#স্বর্নাভ_সুখানুভূতি। (পর্ব-৩০)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
বসার ঘরের ডাবল সিট সোফার এক কোণে বসা জয়নাল আবেদীন। চোখে মুখে উৎফুল্লভাব তার। অপরকোণে বসা মায়মুনা। তার কপালে বিরক্তির ভাজ, চোখে মুখে বিতৃষ্ণা ভাব। দুজনের মাঝে বসা জিহান। ওর চোখে আগ্রহ। ডাবল সিট সোফার দু’পাশে দুটো সিঙ্গেল সোফা। একটায় বসে আছে কাকন। ওর চোখমুখ শান্ত, না কোন আগ্রহ না কোন বিতৃষ্ণা। তবে কপালে সুক্ষ্ম একটা বিরক্তির ভাজ উঁকি দিচ্ছে ঠিকই। মুশরাফাকে অপছন্দ করা মানুষের দলে মায়মুনার পরে তারই যে স্থান। অপছন্দনীয় ব্যক্তির উপহার নিশ্চয় অপছন্দই হবে। এই ভেবেই আসতে চাইছিল না, কিন্তু শ্বশুর ডাকছিলেন বারেবার। না এসে পারা গেল না। অন্য সোফায় বসা মুশরাফা। হাতে এক গাদা প্যাকেট। একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল শ্বশুরকে। বলল,
‘দেখুন তো বাবা এগুলো পছন্দ হয় কি না।’
জয়নাল আবেদীন প্যাকেট খুলে একটা সাদাটে পাঞ্জাবি পেলেন। গলায় হাতায় কাজ। পাঞ্জাবির সাথে দুটো ফতুয়া ও আছে। বেশ পছন্দ হলো তার। হেসে বললেন, ‘বেশ সুন্দর হয়েছে। আমার পছন্দ হয়েছে।’
মুশরাফা হাসল। তারপর কাঁপা হাতে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল শ্বাশুড়ির দিকে। ধীর স্বরে বলল,
‘মা, এটা আপনার জন্য। ‘
মায়মুনা নিজের আত্মসম্মান রক্ষার্থে নিলেন না। অন্যদিকে ফিরে বসে রইলেন। মুশরাফা বিনয়ের সাথে বলল,
‘টাকাটা আপনার ছেলের। আমার নয়। ‘
মায়মুনা গুমোট হয়ে বসে রইলেন। তাকালেন ও না। জয়নাল আবেদীন ভ্রু কুঁচকালেন,
‘কী হলো নাও?’
মায়মুনা স্বামীর দিকে তাকালেন এক পলক। সে পলকে কী ছিল কে জানে, মায়মুনা প্যাকেটটা হাতে নিলেন। তবে খুলে দেখলেন না। পাশে রেখে দিলেন। মুশরাফা আরেকটা প্যাকেট কাকনকে দিল। সে নিয়ে ফাঁক করে দেখল। নাহ্, যতটা খারাপ ভেবেছে ততটা খারাপ নয়। মুশরাফা একটা প্যাকেট দিল জিহানকে। তাতে ওর জন্য একটা গাড়ি আর একটা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির দিকে তাকাল ও না, গাড়ি দেখেই লাফিয়ে উঠল। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,
‘ থ্যাঙ্কিউ চাচী।’
প্যাকেট নিয়ে মায়মুনা আর কাকন নিজের রুমে চলে গেল। মুশরাফা হাফ ছাড়ল। যাক, মান রক্ষা হলো। বিড়বিড় করে, ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়ল।
জয়নাল আবেদীন খোশগল্প পুত্রবধূর সাথে কথা বললেন কিছুক্ষণ।
জাওয়াদ রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে মুখে বসে আছে নিজের ঘরে। বসার ঘরে কী হচ্ছে সেই চিন্তায় বুক ভারি হয়ে আসছে। দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ বলছে, এখনি মেয়েটা মলিন মুখে ঘরে ফিরবে। মন বলছে, মলিন মুখে না আসুক, হাসিমুখেই আসুক। ওর চিন্তায় ভয়ের মাত্রা ছড়িয়ে ডেকে উঠলেন মায়মুনা,
‘জাওয়াদ?’
