হৃদপূর্ণিমা,পর্ব ০৪,০৫

#হৃদপূর্ণিমা,পর্ব ০৪,০৫
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ০৪ |

সকাল নয়টার মধ্যেই আমি কোচিং এ পৌঁছালাম। কোচিং এর একজন টিচার হিসেবে জব করছি। পড়াশোনা ছেড়েছি আরও আগে। পড়ালেখার খরচ চালানোর কেউ-ই নেই আমার। এতদিন টিউশনি করিয়ে চলতাম এখন কোচিং-এর টিচার হিসেবে আছি গত দেড় মাস। মা হার্টের রোগী। প্রতি মাসে ওষুধ এবং খাওয়ার খরচেই সব বেতন চলে যায়। এখন মাসের বাকি দিনগুলা টিউশনির টাকাতেই কোনরকমে চালাচ্ছি। কোচিং সেন্টারের টিচার্সরুমে হাজিরা খাতায় সাক্ষর করার পরমুহূর্তেই আতিক স্যারের সাথে দেখা। উনি জীব-বিজ্ঞানের টিচার এবং আমার বাবার মতোই আমায় স্নেহ করেন। আতিক স্যার হেসে বললেন,

-‘গুড মর্নিং ইংলিশ মম!’

আমি হাসলাম। হেসেই উত্তর দিলাম,
-‘ইংলিশ পড়ালেও আমি কিন্তু পাক্কা বাঙালি, স্যার। তাই ওই নাম না দিলেই পারতেন!’

-‘মাঝেমধ্যে পেশাকে ঘিরে নাম রাখলে মন্দ হয় না!’

-‘মাঝমধ্যে আপনার মুখে “মা” ডাক শুনলেও কিন্তু মন্দ হয় না!’

আতিক স্যার হাসলেন। অতঃপর বলে উঠলেন,
-‘নতুন টিচার আসছে জানো?’

-‘না, আমি তো সবেই এলাম!’

-‘আমি শুনেছি। আচ্ছা, আমার ক্লাস আছে আমি গেলাম!’

-‘ঠিক আছে স্যার।’

আতিক স্যার চলে গেলেন। আমিও কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে গেলাম। ক্লাসে যেতে যেতেই ব্যাগের ফোন হঠাৎ বেজে উঠলো। ইশ! ফোন সাইলেন্ট করতে ভুলে গেছি। ভাবতে ভাবতেই নিজের ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে করতে হাঁটছিলাম তখনই কারো সঙ্গে ধাক্কা খেলাম। আমি দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম বেশ পরিপাটি। হয়তো কোনো স্টুডেন্টের গার্জিয়ান। আমি তাকে ছোট করে ‘সরি’ বলে পাশ কাটিয়ে চলে আসলাম।

ক্লাস শেষ করে অফিসরুমে আসতেই দেখলাম আমাদের কোচিং সেন্টারের যে হেড সেই তারিক স্যার কারো সাথে সকলকে পরিচিত করিয়ে দিচ্ছে। একজন টিচার আমায় দেখতে পেয়ে ইশারায় জলদি তাদের সঙ্গে দাঁড়াতে বললো। আমিও দেরী না করে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম এবং তারিক স্যারের নোটিশ শুনতে লাগলাম। কিন্তু স্যারের পাশের ব্যক্তিটিকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। এই লোকটি সেই লোক না যার সাথে আমি কিছুক্ষণ পূর্বে ধাক্কা খেয়েছিলাম? আমার ভাবনার মাঝেই তারিক স্যার বলে উঠলো,

-‘উনি হচ্ছেন আমাদের মাঝে আরেকজন টিচার। ওনার নাম ফাহাদ এবং মাধ্যমিক শ্রেণির গণিত শিক্ষক। আপনারা তাকে স্বাগতম জানান!’

