হলুদ_বসন্ত,পর্ব_১৫,১৬

হলুদ_বসন্ত,পর্ব_১৫,১৬
Eshika_Khanom
পর্ব_১৫

“তোমায় ভালোবাসি এটা না জানিয়ে মারা গেল আমার একটা আফসোস থেকে যেতো, কষ্ট হতো খুব। কাকতালীয়ভাবে তোমায় পেয়ে গেলাম। কিন্তু ভাগ্য কেমন তাইনা? তোমায় পেয়েও হারিয়ে ফেলব আমি। পেয়েও পাওয়া হলো না আমার তোমায়।”
দেওয়ালে টাঙালো আয়াতের একটি ছবি ছুয়ে আদ্রাফ কথাটি বলল। একটা ডায়েরী খুলে নিল সে। মাঝ দিয়ে একটি পৃষ্ঠায় লিখতে শুরু করল।

“হয়তো আমার মৃত্যুর পর তুমি এই ডায়েরীটি পড়বে। তখন কি আমার জন্যে তোমার চোখ থেকে মুক্তদানাগুলো গড়িয়ে পড়বে? জানিনা। হয়তো নিজের সুন্দর এক সাজানো সংসার গড়িয়ে নিবে তুমি। তোমার জন্যেই তো সব রেখে গেলাম। যাওয়ার আগের দিন তোমায় একটা কথা বলে যাব। কি বলব তা হয়তো তোমার এই ডায়েরী দেখে মনে পড়বে। মনে পড়বে সেই গল্প যখন তোমার হাত ধরে আমি বলেছিলাম নিজের এবং আমার দাদীর খেয়াল রেখ। এই কাঁদবে না কিন্তু তুমি। নিজে ভালো থেকো। জানিনা কোনো হলুদ বসন্তে কি তোমায় আমার আবার ফিরে পাওয়া হবে কি না? তবে আমি মৃত্যুর পর আল্লাহর কাছে কিছু চাইতে বললে জান্নাতের হলুদ বসন্তে তোমায় চাইবো।”
.
.
.
নিস্তেজ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে আয়াত। চোখের জলের ছাপ বসে গিয়েছে তার কপোলদ্বয়ে। ফ্রেশ না হয়েই সে সোজা চলে গেল দিলারা জাহানের ঘরে। আচমকাই জড়িয়ে ধরল তাকে। আয়াতের এমন কাণ্ডে ভয় পেয়ে গেলেন দিলারা জাহান। আয়াত তখন তার বুকে মুখ গুজে রেখেছে। দাদী জিজ্ঞেস করলেন,
“কিরে? কি হয়েছে সতীন?”

কোনো সাড়া দিল না আয়াত। আগের মতোই রয়ে গেল দাদীর বুকে। দাদী আয়াতের মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। কিছু সময় এভাবেই স্নেহ মমতা বিনিময়ের মাধ্যমে পার হলো। আয়াত মাথা তুলে চাইলো দাদী দিকে। তাকিয়েই একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিল। দাদীও হেসে দিলেন এই বাচ্চা হাসি দেখে। আয়াতের দাদীকে প্রশ্ন করলেন,
“কি অবস্থা এখন শরীরের?”

দাদী উত্তরে বললেন, “তা আমার শরীরের অবস্থা জানতে বুঝি এসেছিস?”

আয়াত দাদীকে বিছানায় বসিয়ে বলল, “উহু শুধু এই বিষয়ের জন্যে নয়, তোমার সাথে গল্প করতেও এসেছি। দাদী আহ্লাদী স্বরে বলল, ” বাহ তাই নাকি?”

আয়াতও আহ্লাদী স্বরে উত্তর দিল,”হুম।”

দাদীর সাথে একসাথে বসে গল্পে মেতে উঠলো তারা দুইজন। মাঝ দিয়ে আবার দাদীর একটু কাশি শুরু হয়েছিল, আসলে বয়সের ভারে বর্তমানে যা একটু হয় সেটাই। তবুও আজও দিলারা জাহান অনেক শক্তিশালী বলা যায়। এখন সেটা মানসিকভাবে হোক অথবা শারীরিকভাবে। আয়াত কথার মাঝেই দাদীকে প্রশ্ন করে বসল,
“আচ্ছা দাদী কিছু মনে করবে না তো যদি আমি একটা প্রশ্ন করি?”

