স্বর্নাভ_সুখানুভূতি।( পর্ব-৩২)

#স্বর্নাভ_সুখানুভূতি।( পর্ব-৩২)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

যতক্ষণে জাওয়াদের বোধদয় হলো ততক্ষণে মুশরাফা সিড়িঘরের কাছে চলে গিয়েছে। জাওয়াদ দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে ফেলল। রাগ রাগ স্বরে বলল,
‘ আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি। উত্তর না দিয়ে কোথায় যাচ্ছো?’

মুশরাফা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল। জাওয়াদ হাতের বাধন শক্ত করে বলল,
‘ চুপচাপ আমার সাথে বসবে ওখানে এবং আমার প্রশ্নের উত্তর দিবে। তারপর যাবে। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে যাওয়ার চিন্তাও মাথায় এনো না।’

বলে আগের জায়গায় নিয়ে বসাল। নিজে ও বসল পাশে। মুশরাফার ফুলো মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ এবার বলো, আমার তোমাকে দেখে এত আনন্দ লাগছে কেন?’

‘ জানি না।’ রাগত স্বরে বলল মুশরাফা। জাওয়াদ অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
‘ রাগের বিরুদ্ধে কত কথা শুনালে না তুমি! এখন নিজেই রাগ ঝাড়ছো! ‘

মুশরাফা গম্ভীরমুখে বলল, ‘স্বামী যদি বিপথে থাকে, তাকে পথে আনার জন্য রাগ দেখানো জায়েজ আছে।’
‘পথে না এলে!’
‘আমি আল্লাহকে বলব। আল্লাহ করবেন যা করার।’ ওকে ভয় দেখানোর জন্য বলল মুশরাফা।

জাওয়াদের মুখটা পাংশুটে হয়ে গেল। ও বলল,
‘ কী করতে হবে বলো! আমি করব। তাও আল্লাহর কাছে বিচার দিও না, প্লিজ! আল্লাহ আমার বিচার করতে বসলে আমি পার পাবো না। প্লিজ!’

ওর এই আল্লাহর বিচারে ভয় পাওয়াটা চমৎকার লাগে মুশরাফার। ও অভিমান ভেঙে মুখ টিপে হাসল জাওয়াদের অগোচরে।

তারপর গম্ভীর মুখে বলল,
‘ আপনি আমার সাথে অবিচার করে মেয়েদের সাথে সম্পর্কে লিপ্ত ছিলেন। ব্যাপারটা গুনাহ হওয়া সত্ত্বেও আপনার কোন অনুশোচনা নেই। তারউপর আবার গুনাহে ডুবানো অতীত গর্বের সাথে আমাকে শুনাচ্ছেন। আমি কষ্ট পেয়েছি। স্ত্রীকে কষ্ট দেয়া ও গুনাহ। কতগুলো গুনাহের কাজ করেছেন আপনি! আমি তো আল্লাহর কাছে বলবই। যা করার আল্লাহ করবেন, আমি সব আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছি।’

জাওয়াদের ভয়ের মাত্রা বাড়ল। ওর মুখ একবারে রক্তশূণ্য হয়ে গেল। এই মেয়ে প্রতিনিয়ত কথায় কথায় যে হাদিস ঝাড়ে, আল্লাহর বিধান মানে, তাতে আল্লাহ ওর উপর সন্তুষ্ট হয়ে থাকবেন। এমতাবস্থায় ওর সব দোয়া কবুল হবে। ও যদি এখন কোন বদদোয়া করে, আর তা কবুল হয়ে যায় তবে ওকে তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না। সাংঘাতিক ব্যাপার স্যাপার। জাওয়াদ কোমল স্বরে বলল,
‘ আচ্ছা মানলাম আমি গুনাহের কাজ করেছি। এখন কী করলে আল্লাহ আমাকে মাফ করবেন, তা বলো। আমি তাই করব। কিন্তু তাও তুমি আল্লাহর কাছে বিচার দিও না।’