ফাহাদ সকলকেই প্রথমে সালাম জানালেন। আমাদের মাঝে মধ্যবয়সী টিচাররা সালামের উত্তর নেন আবার কেউ কেউ মনে মনে। তারিক স্যারের আরও কিছু ভাষণ শোনার পরপরই যে যার ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। আমিও আমার ক্লাসের জন্য যেতে নিলে পেছন থেকে ফাহাদ স্যার ডাকলো। আমি ভদ্রতার খাতিরে দাঁড়িয়ে গেলাম।
ফাহাদ স্যার আমার সামনে এসে বলে,

-‘আপনিও কী শিক্ষক?’

-‘জ্বী।’

-‘প্রথম যখন দেখেছিলাম তখন মনে হয়নি। আপনার নাম কী? আর আমার ইন্ট্রোডাকশন তো কিছুক্ষণ আগে তারিক স্যারের থেকেই পেলেন! আপনি চাইলে আমি আবারও দিতে পারি।’

-‘আমার ক্লাস আছে স্যার, ক্লাস সেরে কথা হবে।’

বলেই আমি চলে আসলাম, ফাহাদ স্যারকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই। এখন ক্লাস সিক্সের ইংরেজী ক্লাস আছে। ক্লাস শেষ হলে আর অফিসরুমে গেলাম না, পরপর ক্লাস সেরে ব্রেকের সময়ই অফিসরুম আসলাম। অফিসরুম যাওয়ার পথেই ফাহাদ স্যারের সঙ্গে দেখা। উনি আমার সাথে যেতেই যেতে বলে,

-‘আপনি কী আমার তখনকার ব্যবহারে রাগাম্বিত? না মানে হুট করে চলে গেলেন?’

-‘ক্লাস ছিলো স্যার, দেরী হচ্ছিলো তাই চলে এসেছি। আর আমিও তখনকার জন্য দুঃখিত, একচুয়ালি আমি আমার চাকরি নিয়ে খুবই সেন্সিটিভ।’

-‘ও আচ্ছা। এখন তো জানতে পারি আপনার নাম?’

-‘জ্বী। রথি।’

-‘বাহ খুব সুন্দর নাম আপনার।’

-‘ধন্যবাদ।’ মিষ্টি হেসে বললাম।

অতঃপর দুজনেই টুকটাক পরিচিত হলাম। একপর্যায়ে বলা চলে ফাহাদ স্যার এবং আমার মাঝে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ফাহাদ স্যার বড়ই মিশুক মানুষ। তবে আজ আতিক স্যারের কথায় অসন্তুষ্ট হলাম।

-‘ফাহাদকে এতোটাও ভরসা করিও না। তুমি তো জানো কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক।’

আমি স্যারের কথায় ছোট করে শুধু ‘জ্বী’ উত্তরই দিয়েছিলাম। পরমুহূর্তে অসন্তুষ্টি কেটে গেলো। আমি জানি স্যার আমায় কোনদিকে ইঙ্গিত করেছে। বর্তমান সময়ে মেয়েদের নানান ঝামেলা হয় সেখানে আমি নিজে রোজগার করে মাকে চালাচ্ছি। আমার জন্য তো সেফটি দেয়ার কেউ নেই, তাই নিজের রক্ষা নিজেকেই করতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই আমার আজকের মতো শেষ ক্লাসটা করতে চলে গেলাম।

নাশিদ কপালে হাত দিয়ে নিজের কিছু ফাইলস চেক করছিলো তখনই নয়ন লাল, লাল চোখে এলোমেলো ভাবে নাশিদের কেবিনে প্রবেশ করলো। নাশিদ কারো উপস্থিতি টের পেতেই মাথা উঠিয়ে নয়নের দিকে তাকালো। নয়নের অবস্থা দেখে নাশিদ সামান্য হেসে বলে,

-‘কী অবস্থা ঘুম হলো?’

-‘হয়েছে স্যার, তবে আমি নাক টানিনি।’

-‘মানে?’

-‘আপনি তো আমার ঘুমানোর সাথে সাথে নাকও টানতে বলেছিলেন, সকালে ঘুম থেকে উঠে আপু জানালো আমি নাক টানিনি। এর জন্য কী আমায় শাস্তি দিবেন?’