“কি প্রশ্ন?”

একটা প্রশ্ন বিয়ের প্রথম দিন থেকেই আয়াতের মনে বারবার উঁকি দিয়ে চলেছে। সেই প্রশ্নটাই আজ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। দাদীকে নিশ্চয়তার জন্যে প্রশ্ন করল,
“তুমি সত্য এবং সঠিক উত্তর দিবে তো?”

দাদী জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কি এমন প্রশ্ন করবি রে?”

আয়াত বলল, “আগে বলো বলবা আমায় আমি যেটা প্রশ্ন করব?”

দাদী আয়াতের চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল,
ঠিক আছে। ইনশাআল্লাহ আমি চেষ্টা করব।”

আয়াত খুশি হয়ে গেল দাদীর উত্তরে। মনে এক আশার রেশ জাগলো সে আজ তার প্রশ্নের উত্তর সে পাবে। দাদী তাড়া দিয়ে বললেন,
“কিরে বল তোর কি প্রশ্ন?”

আয়াত সোজাসাপ্টা এবার প্রশ্ন করল,
“আদ্রাফের বাবা মা কোথায় দাদী?”

দাদীর নিষ্পাপ মুখখানায় অতিশয় যেন কালো ছায়া দিয়ে ঢেকে গেল। ছলছল করে উঠল নয়নজোড়। তবে আয়াতের মাথায় বিলি কাটা বন্ধ হলো না। সেভাবেই সে বলতে লাগলো,
“আদ্রাফ যখন খুব ছোট তখন ওর বাবা ওর মাকে মানে আমার বউমাকে তাড়িয়ে দেয়। তখন আমার বউমা জোর করে আদ্রাফকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। আদ্রাফ তবে খুব ছোট ছিল রে, তাই সে বাবা মায়ের মধ্যকার বিরোধ বুঝতে পারেনি। রোজ আদ্রাফের বাবা বউমাকে মারধর করত, বাসা থেকে বের করে দিতে চাইতো। তবে বউমা আমার দাঁত কাঁমড়ে এই সংসারেই পড়ে থাকতো। আমাদের তো কম ছিল না রে, তবুও আমার ছেলেটার বউমার সম্পত্তির প্রতি লোভ ছিল। এই সম্পত্তিই সব বিরোধের সৃষ্টি করে। আদ্রাফ রোজ রাতে ঘুমের মধ্যে ঘোরে বাড়ির সদর দরজার সামনে চলে যেতো। হয়তো বেচারা আমার নাতি স্বপ্নে দেখতো যে তার মা কে তার বাবা তাড়িয়ে দিচ্ছে। এরপর তো বললাম বউমা আদ্রাফকে নিয়ে চলে যায়। আমি বারবার আমার ছেলেকে বোঝাতাম যে দেখ আমার বউমা আর নাতিকে ফিরিয়ে আন। আমার বাড়িটা শূন্য শূন্য লাগে রে। আমার ঘরের লক্ষীকে তুই কেন তাড়িয়ে দিলি? আমার ছেলের এক কথা ছিল, যদি তোমার বউমা ওর বাবার বাড়ির সম্পত্তি না নিয়ে এ বাড়িতে ফিরে আসে তবে ওর লাশ এই বাড়ির বাগানে পড়বে। সবার মঙ্গলের জন্যে তাই আমিও চুপ করে যেতাম। এভাবে সময় যেতে থাকে। আমার ছেলে অন্য একটা মেয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ে সময়ের প্রবাহে। মেয়েটা তাকে বিয়ের জন্যে চাপ দিতে থাকে। তাই আমার ছেলে আমার বউমাকে তালাক দিয়ে দেয় এবং আইনের সাহায্যে আদ্রাফকে জোড় করে নিজের দখলে নিয়ে আসে। বউমা নিজের ছেলেকে ছাড়া থাকতে চাইনি। আমার ছেলেটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল রে। সে বউমাকে হুমকি দেয় যে সে যদি আদ্রাফকে দেখতেও এখানে আসে তবে আদ্রাফের লাশ পড়বে বউমার সামনে। ”

