হৃদয়ের_প্রতিশ্রুতি🌸,পর্বঃ২৬
লেখিকাঃআদিলা
বৃষ্টি পড়া অনেক আগে থেমে গেছে। কচি সবুজ পাতায় বিন্দু বিন্দু পানি গুলো চিকন সরু সুরু রোদ্দুরের আলোয় ঝকমক করচ্ছে। পাতার ফাকে ফাকে বিন্দু কোনা জমা পানি গুলো ইয়ামিনার চোখের অশ্রু মত গড়িয়ে পড়ছে। গুরুম গুরুম মেঘের শব্দ এখনও ইয়ামিনার কান জুড়ে স্থান করচ্ছে।হয়তো বা সন্ধ্যায় ঝুম ধরে বৃষ্টি হবে।। ইয়ামিনা ছাদে দাড়িয়ে আছে। আজ অনেক দিন পর ছাদে আসা হয়েছে। খুব ভিজতে ইচ্ছে করছে। নিজের কষ্টগুলো যদি একটু বৃষ্টি পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা যেত। একটু হলেও কষ্ট কমানো যেত তাহলে ইয়ামিনা প্রতিবারই এই বৃষ্টির মধ্যে বসে বসে নিজের দুঃখ কষ্ট অশ্রু গুলো ধুলিসাত করত কিন্তু সেটা করাও যে বৃথা বৃষ্টির পানিতে অশ্রু গুলো ঢাকা পড়লে কষ্ট গুলো কিভাবে লুকাইত করবে।
ইয়ামিনার নিজের ওপর রাগ হচ্ছে অন্যদিকে কিছুটা ঘৃণা সেটাও নিজের ওপর। আসলে কি সে আমিরের গভীর সমুদ্রের ভালোবাসা অনুভব করতে পারি নি নাকি চোখে দেখতে পারে নি।ভালোবাসা থাকলে তো বিশ্বাস থাকতে হয় তা না হলে সে সম্পর্কটা কাঠগুঁড়ো কয়লা মত হবে। নিজেও পুড়বে অন্যকেও পুড়াবে৷ আর ওই ইশিতার একটা মেসেজ ছবি দেখে কিভাবে আমিরের ওপর খারাপ চিন্তা আনতে পারে।ভালোবাসাটাকে সন্দেহ করতে পারে।আমিরের চোখে তাকালে ইয়ামিনা এক অন্য জগতে হারিয়ে যায় সেখানে শুধু ভালোবাসা দেখতে পায়। ইয়ামিনা এসব ভাবচ্ছে আর ছাদে হাটু মুড়ে বসে আছে।।
—
—
এদিকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা আমির অফিসে আছে ইচ্ছে করেই।কিন্তু আমিরের বেহায়া মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না।ইচ্ছে করছে ইয়ামিনাকে জড়িয়ে ধরে বলতে আমার ভালোবাসা কি দেখতে পাও না নাকি এত ভালোবাসার পরও আমার ভালোবাসায় ক্ষুত আছে কোনটা। অনেক হয়েছে আর না আমার ভালোবাসাটা কিভাবে সন্দেহ করতে পারলে।রাগে ডেস্কে একটা সজোরে বারি দেয় আমির।।
ইয়ামিনা রুমে এসে কাপড় চেঞ্জ করে নেয়। ঘড়ির দিকে তাকায় সাতটা বাজে কিন্তু আমিরের কোনো খবর নেই। ইয়ামিনার একটু একটু করে টেনশন বাড়চ্ছে। আমিরের এমনি অনেক রাগ রাগে না আবার উল্টো পাল্টা না কিছু করে ফেলে ভেবে ভেবে ইয়ামিনার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। হটাৎ সদর দরজায় আরুশিকে আসতে দেখে। আরুশির শরীর পুরো কাদাতে মাখামাখি হয়ে গেছে কিন্তু বৃষ্টি অনেক আগে থেমে গেছে তাছাড়াও আরুশি গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে ফ্রেন্ডসদের সাথে ঘুরবে বলে ইয়ামিনাকে বলেই গিয়েছিল। আরুশির এরকম অবস্থা দেখে ইয়ামিনা কিছুটা অবাক হয় আরুশির সামনে গিয়ে দাড়ায়।।