মুশরাফা গম্ভীরমুখে বলল,
‘ মন থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবেন, তাওবা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল। তিনি তাওবাকারীদের পছন্দ করেন।

আল্লাহর রাসূল বলেন, “তোমাদের কেও মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া উট খুঁজে পেয়ে যতটা খুশি হয়, আল্লাহ তাঁর বান্দার তওবাতে তাঁর চেয়েও বেশি খুশি হন। (সহীহ বুখারী)

আপনি যদি মনে থেকে তাওবা করেন, তবে আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করবেন। সেই সাথে আপনি শপথ করবে, আগামী জীবনে নিজেকে বেগানা মহিলা থেকে দূরে রাখবেন। তাহলেই হবে।’

ব্যাস এতটুকুই! জাওয়াদ অবাক হলো। ও বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইব। এবার বলো, তুমি আমার নামে আল্লাহর কাছে বিচার দিবে না তো!’

চাঁদের আলোয় চকচক করে ধরা পড়েছে জাওয়াদের চেহারার অনুতপ্ততা। যা মুশরাফার মাঝে আনন্দের জোগান দিচ্ছে। ও তীর্যক চোখে পরখ করল কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘দেখা যাক। ‘

জাওয়াদ ওকে আটকানোর চেষ্টা করে বলল, ‘এ্যাই, তুমি আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে যাও। ‘

মুশরাফা থামল না। হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। সোজা রুমে চলে গেল। জাওয়াদ ও পিছু পিছু ঘরে ঢুকল। রুমে গিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। ওর চোখে মুখে চিন্তা।

মুশরাফা ওয়াশরুমে গেল, ফ্রেশ হয়ে এসে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসল। চুল আঁচড়াল। মুখে হাতে পায়ে নাইট ক্রিম মেখে এলো বিছানায়। নিজের দিকটা ঝেড়ে শুয়ে পড়ল।

জাওয়াদ তখনো বসা বিছানায়। আকস্মিক উঠে অযু করে এসে নামাজে দাঁড়াল। মুশরাফা মুখ টিপে হাসল। আজ সেজদায় অনেকক্ষণ কাটাল ও। দুই রাকাত পড়ে সালাম ফিরিয়ে মোনাজাতে ও সময় নিল। মুশরাফা হুট করে উঠে দাঁড়াল। একটা জায়নামাজ নিয়ে নিজেও জাওয়াদের পাশ করে পিছনে দাঁড়াল। জাওয়াদ মোনাজাত শেষ করতেই মুশরাফার অস্তিত্ব টের পেল। তড়িৎ পিছু ফিরে ওকে নামাজে দাঁড়াতে দেখে ভেবে নিল, ওর জন্য বিচার দিতেই নামাজে দাঁড়িয়েছে মেয়েটা।

মুশরাফা সবে জায়নামাজের দোয়া পড়ছিল। নিয়ত বাধার আগেই জাওয়াদ ওর হাত টেনে ওর নামাজ ভেঙে ফেলল। ওকে হাতে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘ তুমি আমার নামে বিচার দিতে যাচ্ছো? তোমাকে নিষেধ করেছি না? ‘

ওর এহেন ভঙিতে মুশরাফার থ বনে গেল। ঘটনা বোধগম্য হতেই পেট ফেটে হাসি আসার জো হলো। কত কষ্টে যে হাসি থামাল। তারপর ভ্রু কুঁচকাল,
‘সরুন। আমাকে নামাজ পড়তে দিন।’

‘না, দিব না। তুমি এখন নামাজ পড়তে পারবে না। এখন চুপচাপ গিয়ে ঘুমাবে।’ হাত চেপে আদেশের সুরে বলল জাওয়াদ।
মুশরাফাও জেদী সুরে বলল,
‘ আমার আল্লাহর সাথে কথা আছে। আমি নামাজে বলব। বাধা দিবেন না।’ মুশরাফা আবার জায়নামাজে দাঁড়াল।