নিজ ঘর থেকে চেঁচিয়ে ডাকছেন ছেলেকে। ডাকের ধরন স্পষ্ট বলছে, মেজাজ খুব একটা সুবিধার নয়। জাওয়াদ ভীত ঢোক গিলল। এবার কী হবে? মায়মুনা অনবরত ডেকেই চলেছেন। না গিয়ে উপায় নেই। সাহস সঞ্চার করে রুম থেকে বেরুলো জাওয়াদ। বসার ঘরে বাবার সাথে স্ত্রীকে কথা বলতে দেখল। মুশরাফার চোখে চোখ পড়তেই স্মিত হাসল সে। এই হাসিতে কী সুখ ছিল কে জানে? চট করে জাওয়াদের মন থেকে চিন্তা সরে গেল। বউয়ের মান রক্ষা হয়েছে। এবার মাকে দেখা যাক। ও মায়ের ঘরে গেল। মায়মুনা গম্ভীরমুখে বসে আছেন খাটে। ছেলেকে দেখেই বললেন,
‘বস এখানে।’
জাওয়াদ বসল মায়ের পাশে। আলতো সরে বলল,
‘কী হয়েছে মা?’
মায়মুনা প্রগাঢ় স্বরে বললেন, ‘তোর বউ শাড়ি দিয়েছে। নিয়ে যা, ওর দেয়া কিছু লাগবে না আমার।’
জাওয়াদ অবাক হয়ে বলল, ‘ ও কিনে নি। আমি কিনেছি। ও শুধু পছন্দ করেছে। আর কিছু না। ‘
‘তাও নিব না। ‘ থেমে বললেন, ‘আমার ব্যাগ এনেছিস?’
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল, ‘ ব্যাগ তো শাড়ির সাথেই ছিল। আসেনি?’
মায়মুনা চুপ করে রইলেন। তিনি প্যাকেট খুলে দেখেন নি। জাওয়াদ টের পেল ব্যাপারটা। ও পুরো রুমে চোখ বুলাল। দেখল ওয়ারড্রবের উপর ফেলে রাখা একটা প্যাকেট। জাওয়াদ উঠে গিয়ে তুলে আনল প্যাকেটটা। বলল,
‘দেখোনি, তাই না? আমি দেখাচ্ছি। ‘
জাওয়াদ প্যাকেট থেকে প্রথমে ব্যাগটা বের করল। নকঁশি কাঁথা কাজের কালো লালের সংমিশ্রণের একটা কাধব্যাগ। জাওয়াদ মায়ের সামনে ধরে বলল,
‘মা, দেখো? এটা সেই ব্যাগ না?’
মায়মুনা আঁড়চোখে তাকালেন। তারপর পূর্ণ চোখে তাকালেন। ভালো করে পরখ করে দেখলেন, আসোলেই ফেলে আসা সেই ব্যাগটা। তিনি ধীর স্বরে বললেন,
‘হ্যাঁ। তুই-ই নিয়েছিস?’