__-এমা আরু তুমি এইভাবে ভিজে গেছো কেন আর গায়ে এত কাদা কেন? তুমি না গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলে।।
আরুশি কাদো কাদো হয়ে বলে.. আর বলো না ভাবী সব ওই ফাজিল অসভ্য মেয়ের জন্য হয়েছে। দেখলে রাগ উঠে যায় কত অসভ্য একটা মেয়ে।এই মেয়ের জন্য সব হয়েছে আমার শখের জামাটার কি অবস্থা করেছে।
ইয়ামিনা কিছুটা চিন্তিত হয়ে আরুশির দিকে তাকায়…
_কার কথা বলছো। আর কিভাবে জামা নষ্ট হয়েছে।।
_কার কথা আর বলোনা ভাবি ওই ইশিতা ঢঙি আমার জামার নষ্ট করে দিয়েছে। কারো সুখ সহ্য হয় না ওই ইশিতার।
_তুমি ওকে কোথায় পেয়েছো আর ও তোমার ড্রেস কেন নষ্ট করবে।
_ইচ্ছে করে করছে ভাবি। ফ্রেন্ডের সাথে যাচ্ছিলাম গাড়িতে উঠবো এমন সময় পাশ দিয়ে একটা গাড়ি ইচ্ছে করে ব্রেক কষে যার কারনে সব কাদা আমার গায়ে ওপর পড়ে আমার ফ্রেন্ডসদের জামাতেও কিছু লেগেছে কিন্তু সামনে আমি থাকায় সব টুকু আমার গায়ে পড়েছে। ওই ইশিতা ভালো করে জানে ওকে কোনো দিন আমার পছন্দ ছিল না সেই জন্য এমন করেছে। আমার ঘুরাটাই মাটি করে দিল। ভাইয়ার মত মানুষ এই ফাজিল অসভ্য মেয়ের প্রেমে কি ভাবে পড়লো আমার মাথায় ধরে না।।
আরুশির কথা শুনে ইয়ামিনা ভাবে এটাই সুযোগ আমিরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা তাই আগ বাড়িয়ে বলে… কেন তোমার ভাইয়া এর আগে কোনো রিলেশন করে নি।
কি যে বলো ভাবি ভাইয়ার মত মানুষ আর রিলেশন সেটা আমরা কেউ মাথায় আনতাম না। ওই ইশিতা কিভাবে পাগল করেছে সেটা ওই ঢঙি ভালো জানে। জাবির ভাইয়া আর ভাবি যখন জানতে পেরেছিল তখন অনেক অবাক হয়েছিল।কারন ভাইয়া ছোট বেলা থেকে রাগী আর বদমেজাজি ছিল কোনো মেয়েই ধারে কাছে ঘেষত না ভাইয়াই ঘেষতে দিত না। সারাদিন বইয়ের মাঝে মুখ গুজে রাখতো। আরুশি পট পট করে এক এক কথা বলেই যাচ্ছে৷ ইয়ামিনার কাছে এখন সব স্পষ্ট হয়ে গেছে।
ভাবী আমি চেঞ্জ করে আসি গা মেচমেচ করছে।ফ্রেশ হয়ে তোমার সাথে গল্প করবো। আচ্ছা ভাইয়া কোথায় যাওয়ার সময় দেখলাম খুব রেগে ছিল।
___ইয়ামিনা নিজে তো জানে না আমির কোথায় গেছে আরুশি কে কি বলবে। ইয়ামিনা কোনো রকম বলে উঠে….আরু তুমি যাও আগে ফ্রেশ হয়ে আসো তারপর কথা বলবো।
আচ্ছা ভাবি বলে আরুশি কাপড় ঝাড়তে ঝাড়তে রুমে চলে যায়।।
ইয়ামিনা রুমে এসে অস্থির হয়ে ফোনটা খুজে রাগে কোথায় রেখেছে খেয়ালি হচ্ছে না। বালিশের নিচে হাত দিতে পেয়ে যায় ফোনটা। ফোনটা হাত নিয়ে মেসেজ অপশনে গিয়ে ইশিতার মেসেজটা ওপেন করে….
