হলুদ_বসন্ত,পর্ব_০৩
Eshika_Khanom
“তোর কি বরকে সাথে নিয়ে আসার মুরদ নাই?”
এটা বলেই দাদী হেসে দিলেন। প্রশ্নটা শুনে কিছু সময়ের জন্যে ভয় পেয়ে গিয়েছিল আয়াত। দাদী হাসতে হাসতে আয়াতের গালে হাত রেখে বললেন,
“ভয় পাস নাকি আমার নাতিরে?”
প্রশ্নটা আয়াতের মনে খুব ভালোভাবে গেঁথে গেল। নিজেকে মনে মনে নিজেই প্রশ্ন করে বসল, আচ্ছা সত্যিই কি সে আদ্রাফকে ভয় পায়? পেলেও কতটুকু পায়?
আদ্রাফের দাদী দিলারা জাহান আয়াতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। বুঝলেন আয়াত কিছু একটা চিন্তা করছে। দাদী আয়াতের কপালে একটা টোকা দিলেন। কেঁপে উঠলো আয়াত, ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইল সে। দাদী প্রশ্ন করলেন,
“কি সতীন এখনই বরকে মিস করছিস?”
লজ্জা পেল আয়াত। কোথা থেকে লজ্জাটা তার মধ্যে ভর করল সে জানে না। দাদী হাসিমুখে বললেন,
“থাক থাক তোর লাল হয়ে যাওয়া গাল দেখে আমি আমার উত্তর পেয়ে গিয়েছি।”
আয়াত নিজের গালে হাত দিল। কি বলছেন এসব দাদী? আয়াতের মাথায় গোলমাল পাকিয়ে গেল। আদ্রাফের দাদী আয়াতের কাণ্ড দেখে খিলখিল করে আবার হেঁসে উঠলেন। বললেন,
“হয়েছে আর কিছু ভাবতে হবে না। বেশি চিন্তা করলে আমার মতো চুল পেকে যাবে। এজন্যই তো আমার নাতি আমায় ছেড়ে দিয়ে একটা সতীন এনেছ্র আমার জন্যে। আবার এই সতীন আমার সাথে কথাও বলে না।”
আয়াত হেসে দিল। বলল,
“দাদী আপনার চুল পাকা হলেও আপনি অনেক মিষ্টি। ”
“তাই নাকি?”
আয়াত বলল, “হুম তাই। এতো কিউট আপনি যে এখনো আপনাকে পাওয়ার জন্যে আপনার পিছনে ছেলেরা লাইন ধরে থাকবে।”
দাদী মুখ বাকিয়ে বললেন,
“তাহলে তোর বর তোকে বিয়ে করল কেন? আমার পিছন ছেড়ে দিল কেন?”
“কে বলেছে আমি তোমার পিছু ছেড়েছি?” দরজার বাহির থেকে প্রশ্ন করল আদ্রাফ।
আয়াত আর আদ্রাফের দাদী দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো আদ্রাফ এসেছে। আয়াত কেন যেন মুখ ঘুরিয়ে নিল। আদ্রাফ খেয়াল করল ব্যপারটা, তবে বিষয়টা স্বাভাবিকই নিল। বাঁধ সাধলেন আদ্রাফের দাদী। বললেন,
“সতীন দেখি আমার আদ্রাফের দিকে তাকিয়েও দেখে না। এই আদ্রাফ তুই এদিকে আয় তো।”
আদ্রাফের একটু সংকোচ হলো। পরে দাদী মন খারাপ করতে পারে এই চিন্তা করে দাদীর সামনে এলো। তখন দাদী বলল,
“এই আমার বালিশের নিচে যে আলমারির চাবি থাকেনা? ওইটা আমায় এনে দে।”
আদ্রাফ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। দাদীর বিছানার সামনে গিয়ে বালিশে হাত দিল। হাত দিতেও তার কিছুটা সংকোচ হয়েছিল। তবুই বালিশটি সরিয়ে আলমারির চাবির ছড়াটা এনে দাদীর হাতে দেওয়ার জন্যে উদ্যত হলো। তখনই দিলারা জাহান বাধা দিয়ে বলল,
“এই আমায় দিতে হবেনা। এই পা ব্যথা নিয়ে বারবার উঠতে পারিনা রে। তুই আমার সিন্দুক থেকে নীল রঙা গয়নার বাক্সটা বের কর।
আয়াত সবকিছু চুপ করে শুনলেও দাদীর কথাটার মানে বুঝতে পেরে অবাক চোখে আবার দাদীর দিকে তাকালো। বলল,
” দাদী!”