বলতে বলতে কাঁদতে থাকেন দিলারা জাহান। অশ্রুসিক্ত হচ্ছে আয়াতও। দাদী আবার আয়াতকে বলতে থাকেন,
“আমার বউমা তার পেটের চেলে আদ্রাফ বিহীন মূহুর্তগুলো সইতে পারেনি রে। একদিন ঘুমের মধ্যে সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।”

স্তব্ধ হয়ে যায় আয়াত এটা শুনে। বিলি কাঁটা থামিয়ে নিজের চোখের জল মুছে নেন দিলারা জাহান। আয়াত চিন্তা করতে থাকে সমাজের এই হিংস্র পুরুষদের কথা। যাদের কারণে আজও মেয়েরা নিজে সম্মানের সহিত বাঁচতে পারেনি। ঘৃণা হয় আয়াতের সেই শাসক পুরুষদের প্রতি। যার মধ্যে আদ্রাফের বাবা একজন। আদ্রাফও তো তারই রক্ত, তারই অংশ। তবুও দুইজনের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। ফুঁস করে এক শ্বাস ছাড়ে সে। দাদী কাতর স্বরে আয়াতকে প্রশ্ন করে,
“কিরে বাকিটুকু শুনবি না?”

“শুনব আমি।”

দাদী বলতে থাকেন, “নিজে নতুন একটা বিয়ে করে সেই মেয়েকে নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাবে বলে উদ্দেশ্য নেয়। আদ্রাফ সারারাত কাঁদতো জানিস যে আমার মা কই, আমার মা কই। আমি বলতাম, তোর মা একটু বেড়াতে গিয়েছে। ওকে সামলাতে যে কতোটা বেগ পেতে হতো তা আমি জানি। না খেয়ে থাকতো আদ্রাফ, রোজ বাড়ির সদর দরজার সামনেই বসে থাকতো। অপেক্ষা করত কখন ওর মা আসবে ওর সামনে। কখন ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলবে এইতো বাবা আর ভয় নেই, তোমার মা এসে গিয়েছে। এই অপেক্ষায় সবসময়ই থাকতো আদ্রাফ। তার থেকে যে তার মাকে আলাদা করে দিল তার বাবা চিরদিনের জন্যে। সত্যি বউমা এর মৃত্যুর জন্যে আমার ছেলেই দোষী। সময়ের গতির সাথে আদ্রাফেরও বুঝ হতে শুরু করে। আর আমার ছেলে, সে তার ছেলের দিকে তো ফিরেও তাকায় না। আদ্রাফের সব দায়িত্ব আমার ছিল, সে শুধু টাকা দিত। পরবর্তীতে নতুন বউকে নিয়ে যখন সে বিদেশে যাবে বলে ঠিক করে সেদিন এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় তারা দুইজনেই ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট করে মারা যায়।”

আয়াত কিছুটা তৃপ্তির হাসি নিয়ে বলল,
“যে যার যার পাপকর্মের শাস্তি পেয়েছে।

তারপর আবার আফসোস নিয়ে বলল,
” মাঝ দিয়ে আদ্রাফ আর তোমার কষ্ট হয়েছে। আর কষ্ট ভোগ করেছেন আদ্রাফের মা।”

আদ্রাফের দাদী অশ্রুসিক্ত নয়নে আয়াতের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আর দেখ না আমি আর আদ্রাফ আমাদের প্রিয়জনদের হারালাম এর মাধ্যমে। ”

কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। পুরোনো কষ্টের স্মৃতি যেন বাধনছাড়া হয়ে নিজের প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেছে। আয়াত জড়িয়ে ধরলেন দাদী দিলারা জাহানকে। মনে মনে ভাবতে লাগলো সে,
“হয়তো কষ্ট আমাদের পিছুই ছাড়েনি। একা আমিই কষ্টে কাটাইনি, আদ্রাফ আর দাদীও অনেক কষ্ট পেয়েছে। এমনকি এখনও আদ্রাফ কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে, নিজের জীবন দিয়ে। হতভাগা আমি শেষ চেষ্টা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না আমাদের জন্যে। আল্লাহর কাছে হয়তো আদ্রাফ এখন খুবই প্রিয় তাই আদ্রাফকে নিজের কাছেই নিয়ে নিবেন তিনি।”

