হলুদ_বসন্ত,পর্ব_০২
Eshika_Khanom
আয়াত ভেবে পেল না কি বলবে। শেষে আদ্রাফকে প্রশ্ন করল,
“আপনার এই রোগটি হলো কিভাবে?”
আদ্রাফ শান্তস্বরে বলল, “প্লিজ এই প্রশ্নটা বাদে অন্য কিছু বলো।”
আয়াত আর কিছু বলল না। চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে বাগানের ফুল গাছগুলোর দিকে চলে গেল। সদ্য ফোঁটা বেলীফুল গুলো তীব্র আকর্ষণ করছে তাকে। একই সময়ে আদ্রাফের চোখে বন্দী হয়ে গেল এক স্নিগ্ধ যুবতী। সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের চেয়েও আবেদনময়ী লাগছে তাকে। বেলীফুলের গাছগুলো যেমন আয়াতকে আকর্ষণ করছে ঠিক তেমনই আদ্রাফকে তীব্র ভাবে আকর্ষণ করছে আয়াত তার অজান্তেই। চোখ সরিয়ে নিল আদ্রাফ আয়াতের থেকে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“আমি আমার ঘরে যাচ্ছি। তোমার যখন মন চায় নিজের রুমে চলে যেও। আর বাড়ি থেকে এক কদমও পা রাখবেনা বলে দিলাম।”
আদ্রাফের কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো আয়াত। আয়াতের কোনো উত্তর না শুনেই প্রস্থান করল সে। পিছনে ঘুরে আয়াত কিছু বলতে যাবে তখন দেখলো আদ্রাফ সেখানে নেই, চলে গিয়েছে। আবার একটু পরই শুনতে পেল একজন সার্ভেন্টের ডাক।
“ম্যাম আপনার আর স্যারের জন্যে কফি।”
আয়াত তার দিকে তাকিয়ে বলল, “উনি তো চলে গিয়েছে।”
সার্ভেন্টটি বলল, “তাহলে আমি স্যারের কফিটা নিয়ে যাই। এইযে আপনারটা রেখে গেলাম ম্যাম।”
“হুম।”
আয়াতকে কফি দিয়ে আদ্রাফের কফিটি নিয়ে সে চলে গেল। আয়াত আরও কিছুক্ষন মোহমুগ্ধতায় পরিপূর্ণ পরিবেশে বসে রইল।
.
.
.
আদ্রাফের ফোনের রিংটোন অনেকক্ষণ ধরে বেজেই চলেছে। যে কল দিয়েছে ফোনের ওপার থেকে যেন খুবই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে আদ্রাফের সাথে কথা বলার জন্যে। তবে আদ্রাফের তো ফোনটা ধরার নামই নেই। হঠাৎ ফোনে কল আসা বন্ধ হয়ে গেল। ৫-৭ মিনিট অতিবাহিত হল। এরপর পুনরায় শুরু হলো রিংটোনের যুদ্ধ। অনেক সময় পরে যেন খোদা তায়ালা ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তির অপেক্ষা প্রহর শেষ করল। আদ্রাফ এতোক্ষন ওয়াশরুমে থাকায় ফোনের কলটা রিসিভ করতে পারেনি। ফোনটা রিসিভ করার পরই ওপর পাশ থেকে একজন বলল,
“কার সাথে রোম্যান্স করছিলি? এতো সময় লাগে ফোন রিসিভ করতে?
আদ্রাফ হালকা হাসল। অতঃপর আফসোসের সহিত বলল,
” যাকে ভালোবাসি তাকে তো একবারও ছুয়ে দেখা হলো না। রোম্যান্স কিভাবে করব?”
ওপাশে থেকে উত্তর দিল, “আচ্ছা এতো দেরি হলো কেন?”
“আমি ওয়াশরুমে ছিলাম।”
“ওহ তাই বল।”
“হুম নুহাশ।”
ফোনের অপর পাশে থেকে আদ্রাফের বন্ধু নুহাশ বলল,
“আমি বাংলাদেশে আছি। চাইলে দেখা করতে পারে আদ্রাফ ইসলাম আমার সাথে।”
আদ্রাফ উত্তেজিত হয়ে বলল,
“দেশে ফিরেছিস আমায় জানালি না কেন?”
“কোথায় জানায়নি? এইযে জানালাম।”
“এটা তো মাত্র বললি।”
“আগে বললেও তুই এ কথাই আমায় শুনাতি।”
“হয়তো।”
“দেখা করবি কবে? চল আজই কোথাও দেখা করি।”
আদ্রাফ বলল, “হুম এক শর্তে দেখা হবে আমাদের।”
“ছোটবেলার বন্ধুর সাথে দেখা করবি আবার কিসের শর্তে? আচ্ছা যা তাও বল।”
“আমাকে তুই ছুতে পারবি না। আমার থেকে কিছুটা দূরে থাকবি।”
“কেন?”