জাওয়াদ হাসল,
‘ আমিই নিয়েছি। ও কি চিনবে এটা? নাও। ‘
মায়মুনা হাতে নিলেন ব্যাগটা। ছুঁয়ে দেখলেন। তার মুখভঙ্গি কিছুটা নরম হলো। জাওয়াদ প্যাকেট থেকে শাড়িটা বের করল। আসমানী কালারের তাঁতের শাড়ি। শাড়িটা মেলে মায়ের কাধে দিয়ে বলল,
‘ বাহ্, শাড়িটা তোমাকে মানিয়েছে ।’
মায়মুনা এক পলক তাকালেন শাড়ির দিকে। তারপর কাধ থেকে সরিয়ে দিলেন, ‘এটা নিব না। তোর বউকে দে গিয়ে।’
‘ ব্যাগের সাথে এটাও আমি নিয়েছি। শুধু পছন্দ করেছে ও। নিয়ে নাও মা। তোমাকে ভালো লাগবে।’ মায়মুনা তাও নিতে চাইলেন না। জাওয়ার এবার হতাশ মুখে বলল,
‘ জীবনে প্রথম তোমার জন্য কিছু এনেছি এত আগ্রহ করে। ফেরত দিলে আমার কষ্ট হবে মা। মুশরাফা তো পরবে না, ঘরে পড়ে থাকবে। টাকাটাও নষ্ট হবে। ‘
মায়মুনা ছেলের দিকে তাকালেন। ছেলের দুঃখী দুঃখী চেহারার দিকে তাকিয়ে তার মন গলতে শুরু করল। খানিক বাদে গলে ও গেল। তিনি স্বর ভারি করে বললেন, ‘ রেখে যা।’
জাওয়াদ মায়ের পাশে শাড়িটা রেখে বলল, ‘আমি একটা কথা বুঝলাম না। তুমি মেয়েটাকে এত অপছন্দ করো, তারপর ও মেয়েটা মার্কেটে গিয়ে সবার আগে তোমার জন্য শাড়ি নেয়ার কথা বলল কেন? আর বেছে বেছে সবার জন্য কত কী কিনেছে। নিজের জন্য কিছুই নিল না। এই ব্যাপারটা বুঝলাম না আমি। ‘
থেমে মুখে বিতৃষ্ণা প্রকাশ করে বলল, ‘ মেয়েটার সাথে তো আমার সেভাবে কথা হয়না। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়নি। তুমি বলো তো মা, মেয়েটা শুধু শুধু আমার এতগুলো টাকা ফেলল কেন? সবার জন্য জিনিস না আনলে ও তো পারতো। হানিমুনে গিয়ে মানুষ নিজের জন্য কেনাকাটা করে, মেয়েটা নিজের জন্য কিছু নিলোই না। সবার জন্য কিনল। কেন মা?’
জাওয়াদের মুখে কৌতুহল। মায়মুনা খানিক উদাস হলেন। পরপরই তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বললেন,
‘ এসব করে সবাইকে নিজের ভাগে নেয়ার চেষ্টা করছে এই মেয়ে। আর কিছুই না। তুই এত কিছু ভাবিস না।’
জাওয়াদ দায়সারাভাবে বলল, ‘আমার মনে প্রশ্ন এসেছিল তাই জিজ্ঞেস করলাম। আচ্ছা, তুমি যেহেতু বলছো আর ভাবব না।’
মায়মুনা বললেন, ‘গুণিনের সন্ধান পেয়ে গেছি। আমরা কালই যাব।’
জাওয়াদ চমকাল। দিশাহীন বোধ করল। পরপরই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
‘ কাল থেকে আমার অফিস শুরু। এ কদিন মিস দেয়ায় কাজের প্রেশার থাকবে। ফিরতে রাত হবে। ‘
মায়মুনা চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘তাহলে?’
জাওয়াদ ভেবেচিন্তে বলল, ‘ আগামী শুক্রবার ছাড়া যাওয়া সম্ভব হবে না বোধহয়। ‘
মায়মুনা সাতপাঁচ চিন্তা করে বললেন, ‘ তাহলে আজই চল।’
‘বাবা বাসায়। বাবা শুনলে ঝামেলা বাঁধাবেন। বাবা ধারণা করবেন, দোষ আমাদেরই। ওই মেয়ে নির্দোষ। কারণ আমি যতদূর জানি ইসলামে তাবিজের মাধ্যমে কাউকে বশে আনার ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আছে। বাবা ও জানেন এটা। ও যেহেতু ইসলামের বিধিনিষেধ মেনে চলে, তাই বাবা ধরেই নিবেন, আমরা ওর উপর অপবাদ দিচ্ছি। উলটো ঘরে অশান্তি হবে মা। তারচেয়ে বরং আজ বাদ দাও।’
রয়েসয়ে মায়ের মনে একটা ধারণা ঢুকাল জাওয়াদ। মায়মুনা ও ভেবে দেখলেন, আসোলেই কথাটা মিথ্যা নয়। জয়নাল আবেদীন এখন পুত্রবধূ বলতে অজ্ঞান। নিশ্চিত তিনি পুত্রবধূকে বিশ্বাস করে, তাদের ভুল বুঝবেন। তিনি চুপচাপ বসে রইলেন। তাকে দিশাহীন দেখাচ্ছে। জাওয়াদ আকস্মিক বলল,
‘ হতাশ হয়ো না। এর মাঝে আমি ছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করব। ছুটি পেলেই যাব।’
মায়মুনা সায় জানালেন। জাওয়াদ হাফ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মায়ের রুম ছেড়ে বের হলো। নিজের রুমে যেতেই মুশরাফার মুখোমুখি হলো। মুশরাফা ওকে দেখেই হেসে সালাম দিল,
‘আসসালামু আলাইকুম।’
জাওয়াদ মনে মনে সালামের উত্তর নিল। তারপর ভ্রু কুঁচকাল, ‘ বেশি খুশি মনে হচ্ছে! শ্বাশুড়ি উপহার নিল তবে?’
মুশরাফা উৎফুল্লতার সাথে বলল, ‘হ্যাঁ, নিয়েছেন। জানেন, পাঞ্জাবিটা বাবার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। বাবাকে কী খুশি দেখাচ্ছিল! আমি ভাবিনি, বাবা এত খুশি হবেন। ‘
জাওয়াদ বাবার খুশিটা মুশরাফার মুখেই দেখতে পেল। মেয়েটা অন্যের খুশিতেই খুশি। একদিন মা ও এভাবে খুশি হোক ওর উপর। মনে প্রাণে এই দোয়া চাইল জাওয়াদ । তারপর বলল,
‘যাক, আমার টাকা বিফলে যায় নি তবে!’
‘ আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিবেন এর বিনিময়ে। ‘ চমৎকার হেসে বলল মুশরাফা।
জাওয়াদ বাইরে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে।
মুশরাফা বলল,
‘ আপনার ময়লা কাপড় রেখে যান, আমি ধুয়ে দিব।’
জাওয়াদ শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল,
‘ একবার ধুতে গিয়ে যে শিক্ষা দিয়েছো, দ্বিতীয়বার আমি আর তোমাকে আমার কাপড় ধুতে দিচ্ছিনা। ‘
‘ তাহলে কোথায় ধুবেন?’ চট করে প্রশ্ন করল মুশরাফা। জাওয়াদ বলল,
‘লন্ড্রিতে দিয়ে দিব।’
‘ওখানে মেয়ে আছে?’ আনমনেই প্রশ্ন করে ফেলল মুশরাফা। জাওয়াদ শব্দ করে হেসে ফেলল। সকালে বয়ে আনা নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে বলল,
‘ নেই। ‘
বাইরের দিকে পা বাড়াল। দরজার কাছে গিয়ে বলল,
‘ বাইরে যাচ্ছি। কিছু লাগলে ফোন দিও।’
এভাবে জাওয়াদ এর আগে বলে নি। মুশরাফা খুশি হলো। মাথা নাড়াল। জাওয়াদ পা বাড়িয়ে আবার থেমে গেল। পিছু ফিরে বলল,
‘ কক্সবাজার ভ্রমণ সম্পর্কে মা বা ভাবির সাথে আলাপ করো না। এমনকি জাহিনের সাথে ও না। সব নিজের মধ্যে রাখবে, ঠিক আছে?’