নয়নের বাচ্চামো কথায় নাশিদ নিঃশব্দে হেসে উঠলো। হাসার এক পর্যায়ে বলে উঠে,

-‘আল্লাহ জানে তোমায় পুলিশের চাকরি কে দিয়েছে। যাইহোক, এখন আমার জন্য এক মগ কফির ব্যবস্থা করো এটাই আপাতত তোমার শাস্তি।’

-‘আচ্ছা, স্যার।’

বলেই নয়ন চলে গেলো। আর নাশিদ আবারও তার ফাইলে মনোযোগ দেয়। এর মাঝে একজন পুলিসজ কর্মকর্তা হাতে লাঠি নিয়ে আসলেন। নাশিদ ফাইল রেখে তার উদ্দেশ্যে বললো,

-‘কিছু বের করতে পারলে?’

-‘না স্যার। একটাও ঠিকমতো কিছু বলেনি। এতো কেলালাম ব্যাটারা তাও কিছুই বলছে না।’

নাশিদ চুপচাপ শুনলো কিন্তু কিছুই বলে না। তখনই নয়ন নাশিদের কফি নিয়ে প্রবেশ করলো। নয়নের দেয়া কফি শেষ করেই নাশিদ বললো,

-‘চলো কিছু মশলা মাখামাখি করি!’

-‘মানে?’

নাশিদ হেসে সেই কর্মকর্তার থেকে লাঠিটা নিজের কাছে নিয়ে অতঃপর নয়নকে নিয়ে লকাপে চলে গেলো। নাশিদও ওদের মেরে কথা বের করতে পারেনি। অতঃপর নাশিদকে কিছু অর্ডার করতেই নয়ন চলে গেলো। নাশিদ একটা লম্বা শ্বাস ফেলে ওদের সামনে এক হাঁটু গেড়ে বসে বলে,

-‘আমি জানি তোদের মেরেও কথা বের করতে পারবো না। এখন ছুঁরি এবং লবণ আনতে পাঠিয়েছি। যার জন্য এতো মার সহ্য করছিস সে কী একবারও জিজ্ঞেস করেছে, তোরা কেমন আছিস? করেনি। তাও তোরা মরেও চুপ করে আছিস। রিযিকের মালিক আল্লাহ! তার প্রতি ইমান যদি কঠোর করতি? নবীজিকে নিয়ে কঠিন আন্দোলনে যদি এমনভাবে শক্ত থাকতি, জীবন পাল্টে যেতো।’

ডাকাতগুলো কিছুক্ষণ এগুলো শুনলেও পরমুহূর্তে তাদের আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে গেলো। এর মাঝে একজন ছেলে বলে উঠলো,

-‘তোরা চুপ থাকলে আমি আর চুপ থাকবো না, অনেক হয়েছে আর মার খেতে চাই না!’

ডাকাতের বস তাকে ধমক দিয়ে বলে,
-‘ওই চুপ কর ব্যাটা! মুখ খুললে নিজে তো এমনেই বাঁচবি না সঙ্গে পরিবারও হারাবি। পরিবারের জান বাঁচাইতে হইলে চুপ মাইরা থাক। এই পুলিশরা দুইদিন পর এমনেই ছাইড়া দিবো, পকেট ভরাইলে!’

সাথে সাথে বসের গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় নাশিদ। এতই জোরে ছিলো থাপ্পড়টা বস তাল সামলাতে না পেরে ধুরুম শব্দে পরে যায়। বলা চলে সিমেন্টের মেঝের বারিতে কপাল ফেটে রক্ত বেরিয়ে যায়। নাশিদের এমন শক্তি দেখে বাকি ডাকাত তো হা করে বসে আছে। তাদের মারের কাছে এই আঘাত তো কিছুই না। নাশিদ চরম রেগে চোখ-মুখ লাল করে আঙুল হুংকারের সুরব বলে,

-‘নাশিদকে মোটেও এতটা সহজ ভাবিস না। আমি যে কী ভয়ংকর তার নমুনা আমি এখনো তোদের দেখাইনি। আর এটা তোর শ্বশুড়বাড়িও না যে পকেটে টাকা ভরলেই কাড়ি কাড়ি খাবার আর আদর-যত্ন পাবি। এই থানা শুধুমাত্র আমার স্টাইলে চলে। তাই যতো যাই করিস না কেন তোদের আমি ছাড়া কেউই বের করতে পারবে না। অত্যাচার সহ্য করতে না পারলে এখানেই মরে পচবি! শালা জানোয়ার!’