আদ্রাফের দাদী এক ভ্রু কুচকে আয়াতের দিকে তাকালো। তারপর আদ্রাফকে বলল,
“কেমন সতীন আনলি রে আদ্রাফ? মাঝে মাঝে কথাই বলে না, আবার যখন কথা বলে তখন বেশিই বলে ফেলে।”
আয়াতের অপরাধবোধ হলো। আদ্রাফ আয়াতকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“দাদী যেটা বলছে সেটা শুনো। এতো চিন্তা করো না তুমি।”
আদ্রাফ আলমারির সিন্দুক খুলে একটি বড় নীল রঙের গয়নার বাক্স বের করল। তারপর সেটি দাদীর হাতে দিয়ে বলল,
“নাও ড্রামাকুইন”
আদ্রাফের দাদী বাক্সটা খুলে আয়াতের সামনে ধরলো। আয়াত দেখতে পেল অনেক ভারী ভারী পুরনো ডিজাইনের গয়না। আদ্রাফের দাদী আয়াতের এক হাত ধরে বলল,
“সতীন তোর হয়তো ভালো নাও লাগতে পারে এই গয়নাগুলো। একটু পুরোনা তো। চিন্তা নাই তোকে আদ্রাফ নতুন গয়নাও গড়িয়ে দিবে। কিন্তু এটা তুই রাখ।”
আয়াতের অজান্তেই তার চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আদ্রাফের দাদী ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,
“কীরে মেয়ে কাঁদিস কেন?”
আয়াত বলল, “এতোকিছুর ভার কিভাবে বইবো দাদী?”
আদ্রাফের দাদী আয়াতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“মেয়েরা হলো তরলের মতো। যে পাত্রে রাখবে সেই আকারই ধারণ করবে। তুইও সব পারবি, চিন্তা করিস না। আছি তো আমি যে কয়দিন আছি। আর এরপর তো আদ্রাফ আছেই তোর সঙ্গে, তাইনা আদ্রাফ?”
আদ্রাফের হৃদয়টা হাহাকার করে উঠলো। আয়াতের মনে প্রশ্ন জাগলো,
সত্যিই কি সে আছে আমার সঙ্গে?” পরক্ষণেই আবার ভাবলো, “সে থাকলেও কি? না থাকলেও কি? এমনিতেই তার যে রোগ, মরণ তার সন্নিকটে। পাশে থাকবেই বা কি করে?”
আদ্রাফের দাদী দুইজনের দিকেই একবার করে চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর বললেন,
“আমি ভুল তো কিছু বলিনি আমার মনে হয়। কি আদ্রাফ, কিরে সতীন কিছু হয়েছে?”
আদ্রাফ বললো,” কি আর হবে? পা দুটো খুব ব্যথা করছে এই আরকি।”
“তাহলে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কয়েকদিন ধরে দেখি তুই আমার ধারেকাছেই থাকিস না?”
” সে অনেক কথা, পরে বলি।”
“আচ্ছা তাহলে আমার সতীনকে এই গয়নাগুলো পড়িয়ে দেখা তো! আমি মনপ্রাণ জুড়িয়ে তোদের দেখি।”
আয়াত আরও অস্বস্তিতে পরে গেল। আদ্রাফ রেহাই পেতে বললো,
“দাদী তুমি জানো এই গয়নার মারপ্যাঁচ আমি কিছুই বুঝিনা। তার চেয়ে বরং তুমিই পড়িয়ে দাও ওকে৷ আমি দেখি।”
“আদ্রাফ আর একটা কথাও না। যেটা বলেছি সেটা কর।” আদেশের সুরে বললেন দাদী।
আদ্রাফ করুণ চোখে আয়াতের দিকে তাকালো। আদ্রাফ কারো বেশি কাছেই যেতে চাইছে না। ওর ভয় হয় যদি ওর থেকে কারও এই রোগ আবার হয়ে যায়? নিজে যেভাবে এবার জীবন দিয়ে ভুগছে, অন্য কেউ সে কষ্টের সম্মুখীন হোক তা সে চায়না। আয়াতের বোধগম্য হলো আদাফের চাহুনী। বুঝতে পারলো আদ্রাফের কেন এতো সংকোচ। নিজে বসা থেকে উঠে গেল আয়াত। আদ্রাফের সামনে এসে দাঁড়ালো আয়াত। আদ্রাফের হাত গয়নার বাক্স দিয়ে বলল,
“এখানে থেকে গয়না গুলো নিয়ে আমায় পড়িয়ে দিন।”
অবাক হলো আদ্রাফ। তার নয়নযুগলে সৃষ্টি হলো হাজারো প্রশ্ন। তবে আয়াত বুঝতে পেরে দুইটি বাক্যেই সমাধান দিয়ে দিল। আয়াত আদ্রাফের কানের সামনে একটু এগিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
“ভয় নেই, রোগটা তো ছোয়াচে নয় যে আমারও হয়ে যাবে। আপনি শুধু শুধু বেশিই ভয় পেয়ে আছেন, চিন্তা নেই।”
আদ্রাফ এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো আয়াতের দিকে। আয়াত বিনিময়ে একটা মুচকি হাসি আদ্রাফকে উপহার দিল। ইশারা করে বলল, পড়িয়ে দিন নাহলে দাদী কষ্ট পাবে। হালকা মাথা নাড়িয়ে আয়াতের ইশারায় সম্মতি দিল আদ্রাফ। একে একে অনেকগুলো গয়না আয়াতকে পড়িয়ে দিল। হাঁপিয়ে উঠল দুজনেই। একজন গয়না গায়ে দিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে, আর একজন পড়িয়ে। দুজনেই একসাথে বলল,
“আর না দাদী।”
দুইজনকে চোখ ভরে দেখলো দিলারা জাহান।
.
