর হয়েছে, জাহেদা।”
জাহেদা বেগম চুপসে গেলেন। প্রেশারটা আবার বেড়ে যাচ্ছে। তিনি ঢোক গিলে আলগোছে সরে গেলেন সামনে থেকে।
বেলী বাবা-মায়ের কথোপকথন শুনে চুপ রইল। অপু তার কাছে এসে বলল,
“বাবার কথা ধরতে হবে না আপু। কাল রুম বদলে নেব। সকাল থেকে হাত লাগালেই হয়ে যাবে।”
বেলী কণ্ঠে ক্ষো’ভ ঝরিয়ে বলল,
“বাবার কানে কথা লাগিয়ে এখানে এসেছিস মহান হৃদয়ের পরিচয় দিতে? পেটে পেটে এত? লাগবে না তোর রুম।”
অপু বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেল। বেলী বিয়ের পর থেকে তাকে সহ্যই করতে পারে না যেন। অপু বিরক্ত গলায় বলল,
“সবকিছুতে তুমি আমার দো’ষটাই কেন দেখো বলতে পারবে? পাড়ার কু’চুটে মহিলাদের মতো স্বভাব হয়ে গেছে তোমার। ছোটো থেকে ছোটো বিষয়ে লেগে যাচ্ছো। আমাকে নিয়ে তোমার এত কীসের সমস্যা?”
“সমস্যা তো তোর মধ্যে। আমি একটু ভালো থাকি তা তোর সহ্য হচ্ছে না। বাড়িতে একাই রাজত্ব করিস কিনা, আমার আসায় সমস্যা হয়ে গেছে।”
বেলী গটগট পা ফেলে চলে গেল। অপু বোকার মতো ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
“মানে যা তা!”
অপুর মাথা দপদপ করে ওঠে। কীসব ভাবছে বেলী তার সম্বন্ধে! অপু লম্বা দম ফেলে। এই মুহূর্তে তার মন ঠিক করা দরকার। সে ছাদের চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
অপুর ফোনটা নিয়ে গেইম খেলছিল শিমুল৷ বেলী রুমে ঢুকে তাকে দেখেই উচ্চস্বরে ধ’মক দিলো। শিমুল ভ’য়ে ফোন ফেলেই দৌড় দেয়। তখনই ম্যাসেজ টোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে আনসেইভ নম্বরের ক্ষুদেবার্তা। বেলী চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায়। মনে হচ্ছে বাবার অতি ভদ্র মেয়ের গোমড় ভাঙার পথ পেয়ে গেছে।
চলবে…
#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[৯]
“এই যে কাঠবিড়ালি, মনের মাঝে একটু কম ছোটাছুটি করলে হয় না? তোমার য’ন্ত্রণায় যে রাতের ঘুমও পালিয়ে যাচ্ছে।”
নির্জন, তমসাচ্ছন্ন ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অপরাজিতা। নির্ভার দেহখানি বাতাসের সঙ্গে সন্ধি করেছে। চুলগুলো মুখের ওপর লুটোপুটি করছে। অপু আঙুল চালায় চুলের মাঝে। তার দৃষ্টি মুঠোফোনে খানিক আগে প্রবেশ করা এক ক্ষুদেবার্তায় নিবদ্ধ। ঠোঁটের কোণে খুবই সুক্ষ্ম এক হাসি। এখন কেন জানি অপু আর অবাক হয় না। বরং অবচেতনে হলেও রাতে একবার ফোন চেক করে দেখে ইনবক্সে কোনো ম্যাসেজ জমা হয়েছে কিনা। এটা অভ্যাস নাকি অন্য কোনো অনুভূতি অপু জানে না৷ জানতেও চায় না। তবে সুপ্তকে সে আশকারাও দিতে চায় না।
সুপ্ত তাকে অফিসিয়ালি প্রপোজাল দেয়নি। কাজে বা কথায় মনের ভাব বুঝিয়েছে। লাগামহীন কথাও এতটা কোমল স্বরে উচ্চারণ করে যে অপু মাঝে মাঝে দ্বিধায় পড়ে কীভাবে রা’গ প্রকাশ করবে। তাছাড়া সুপ্ত যদি ওকে সরাসরি প্রপোজাল দেয়ও, অপুকে তা নি’র্দ’য়ভাবে ফেরাতে হবে। বেলী বাবাকে যে আঘা’ত দিয়েছে, সে কস্মিনকালেও তা করার কথা ভাবতে পারে না। বাবার বিশ্বাস তার কাছে নিজের চেয়েও মূল্যবান। সে জন্যই হয়তো সুপ্তের পা’গ’লামি, নিরলস আবেগ নিবেদন তাকে আচ্ছন্ন করতে পারে না। কিন্তু একটা দ্বিধা মনের ভেতর খচখচ করে। সুপ্তের মতো ছেলে তার উপেক্ষা মানবে?