বস ব্যথায় মেঝেতে কাঁতড়াচ্ছে। বাকি ডাকাত’রা একদম নিশ্চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ বাদে নয়ন হাতে করে একটা বড় পাথর আনে। নাশিদ তখন ভয় দেখাতেই ছুঁরি এবং লবণের কথা বলেছিলো। সেই পাথর আলগাতে নয়নের অবস্থা খারাপ। নাশিদ উঠে সেই পাথরটা নিয়ে একদম বসের সামনে নিয়ে যায়। এর জ্ঞান হারানোর অবস্থা এখন। নাশিদ সকলের উদ্দেশ্যে বললো,

-‘তোরা যদি পরিবার হারানোর ভয়ে কিছু বলতে না চাস তাহলে আমিও বলছি, তোদের মূসার বাপেরও শক্তি নেই ওদের কিছু করার। মূসার চেয়েও বড় বড় কেস আমি একা হাতে সামাল দিয়েছি। তাই ভালোই ভালোই বল নয়তো তোরা প্রত্যেকেই চরম কষ্টে ভুগবি যা আমি দিতে যাই না!’

মেঝেতে পরা অর্ধমৃত অবস্থায় বস বলে উঠে,

-‘কখনোই না।’

নাশিদ পাথরটা পাশে রেখে তার পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করলো যেটায় লবণ-মরিচের গুঁড়ো। নাশিদ হাতে গ্লাবস পরে সেগুলো হাতে নিয়ে বসের কপালের ক্ষততে লাগিয়ে দেয়। এই বসের প্রতি নাশিদ চরম বিরক্ত হয়ে আছে। এবার বস আরও জোরে আর্তনাদ করে উঠলো যা দেখে বাকি চ্যালারাও আঁতকে উঠলো।

-‘এবার তোদের ডিসিশন। কী করবি? আমি কিন্তু এতো ভালো মানুষও নই!’

সবাই রাজি না হলেও দুজন রাজি হলো। তারা গড়গড় করে মূসা সম্পর্কে সব প্লাস মূসার লোকেশনও বলে দিলো। আর ওরা এটাও জানালো ওরা কোনো ডাকাত না, ওরা এক সন্ত্রাসীর আওতাধীনে আছে। সেদিনই বাইরের দেশের সঙ্গে বড়রকম বেআইনি অস্ত্রের ডিল হবার কথা ছিলো কিন্তু নাশিদ সময়মতো যাওয়ায় সব ভেস্তে যায়!

সব তথ্য পেয়ে নাশিদ বাঁকা হাসি দিলো। তার ভেতরের ভয়াবহতা খুব শীঘ্রই মূসা দেখতে চলেছে।

বাড়িতে ফিরে খেয়াল করলাম একজন লোক আমাদের বাড়িতে ঢোকার মাঝারো সাইজের স্টিলের সদর গেটের সামনে উঁকিঝুঁকি মারছে। কিছুটা এগিয়ে যেতেই বুঝলাম এই গর্ধব কে? কালো কোর্ট পরিহিত, বোগলতলায় একটা ছাতা নিয়ে এবং মুখে পান চিবুতে চিবুতে এদিকে সেদিক তাকাচ্ছে। উনি হলেন আমাদের এলাকার সব থেকে নিকৃষ্ট ঘটক(আমার ব্যক্তিগত মতামত) যে কিনা অভাবী পরিবারে গিয়ে গিয়ে কচি মেয়েদের ভালো ছেলের নাম করে বুড়ো আঙ্কেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। এই গর্ধবটার নজর আমার উপরেও পরেছে গত ৬ মাস আগে থেকে। সেই যে আমার পিছু লেগেছে এখনো ছাড়েনি। এ যেন আমায় বিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হবে। বুঝি না, যেখানে আমার ঘরের মানুষই আমার বিয়ে নিয়ে চিন্তা করে না আর এই লোকের এতো কিসের সমস্যা? এরে যে কতবার ঠেঙ্গিয়ে বিদায় করেছি হিসাব নেই। আবারও এসেছে ঠেঙ্গানি খেতে।