জাওয়াদ হতাশ স্বরে বলল, ‘ কেন এমন করছো বলো তো! আল্লাহ যদি আমাকে দুনিয়ায় শাস্তি দেন তবে আমার সাথে তো তুমি ও ভুক্তভোগী হবে। প্লিজ বদদোয়া দিও না! দেখো আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, তাওবা করছি আর করব না। দয়া করে আমার নামে বিচার দিও না!’ অনুরোধ ঝরে গেল জাওয়াদের স্বরে।

মুশরাফা এবার নরম হলো। মুখ থেকে গম্ভীরতা সরিয়ে ভ্রু নাড়িয়ে কোমল স্বরে বলল,
‘আপনি ভাবলেন কিভাবে, আমি আপনার নামে আল্লাহর কাছে বিচার দিব!’

‘দিবে না!’ আকস্মিক খুশির আভা ছড়াল জাওয়াদের মুখে। মুশরাফা হেসে ফেলল। হেসেই বলল,
‘আপনি চান আমি দিই?’
‘না।’ তড়িৎ উত্তর দিল জাওয়াদ।

মুশরাফা শান্ত স্বরে বলল,
‘ আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি যদি কাউকে কারো জন্য সিজদাহ করার আদেশ করতাম, তাহলে নারীকে আদেশ করতাম, সে যেন তার স্বামীকে সিজদাহ করে।’
(তিরমিযি ১১৫৯)
ইসলামে স্বামীকে একজন স্ত্রীর জন্য একান্ত ব্যক্তিগত এবং অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় পাঠানো হয়েছে। ইসলাম একজন স্ত্রীকে বলেছে, তার স্বামীর চাওয়া পাওয়ার গুরুত্ব দিতে, সম্মান করতে ভালোবাসতে, তার কথা শুনতে। এতসব জানা সত্ত্বেও আমি কিভাবে আপনার চাওয়া পাওয়ার গুরুত্ব না দিতে পারি, যদি তা ইসলাম বিরোধী না হয়? আমি অবশ্যই আপনার ভালো চাই। ‘

জাওয়াদ নিশ্চুপ বসে শুনল সে কথা। তারপর প্রশ্ন করল,
‘তাহলে তুমি নামাজে দাঁড়ালে কেন?’

‘আপনার জন্য দোয়া করতে। আল্লাহকে বলব, আল্লাহ যেন আপনার সব গুনাহ মাফ করে আপনাকে একবারে শুদ্ধ বানিয়ে দেন।’ হেসে বলল মুশরাফা।

কী চমৎকার দোয়া! জাওয়াদ খুশি হলো। খানিক বাদেই ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ তুমি চাইলে এটা নাও করতে পারো। তবে করছো কেন?’

মুশরাফা উৎফুল্ল হয়ে বলল,
‘এতে আমার একটা স্বার্থ আছে। তাই করতে হচ্ছে। ‘

‘কী স্বার্থ!’ আগ্রহী গলায় জিজ্ঞেস করল জাওয়াদ। মুশরাফা খুশিমনে বলল,

‘ দেখুন, আমরা এখন এক। আমি স্বপ্ন দেখি, আমরা একসাথে জান্নাতে যাব। এখন একজন যদি কোন গুনাহের কারণে জান্নাত মিস করে ফেলে, তবে আমার দেখা স্বপ্নটা পূরণ হবে না। আমার স্বপ্নপূরণের জন্য হলেও আমাদের দুজনকে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এই জন্যই আমি আল্লাহর কাছে আমার সাথে সাথে আপনার জন্য ও দোয়া করতে চাইছি। ‘

এত সুন্দর স্বার্থ! এত মঙ্গলকর স্বার্থ ইতঃপূর্বে দেখেনি জাওয়াদ। ও স্থবির হয়ে চাইল স্ত্রীর পানে। ওর চোখে মুগ্ধতা। আকস্মিক দিক বিগলিত হয়ে মুশরাফাকে জড়িয়ে ধরল। এই প্রথম! মুশরাফা চমকে তাকাল। জাওয়াদ আনন্দিত স্বরেই বলল,
‘ থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।’

মুশরাফা সে অবস্থাতেই বলল,
‘ একটা হাদিস মনে পড়ছে, বলি?’