মায়মুনা যেন বিষয়টা ভালো চোখে না নেয় তাই এই কথা বলল জাওয়াদ। মুশরাফা চট করে ধরে ফেলল জাওয়াদের কথার পেছনের কারণ। মুশরাফা প্রাণবন্ত হাসল। বলল,
‘কেন?’
জাওয়াদ কৌতুকের সুরে বলল, ‘তুমি ছোটো মানুষ। এতসব বুঝবে না। যাচ্ছি, হ্যাঁ? ‘
‘ফি আমানিল্লাহ। দোয়া পড়ে যান। সাবধানে যাবেন।’ মুশরাফা সতর্কতার বাণী ছুঁড়ল। জাওয়াদ হেসেই বিদায় নিল।
সেদিনকার মতো ব্যাপারটা কাটল এভাবেই। পরদিন সকালে সবাই অফিসে যেতেই আবার ও মায়মুনা মুশরাফাকে কথা শুনালেন। ফিরে আসলে জাওয়াদকে ছুটির কথা জিজ্ঞেস করলেন। জাওয়াদ এটা ওটা বলে কাটাল কদিন। বৃহস্পতিবার রাতে তিনি ছেলেকে নিজের রুমে ডেকে মনে করিয়ে দিলেন,
‘ কাল সকালে উঠবে। আমি তোকে নিয়ে গুনকের(গুনীন) কাছে যাব।’
জাওয়াদ মায়ের পাশে বসল। বলল,
‘সে না হয় যাব। কিন্তু তার আগে এই তাবিজ বা গুনক সম্পর্কে জেনে নিই। আমার ওদের সম্পর্কে কোন ধারণা নেই।’
জাওয়াদ ফোন বের করল। গুনকের কাছে যাওয়ার বিধান’ লিখে সার্চ দিল।
তারপর আসা প্রথম তথ্যে ক্লিক করে জোরে জোরে পড়তে লাগল,
‘গণক এমন লোককে বলা হয়, যে অনুমানের ওপর নির্ভর করে ভিত্তিহীন বিষয়ের অনুসন্ধান করে থাকে। জাহেলী যামানার কিছু পেশাদার লোকের সাথে শয়তানের যোগাযোগ ছিল। শয়তানেরা চুরি করে আকাশের সংবাদ শ্রবণ করত এবং তাদের কাছে বলে দিত। আকাশ থেকে যা শ্রবণ করত, তার সাথে আরো অনেক মিথ্যা কথা সংযোগ করে মানুষের মধ্যে তা প্রকাশ করত। তারা যা বলত, তার একটি কথা সত্য হলে মানুষ ধোকায় পড়ে যেত এবং অন্যান্য সমস্যার সমাধানের জন্য ও ভবিষ্যতে কি হবে, তা জানতে গণকদের কাছে আসা শুরু করত। যারা গণকের কাছে আসে, তারা তিনভাগে বিভক্ত:
(১) গণকের কাছে এসে তাকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করা এবং তার কথায় বিশ্বাস না করা। এটা হারাম। এ ধরণের লোক সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“যে ব্যক্তি গণকের কাছে গিয়ে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করল, চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার সালাত কবূল হবে না।”[1]
(২) গণকের কাছে এসে তাকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করা এবং তার কথায় বিশ্বাস করা। এটা আল্লাহর সাথে কুফুরী করার অন্তর্ভুক্ত। কারণ, সে ইলমে গায়েবের দাবীতে গণককে বিশ্বাস করেছে। মানুষ ইলমে গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করলে আল্লাহর কথাকে অবিশ্বাস করা হবে। আল্লাহ বলেন,
“বলুন, আকাশ এবং জমিনে আল্লাহ ছাড়া গায়েবের সংবাদ অন্য কেউ জানে না।” [সূরা আন-নামল, আয়াত: ৬৫]’
এটুকু পড়ে জাওয়াদ থামল। তারপর বিস্ময়ের সাথে বলল, ‘ সাংঘাতিক ব্যাপার, মা! আমার কী হয়েছে, এটা তো উনি জানার কথা না। আর উনার কাছে গিয়ে সমাধান চাওয়া মানেই তো কুফরি। উনার কাছে গেলে তো বিপদ কমার পরিবর্তে বেড়ে যাবে। এসব কুফরী করতে চাও তুমি?’
