স্বপ্নচারিণী,পর্ব_২
লেখিকাঃসামান্তা সিমি
যূথী বাড়ি গিয়ে কি কি কাজ শেষ করবে তা মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছে।সকালবেলা কলেজ যাওয়ার সময় দেখে গেছে মা’য়ের শরীরটা খুব খারাপ। ঘরে ঢুকেই আগে মা’কে ভাত খাইয়ে ঘুম পাড়াবে।তারপর অন্য কাজ।মাঠ পেরিয়ে ঝোপঝাড়ে ঢাকা রাস্তায় পৌঁছাতেই সামনের মানুষটাকে দেখে থেমে গেল যূথী।
গ্রামের গুন্ডা নামে খ্যাত যে ছেলেটা সে পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।দেখেই বুঝা যাচ্ছে কাসেম যূথীর জন্য অপেক্ষা করছে।মুহূর্তেই যূথীর মেজাজটা বিগড়ে গেল।এই গুন্ডাটা তাহলে গ্রামে চলে এসেছে! এতদিন নিশ্চিন্ত মনে সে কলেজে যাওয়া-আসা করেছে।কিন্তু এখন থেকে আবার এই বদ ছেলের নোংরা কথাগুলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে সহ্য করতে হবে।
—কিরে যূথী! তোর রূপ তো দেখি দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।কয়েকদিন গ্রামে ছিলাম না।আর আজ এসেই এমন চমক দেখব ভাবতে পারিনি।
কাসেমের এমন ফাইজলামি কথাবার্তা শুনে যূথীর গা ঘিনঘিন করে উঠল।বইয়ের ব্যাগটা শক্ত করে চেপে বলল,
—এভাবে রাস্তায় আমাকে বিরক্ত করবেন না এই কথাটা আর কতবার বললে শুনবেন কাসেম ভাই?
—আচ্ছা? তাহলে রাস্তায় না দাঁড়িয়ে তোকে ঘরে গিয়ে বিরক্ত করলে কেমন হয়?
কাসেমের সাথে কথা বলতে গেলেই যূথীর রুচিতে বাঁধে।এই ছেলের মত এমন নোংরা মন-মানসিকতার মানুষ আর দুটা দেখেনি সে।চোখ গরম করে বলল,
—লজ্জা করে না আপনার? গত মাসেও তো চেয়্যারম্যানকে বলে আপনাকে সাবধান করেছিলাম আমি।তারপরও কিভাবে এই মুখটা নিয়ে আমার সামনে আসেন?
—তোর তেজ দেখি খুব বেড়ে গেছে, তাই না? চিন্তা করিস না।মেয়েদের তেজ কিভাবে কমাতে হয় সেটা এই কাসেম খুব ভালো করে জানে।
রাগে গজগজ করতে করতে কাসেম উল্টো পথে হাঁটা দিল।যূথী চোখ-মুখ শক্ত করে কাসেমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।দিনদিন এই বদ ছেলের অসভ্যতামি বেড়েই চলেছে।হঠাৎ করেই যূথীর বাবার কথা মনে পরল।মাথার উপর বাবার ছায়া নেই বলেই হয়তোবা আজকে রাস্তা -ঘাটে এভাবে কাসেমের মত ছেলেদের ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়।
* বাড়ির সামনে আসলেই তাঁর মনটা কেমন বিষন্নতায় ছেয়ে যায়।তাঁর বাবা এমন এক জায়গায় ঘরটা তুলেছে যে একদম লোকালয়ের বাইরে।পায়ে হেঁটে দুই মিনিটের পথ গেলে তবেই শীলাদের বাড়ি।মাঝেমাঝে নিজের এই বাড়িটাকেই যূথীর ভুতুড়ে লাগে।
ঘরে ঢুকে যূথী মা’কে ডাকতে লাগল।
—মা! শরীর এখন কেমন? উঠে বসতে পারবে?
তাঁর মা’য়ের কোনো সাড়াশব্দ নেই।মনে হচ্ছে যেন চোখ বন্ধ করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।যূথী ভাবল হয়তোবা শরীর এখনো দূর্বল তাই এভাবে ঘুমাচ্ছে।থাক আগে রান্না শেষ করুক তারপর মা’কে ডেকে তুলা যাবে।
টিউবওয়েল থেকে হাত-মুখ ধুয়ে যূথী রান্নাঘরের ঝুপড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
* রান্না শেষ করে একটা থালায় ভাত,আলু ভর্তা আর একবাটি ডাল সাজিয়ে নিল যূথী।তাঁর মা এখনো ঘুমে আচ্ছন্ন। যূথী ভাতের থালা পাশে রেখে আস্তে করে ডাকতে লাগল,
—আর কত ঘুমাবে মা? মা?
