স্বপ্নচারিণী,পর্ব_৫
লেখিকা : সামান্তা সিমি
আকাশে চাঁদ ডুবে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই।ছাদের চারপাশটা আবছা অন্ধকারে ঢেকে আছে।শুধু একপাশে ফেইরি লাইটের আলো জ্বলছে।
যূথী পা টিপে টিপে সিড়ি বেয়ে ছাদের দরজার সামনে চলে আসলো।ছাদের দরজা খোলা দেখে সে কিছুটা অবাক হলো।ভাবছে এরা কি রাতে দরজা খোলা রাখে নাকি!
ছাদে পা রেখে ডানে মোড় নিতেই থেমে গেল যূথী।অপর পাশের ফেইরি লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রেলিঙে হেলান দিয়ে কোনো পুরুষ লোক সামনে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে।ভয়ে যূথীর কপালে ঘাম জমে উঠল।লোকটা কি এই বাড়ির? একটা মানুষ এত্ত লম্বা কি করে হতে পারে? বাড়িতে তো এত লম্বা কাউকে দেখেনি। কোনো জ্বীন-ভূত নয়ত আবার!
যূথী বড়সড় একটা ঢোক গিলল।
কিন্তু পরক্ষণেই বাতাসের সাথে সিগারেটের কটু গন্ধ তাঁর নাকে লাগল।সাথে সাথেই চোখ মুখ কুচকে ফেলল যূথী।তাঁর মানে এটা জ্বীন-ভূত নয়।ভূতেরা কখনো সিগারেট টানতে পারে না।
ছোটবেলা থেকেই যূথী সিগারেটের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারে না।তাঁর বাবা যখন এই পঁচা জিনিসটা খেত তখন সে দূরে দূরে থাকত।সিগারেট খাওয়ার ছয়-সাত ঘন্টা পরও সে বাবার আশেপাশে যেত না।
এই লোকটা তো তাঁর থেকে কত দূরে দাঁড়িয়ে আছে তবু অসহ্যকর গন্ধটা তাঁর নাকে এসে হামলা করছে।যূথী সিদ্ধান্ত নিল রুমে ফিরে যাবে।
সিড়িতে পা রাখতে গিয়েই হঠাৎ তাঁর পা ফসকে গেল।ব্যথা পেয়ে যূথী “আহ্” শব্দ করে উঠল।
* দূরে টাওয়ারের মাথায় জ্বলজ্বল করতে থাকা লাল বাতিটার দিকে তাকিয়ে কোনো এক ভাবনায় বিভোর ছিল নিশান।তখনই মেয়েলি কন্ঠের অস্পষ্ট একটা আর্তনাদ কানে আসলো তাঁর।ব্রেইন বলছে শব্দটা সিড়ির মাথা থেকে এসেছে।হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে সেখানে এগিয়ে গেল নিশান।
আধো অন্ধকারে দেখতে পেল কেউ একজন উবু হয়ে ফ্লোরে বসে কিছু একটা করছে।অন্ধকার থাকার কারণে চেহারা ভালেভাবে দেখতে পারছে না।
সাথে সাথেই সে হুঙ্কার দিয়ে উঠল,
—হো ইজ দেয়্যার?
যূথী চমকে মাথা তুলে উপরে তাকাল।একজোড়া রক্তচক্ষু নিয়ে সামনের লোকটা দেখছে তাঁকে।পায়ে ব্যথা পাওয়াতে নিচু হয়ে পা ঘষায় ব্যস্ত ছিল সে।কিন্তু এখন এসব ফেলে রেখে ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে পরল।এই লোকটাই কি তাহলে নিশান? যার ভয়ানক কাহিনী তখন বিদীষা থেকে শুনেছিল!নিশ্চয়ই তাঁর গলা শুনে ফেলেছে লোকটা!