কোমড়ে দু’হাত রেখে বলে চেঁচিয়ে বললাম,

-‘ও বুড়ো! আবার আমার বাড়ির সামনে এসেছেন কী করতে?’

ঘটক হুড়ঁমুড় করে পিছে ফিরে আমার দিকে তাকালো। উনি তার বড় মোটা ফ্রেমের চশমাটি ঠিক করতে করতে বলে,

-‘তোমার আম্মার সাথে কথা বলতাম, বাড়ি আছেন নাকি?’

আমি এবার পায়ের জুতোটা খুলে হাতে নিলাম এবং বলে,

-‘যদি এর মার খেতে না চান তাহলে এক্ষুনি বাড়ির সামনে থেকে চলে যান। যদি না যান আপনার ঘটকালি আমি চিরজীবনের মতো বুঝায় দিবো। যাবেন নাকি এইটার স্বাদ নিবেন?’

-‘মায় কী শিক্ষা-দীক্ষা দেয় নাই? বড় গো লগে এমনে কথা কস আবার জুতা দেখাস?’

এবার আমি জুতা নিয়ে ওনার দিকে ছুটলাম। ঘটক কয়েকটি শুকনো ঢোক গিলে সাদা লুঙ্গি হাত দিয়ে খানিক উঁচু করে উল্টোদিকে দৌড় দিলো।

~চলবে।

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ০৫ |

মূসার কেস শেষ করে নাশিদ সবে শান্তিতে বসেছে তখনই নয়ন এক বাক্স লাভ লেটার সশব্দে রাখলো। নাশিদ একবার বক্সের দিকে তো আরেকবার নয়নের দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো। নাশিদ ভ্রু কুচকে বললো,

-‘এগুলো কী নয়ন?’

-‘আপনার লাভ লেটার। প্রতিদিন আপনার জন্য লাভ লেটার আসে স্যার, মূসার কেস সেরে তো আপনি পুরো পাবলিক ফিগার হয়ে গেছেন। রোজ রোজ যেই পরিমাণ লেটার আসে, আমি জাস্ট স্পিচলেস!’

-‘জাস্ট শাট আপ নয়ন! এগুলো ফেলো বলছি। এসব আজারে কাজ দেখা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই তোমার?’

নয়নের দাঁত কেলানো বন্ধ হয়ে গেলো নাশিদের ধমকে। সে মুড অফ করে বাক্সটি নিয়ে জানালা দিয়ে চিঠিগুলো ফেলে দিলো। সেই রাস্তা দিয়েই রথি যাচ্ছিলো আর সব চিঠি তার উপরেই পরলো। নাশিদ নয়নকে আবার দেয় ধমক! নয়ন চিঠি ফেলা বন্ধ করে চুপ করে দাঁড়িয়ে যায়।

-‘কমসেন্স নাই তোমার? বলি কী আর করছো কী? তোমায় কে বলেছে এসব জানালা দিয়ে ফেলতে?’