আমিরের সাথে অনেক গুলো মেয়ের ছবি বেশ ক্লোজ ভাবে। দেখে বুঝা যাচ্ছে ছবি গুলা বাজে কিছু বোঝানোর জন্য তোলা হয়েছে।
ইয়ামিনা এখন ভালোভাবে বুঝে গেছে ইশিতা বার বার আমিরের কাছে এসে ভালোবাসা দাবী করে আর সেই আমিরের খারাপ বানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে ইয়ামিনার কাছে সব কিছু ক্লিয়ার হয়ে গেছে সব ছবি গুলোই ফেক সবটাই ফেক। ইশিতা কতটা নীচ আমিরকে পাওয়ার জন্য কতটা নীচে নামতে পারে তাতে আমিরের চরিত্র খারাপ বানাতে দিধা করে নি। ইয়ামিনা নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ লাগচ্ছে আবারও আমিরের ভালোবাসাকে সন্দেহ করেছে যে ভালোবাসায় কতটা পবিত্র ছিল সেটাকে ভুল বলে জানান দিয়েছে। রাগে ইয়ামিনা এক হাতে ফোন চেপে চোখ বন্ধ করে নেয়। ইচ্ছে করছে ওই ইশিতাকে গিয়ে খুন করতে। কত বড় সাহস আমার আর আমিরের মাঝে দেওয়াল তৈরি করতে চায়।
ইয়ামিনা আমিরকে অনেক গুলো ফোন দেয়। না কিন্তু ফোন রিসিভ হচ্ছে না। পড়ে না পেরে ইয়ামিনা ড্রাইভার কাকা কে ফোন দিলে জানতে পারে আমির অফিসেই আছে। ইয়ামিনা একটা বড় নিশ্বাস ছাড়ে। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। কিভাবে আমিরকে এত গুলো কথা শুনিয়ে দিল একবারের জন্যও ভাবলো না আমিরের ওপর দিয়ে কিভাবে যাবে।
—
—
—
রাত ১০টা বাজে এদিক দিয়ে ইয়ামিনা অনেক বার ফোন দিয়েছে কিন্তু আমির রিসিভ করছে না। ইয়ামিনার চোখ বার বার ঘড়ির দিকে যাচ্ছে। ইয়ামিনা বুঝতে পারছে আমির কতটা হার্ট হয়েছে এসব কথায় কেন যে একবার পরখ করে দেখলাম না। না বুঝে কি সব ভেবে ফেলেছি ইয়ামিনার চোখ দিয়ে কয়েকফোটা জল গড়িয়ে হাতে রাখা ফোনের ওপর পড়চ্ছে। এসব কিছু চিন্তা করতে করতে কখন যে ইয়ামিনা ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়ালই নেই।
রাত ১টা ছুই ছুই আমির বাসায় ফিরে। ইচ্ছে করে আমির দেরিতে ফিরেছে। ফোনটা রিসিভ করেনি ইচ্ছে করে৷প্রচন্ড অভিমান জমেছে ইয়ামিনার উপর। পুরো রুম জুড়ে অন্ধকার বিরাজ করছে৷আমির যেয়ে জানালাটা হাল্কা খুলে দেয় চাদের আলোয় ইয়ামিনার ঘুমন্ত মুখটা আরও বেশি মায়াবি হয়ে উঠেছে। এক চিলতি কাচের ফাক বেধ করে চাদের আলোয় যেন আমির ইয়ামিনাকে ভালো পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছে আমির। ইয়ামিনা এলোমেলো ভাবে শুয়ে আছে চুলও গুলোও এলোমেলো হয়ে আছে। আমির কিছুক্ষন এক পলকে ইয়ামিনার দিকে তাকিয়ে থাকে। পায়ের নিচে চাদরটা ভালো করে ইয়ামিনার শরীরে দিয়ে দেয়। আস্তে করে চুল গুলো সড়িয়ে পরম যত্নে কানে গুজে দেয়।এত মায়া কেন আসে আমির ভাবে অনেকক্ষন ধরে ভাবে। কেন জানি ইয়ামিনার মুখটা দেখলে আমিরের সব রাগ পানসা হয়ে যায় খুব ইচ্ছে করে রাগ করতে কিন্তু বার বার ওই ভয়ংকর টোল পড়া এক গালে যেন তৃষ্ণা আরও বাড়িয়ে দেয় আমিরের এই ভাঙা মনে যা আজ নিজ হাতে ইয়ামিনা ভেঙে দিয়েছে। কষ্ট হচ্ছে কিন্ত তা ইয়ামিনার মুখ দেখলে কেন চাপা পড়ে যায়। কপালে ঠোট ছোয়াতে যেয়ে আমির থেমে যায় ইয়ামিনার কথা গুলো বার বার কান খাড়া করে জানান দিচ্ছে এটা ভুল। আমির চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নেয়। তারপর উঠে ফ্রেশ হয়ে সোফায় শুয়ে পড়ে।।