অপুর খন্ড খন্ড ভাবনার মাঝে ফোনটা কেঁপে উঠল। অপু চমকে তাকায়। সুপ্তের ফোন! ম্যাসেজ থেকে সোজা ফোনকল করার সাহস করে ফেলেছে লোকটা! হঠাৎ কেন জানি হাত কেঁপে ওঠে ওর। বিজন ছাদেও আ’ত’ঙ্কিত হয়ে আশেপাশে তাকায়। ফোন বেজে বেজে কেটে পুনরায় বেজে ওঠে। পর পর তিন বার কেটে যাওয়ার পর চতুর্থবারে রিসিভ হলো। নির্মল বাতাসের সঙ্গে ওপাশ থেকে ভেসে এলো সুপ্তের ভারী নিশ্বাসের শব্দ,
“অশেষ মেহেরবানি আপনার!”
অপু ফোন কানে চেপে চুপ করে রইল। সুপ্ত এবার হাসল।
“কথা বলবে না? লজ্জা পাচ্ছো নাকি?”
“মোটেও না।”
অপু প্রতিবাদ করেই চুপসে গেল। সুপ্ত দুষ্টুমি ভরা গলায় বলে,
“হুম, নিশ্চয়ই পাচ্ছো। গালদুটোতে র’ক্ত জমেছে। নিশ্চয়ই এতক্ষণ আমার কথাই ভাবছিলে?”
“কে বলল আপনাকে?”
“মন বলছে।”
“আপনার মন কী জ্যোতিষী?”
“আমার মন প্রেয়সীর প্রণয়াক্রান্ত। কিন্তু দুষ্টু প্রেয়সী তা বোঝেই না।”
অপু খুব রাগ করার চেষ্টা করল। কিন্তু সেই তেজটা পাচ্ছে না। কণ্ঠে ঝাঝ মিশিয়ে বলল,
“বাজে কথা বলতে ফোন দিয়েছেন?”
“কেন? তুমি কী রাত আটটার সংবাদ শুনতে ফোন রিসিভ করেছিলে?”
সুপ্ত ঠোঁট চেপে বলে। ফোনের ওপাশ থেকে অপু এবার সত্যিই ক্ষে’পে গেল। সুপ্ত সঙ্গে যোগ করল,
“মনের সংবাদ দিতে পারি। এতক্ষণ শুনছিলে শিরোনাম এবার বিস্তারিত প্রণয় সংবাদ…”
অপু ফোন কাটল। সুপ্ত অন্যদিকে হেসে বিছানায় গড়িয়ে পড়েছে।
______________
বেলী অস্থির হয়ে আছে। একটুর জন্য, শুধু একটুর জন্য বিশাল সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেল। স্ক্রিনে ম্যাসেজটা ভেসে ওঠার পর পরই বেলী ম্যাসেজ বক্সটা চেক করতে গিয়েছিল। তখনই আজিজ বাথরুম থেকে ডেকে উঠল তোয়ালে দিতে। তার এই অসময়ে গোসলের কারণটাও বেলী। প্রেগ্ন্যাসির শুরু থেকেই সে আজিজকে পাশে ঘেষতে দেয় না। নাক চেপে ধরে দূরে সরে যায়৷ অগত্যা বেচারাকে এখন দিন নেই রাত নেই গোসল করতে হচ্ছে বউয়ের সান্নিধ্য পেতে। বেলী বিরক্ত হয়ে তাকে তোয়ালে দিয়ে ফিরতে ফিরতে ফোনটা অফ হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই ফোন লক করা। এদিকে বেলী পাসওয়ার্ড জানে না। উত্তেজনায় এমনিতেই বেলী টগবগিয়ে উঠছিল। বাবার অতি আদরের মেয়ের গোপন প্রেম ফাঁ’স করতে পারলে বাবার এত অ’হং’কার কই থাকে সেও দেখে নিতো। যত দো’ষ বেলীর বেলায়, বাকিরা তলে তলে ধান খেয়ে উড়ে যায় বলে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমন জল্পনাকল্পনার মুহূর্তে হুট করে পাসওয়ার্ডের ঝামেলা মেজাজটা আরেকদফা বিগড়ে দিলো। বেলী ছুটে গেল শিমুলের কাছে। শিমুল অপুর ফোন নড়াচড়া করে বেশি, সে নিশ্চয়ই পাসওয়ার্ড জানে। কিন্তু তখনই অপুর সামনে পড়ল। অপু তার হাতে ফোন দেখেই টেনে নিয়ে বলল,
“ওহহ তোমার ঘরে ছিল! খুঁজে পাচ্ছিলাম না।”
“কেন? প্রেমলীলা করার সময় হয়েছে বুঝি?” বেলী বলতে বলতেও নিজেকে সামলে নেয়। কোনো তর্ক-বিতর্ক নয়, সরাসরি বাবার সামনে প্রমাণ দেবে সে। আগে বলা মানেই অপুকে সতর্ক করে দেওয়া। অপু ফোনটা নিয়ে চলে যাওয়ার সময় যদি একবার পিছু ফিরত, দেখতে পেত বেলীর চোখ দুটি ভাটার মতো জ্বলজ্বল করছে।
বেলীর সামনে এখন কাজু মামা উপস্থিত। সেদিন দুলাভাইয়ের সামনে থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছিল সে। আজ এসেছে চো’রের মতো। পকেটে টান পড়েছে। তাছাড়া মাথায় একটা নতুন বিজনেস আইডিয়া এসেছে। সেটার জন্যও টাকার দরকার। বোনের বাড়িই তার একমাত্র ব্যাংক একাউন্ট যেখানে তৈলমর্দন করলে ঝা’টার বা’রির সঙ্গে টাকাও খসানো যায়। কাজু অবশ্য ঝা’টার বা’রিকে প্রাধান্য দেয় না। টাকা পরিশ্রম করে আয় করতে হয়। তার জন্য গা’লি, মুখ ঝামটা, ঝাটার বা’রিই সেই পরিশ্রম। কাজু বেলীকে জিজ্ঞেস করল,
“কিরে? তোর পোষা বেড়ালটা কই?”