নিশান এখনো যূথীর চেহারা স্পষ্ট দেখেনি।তবে এটুকু বুঝেছে এই মেয়েটা তাঁর তিন বোনের একজনও নয়।ওরা এত রাতে ছাদে আসার সাহস দেখাবে না।তাঁর মানে এটা যূথী নামের সেই মেয়েটা।
যেখানে মনীষারা তাঁর ভয়ে এত রাতে ছাদের কিনারাও মাড়ায় না তো এই মেয়েটা কিভাবে আসলো।
—এটাই লাস্ট! আর যেন কখনো রাতের বেলা ছাদে না দেখি।
এমন একটা হুমকি শুনে যূথী ভয়ে জমে গেল।কোনো উত্তর না দিয়ে দৌড়ে চলে এল ছাদ থেকে।রুমে এসে দরজা বন্ধ করেই হাঁপাতে লাগল।ভাবছে নিশান নামের লোকটা তো পুরোই যমের মত।যূথী তো এই বাড়িতে নতুন এসেছে।সে কি আর জানে যে রাতের বেলা ছাদে যাওয়া নিষেধ! মাহির ভাইয়া আর এই লোকটা তো একদম ভিন্ন গ্রহের মানুষ।কি হাসিখুশি মাহির ভাইয়া!অথচ উনার কথা শুনে তো তখন যূথীর গায়ে কাটা দিয়ে উঠেছিল।দুনিয়াতে যে কত বিচিত্র স্বভাবের মানুষ আছে সেটা এ বাড়ির লোকজনদের দেখলেই বুঝা যায়।
____________________
দরজায় ধুমধাম আঘাতের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল যূথীর।লাফ দিয়ে উঠে বসে আগে ঘড়ি দেখল।গ্রামে থাকতে তো খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যেত।কিন্তু এখানে এসে তাঁর ঘুমের নিয়ম একদম পাল্টে গেছে।
দরজার খুলে দিতেই মনীষা, বিদীষা এবং নীলিমা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পরল।
নীলিমা যূথীর গাল টেনে বলল,
—গুডমর্নিং যূথী!
যূথী মুচকি হেসে উত্তর দিল,
—গুডমর্নিং নীলিমা।
—গোসল করে চটপট রেডি হয়ে নাও।আমাদের সাথে কলেজে যাবে তুমি।আব্বু তোমাকে ভর্তি করিয়ে দিবে আজ।
যূথীর মুখে হাসি ফুটে উঠল।কত ভালো মানুষগুলো! কিভাবে ওদের ঋণ শোধ করবে সে?
কাল রাতের কথা মনে পড়তেই যূথী বলে উঠল,
—মনীষা কাল রাতে আমার ঘুম আসছিল না।তাই ভাবলাম ছাদ থেকে ঘুরে আসি।কিন্তু ছাদে গিয়ে দেখি…
তিনবোন একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠল।কারণ ওরা জানে নিশান রাতের বেলা ছাদে নিজের মত করে সময় কাটায়। কেউ গেলে সে খুবই বিরক্তবোধ করে।
যূথী আবার বলল,
—ওটাই নিশান ভাইয়া ছিল তাই না?আমাকে দুটো কড়া করে শুনিয়ে দিয়ে বলেছে রাতে যেন আর কখনো ছাদে না যাই।
—জোর বাঁচা বেঁচে গেছ যূথী।তোমার জায়গায় আমরা হলে নির্ঘাত থাপ্পড় খেতাম।যাই হোক এই কাজটা আর কখনো করো না।
মাথা নেড়ে যূথী ” আচ্ছা ” বলল।সে বুঝে গেছে তিনবোন নিশানকে বাঘের মত ভয় পায়।অবশ্য ভয় পাওয়ারই কথা।রাক্ষস লোক একটা!
* ভর্তির কাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরতে বারটা বেজে গেল।মনীষা বিদীষার ক্লাস থাকায় ওরা আসেনি।যূথী একাই ড্রাইভারের সাথে চলে এসেছে।
রুমে এসে গোসল করে বের হতেই দেখল বিছানায় সাফা বসে আছে।যূথীকে দেখতে পেয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
—নিচে চলো যূথী আপু! বড়মা তোমাকে ডাকছে।
—কোনো জরুরি দরকার বুঝি?
—এটা তো আমি জানি না আপু।
যূথী ভেজা চুলগুলো ঠিক করে সাফার সাথে নিচে চলে এল।নীলুফা চৌধুরী এবং বিথী চৌধুরী সোফায় বসে গল্প করছিলেন।বিথী চৌধুরীকে দেখে যূথী কিছুটা অস্বস্তিতে পরে গেল।যূথীর সবসময়ই মনে হয় ছোট মা তাঁকে দেখলেই বিরক্ত বোধ করে।
বড়মা যূথীকে কাছে ডেকে বললেন,
—বিকেলে মনীষাকে নিয়ে আমি শপিংয়ে যাব।তোর জন্য কিছু জামাকাপড় কিনতে হবে তো!কি ধরনের জামা তোর পছন্দ বল।
—জামা লাগবে না বড়মা।আমার যেগুলো আছে ওতেই হবে।
তখনই ছোটমা চোখমুখ কুঁচকে বলে উঠল,
—শোনো মেয়ে, এটা তোমার সেই অজপাড়াগাঁ নয়।এটা হলো ঢাকা শহর।যেহেতু এখন থেকে ঢাকা শহরে থাকবে তাহলে এখানকার কালচারের সাথে মিলিয়ে তোমায় চলাফেরা করতে হবে।তুমি যে ধরনের জামাগুলো পরো এগুলো আমার একটুও পছন্দ না তাই আপা যা বলছে সেটাই করো।
যূথী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।এটাতো সে ভেবেই দেখেনি। এ বাড়ির লোকজন কত হাই ফাই জামাকাপড় পরে।সেখানে তাঁর এইসব সুতি থ্রি-পিস কারোরই ভালো লাগার কথা নয়।
যূথী আস্তে করে বলল,
—তোমার যা পছন্দ হয় তা-ই নিয়ে এসো বড়মা।
* সন্ধ্যায় নিজের রুমে বসে নতুন বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখছিল যূথী।তখনই তিনবোনের দলটা হৈচৈ করতে করতে যূথীর রুমে আসলো।মনীষার হাতে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ।বিছানার উপর ব্যাগগুলো রেখে মনীষা বলল,
—এখন থেকে এরকম থ্রি-পিস আর পরা যাবে না।আমরা বাড়িতে থ্রি-পিস পরি না। তাই তুমিও পরবে না।
—তাহলে কি পরবো আমি?