🌸
🌸
একটু দেরি করে ইয়ামিনার ঘুমটা ভাঙে। আরমোড়া দিয়ে উঠতে নিজেকে এমন চাদরে মুড়ানো দেখে কিছুটা অবাক হয়। পরক্ষনে আমিরের কথা ভেবে মুচকি হাসে ইয়ামিনা।
আমির!!!পাশ ফিরে তাকাতে দেখে আমির নেই। আশ পাশ চোখ বুলাতে যেন সোফার দিকে নজর যায়।আমর এক হাত মাথায় অন্য হাত পেটের উপর রেখে শুয়ে আছে। ইয়ামিনা ব্রু সামান্য কিঞ্চিৎ করে উঠে আমিরের সামনে দাড়িয় বুঝতে পারে আমিরের এখানে কেন শুয়ে আছে। আমিরকে কয়েক বার মৃদু স্বরে ডাক দেয় কয়েক বার কিন্তু না আমির ঘুমের মধ্যে বির বির করছে……
বলো না কি করলে বুঝবে আমার ভালোবাসাটা সত্যি। তুমি অনেক খারাপ কি ভাবে আমার ভালোবাসাটা কে ভুল বললে একবার আমার কথা চিন্তা করো নি আমি যে তুমি ছাড়া অর্থহীন।
অস্পষ্ট হলে ইয়ামিনার আমির কথা গুলো বুঝতে পারছে ভুল বুঝে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে আমিরেকে। ইয়ামিনা আর না ডেকে ফ্রেশ হতে চলে যায়।।
ফ্রেশ হতে এসে দেখে আমির সোফায় নেই। ইয়ামিনা ভেবেছে হয়তো আমির ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে গেছে।তাই ইয়ামিনা নামাজটা পড়ে নেয়৷ নিচে গিয়ে দেখে আমির নেই।। সার্ভেন্টের কাছ জানতে পারে আমির কিছুক্ষন আগে বেড়িয়ে গেছে।।
—
—
—
আজ সারাদিন ইয়ামিনা বাসায় ছিল।আমিরকে অনেক বার ফোন দিয়েছে কিন্তু আমির ফোন রিসিভ করে নি। এতটাই রাগ করে আছে যে কথাটুকু বলা যায় না। কাল থেকে আমির কে একটু ভালোভাবে দেখতেও পারে নি। ইয়ামিনা মনটা যেন অস্থির হয়ে উঠেছে। এত এত ফোন দিয়েছে তারপরও ধরচ্ছে না আমির তারপর আর না পেরে ইয়ামিনা রিসিপশনে ফোন দিয়ে জানতে পারে আমির মিটিং এ আছে।
ইয়ামিনার কাছে রাতটা যেন আরও বেশি বড় মনে হচ্ছে। কান্না পাচ্ছে ইয়ামিনার খুব। এতটাই অভিমান করে আছে একটি বারের জন্য কি আমার কথা মনে পড়চ্ছে না উনার।একটা বার তো ফোন নিয়ে খোজ নিতে পারত আমি খেয়েছি কিনা ঠিক আছি কিনা। আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে উনার কি হচ্ছে না। আসলে যার ভালোবাসা যত গভীর তার ভালোবাসায় কষ্ট বেশি থাকে।।
“আমির কাচের জানালার সামনে দাড়িয়ে ব্যাস্ত নগরী দেখচ্ছে। মানুষ কত অদ্ভুত এই ব্যাস্ততার মাঝে এতটাই ডুবে থাকে যে এক সময় মানুষ জীবনের সবথেকে মুল্যবান সময়টাকে হারিয়ে ফেলে।। দেখছে আর সেদিনে ইয়ামিনার বলা কথা গুলো চিন্তা করছে। আসলেই কি ভুল ছিল সব কিছুই ভুল ছিল।
হটাৎ দারোয়ান কাকার কথায় আমিরের ধ্যান ভাঙে।
___ছোট স্যার মেলা রাত হইসে বাসায় যাইবেন না।
আমির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত ১২টা বাজে। কাচের জানালার দিকে দৃষ্টি রেখে বলে…
___চাচা আপনি চলে যান আমার যাতে লেট হবে।
__আচ্ছা স্যার। বলে দারোয়ান চাচা চলে যায়।
.
.
.
চলবে…🌸