জাওয়াদ নিজের অবস্থান টের পেল। কিঞ্চিৎ জড়তা কাজ করল ওর মাঝে। দূরে সরে গেল। তারপর জায়নামাজে বসে বলল,
‘বলো!’

মুশরাফা ওর পাশেঘেঁষে বলল,
‘হযরত উসামা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমার প্রতি যদি কেউ কৃতজ্ঞতার আচরণ করে তখন যদি তুমি তাকে জাযাকাল্লাহু খাইরান (আল্লাহ তোমাকে উত্তম বিনিময় দান করুন) বল তাহলেই তুমি তার যথাযোগ্য প্রশংসা করলে।”

থেমে বলল, ‘ আমার মনে হয়, ধন্যবাদ দেয়ার পরিবর্তে এই দোয়াটা বেশি সুন্দর শুনায়। আপনি এই দোয়াকে ‘ধন্যবাদ’ এর রিপ্লেসমেন্ট করতে পারেন। ‘

হাদিসটা সুন্দর লাগল জাওয়াদের। অনেক সময় মানুষ এত উপকার করে যে আমরা ‘ধন্যবাদ’ কথাটা বলে পাশ কাটিয়ে আসতে লজ্জাবোধ করি। মনে হয় এত উপকারের বিনিময়ে ‘ধন্যবাদ’ শব্দটা ছোটো হয়ে যায়। এই দোয়ার অর্থ সুন্দর। এই দোয়া করার পর আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দিবেন, যা হয়তো আমরা পারব না। কী চমৎকার চেইন! ও হেসে বলার চেষ্টা করল,
‘জাযাকা…

মুশরাফা চওড়া হাসল এ পর্যায়ে। বলল, ‘আপনি যখন কথাটা কোন নারীকে বলতে যাবেন তখন আপনাকে বলতে হবে ‘জাযাকিল্লাহু খায়রান।’ কোন পুরুষকে বলতে গেলে বলবেন, ‘জাযাকাল্লাহু খায়রান।’ আর যখন নারী পুরুষ সবাইকে বলবেন, তখন বলবেন, ‘জাযাকুমুল্লাহু খায়রান।’ সবগুলোর অর্থ এক। নারী, পুরুষ লিঙ্গবেদে উচ্চারণ আলাদা। আপনি এখন আমাকে বলবেন, জাযাকিল্লাহু খায়রান।’

জাওয়াদ ওর সাথে বলল। মুশরাফা হেসে বলল,
‘ ওয়া আনতুম ফাজাকুমুল্লাহু খায়রান (আল্লাহ আপনাকে ও উত্তম প্রতিদান দিক।) ‘

জাওয়াদের চোখ মুখে খুশির আভা। আকস্মিক ওর মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হলো। এমন স্ত্রী ক’জনার ভাগ্যে জুটে! জাওয়াদ বলল,
‘আমাকে মনে করিয়ে দিও।’

মুশরাফা সায় জানাল। পরপর জাওয়াদের হাত ধরে বলল,
‘আপনাকে একটা কথা বলি? এটা অনুরোধ ও বলতে পারেন।’

জাওয়ার আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘কী কথা?’

মুশরাফা ধীর স্বরে বলল, ‘আপনি আর কখনো আমার সামনে কোন বেগানা মহিলা সম্পর্কে আলোচনা করবেন না। আপনি অতীতে কী করেছেন, আমি শুনতে চাইনা। যা করেছেন, তা বাদ। আপনার জীবনে এখন আমি আছি, আমাকে নিয়ে ভাববেন। দয়া করে অন্য নারীর কথা আমার সামনে বলবেন না। আপনার মুখে অন্য নারীর কথা শুনলে আমার কষ্ট হয়। ‘

কাতরতায় ভরাট ওর স্বরটা। একটা অনুশোচনার ছাপ দেখা গেল জাওয়াদের চোয়ালে। পরক্ষনেই তা ঢেকে পড়ল উচ্ছ্বাস হাসিতে। সে মুশরাফার মাথার উপর হাত দিল। মাথার উপর হাতের ভার দিয়ে উঠে দাঁড়াল। দেখলে মনে হবে উঠার জন্যই হাত দিয়েছে। মুশরাফাও তাই ভাবল। উঠে দাঁড়িয়ে জাওয়াদ কোমল স্বরে বলল,
‘ আসো নামাজে দাঁড়াই।’

মুশরাফা তাকাল ওর দিকে। বলল, ‘আপনি আমাকে নামাজ পড়ার অনুমতি দিচ্ছেন? আমি নামাজ পড়ব!’

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল, ‘ আমার অনুমতি লাগবে কেন? আমি অনুমতি দেয়ার কে?’

মুশরাফা হেসে বলল, ‘আপনি স্বামী। আপনি কল্পনা ও করতে পারবেন না ইসলাম আপনাকে কত গুরুত্ব দিয়েছে। দায়িত্ব যেমন দিয়েছেন, গুরুত্ব ও দিয়েছেন। আপনার অনুমতি ছাড়া আমি নফল রোজা রাখতে পারব না। আপনি যদি চান এখন আমি নামাজ না পড়ি তবে আমি নামাজ পড়তে পারব না। কুরআন তেলাওয়াত ও করতে পারব না। আপনার অনিচ্ছায় আমি কোন নফল ইবাদাত করতে পারব না। তখন মানা করলন না? তাই আমি এখনি আমি নামাজ পড়তে পারব না। অন্যসময় পড়তে পারব। এখন পড়তে হলে আপনার অনুমতি লাগবে। আপনি অনুমতি দিবেন?’

জাওয়াদ স্তব্ধ হয়ে শুনল। ওর চোখে বিস্ময়, মুগ্ধতা। ইসলাম একটা স্বামীর মতামতকে এত গুরুত্ব দিয়েছে! একজন স্বামী হিসেবে এটা তার জন্য সুখের, ভীষণ সুখের। আজ আবার মুশরাফা নতুন অধ্যায় পড়াল ওকে। নিজেকে ধাতস্থ করে হেসে ফেলল জাওয়াদ। মুশরাফার অনুমতি প্রার্থনা ভীষণ আকর্ষণীয়। আকস্মিক ওর প্রেমিক মন জাগ্রত হলো। হাত বাড়িয়ে বলল,
‘উঠো। আমরা একসাথে নামাজ পড়ব।’

মুশরাফা চমকাল, থমকাল। চমৎকার হাসল। আলতো হাত রাখল ওর হাতে। তারপর নামাজে দাঁড়াল একসাথে। জাওয়াদ তপ্ত মনে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইল। সেজদায় কাঁদল। সালাম ফেরানোর পর কারো কান্নার আওয়াজ কানে এলো। পাশ ফিরে দেখল, মুশরাফা কাঁদছে। ওর গুনাহ মাফের জন্য! জাওয়াদ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। রাত জেগে মুভি দেখা ছেলেটা রাত জেগে নামাজ পড়ছে। ওকে কত পরিবর্তন করেছে এই মেয়ে!
ওর মনে হলো, এই মেয়েটা নিজেই শুদ্ধ। ওর চারপাশে যারা থাকবে তারা শুদ্ধ হতে বাধ্য হবে। ওর মাঝে আছে একটা স্বর্ণের আভা যুক্ত সুখের অনুভূতি। যা সোনার মতো আলো ছড়ায় চারদিকে। স্বর্ণাভ সুখানুভূতিতে মাতায় সবাইকে।