নীলিমা ব্যাগ থেকে একটা ড্রেস বের করে বলল,
—এই যে এটা।এখন থেকে এই শর্ট টপস্ আর লং স্কার্ট পরবে তুমি।আশা করি তোমার পছন্দ হয়েছে?
যূথী হাত বাড়িয়ে জামাটা দেখল।এত কালারফুল আর সফট্ জামা সে কখনো দেখেনি।হঠাৎই তাঁর চোখের কোনে জল জমে উঠল।
যূথীকে কেঁদে উঠতে দেখে তিনবোন মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।ওরা বুঝতে পারছে না এখানে কাঁদার কি আছে।নতুন জামা পেলে কেউ কখনো কাঁদতে পারে এটা ওদের জানা নেই।
যূথীকে জড়িয়ে ধরে বিদীষা জিজ্ঞেস করল,
—কাঁদছো কেনো আপু?
হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে যূথী উত্তর দিল,
—তোমাদের এত ভালোবাসা পাব এটা কখনো ভাবতে পারিনি।তোমরা সবাই খুব ভালো।বাবা-মা হীন এতিম ছেলেমেয়েদের সবাই বোঝা মনে করে।কিন্তু তোমাদের আদর ভালোবাসা দেখে নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবতী মনে হয়।
যূথীর এমন কান্নামাখা কথা শুনে মনীষা কিছুটা ধমকের সুরে বলে উঠল,
—নিজেকে কখনো এতিম ভেবো না যূথী।আমরা সবাই তোমার সাথে আছি।
তিনবোন মিলে যূথীকে জড়িয়ে ধরল।
________________
সকালে ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছে সবাই।যূথী আজ কলেজে যাবে।তাই মনীষা আর নীলিমার সাথে রেডি হয়ে নাস্তা করতে চলে এসেছে।
মুখে পাউরুটির টুকরো ঢুকিয়ে যূথী সবার দিকে একবার চোখ বুলালো। বাড়ির মহিলারা যার যার স্বামীর প্লেটে এটা ওটা তুলে দিছে।বড় আব্বু, মেজো আব্বু আর ছোট আব্বু নিজেদের মধ্যে নানা আলোচনায় ব্যস্ত।মাহির ভাইয়া তো একবার সাফার সাথে একবার বিদীষার সাথে কি যেন বলে একটু পরপর হেসে উঠছে।
যূথী এবার নিশানের দিকে নজর দিল।লোকটা কেমন স্টিল হয়ে বসে আছে। কোনোদিকে না তাকিয়ে চুপচাপ খাবার মুখে ঢুকিয়েই যাচ্ছে।যূথী ভাবছে লোকটার চেহারায় একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য আছে কিন্তু সবসময় মুখটাকে পেঁচার মত করে রাখার কারণে সেই সৌন্দর্য ম্লান হয়ে থাকে।এমন কেন লোকটা?
যূথী যখন নিশানকে পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত ঠিক ওই মুহুর্তে নিশান চোখ তুলে একদম সরাসরি যূথীর দিকে তাকাল।
এমন রক্তিম চোখের তাকানো দেখে যূথীর গলায় খাবার আটকে গেল।ব্যস্! ফলাফলস্বরূপ জোরে জোরে কাশতে লাগল সে।
বিথী চৌধুরী তাড়াতাড়ি পানির গ্লাস এনে ধমকের সুরে বললেন,
—একটু আস্তে কি খাওয়া যায় না? কি যে করো তুমি!
যূথী ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল।একে তো নিশান নামের রাক্ষস লোকটা তাঁকে দেখে ফেলেছে তার উপর সবার সামনে এভাবে কাশি উঠে গেল।সে তো ভুলেই গেছে সিআইডিদের মাথার সবজায়গাতেই অদৃশ্য চোখ থাকে।নিশ্চিত লোকটা বুঝে ফেলেছে সে লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁকে পর্যবেক্ষণ করছিল।
চলবে…………….