-‘আপনি-ই তো বললেন ফেলে দিতে।’

নাশিদ মাথা নিচু করে দুই হাতে নিজের চুলগুলি মুঠ করে ধরলো। নয়ন একবার জানালার দিকে তো আরেকবার হাতের চিঠিগুলোর দিকে তাকালো।

থানার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম তখনই যেন আমার উপর চিঠির বর্ষণ শুরু হয়ে যায়। এসবে আমার চরম রাগ হলো। একবার উপরে তাকিয়ে হাতে কয়েকটি চিঠি নিয়ে থানায় ঢুকে গেলাম। একজন কর্মচারী আমাকে তাদের স্যারের কাছে নিয়ে যেতেই দেখলাম চিঠিগুলো পরেছে ওনার কক্ষ থেকেই। এবার আমার ক্রোধ আরও বেড়ে যায়। যার হাতে চিঠির বক্স ছিলো তাকে বলে উঠলাম,

-‘আপনি কী পাগল? এভাবে আমার উপর চিঠি ফেলার মানে কী? ওটা রাস্তা, মানুষ ওখান দিয়ে চলাচল করে। আপনার মাঝে যদি এইটুকু কমনসেন্স না থাকে তাহলে আপনি কেমন পুলিশ? চিঠির জায়গায় যদি অন্যকিছু হতো আর আমার যদি কোনরকম ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো তাহলে তার দায়ভার কী আপনি নিতেন?’

মেয়েলি কন্ঠ পেয়ে নাশিদ মাথা তুলে তাকালো এবং রথিকে দেখে সে খানিক চমকে গেলো। বিয়ে বাড়ির রথি এবং বর্তমান রথির মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য লাগছে।
আমি এবার অফিসারের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাবো তৎক্ষনাৎ ওনাকে দেখে আমার মুখ অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়। এ যে নাশিদ, নাফিসার ভাই। উনি তাহলে এই থানায় দায়িত্বে আছে? দুজনই দুজনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নয়ন ততক্ষণে জলদি কাউকে দিয়ে রাস্তায় পরা চিঠিগুলো পরিষ্কার করতে বলে দেয়। নাশিদ অস্ফুট সুরে বলে উঠে,

-‘তুমি রথি, রাইট?’

আমার মুখ দিয়ে যেন কথা বের হচ্ছে না। ওনার সামনে আমি কীসব বলে ফেললাম, এখন উনি আমার সম্বন্ধে কী ধারণা করবেন? আমি বাজে মেয়ে? পরমুহূর্তে ভাবলাম, আমি তো ভুল কিছু বলিনি। ভেবে নিজেকে কিছুটা শান্ত করলাম এবং একটা কথাই বললাম,

-‘হুম। আপনার কর্মচারীদের একটু কমনসেন্স শিখিয়ে দিয়েন। নয়তো দেখা যাবে পুলিশ সাধারণ মানুষকে নয় সাধারণ মানুষ পুলিশকে সেবা দিচ্ছে!’

বলেই আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে চলে আসলাম। কেন যেন ওনার ওই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত আমার সহ্য হয় না, অস্বস্তি অনুভব হয়।

নাশিদ এখনো রথির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে রথির কথাগুলো সে ঠিকমতো হজম করতে পারেনি। এতদিন কেসের মাঝে ডুবে থাকার কারণে তার মগজ থেকে এই “রথি” একদমই মুছে গেছিলো। আবারও এই রথি তার মগজে হানা দিলো। আবারও সে রথির রহস্য জানতে পূর্বের ন্যায় আগ্রহী হয়ে উঠে। সেদিন নাশিদ নয়নকে আচ্ছাশিড় বকাঝকা করলো। কারণ, তার কারণে বাইরের মেয়ে এসে জ্ঞান দিয়ে গেছে যা নাশিদ এখনো হজম করতে পারছে না।
নয়নও সেদিন থেকে নিজেকে শোধরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো।

কোচিং সেন্টারে যেতে একটু দেরী-ই হয়ে গেলো। কোনরকমে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতেই ফাহাদ স্যারের সঙ্গে দেখা হলো।

-‘কী ব্যাপার রথি? আজ দেরী হলো যে?’

থানার কথা বলতে চেয়েও রথি বললো না। থানা এবং নাশিদ, এই দুটো শব্দ রথি নিজের মাঝেই রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তাই “এমনি” বলে ফাহাদকে পাশ কাটিয়ে ক্লাসে ছুটে গেলো। সারা ক্লাসেও নাশিদের সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ভুলতে পারলো না। কই এতদিন তো নাশিদের কথা এতবেশি মনে পরেনি তাহলে আজ এসব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে কেন? ওনাকে থানায় দেখতে পেয়ে?