#চলবে

#হ্লুদ_বসন্ত
#পর্ব_১৬ (বোনাস)
#Eshika_Khanom

নদীর ধারে বসে রয়েছে নুহাশ। তার মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে হাজারো চিন্তা ভাবনা। প্রেমদিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে হাজারো ভালোবাসা। ফুলের প্রস্ফুটনের সাথে তাল মিলিয়ে প্রস্ফুটিত হচ্ছে নতুন প্রেম। নৌকায় নৌকায় ভালোবাসার জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে কিছু ভালোবাসার মানুষ। আবার পরিবারের সাথে হাঁটতে বেরিয়েছে অনেকেই। একলা একলা অনেকের সেই মূল্যবান মূহুর্তের সাক্ষী হয়ে থাকছে নুহাশ। তপ্ত বেলায় স্মরণ করছে নিজের বন্ধুর কথা। জানা নেই আর কয়টা দিন সে তার বন্ধুর সাথে থাকতে পারবে। মরণ ছাড়া তো আদ্রাফের সকল কষ্ট থেকে মুক্তির আর কোনো পথ নেই। প্রেমিক প্রেমিকাদের দেখলে আগে খেয়াল আসতো আয়াতের। আর এখন সব কিছু শুধরে নিয়েছে নুহাশ, নিজেকে শুধরে ফেলেছে। নিজের প্রবৃত্তির সাথে যুদ্ধ করে জিতে গিয়েছে সে। পণ করেহে নুহাশ, আয়াতের প্রতি কোনো কিছু সে অনুভব করলেও সেটা পূর্ণতা পেতে দিবেনা নুহাশ। নিকের সিদ্ধান্তে ইনশাআল্লাহ সর্বদাই অটল থাকবে সে।

জ্যাকেটের পকেটে হাত গুজে নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে যেতে থাকল নুহাশ। শীতের আমেজে ভালোবাসাও জমে উঠেছে যেন অনেকের। আবার সামনে আসছে নতুন বছর। নুহাশের কাছে যে পরিবেশে কিছুটা বিরহ বিরাজমান, সেই পরিবেশই কারো কারো কাছে আনন্দের। সময় একেকজনের কাছে একেক রুপে রয়েছে। একটি বাচ্চা ছেলে আর বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে আসছে সেই নদীর ধার দিয়ে। দেখে মনে হয় ছেলেটা আট বছর বয়সী এবং মেয়েটা ছয় বছর বয়সী। তারা পরিবেশটাকে মাতিয়ে তুলেছে। অনেকক্ষণ ধরেই তাদের দুষ্টুমি পর্যবেক্ষণ করছে নুহাশ। মাঝে মাঝে তাদের কীর্তির জন্যে হেসেও উঠছে। শুধু নুহাশ একা নয়, উপস্তিত অনেকেরই নজর কাড়ছে সেই বাচ্চা দুইটি। দৌড়াতে দৌড়াতে বাচ্চা মেয়েটি অসাবধানতায় নুহাশের সাথে ধাক্কা খেলো। মেয়েটা পড়ে যেতে নিলে ধরে তাকে নুহাশ। বাচ্চা ছেলেটা তখন তার দিকে তেড়ে এসে তার এক ঝুটি হালকা টান মেরে বলল,
“কীরে বসন্ত? দেখে দৌড়াতে পারিস না? এখনি তো ব্যথা পেতি যদি আংকেল তোকে না ধরত।”

ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো সেই মেয়েটি। প্রতিবাদী স্বরে বলল,
“তাই বলে আমায় মারবে তুমি?”

“ভুল করলে একশবার মারবো।” এটা বলেই আবার বাচ্চা ছেলেটা মেয়েটার ঝুটি ধরে টান দিল। এবার হালকা কেঁদে দিল মেয়েটি। ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল ছেলেটি মেয়েটির চোখের জল দেখে। নু্হাশ এদের কাজ দেখে হেসে দিল। তবে একটি বিষয় নুহাশের নজর এড়ালো না, ছেলেটা দেখতে একদম ছোটবেলার আদ্রাফের মতো। আর মেয়েটার সাথেও কিছুটা আয়াতের মিল রয়েছে। বাচ্চা ছেলে ও মেয়েটা নিজেদের মধ্যেই ব্যস্ত। ছেলেটা তখন মেয়েটাকে বল,
“আংকেল তোকে বাঁচিয়েছে, চল আমি আর তুই আংকেলকে থ্যাংক ইউ বলি।”

সম্মতি দিল মেয়েটি। দুজনেই একসাথে বলল,
“থ্যাংক ইউ আংকেল।”

নুহাশ হালকা হেসে দুই হাত দিয়ে একই সাথে দুইজনের গাল টেনে বলল, “ওয়েলকাম। আচ্ছা তোমাদের নাম কি?”