বেলী না বুঝে বলল,
“বেড়াল কোত্থেকে আসবে? আমি ওসব বেড়াল-ফেড়াল পছন্দ করি না।”
“বিড়ালতপস্বী বলে কী? কেন, যে বেড়াল তোকে ভাগিয়ে নিয়ে চান্দিছোলাটার মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে, সেটাকে ছেড়ে দিয়েছিস?”
বেলী ভোঁতা মুখে উত্তর দিলো,
“ও ঘরেই আছে।”
কথার মাঝে আজিজ বেরিয়ে এলো ড্রইংরুমে। কাজু হাত নেড়ে উৎফুল্ল গলায় ডাকে,
“আরে ভা’দাইম্মা ক্লাবের নতুন সদস্য, এসো এসো।”
আজিজ ইতস্তত করে কাজুর পাশে চেয়ার টেনে বসে বলল,
“জি? বুঝলাম না।”
“কাজকাম নেই বলে বুবু আমাকে ভা’দাইম্মা ডাকে। তুমি জামাই বলে বোধহয় ডাকতে লজ্জা পাচ্ছে। আমিই ডাকলাম নাহয়।”
আজিজ লজ্জায় মুখ কাচুমাচু করে। বেলী উঠে চলে গেছে। কাজু আজিজের কাঁধে থাবা দিয়ে বলল,
“আরেহ সত্যি কথায় লজ্জা পেতে নেই। এসব সংকীর্ণ অনুভূতি আমাদের মসৃণ জীবনের পথে সবচেয়ে বড়ো অন্তরায়। তুমি যত বে’শরম হবে তত রিল্যাক্স লাইফ লিড করবে, বুঝেছো? মনে মনে স্লোগান দাও। সুন্দর জীবন পেতে লজ্জা, ঘেন্না, ভয়, তিন থাকিতে নয়।”
“জি?” আজিজ মাথা চুলকায়।
কাজু আরেকটু পাশ ঘেঁষে বসে বলল,
“শোনো, এত সংকোচের কারণ নেই। আমার কাছে একটা বিজনেস প্ল্যান আছে। ইন্দুর, তেলাপোকা, ছারপোকা, মশা মা’রার ঔষধ বেঁচবো দুজনে। হকারদের সঙ্গে থেকে দুদিন তালিম নিয়েছি। ভালো বিজনেস। কাঁধে বোচকা ঝুলিয়ে হেঁটে হেঁটে ডাকবে, ‘চো’রার ঘরে চো’রা তেইল্যা চো’রা। আঁক দিলে ম’রে, দাগ দিলে ম’রে, ঘষ্যা দিলে ম’রে। এ্যাই লাগবোনি তেইল্যাচোরা, ইন্দুর মা’রার জাদুকরী ঔষধ।’
” এ্যাহ্!” আজিজ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। কাজু আরেকটু উৎসাহ নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ। দরকার হলে ইন্দুর, তেলাপোকা ধরে ধরে মানুষের বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে আসব। এরপর দেখবে তরতরিয়ে ব্যবসা চলবে।”
ব্যবসার পদ্ধতি শুনে আজিজের ঘাম হচ্ছে। এখন ঘামে শরীরে গন্ধ হলে বেলী তাকে আবার গোসল করাবে। আজিজ মোটেও তা চাইছে না। সে আঙুল উঁচিয়ে টয়লেটে যাওয়ার ইশারা দিয়ে সেখান থেকে সরে গেল। কাজু তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“শা’লা নিম্নমানের ভা’দাইম্মা!”
অপু ছাদ থেকে নেমে এসে সে কথা শুনেই বলে উঠল,
“ছি মামা! দুলাভাই তোমার শা’লা হতে যাবে কেন? উনি তোমাদের জামাই হয়।”
“সরি মিস্টেক! শা’লা নিন্মমানের ভা’দাইম্মা জামাই!”
অপু নিস্তব্ধ চোখে মামার দিকে তাকিয়ে রইল।
চলবে…