কর্মজীবন শুরুর পর বন্ধুদের সাথে সেভাবে আড্ডা দেয়া হয়না জাওয়াদের। বন্ধুদের ও সময় হয়না। কারো অফিস, কারো ব্যবসা। অনিকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হয়, দেখা হয়। সরকারি ছুটি হওয়ায় সেদিন সবাই অবসর ছিল। সন্ধ্যার পর আড্ডার ডাক দেয়া হলো। জাওয়াদ বিকেলে তৈরি হবার সময় মুশরাফা জিজ্ঞেস করল,
‘কোথাও বেরুচ্ছেন?’

জাওয়াদ আয়নায় নিজেকে দেখার মাঝে বলল,
‘হ্যাঁ। কোন কিছু দরকার?’

মুশরাফা বলল, ‘মামী, ফাবিহা আপুর শাড়ি দেয়া হয়নি। ওদিকে গেলে দিয়ে আসতেন।’

জাওয়াদ থেমে গেল। খানিক ভেবে বলল, ‘আমি অনিকের বাসার দিকেই যাচ্ছি। একটা কাজ করো, তুমি ও চলো সাথে। তোমাকে মামার বাসার কাছে নামিয়ে দিয়ে যাব।’

মুশরাফা অবাক হয়ে বলল, ‘ আপনি আমাকে পর্দাবস্থায় নিজ থেকে বাইরে নিতে চাচ্ছেন!’

জাওয়াদ বিরক্তির ভান করে বলল, ‘ এত কথা বলো কেন? গেলে বলো। না হয়, আমি একাই যাব। ‘

মুশরাফা আবার বলল, ‘তার মানে কি আমার বোরকায় আপনার আর সমস্যা নেই?’

জাওয়াদের কপালে বিরক্তির ভাজ গাঢ় হলো। নিজেই কেবিনেট খুলে মুশরাফার জিলবাব বের করে আনল। ওর হাতে দিয়ে বলল,
‘ আমার হাতে সময় নেই। দুই মিনিটের মাঝে তৈরি হয়ে বাইরে আসো। আমি ড্রয়িংরুমে আছি।’

জাওয়াদ চলে গেল। মুশরাফা তখন খুশিতে আটখানা। ওর চোখে পানি, ঠোঁটে হাসি। নিজ থেকে যেতে বলল, আবার নিজ হাতে জিলবাব তুলে দিল! এভাবে সরাসরি, পুরোপুরি জাওয়াদ ওকে পর্দার ব্যাপারে সাপোর্ট করল! ভাবতেই অবাক লাগছে, আনন্দ লাগছে। খুশিতে কান্না পাচ্ছে।
বলা বাহুল্য, হানিমুন প্ল্যানার যে জাওয়াদ এটা মুশরাফার অজানা।

মুখে খুশির ঝিলিক নিয়ে তৈরি হয়ে নিল মুশরাফা। তৈরি হয়ে বের হলো। বের হতেই মায়মুনা সামনে পড়ল। মুশরাফাকে দেখে মুখ কুঁচকে বললেন,
‘কোথায় যাচ্ছো?’