এই মাসের বেতনের হিসেব করতে করতে হেঁটেই বাসায় ফিরছিলাম তখনই আমাদের এলাকার বখাটে শামুন আমার পথ আটকে দাঁড়ালো। আমি তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই শামুন বুকের বা পাশে হাত দিয়ে বলে,

-‘হায়! মে মার যাওবা! এভাবে তাকিও না, এখানে লাগে!’

-‘ফাইজলামি একদম ভালো লাগে না শামুন, পথ ছাড়!’

-‘আগে হ্যাঁ বলে দাও, ছেড়ে দিবো।’

-‘কিসের “হ্যাঁ”?’

-‘ওইযে, তিন মাস আগে যেটা বলেছিলাম, সেটার উত্তর!’

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বুকে দুইহাত গুঁজে বললাম,

-‘আমি মরে গেলেও তোকে আমার উত্তর “না”-ই থাকবে। সাবধান করছি, আমার থেকে দূরে সরে যা। নয়তো তোর এমন হাল হবে তুই তা এই জীবনেও ভুলতে পারবি না!’
আমার কথায় শামুন ফিক করে হেসে দেয়।

-‘যা হবে না জেনেও এক কথা দিয়ে ভয় দেখাও এটা বেশ ভালো লাগে। তোমার তেঁজ তো আরও বেশি। তাইতো হুট করে তোমায় পুরো মনটা দিয়ে দিলাম। যাইহোক, আমি তোমার জন্য সব করতে রাজি, জাস্ট! অন্য ছেলের প্রতি দুর্বল হলে তোমার কী হাল করতে হয় তাও আমার জানা আছে। তুমি আমার ওকে? বাই ডার্লিং!’

বলেই আমার থুঁতনিতে হাত দিতে যাবে তখনই আমি দু’কদম পিছিয়ে গেলাম। শামুন হাসতে হাসতে আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেলো আর আমি বিষন্ন মনে বাড়িতে ফিরলাম। বাড়ি ফেরার সময় যেন আমার পা চলছিলো না। ইচ্ছে করছিলো সব ফেলে এমন একটা দুনিয়ায় চলে যাই যেখানেই শুধুই আমার নিজস্ব রাজত্ব চলবে, একান্তই নিজস্ব রাজত্ব। সেখানে কেউ থাকবে না।

সন্ধ্যার পর নাফিসা, নেওয়াজ, তার বউ এবং নাশিদ একসাথে ঘুরতে বের হয়। কিছুদিন আগেই নেওয়াজ ও তার বউ তনু হানিমুন থেকে ফিরেছে। নাফিসা আর তনু কথা বলে বলে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং বিভিন্ন আলাপ করছে। নেওয়াজ কেএফসির থেকে দুটো জুস নিয়ে আসে। অতঃপর নাশিদকে এক গ্লাস দিয়ে নিজেরটা পাইপ দিয়ে খেতে শুরু করে। নাশিদ আনমনেই জুসটা খাচ্ছে। নেওয়াজ অনেকক্ষণ ধরেই নিজের ভাইয়ের আচরণ লক্ষ করছে। এবারও নাশিদের আনমনা তার চোখ এড়ালো না।

-‘কী ব্যাপার নাশিদ? এমন আনমনা দেখাচ্ছে কেন তোকে? অনেকক্ষণ ধরেই আমি তোকে লক্ষ করছি, কোনো কী সমস্যা?’

-‘না ভাইয়া। তেমন কিছু না!’

-‘আমার থেকে কিছু লুকানোর চেষ্টা করছিস?’

-‘আরে নাহ।’

-‘আমার সাথে চালাকী করবি না নাশিদ!’