.
.
“শীতের এই শেষ মূহুর্তের আবহাওয়াটা দারুন তাইনা আয়াত?” বাগানে হাঁটতে হাঁটতে আয়াতকে প্রশ্ন করল আদ্রাফ। তবে বিনিময়ে উত্তর পেল, “হুম।”
আদ্রাফ বললো, “আমার দাদী মতো এবার আমারও বলতে ইচ্ছে করছে যে তুমি কথা বলতে পারেননা।”
আয়াত ভ্রু কুচকে আদ্রাফের দিকে তাকালো। আদ্রাফ তখন দুই হাতের শাহাদাত আঙুল দুইটি উঠিয়ে বলল,
“এইযে খালি একেক রকম এক্সপ্রেশন দিবে, কিন্তু কোনো কথা বলবেই না।”
আয়াত রেগে বলল, “তো আমি কি এখন মাইক নিয়ে গান বকবক শুরু করব?”
আদ্রাফ বললো, “করতেই পারেন, জীবনের শেষ মূহুর্ত আমার বন্ধুর বকবক শুনেই নাহয় কাটাই।”
আয়াত চুপ করে গেল। কোনো এক গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। আদ্রাফ বলতে লাগলো,
“আচ্ছা আয়াত, সত্যিই তো এইডদ রোগ এমনি সবাত একটু সান্নিধ্যে থাকলে ছড়াবে না তাইনা?”
আয়াত উত্তর দিল না। আদ্রাফ জোরে ডাক দিয়ে বলল,
“এই আয়াত, শুনতে পেলে না?”
আয়াত চমকিয়ে উঠল। তারপর বললো, “শুনেছি তো৷ মাথায় রাখুন এইডস রোগ ছোয়াচে নয়। তাই সবার থেকে দূরে থাকতে হবেনা। কাছে থাকলেও কিছু হবেনা। চিন্তা নেই।”
আদ্রাফ বললো, “জানো আয়াত, জীবনের শেষ অংশটুকু সবার সাথেই হাসিখুশি হয়ে কাঁটাতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু সে বলল, তুই যার কাছেই যাবি যার কাছাকাছি থাকবি সেই তোর রোগ পেয়ে যাবে। তাই সবার থেকে দূরে থাকা। কিন্তু তোমার কথায় বিশ্বাস করলাম। তোমার চোখে মিথ্যা দেখতে পাইনি। তুমি যেহেতু বলেছ, তাহলে এখন থেকে যে কয়দিন বাঁচি সবার কাছাকাছিই থাকব। ইনজয় করবো।”
আয়াত তখনই আদ্রাফের কথার মাঝে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠল,
“আমি বাবার সাথে দেখা করবো!”
#চলবে
[অনেকেরই কথা আমি গল্পের মাধ্যমে এইডস সম্পর্কে ভুল ধারণা প্রকাশ করছি। আপনাদের মতামত আপনারা প্রকাশ করেছেন, ধৈর্য্য সহকারে গল্পের পুর্বের ২টা পর্ব পড়েছেন আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আশা করি গল্পের শেষ পর্যন্তই আমার পাশে থাকবেন, সাপোর্ট করবেন আমায়। আদ্রাফের ভয় হয় সে কারো কাছাকাছি থাকলেই সেও এইডস আক্রান্ত হয়ে যাবে। তবে আজ অন্যের কথা বিশ্বাস না করে নিজের প্রিয় মানুষের কথা বিশ্বাস করে নিয়েছে আর একটা ভুল ধারণা ভেঙ্গে ফেলেছে। ভুলত্রুটি মাফ করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের আশা করছি।]