যূথীর কেমন একটা সন্দেহ হলো।।আগে তো এত ডাকাডাকি করা লাগত না।সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় সে পালস্ রেট যাচাই করার জন্য মা’য়ের হাত স্পর্শ করল।তৎক্ষনাত যূথীর মুখ রক্তশূণ্য হয়ে গেল।
তাঁর মন এবং মস্তিষ্ক দুটোই ভয়াবহ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।
দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় উড়না লেগে পাশে রাখা জলের গ্লাস উল্টে পরে গেল।কিন্তু যূথীর সেদিকে ধ্যান নেই।শ্বাস বন্ধ করে সে ছুটতে লাগল লতিফা চাচীর বাড়ির দিকে।
* লতিফা বেগম উঠোনে দাঁড়িয়ে তাঁর আপার সাথে গল্প করছিল।হাতের ভেজা কাপড়গুলো দড়িতে মেলে দিয়ে বলল,
—আরো কয়েকদিন থেকে যাও আপা।কতদিন পর আসলে তুমি!
—না লতু! আমার ছেলেদের তো চিনিস! এখানে আসার আগেই হুমকি দিয়ে দিয়েছে দুইদিনের বেশি থাকা যাবে না।
—তোমার দুই ছেলেকে দেখি না অনেক বছর হলো।
—দেখবি কিভাবে? ওরা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পা মাড়াতে চায় নাকি! দুজনই নিজেদের ডিউটি নিয়ে ব্যস্ত।
লতিফা বেগম উত্তরে কিছু বলতে নেবেন তখনই দেখেন যূথী উর্ব্ধশ্বাসে দৌড়ে এদিকেই আসছে।মেয়েটার এমন অবস্থা দেখে নীলুফা চৌধুরী এবং লতিফা বেগম দুজনেই ঘাবড়ে গেলেন।
লতিফা বেগম যূথীকে কাছে টেনে বললেন,
—যূথী! কি হয়েছে? এমন পাগলের মত ছুটছিস কেনো?
নীলুফা চৌধুরীও একই কথা জিজ্ঞেস করলেন।এদিকে আতংকে যূথীর মুখ দিয়ে কথা বের হতে চাইছে না।
—মা! মা’য়ের কিছু হয়েছে চাচী।একটু দেখে যাও না!
এই কথা শুনে দুইবোন যূথীর পেছন পেছন যাওয়ার জন্য পা বাড়াল।
তাঁরা যখন ঘরে ঢুকল তখন দেখল ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ভাতের থালায় কয়েকটা মাছি ভনভন করে উড়ছে।পাশে বিছানাতেই যূথীর মা আধবোজা চোখে শুয়ে আছে।তিনজনের চেঁচামেচিতে অনেক মানুষই ইতিমধ্যে জড়ো হয়ে গেছে।যূথী মা’কে ডেকেই চলেছে। কিন্তু নিষ্প্রাণ দেহটার মুখ থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না।
কেউ একজন দৌড়ে গিয়ে গ্রামের ডিসপেনসারিতে সদ্য জয়েন করা ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আসলো।
ডাক্তার তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা সমাপ্ত করে ঘোষণা দিল যূথীর মা আর এই দুনিয়ায় নেই।
“মা” বলে আর্তনাদ করে উঠল যূথী।ঝাপিয়ে গিয়ে পরল তাঁর মা’য়ের প্রাণহীন শরীরটার উপর।গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে সে।
তাঁর এমন গগনবিদারী চিৎকারে সেখানে উপস্থিত সকলেরই চোখে পানি এসে গেছে।
তিন-চার জন মিলেও যূথীকে ধরে রাখতে পারছে না।কাঁদতে কাঁদতে একপর্যায়ে জ্ঞান হারালো যূথী।
* প্রকৃতিকে মাঝেমাঝে খুবই নিষ্ঠুর মনে হয়।সে তার নিজের নিয়মে চলে।কারো সুখ-দুঃখ, আনন্দ -বেদনা কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করে না।নিজের শৃঙ্খলা বজায় রেখেই সকালে পূর্বদিকে সূর্যের কিরণ ফুটিয়ে তুলে আবার দিনশেষে সন্ধ্যায় সেই প্রজ্জ্বলিত সূর্যের আলো পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে দেয়।কে জন্মেছে, কে মরেছে এসব হিসেব রাখার সময় প্রকৃতির নেই।
প্রকৃতির এই নিয়মের বেড়াজালের রেশ ধরেই রসুলপুর গ্রামেও বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে আসলো।ততক্ষণে যূথীর মা’য়ের দাফনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
যূথীদের ঘরটাও যেন আজ নিষ্প্রভ হয়ে আছে।এখনো জ্ঞান ফেরেনি যূথীর।মা’কে হারিয়ে সে যেন তাঁর অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলেছে।চেতনাহীন অবস্থাতেও অস্ফুটস্বরে “মা মা” বুলি আওড়ে যাচ্ছে।
তাঁর পাশে বসে লতিফা বেগম এবং নীলুফা চৌধুরী হাতপাখা দিয়ে সমানে হাওয়া দিয়ে চলেছে।
হঠাৎ করেই জেগে উঠল যূথী।যখনই মনে পরল তাঁর মা আর এই পৃথিবীতে নেই তখনই চোখ বেয়ে বুকভাঙা কান্না নেমে আসলো।
_________________
দুইবোন রাতের খাবার খেতে বসে যূথীকে নিয়ে কথা বলছে।নীলুফা বেগমের সেদিন ঢাকায় ফেরার কথা থাকলেও যাওয়া হয়নি।যূথীর মত একটা সহজ সরল মেয়ের এমন দুর্দিনে ফিরে যেতে তাঁর মন সায় দিচ্ছিল না।
প্লেটে তরকারি তুলে লতিফা বেগম বলে উঠল,
—মেয়েটার কপালে সুখ নেই আপা।জ্ঞান হওয়ার আগেই জন্মদাত্রী মা’কে হারালো।তারপর বাবা চলে গেল আর এখন…..