ছেলেটা ঝটপট বললো, “আদ্রাফ।”

চমকে গেল নুহাশ। তখনই মেয়েটা উত্তর দিল,
“আর আংকেল আমার নাম হলো আয়াত।”

বেশ বড় ধরণের শক খেলো নুহাশ। এতোটা মিল দেখে অবাক না হয়েও উপায় নেই। আদ্রাফ বাচ্চা আয়াতের হাত ধরে বলল,
“আচ্ছা চল যাই আমরা।”

বাচ্চা মেয়েটাও সম্মতি দিল। একে অপরের হাত ধরে তারা সেই জায়গা থেকে প্রস্থান করল। কিন্তু তখনও নুহাশ অবাক হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই।
.
.
.

জায়নামাজ বিছিয়ে সেখানে বসে দোয়া করছিল আদ্রাফ।হঠাৎ খুব বেশি পরিমাণেই কাশি শুরু হল তার। মুখ চেপে কাশতে লাগলো সে। নার্স দুইজন বিশেষ কাজে একটু বাহিরে। আদ্রাফ বসা থেকে উঠে দৌড়ে চলে গেল ওয়াশরুমে। মুখে বিদ্যমান শ্লেষা ফেলে দিল বেসিনে। তবে বেসিনে শ্লেষার বিপরীতে যা দেখলো তা দেখে অনেকটা ভয় পেয়ে গেলো সে। বেসিনে দেখা যাচ্ছে তাজা রক্ত। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে বেসিনটা পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নিজের মুখটাও ধুয়ে নিল সে। ফোনের রিংটোনের শব্দ পেলো আদ্রাফ। রুমে গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো ডক্টর ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করেই প্রথমে সালাম দিল সে। ডক্টরও সালামের জবাব দিলেন। তারা কিছু সময় নিজেদের মধ্যে কুশলাদি বিনিময় করলেন। অতঃপর ডক্টর আদ্রাফকে বললেন,
“আদ্রাফ তোমার স্ত্রী এসেছিল আমার কাছে।”

কথাটা বেশ স্বাভাবিকভাবেই নিল আদ্রাফ। তবুও প্রশ্ন করল, “কিসের জন্যে? ”

ডক্টর বললেন, “তোমার রোগের প্রতিকারের জন্যে।”

“তারপর?”

“এইডসের যে ভ্যাক্সিন ট্রায়াল করা হয়েছিল সেটা নিয়েই কথা বলল। প্রশ্ন করেছিল যত খরচই হোক সেটার মধ্যে তোমাকে সুস্থ করা যায় নাকি?”

হাসলো আদ্রাফ। তবে সে হাসির মধ্যেও অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আদ্রাফ প্রশ্ন করল,
“ওকে সব বলেননি? ”

ডক্টর বললেন, “আমি বলেছি তুমি এখন লাস্ট স্টেজে আছো। ভ্যাক্সিন দিলেও তোমার সুস্থ হওয়াটা অনিশ্চিত। আর সেই ভ্যাক্সিন ট্রায়াল দেওয়া হয়েছে শুধু, তাই সরকার অনুমোদিত নয়। তাই সেই ভ্যাক্সিন লাখ লাখ টাকার বিনিময়েও আদ্রাফকে দেওয়া যাবেনা।”

তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে আদ্রাফ বলল, “এরপর কি করলো আয়াত?”

ডক্টর বললেন, “কথাটা শুনে মেয়েটা খুবই আশাহত হয়েছে। শেষ একটা আশা নিয়ে সে এখানে এসেছিল। তবে আর কিছুই করার নেই।”

বুকটা ধক করে কেঁপে উঠলো আদ্রাফের। তার মনে হলো আয়াত অনেক কেঁদেছে। ডক্টরকে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে।”

ডক্টর প্রশ্ন করলেন,
“তোমার শরীরের কি অবস্থা?”