“দেখা হলেই বলব।”
“আচ্ছা যা ঠিক আছে।”
“হুম।”
আদ্রাফ ফোন কেটে দিল। দরজার অপর পাশ থেকে কেউ নক করায় পিছনে ঘুরে তাকালো। দেখলো তার দাদী এসেছে। আদ্রাফ দূর থেকেই তার দাদীকে বলল,
“দাদী আমার রুমের সামনে কেন আসলে? তোমার যদি কোনো সমস্যা হলে তখন কি করবে তুমি? কাউকে দিয়ে আমায় ডেকে নিতে তাহলেই তো হতো।”
আদ্রাফের দাদী বাহিরে দাঁড়িয়েই বলল
“ওই রোগটা হওয়াতে কি এমন হয়েছে যে নিজেকে গৃহবন্দী বানিয়ে ফেলেছিস তুই?”
আদ্রাফ মুচকি হেসে বলল,
“আরে দাদী তেমন কিছুনা। শুধু আর কিছু ভালো লাগেনা। তুমি তোমার রুমে যাও, আমি আসছি।”
আদ্রাফের দাদী বাহিরে থেকেই আদ্রাফের রুমে হালকা উঁকি মেরে নিল। তারপর হতাশ হয়ে বলল,
“তা আমার সতীন কই রে?”
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল আদ্রাফ তার দাদীর কথা শুনে। প্রশ্নটা বুঝতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো তার। দাদীর কথা শেষে বুঝতে পেরে হালকা সংকোচ নিয়ে বলল,
“দাদী তুমি কি আয়াতের কথা বলছ?”
আদ্রাফের দাদী মুখ ভরা হাসি নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ রে! কই আমার আয়াত সতীন?”
আদ্রাফ উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারলো না। আদ্রাফের দাদী এইডস রোগ এবং এর ঘাতকতা সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত নয়। আদ্রাফ তার দাদীকে জানাতে চায়নি যে সে এইডস রোগে আক্রান্ত। গোপন খবর তো বাতাসে উড়তে উড়তে ছড়ায়। সে সাথে আদ্রাফের এইডস হয়েছে এই খবরটাও কিছু দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের কানে পৌছে গেল। আর তা থেকে খবরটা গেল দাদীর কানে। আদ্রাফ তার দাদীকে সামলাতে তখন তাকে বলেছিল যে এটা তেমন কোনো রোগ নয়। সেরে যাবে জলদিই। আদ্রাফের দাদী তার নাতি আদ্রাফকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করে। আর রোগ সম্পর্কে ধারণা না থাকায় বিশ্বাসটা জলদিই করে ফেলে সে। এবার আব্দারই করে ফেলে নাতিবউ পাওয়ার। দাদীর কথা রাখতে বাধ্য হয়ে তাই নিজের ভালোবাসাকেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয় সে।
আদ্রাফের দাদী আদ্রাফকে আবার ডাক দিয়ে প্রশ্ন করল,
“কিরে কই হারায় গেলি?”
আদ্রাফ বলল, “তুমি তোমার ঘরে যাও, আরামে বস একটু, শান্ত হও, আমি আয়াতকে পাঠাচ্ছি।”
“কই ও?”
আদ্রাফ মিথ্যে বলল। বলল, “ওয়াশরুমে।”
দাদী বলল, “আচ্ছা।”
.
.
.
আয়াত সার্ভেন্টের দেখানো অনুযায়ী একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজা খানিকটা ভেজানো। ভিতরে রকিংচেয়ারে একটা ছাইরঙা পোশাক পড়া মহিলাকে দেখা যাচ্ছে। আয়াত বুঝে নিল ইনিই আদ্রাফের দাদী। কিছুক্ষণ আগে আদ্রাফ একজন সার্ভেন্টকে পাঠায় তার রুমে। সে তাকে জানায় আদ্রাফ তাকে তার দাদীর সাথে দেখা করতে বলেছে। দাদী নাকি তার সাথে দেখা করতে চায়। আয়াতও বাধ্য মেয়ে হয়ে সার্ভেন্টের পিছু পিছু দাদীর ঘরের দিকে যায়। পথিমধ্যে সার্ভেন্টকে প্রশ্ন করে,
“আপনারা সবাই এমন রোবটের মতো কেন?”
সার্ভেন্ট বলল, “স্যারের অসুস্থতার পর এই বাড়িতে যতটুকু প্রাণবন্ততা ছিল সেটাও হারিয়ে গিয়েছে।”
আয়াত চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ কি যেন চিন্তা করে আবার প্রশ্ন করল,
“ওনার বাবা মা কোথায়?”