জাওয়াদ বসার ঘরে বসা ছিল। আওয়াজ শুনে উঠে এলো। আগ বাড়িয়ে বলল,
‘ মামীর কি যেন একটা মুশরাফার ব্যাগে চলে এসেছে। ওটা ফেরত দিতেই ওকে নিয়ে যাচ্ছি মা।’

মায়মুনা ছেলের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকালেন, ‘তুই নিয়ে যাচ্ছিস!’
‘ আমি অনিকের বাসার দিকেই যাচ্ছি। একজনের জিনিস এভাবে রেখে দেয়া তো ঠিক না। তাই ফেরত দিব ভেবেছি। এখন আমার হাতে সময় নেই যে আমি বাসায় গিয়ে দিব, তাই ওকে নিয়ে যাচ্ছি। আমি ওকে বাসার কাছে নামিয়ে দিব।’

মায়মুনা কিছু বলতে গেলেন। জাওয়াদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,
‘আমার দেরি হচ্ছে। আসি মা? আর কিছু লাগলে ফোন দিও।’

কোনমতে পাশ কাটিয়ে মুশরাফাকে বের হলো ও। মুশরাফা ওর কাভার দেখে বেশ অবাক হলো! এভাবে ওর ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারে লোকটা! আজ সব চমকপ্রদ দিক সামনে আসছে। এত খুশি লাগছে কেন? ও হেসে বলল,
‘মাকে মিথ্যা বললেন কেন?’

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল, ‘শাড়ি অবশ্যই জিনিসের মাঝে পড়ে। আমি তো জিনিসের নাম নিই নি। আর সময় নেই, ওদিকে যাচ্ছি তাও সত্য। এখানে মিথ্যা পেলে কোথায়?’

মুশরাফা আনন্দিত হয়ে বলল, ‘আপনি দিন দিন স্বামী স্বামী ধরনের দায়িত্ববান হয়ে যাচ্ছেন।’
জাওয়াদ উত্তর দিল না। ওর থেকে ব্যাগটা নিয়ে বলল,

‘কথার দিকে খেয়াল না দিয়ে হাঁটার দিকে খেয়াল দাও। ‘

আজ বাবার গাড়ি গ্যারেজে আছে। জাওয়াদ গাড়ি নিয়ে বের হলো। কথা ছিল মুশরাফাকে মামার বাসার সামনে নামিয়ে দিবে। কিন্তু মুশরাফা নামার পরে নিজেও নেমে গেল। ওর সাথে সাথে উপরে উঠল। মুশরাফা ভ্রু নাড়াল, ‘আপনার না সময় নেই?’

জাওয়াদ বলল, ‘অনিক নামেনি এখনো। বাসা থেকে ওকে নিয়ে আসি।’

মুশরাফা হাসল কেবল। চারতলায় এসে প্যাকেটটা ওর হাতে দিয়ে বলল,
‘যাওয়ার সময় ফোন দিব। তৈরি হয়ে থেকো।’

‘আজ থাকি?’
আবদারের সুরে বলল মুশরাফা। জাওয়াদ কড়া স্বরে বলল,
‘ মাকে বলে আসিনি। না গেলে মা বকবেন। আমি ফেরার সময় নিয়ে যাব। তৈরি থেকো।’

মুশরাফা ঠোঁট চেপে হেসে বলল, ‘মা তো বাহানা। মূল কথা হলো, আপনি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন না।’

জাওয়াদ কলিংবেল চেপে রাগ রাগ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ এত উদ্ভট ভাবো কেন? কোন বাহানা টাহানা নেই। মায়ের জন্যই তুমি থাকতে পারবে না। তবে যদি মাকে ফোন দিয়ে অনুমতি নাও, তবে পারবে। যদি অনুমতি নিতে পারো, তবে আমাকে জানাবে। আসি।’

বলে দ্রুত পায়ে উঠে গেল। দরজা খুললেন ফরিদা। অসময়ে মুশরাফাকে দেখে অবাক হলেন। তার চমকানো স্বর শুনে পাঁচতলায় থেমে যাওয়া জাওয়াদ আবার হাঁটা ধরল।

বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসল ওরা। আজও সাদাফের প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হলো জাওয়াদ। মুশরাফাকে কটাক্ষ করল ও। অনিক ভ্রু কুঁচকে বন্ধুর উত্তরের অপেক্ষায় রইল।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here