নীলুফা চৌধুরী চিন্তিত মুখে বললেন,
—মেয়েটার এখন কী হবে রে?
—চুনির বাবা তো বলেছে ওকে এবাড়িতেই রেখে দিতে।কিন্তু ওই বেয়াদপ কাসেমের তা হয়ে উঠবে না।শকুনের নজর দিয়ে রেখেছে যূথীর উপর।
—আমার একটা কথা রাখবি লতু?
—ওমা! অনুমতি চাইছো কেনো আপা?
নীলুফা চৌধুরী দ্বিগুণ উৎসাহে বলে বসল,
—আমি যূথীকে ঢাকায় নিয়ে যেতে চাই।
এমন একটা কথা লতিফা বেগম হজম করতে পারলেন না।চোখ বড় বড় করে তিনি তাঁর আপার দিকে তাকিয়ে আছেন।
—কি বলছো আপা? মানে তুমি ওকে তোমাদের..
—হ্যাঁ! আমাদের বাসায় নিয়ে যেতে চাই।ভেবে দেখ বাবা-মা হীন উঠতি বয়সী একটা মেয়ে গ্রামে থাকলে কাসেমের মত এমন হাজারো শকুনের নজরে পরবে।তাঁর চেয়ে ওকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাই।মেয়েটা যে আমাকেও মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে।
লতিফা বেগম ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলেন,
—ওকে নিয়ে গিয়ে কি করবে? আপা তুমি ওকে কাজের মেয়ে হিসেবে রাখতে চাইছো না তো! তাহলে আমি যূথীকে কিছুতেই তোমার সাথে পাঠাবো না।এটা আমি বলে দিলাম।
এই কথা শুনে নীলুফা চৌধুরীর মুখ বিরক্ততে ছেয়ে গেল।ভাবছে তাঁর এই বোন এখনো আগের মত সন্দেহবাতিক রোগে আক্রান্ত।
—তুই ভাবলি কি করে এমন ফুলের মত একটা মেয়েকে কাজের লোক বানিয়ে রাখব? আমার বাড়িতে কাজের মেয়ের অভাব পরেছে নাকি? চোখের সামনে একটা মেয়ের এমন খারাপ অবস্থা আমি মেনে নিতে পারছি না।আমি চাই যূথী আমার বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করুক।একটা ভালো কাজ করার সুযোগ যখন পেয়েছি সেটা আমি হাতছাড়া করব না।তুই কিছু ভাবিস না! যূথীকে আমি নিজের মেয়ের মতই রাখব।
এই কথায় স্বস্তি পেল লতিফা বেগম।তাঁর আপার পরিবার বিশাল বড়লোক।উনি যখন নিজে দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছেন তাহলে যূথীকে নিয়ে চিন্তা লাঘব হবে।
* খাবারের প্লেট হাতে দুইবোন কোণার রুমটাতে প্রবেশ করলেন।জানালার পাশে জড়োসড়ো হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে যূথী। আর মাঝেমাঝে কি যেন বিড়বিড় করছে।রুমে যে কেউ ঢুকেছে সেদিকে ওর খেয়ালই নেই।
লতিফা বেগম সন্তর্পণে যূথীর দিকে এগিয়ে গেলেন।গত দুইদিন ধরে যূথী এই বাড়িতেই আছে।লতিফা বেগম বুঝিয়ে সুজিয়ে নিয়ে এসেছেন।
কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠল যূথী।
—লতিফা চাচী! কিছু বলবে?
লতিফা বেগম অনুযোগের সুরে বললেন,
—কিছু বললে তুই শুনিস আমার কথা? এভাবে না খেয়ে চেহারার কি হাল বানিয়েছিস দেখ।তোর মা ভালো মানুষ ছিলেন।তাই আল্লাহ তাঁকে তুলে নিয়েছেন।আর মন খারাপ করে থাকিস না আম্মু।এই যে খাবারের প্লেট।আমি খাইয়ে দিব।একদম না করতে পারবি না।দেখি হা কর!
যূথী শুকনো হেসে লতিফা চাচীর কাছে গিয়ে বসল।লতিফা চাচী যেন মায়েরই এক প্রতিরূপ। তাঁর মা ও তো তাঁকে কত এভাবে খাইয়ে দিত।পুরনো স্মৃতি মনে করে যূথীর চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরল।
চলবে……?
[এই পর্বটা লিখতে গিয়ে তো আমার কান্না পেয়ে গেল। তাহলে আপনাদের পড়ে কেমন লাগছে বলুন।]