উত্তর দেয়নি সে। দাদীর ঘরের সামনেই এসে পড়ে তারা। সে সার্ভেন্ট আয়াতকে বলে,
“ভিতরে বড় ম্যাডাম বসে আছেন। আপনি যান, গিয়ে দেখা করুন।”
এই বলে সে চলে যায়। আয়াত রুমের দরজার সামনে যায়। বাকিটুকু সবার জানা। আয়াত কেন যেন ভয় পাচ্ছে আদ্রাফের দাদীর সাথে দেখা করতে। ঘরের ভিতর থেকে আয়নার মধ্যে একটা মেয়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় আদ্রাফের দাদী মিসেস দিলারা জাহান। তিনি বলেন,
“বাহিরে কেন দাঁড়িয়ে আছিস সতীন? ভিতরে আসো।
টাসকি খেয়ে গেল আয়াত। কি বললেন উনি এটা? ধীর পায়ে মাথা নিচু করে ঘরটিতে প্রবেশ করে আয়াত। পুরোনো আমলের বিভিন্ন আসবাবপত্র দ্বারা সুসজ্জিত এই ঘরটি। বেশিরভাগই জমিদারদের ব্যবহার করা আসবাবপত্রের অনুরূপ। ঘরটির ভিতরে কিছুটা প্রবেশ করে আবার স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। দিলারা জাহান আবার বললেন,
” কিরে আমার সামনে আসবি না?”
আয়াত এই কথা শুনে সামনে আসে আদ্রাফের দাদীর। দেখতে পায় পাকা পাকা চুল ও দুধে আলতা গায়ের রঙ নিয়ে একটা বই হাতে রেখে বসে আছেন সে। বুড়ো বয়সেও এতো রুপ! ভাবতেই বারবার অবাক হচ্ছে আয়াত। দিলারা জাহান আয়াতকে একটা সোফা দেখিয়ে আবার বললেন,
“এদিকে বস তো! আমি একটু দেখি তোকে।”
চুপ করে আয়াত আদ্রাফের দাদীর সামনে এসে মাথা নিচু করে বসে। কেমন যেন একটা আজব অঅনূভুতি হচ্ছে তার। কিছুটা লজ্জা গ্রাস করছে তাকে। আদ্রাফের দাদী আয়াতের থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে নেন। সাথে সাথেই বলে উঠেন,
“মাশাল্লাহ!”
এরপর আর কিছু না ভেবেই নিজের গলা থেকে একটা মোটা স্বর্ণের চেইন আয়াতকে পড়িয়ে দিল। আদ্রাফের দাদীর এহেন কাজে আয়াত স্তব্ধ। হা করে তাকিয়ে রইল আয়াত। আদ্রাফের দাদী আয়াতের গালে হাত দিয়ে বলল,
“এখন এটাই দিলাম সতীন। একটু পরে তোকে আরও গয়না দিব। আসলে এখন হাতের কাছে এটা ছিল তাই আরকি।”
আয়াত দাদীর আচরণে অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। দিলারা জামান মুচকি হেসে বললেন,
“কিরে আমি তোকে সতীন বলায় রাগ করলি? নাকি শুধু একটা চেইন দিলাম দেখে মন খারাপ করলি?”
এবার আয়াত যেন কিছু না বললেই নয়! আয়াত বলল,
“বলেন কি দাদী? আপনি যা দিয়েছেন তাই তো অনেক বেশি। আমি কখনোই এসবের আশা করিনি দাদী। আর রইলো সতীনের কথা, আমি একটুও রাগ করিনি বা মন খারাপ করিনি।”
দাদী বললেন, “তাই নাকি? খুব ভালো। তা আদ্রাফ কি করে? তোকে পাঠাতে বললাম বলে কি সে আসতে পারবে না?”
আয়াত মাথা নিচু করে নিল। ফর্মালিটি অনুযায়ী প্রথমে সবকিছু করলেও শেষের কথাটা তার খারাপ লাগায় মন থেকেই দাদীকে উত্তর দিয়েছিল সে। তবে এবার কি বলবে তা ভেবে পেল না আয়াত। মাথা নিচু করে নিল সে। দাদী আবার বললেন,
“তোর কি বরকে সাথে নিয়ে আসার মুরদ নাই?”
#চলবে
[ গল্পটিতে আদ্রাফের ভুল ধারণাটাই প্রকাশ করেছি। এইডস ছোয়াচে রোগ নয়। তবুও আদ্রাফ ভয়ে সবার থেকে দূরে থাকছে। আশা করি এটা নিয়ে আর কারো কোনো সমস্যা নাই। আজ বাহিরে ছিলাম এবিং দ্বিতীয়ত ওয়াইফাই না থাকায় গল্প দিতে দেরি হলো। ভুলত্রুটি মাফ করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের আশা করছি।]