মায়মুনা চুপচাপ বসে আছে। তাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। জাওয়াদ সচেতনভাবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর ‘তাবিজ-কবচ ব্যাবহার করা কি জায়েজ?’ লিখে সার্চ দিল। তারপর সেটাও মাকে পড়ে শুনাল,
”
‘হযরত উকবা বিন আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুলকে (সা.) বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি গলায় তাবিজ লটকালো, আল্লাহ তাকে পূর্ণতা দেবেন না, আর যে কড়ি ব্যবহার করবে, আল্লাহ তাকে মঙ্গল দান করবেন না। ’ (মুসনাদে আহমদ, হাকেম)
রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তাবিজ ঝোলাল, সে ব্যক্তি কুফরি করল এবং শিরক করল। ’ ”
থেমে বলল,
‘ আমি শুনেছি তাবিজ সরাতে গেলে আবার তাবিজ দেয়। এগুলো পরলে তো ঈমান নিয়ে টানাটানি লাগবে। আর ম তাবিজ করতে গুনকের কাছে গেলে নামাজ হবে জেনেও মুশরাফা তাবিজ করবে বলে মনে হয়না। ও ধর্ম মানে বেশ। আমার মন টানছে না। মঙ্গল না হওয়া মানে, জীবনে বিপদ আসা। ধরো, এমন ও হতে পারে, অফিস থেকে ফিরতে গিয়ে আমার এক্সিডেন্ট হয়ে গেল। মা তুমি কি তাও যাবে?’
ছেলের বিপদের কথা শুনে মায়মুনা আঁতকে উঠলেন। চমকে তাকালেন। জাওয়াদ উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ তুমি ভেবে দেখো। যদি মনে হয়, সব বাদ দিয়ে যাওয়া উচিত, তবে আমাকে বোলো। আমি তৈরি হয়ে থাকব। ‘
মাকে একা ছেড়ে দিল ও। একা একা ভাবুক। তার বিবেক তাকে ভালো মন্দের হিসেব দিবে। প্রসন্ন মনে রুমে গেল সে। মুশরাফা সুরা মুলক তেলাওয়াত করছে তখন। কুরআন তেলাওয়াত শেষে বলল,
‘ কাল আমাকে আজওয়া খেজুর এনে দিতে পারবেন?’
মুশরাফা নিজ থেকে কিছুর জন্য বলে না। আজ হঠাৎ বলায় অবাক হলো জাওয়াদ। ধীর স্বরে বলল,
‘আচ্ছা। ‘
‘এক প্যাকেট নিবেন। নিয়ে র্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে আনবেন।’
এ পর্যায়ে ভ্রু কুঁচকাল জাওয়াদ, ‘ কেন? কাউকে গিফট করবে?’
মুশরাফা হাসল শুধু। আর কিছু বলল না। জাওয়াদ সেটাই ধরে নিল।
পরদিন সকালে মাকে জিজ্ঞেস করল,
‘ মা, আমি তৈরি হবো?’
মায়মুনা গম্ভীরমুখে বললেন, ‘না। থাক।’
জাওয়াদ প্রাণবন্ত হাসল। প্রসন্ন মনে বাইরে গেল। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার সময় খেজুর নিয়ে এলো। ওর মাঝে কৌতূহল কাজ করছে। মুশরাফা খেজুর দিবে কাকে? মুশরাফা বলল,
‘ আমি ধরব না। আপনি গিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখুন। ‘
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। মেয়েটা কী করতে চাইছে! একরাশ কৌতুহল নিয়ে ডাইনিংরুমে গেল। টেবিলে বসে আছেন মায়মুনা। সন্ধ্যায় মুশরাফা হালিম বানিয়েছে। হালিম খাচ্ছেন। জাওয়াদ গিয়ে প্যাকেটটা মায়ের সামনেই রাখল। দৃশ্যপট দেখার আশায় টেবিলে বসে পড়ল। মায়মুনা ভ্রু কুঁচকালেন,
‘এটায় কী?’