-‘ফাইন! বলছি, থানায় এক মেয়ে ইনডাইরেক্টলি আমায় জ্ঞান দিয়ে গেছে।’

বলেই পুরো কাহীনি সংক্ষেপে তুলে ধরলো। তবে নাশিদ জানালো না রথি নাফিসারই বেস্টফ্রেন্ড। অচেনা মেয়ে বলে পুরো ঘটনাটিই সে তুলে ধরলো। নেওয়াজ নাশিদের এসিস্ট্যান্টের কর্মকান্ডে হু হা করে হেসে উঠলো। এমন বলদও পুলিশের চাকরি মানে নাশিদেরই এসিস্ট্যান্ট! হাস্যকর।

-‘যাক, আশা করছি মেয়েটার কথায় নয়নের মাথা খুলবে। হায়রে কাহীনি লাভ সেটারময়।’

নাশিদ উত্তরে কিছু বললো না। নেওয়াজ আবারও নাশিদকে খুচিয়ে বলে উঠলো,

-‘তুই বিয়ে করলেই দেখবি মেয়েরা তোর পিছে ঘুরা বন্ধ করে দিছে। আসলে তুই তো আমার মাহশাল্লাহ ভাই তো তাইতো মেয়েদের লাভ লেটার নিতে নিতে বেচারা নয়ন মাঝখান দিয়া ফাইসা গেছে। বিয়ে করে ফেল, আমি তো করেই ফেললাম। সো তোর লাইন ক্লিয়ার বস!’

-‘নো ওয়ে। কোনো আলতু ফালতু মেয়েদের আমার জীবনে জায়গা নেই! আর এদের কাউকে বউ বানানো তো বিলাসিতা!’

-‘তাহলে তোর কেমন মেয়ে পছন্দ?’

-‘আত্মনির্ভরশীল, সাধারণ একজন! এইটুকুই আমার এনাফ ভাইয়া!’

নেওয়াজ চুপ করে গেলো। কারণ সে জানে এরকম মেয়ে হারিকেন দিয়ে সারাজীবন খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। আর পেলেও তারা নাশিদের পার্সোনালিটির সঙ্গে ম্যাচ করবে না। নেওয়াজের মতে তার ভাই তার একজন আদর্শ। হ্যাঁ নাশিদ তার ছোট ভাই হওয়া সত্ত্বেও নেওয়াজ নাশিদকে আদর্শ হিসেবে মানে এবং ভালোবাসে। একচুয়ালি নাশিদ মানুষটাই এমন, তার মধ্যে কী কী জ্ঞান, বিচক্ষণতা লুকিয়ে আছে সবটাই যেন রহস্য। নাশিদকে কখনো অচেনা কারো সঙ্গে মিশতে দেখেনি, সেই ছোটবেলা থেকেই। হয়তো উপলব্ধি করেছিলো, তার এই দুনিয়ায় আপন মা বলতে কেউ নেই।

ভাবতেই নেওয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হ্যাঁ নেওয়াজ জানে নাশিদ তার আপন ভাই নয়। যখন নাশিদের মা মারা যায় তখন নাশিদ মাত্র ২ বছর বয়সী ছিলো আর নেওয়াজ ছয় বছর বয়সী। আর নাফিসা, সে তো দুনিয়ার আলো দেখতেই তার মা দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে। নেওয়াজের এখনো ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, ওই টুকুনি দুই বাচ্চার পরিস্থিতি কী-রূপ ছিলো, তার মা কীভাবেই না দুজনকে একত্রে সামাল দিয়েছিলো। সবটা আজও তার চোখে ভেসে উঠে। চাইলেও ভুলতে পারে না। তবে সে নাশিদকে এবং নাফিসাকে আজও বুঝতে দেয়নি তাদের সৎ ভাই হচ্ছে নেওয়াজ। কারণ সে চায় না বাকি সৎ ভাইদের মতো নিজের চরিত্র খারাপ করতে। সে একজন আদর্শ ভাই হবে বলেই প্রতিজ্ঞা করেছে।

~চলবে।

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম, আসসালামু আলাইকুম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here