“পরে জানাবো,” এটা বলেই আদ্রাফ ফটাফট ফোন রেখে চলে গেল আয়াতের কাছে। গিয়ে দেখলো মেয়েটা হাঁটু মুড়ে সেখানে মাথা গুজে বসে রয়েছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল আদ্রাফ তার দিকে। এক হাত দিয়ে আয়াতকে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে নিল। হঠাৎ কারো স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলেও আয়াত বুঝতে পারলো আদ্রাফ এসেছে। চুপটি মেরে আদ্রাফের বুকের মুখ লুকালো। আদ্রাফ সেভাবেই আয়াতের চোখের জল মুছিয়ে দিল। আদ্রাফ বলল,
“কি হলো আর তোমার ডক্টরের কাছে গিয়ে? আর এখন বসে বসে কাঁদছে এখন ম্যাডাম। খালি ঢং করে।”

আয়াত কান্না করে দিল আরও বেশি। আদ্রাফের চেষ্টা বিফল হলো। আয়াতের ধ্যান অন্যদিকে সরাতে চেয়েও পারলো না। আয়াত বলল,
“ভাগ্য কেন এতোটা নিষ্ঠুর আদ্রাফ?”

আদ্রাফ উত্তর খুঁজে পেল না কোনো। আয়াত আবারও বলল,
“আল্লাহ এতোটা কঠোর না হলে কি হতো না? আমাদের এতো শাস্তি না দিলে কি হতো না?”

আদ্রাফ আয়াতকে স্বান্তনা দিয়ে বলল,
“নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী। এর মধ্যেও হয়তো ভালো কিছু নিহিত রয়েছে। তাই হতাশ হয়ো না। ”

“কিসের ভালো? আপনাকে পেয়েও পেলাম না আমি এটা ভালো?”

“আল্লাহই জানে আয়াত। আচ্ছা এখন কান্না বন্ধ করে আমার বুকে একটু মাথা রেখে বসে থাকো তো।”

এরপর আদ্রাফ অশ্রুসিক্ত নয়নে আয়াতের দিকে তাকিয়ে তার দুই গালে হাত ডুবিয়ে বলল,
“দেখ আমি তো আর কয়েকদিনই আছে। এখন তুমি যদি এভাবে কাঁদয়ে থাকো তাহলে কিন্তু আমার কষ্ট নিয়েই কবরে যেতে হবে। তুমি কি চাও আমি অশান্তিতে মরি?”

আরও কেঁদে দিল আয়াত। আদ্রাফও আয়াতকে নিজের মাঝে লুকিয়ে নিয়ে কাঁদতে লাগলো। সত্যি বিধাতা দুইটি ভালোবাসাকে এতো কষ্ট না দিলেই কি হতো না? তাদের কষ্ট দেখে গাছের পাতায় জমে থাকা শিশিরও সহ্য করতে না পেরে মাটিতে পরে মিলিয়ে গেল। সময়টা যেন সেভাবেই থমকে গেল নিশ্চুপ ভালোবাসার বিনিময়ের মাধ্যমে।

অনেক সময় পার হয়ে গিয়েছে। এখনও আদ্রাফের বুকেই মাথা রেখে বসে রয়েছে আয়াত। এতোক্ষণ হালকা কাশি আসছিল আদ্রাফের। তবুও নিজেকে সামলে নিয়েছিল সে। তবে এখন আর পারছেনা আদ্রাফ। কাশির পরিমাণ বেরে গেল। আয়াতকে ছেড়ে দিয়ে মুখে হাত দিয়ে কাশতে লাগলো আদ্রাফ। ব্যস্ত হয়ে আয়াতের আদ্রাফের দিকে পানি এগিয়ে দিল। আদ্রাফ মুখ থেকে হাত সরিয়ে অন্য হাত দিয়ে আয়াতের থেকে পানি নিল। তবে খেয়াল করল না তার অপর হাতে রক্ত লেগে রয়েছে। আদ্রাফের হাতে রক্ত দেখে থমকে গেল আয়াত।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here