জাওয়াদ বলল, ‘খেজুর।’
‘কার জন্য? আর এভাবে প্যাকিং করে এনেছিস কেন?’
জাওয়াদ উত্তর দিল না। ও নিজেই জানে না। মুশরাফা এলো খানিক বাদেই। একটা বাটিতে জাওয়াদের জন্য হালিম বাড়তে বাড়তে বলল,
‘ আমি উনাকে আনতে বলেছিলাম, মা।’
মায়মুনা প্রশ্নবোধক চাহনিতে জানতে চাইলেন, ‘কার জন্য?’
মুশরাফা সরাসরি উত্তর দিল না। হালিমের বাটিটা জাওয়াদের সামনে দিয়ে বলল,
‘রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন সকালবেলা সাতটি আজওয়া (উৎকৃষ্ট) খেজুর খাবে, সেদিন কোনো বিষ ও জাদু তার ক্ষতি করবে না।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৪৪৫)’
থামল ও। পরপরই বলল, ‘আপনার যদি মনে হয়, আমি আপনাদের জন্য তাবিজ বা জাদু করেছি। তবে প্রতিদিন সাতটি খেজুর খাবেন। আমার তাবিজ কাজ করবে না। এই খেজুর উনি এনেছেন। আমি ধরিওনি। তাই নিশ্চিন্তে খেতে পারেন। ‘
জাওয়াদ এক চামচ হালিম মুখে তুলছিল সবে। মুশরাফার জবাব শুনে চমকে তাকাল। খেজুর আনার সাথে যে তাবিজের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে ওর কল্পনাতীত ছিল। সাধারণত, শ্বাশুড়ি জ্বালাতন করলে বউরা মুখে মুখে জবাব দেয়। তর্ক ঝগড়া লেগেই থাকে। মুশরাফাকে মা প্রতিদিন তাবিজ নিয়ে কথা শুনায়, মেয়েটা কোন প্রতিবাদ করে না। চুপচাপ শুনে। না কোন তর্ক, না কোন ঝগড়া। ওর কাছে অভিযোগ ও করে না। তবু জাওয়াদ ভয়ে থাকে, কোনদিন মুশরাফা প্রতিবাদ করে উঠে, এবং বউ শ্বাশুড়ির মুখোমুখি যুদ্ধ বাধে। কিন্তু মুশরাফা যে তর্ক, ঝগড়া, উঁচুবাক্য ব্যবহার না করে শান্ত স্বরে বুদ্ধিমত্তার সাথে এভাবে জবাব দিবে, ও ভাবতেই পারেনি। কী চমৎকার বুদ্ধি মেয়েটার! কথা বলতে গিয়ে স্বরে বিনয়, কথায় পরামর্শ। হাদিস দিয়ে বুঝিয়ে দিল সব! জাওয়ার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। নিজেকে ধাতস্থ করতেই চট করে মায়ের দিকে তাকাল। মায়মুনা শূন্য চোখে তাকিয়ে আছেন। তিনি বোধহয় এখনো বুঝে উঠতে পারেন নি বা হজম করতে পারেন নি।
জিশান এলো খাবার ঘরের দিকে। মুশরাফা সরে গেল। রুমে চলে গেল। জাওয়াদ রাতের খাবার খেয়ে একবারে রুমে গেল। মুশরাফা শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন। জাওয়াদের হুট করে ওর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু পারল না। এখনো সে পুরোপুরি জড়তা কাটিয়ে উঠেনি। শুধু বলল,
‘ আকাশে সুন্দর চাঁদ উঠেছে। দু’কাপ কফি বানিয়ে আনো। ছাদে যাব।’
চলবে.