#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। (পর্ব-২৯)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
‘ আমি ভেবেছিলাম এটি আমার জীবনের সবচেয়ে পানসে ভ্রমণ হবে । অথচ এখন মনে হচ্ছে এটিই আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ভ্রমণ ছিল । কত সুন্দর সুন্দর মুহুর্ত স্মৃতির পাতায় বন্দি হয়েছে! আজ এই স্মৃতিময় ভ্রমণের ইতি টানতে হবে ভাবতেই খারাপ লাগছে। ‘
কাপড় গুছাতে গুছাতে বিরসমুখে বলল মুশরাফা। আজ রাতেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হবে ওরা। এখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা।
জাওয়াদ খাটে আধশোয়া হয়ে ফোন দেখছে। মুশরাফার কথা শুনে ফোন থেকে চোখ তুলে বলল,
‘ তো ইতি টেনো না। থাকো এখানে। একা একা হানিমুন করো।’ রসিকতা জাওয়াদের সুরে।
মুশরাফা ওর রসিকতায় গা মাড়াল না। বলল,
‘মাঝে মাঝে এমন হুটহাট ট্যুর দিলে মন্দ হয়না। আমাদের আর কোথাও যাওয়া হবে?’
‘ দেখা যাক। ‘ দায়সারা জবাব দিয়ে আবার ফোনে মনোযোগ দিল জাওয়াদ। বিকেল থেকেই মেঘ ডাকছিল। এই ক্ষণে আকাশ কাঁপিয়ে ঝুম বৃষ্টি নামল। মুশরাফা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখে খুশি হলো। উৎফুল্ল হয়ে বলল,
‘বৃষ্টি আসছে। তারমানে আজ আমাদের যাওয়া হচ্ছে না!’
জাওয়াদ তাকাল বাইরে। তারপর বলল,
‘ এই বৃষ্টির মধ্যেই যাওয়া হবে।’
‘ এত বৃষ্টির মধ্যে কাকভেজা হয়ে যেতে হবে কেন? তারচেয়ে বরং কাল সকালে যাই?’
অনুরোধ ঝরে পড়ল মুশরাফার। ওর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই এখান থেকে যাওয়ার। বাসায় জাওয়াদকে এভাবে পাওয়া হবে না।
জাওয়াদ বলল,
‘ বৃষ্টিস্নাত পরিবেশে ভ্রমণ করার মজাই আলাদা। ঝুমবৃষ্টিতে বাস ভ্রমণ মনোরম এবং আমার খুব পছন্দের। তাই কোনভাবে মিস করা যাবে না। গিয়েছো কখনো?’
মুশরাফা ভ্রু বাঁকাল। বাহ্! ভদ্রলোক তো দেখি ভালোই রসিক। গম্ভীরতার মাঝে বোধহয় সব চেপে ছিল এত দিল। গম্ভীরতার মাত্রা কমছে এখন, সেই সাথে নিজের স্বভাব বেরিয়ে আসছে। খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে অন্যরকম এক জাওয়াদ। মুশরাফার কৌতুহল জাগ্রত হলো। ও বলল,
‘না বৃষ্টির মাঝে বের হওয়া হয়নি কখনো। আবহাওয়া খারাপ হলে মামা ট্যুর ক্যান্সেল করে দিতেন। ‘
জাওয়াদ হাফ ছাড়ল, যাক অন্তত একটা বিষয়ে অনভিজ্ঞ পাওয়া গেল। স্ত্রীকে নতুন অনুভূতির সাথে পরিচয় করার মাঝে এক ধরনের আনন্দ আছে। জাওয়াদ উঠে দাঁড়াল। ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘হোটেলের গাড়ি ঠিক করেছি। ঘন্টাখানেক পরেই বের হবো। যাওয়ার হলে ব্যাগ গুছিয়ে নাও। ততক্ষণে বৃষ্টিটা থাকলেই হয়।’
মুশরাফা সায় জানাল। জাওয়াদ ওয়াশরুমে যেতেই ওড়নাটা গলায় জড়িয়ে বারান্দায় চলে গেল। উঁকি দিয়ে দেখল আশপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে কি না। নাহ, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। রুমের লাইট অফ করে বারান্দায় এসে রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়াল। আকাশ বেয়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ছে মুখে, ভালো লাগছে ওর।
খানিক বাদেই জাওয়াদ এলো বারান্দার দরজায়। ধমকে উঠল,
‘এই বৃষ্টিতে কী করছো ওখানে? যাওয়ার ইচ্ছে নেই?’
সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে অসুখ বাধিয়েছে, তাও শিক্ষা হয়নি। ওকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেল জাওয়াদের।
মুশরাফা অনুরোধের সুরে বলল,
‘জাস্ট পাঁচ মিনিট ভিজব। তারপর ফিরে আসব। এখনিই তো যাচ্ছি না। সময় আছে।’
জাওয়াদ আবারও ধমকে উঠল, ‘ মেজাজ খারাপ করো না। আসতে বলছি, আসো।’
মুশরাফা মুখ মলিন করে রুমে ফিরে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল। চেঞ্জ করে ফিরতেই জাওয়াদ বলল,
‘ ঝুমবৃষ্টি মাথায় নিয়ে সমুদ্রে নেমেছো কখনো?’
মুশরাফার মুখে অভিমানের ছাপ। ও উত্তর দিল না। জাওয়াদ হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে বলল,
‘আমি যাচ্ছি, গেলে আসো।’
মুশরাফা গেল না। চুপচাপ বসে রইল অন্যদিকে ফিরে। জাওয়াদ দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
‘ বিচে নেমে বৃষ্টিবিলাস করার অনুভূতিটা চমৎকার। যাওয়ার আগে একটা নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করে নাও। আসো।’
জাওয়াদের স্বরটা কোমল। ওর স্বরটা যেন অনুতাপের সুরে বলছে, তখন ও আমি ধমকেছি, এখন আবার বৃষ্টিতে ভেজার সুযোগ ও আমিই দিচ্ছি। এবার অন্তত অভিমান ছাড়ো!
মুশরাফা মুখ তুলে চাইল এক পলক। জাওয়াদ ওর চোখে চোখ রেখে শীতল স্বরে বলল,
‘আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। আসো। ‘
এরপর বোধহয় আর অভিমান করে থাকা যায় না। মুশরাফা উঠে দাঁড়াল। ও স্কার্ট পরা ছিল। উপরে খিমার চাপাল। তারপর বের হলো রুম থেকে। জাওয়াদকে রুমের সামনেই পেল। ওকে দেখে রুম লক করে হাঁটা ধরল।
বিচের মাটিতে পা রাখতেই মুশরাফা চঞ্চল হয়ে উঠল। সমুদ্রের দিকে দৌড় দিল। ভেজা বালিতে গিয়ে দাঁড়াল। বড়ো বড়ো ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে, আকাশ বেয়ে পড়া বৃষ্টি কণা মাথার উপর পড়ছে,টুপটাপ। সমুদ্র আর বৃষ্টির সংমিশ্রণটা চমৎকার। এভাবে বৃষ্টিবিলাস করা হয়নি কখনো। মুশরাফা হাত ছড়িয়ে ঘুরল কিছুক্ষণ। আবার সমুদ্রজলে বসে এক হাতে বৃষ্টি ছুঁলো, অন্য হাতে সমুদ্রের পানি নিয়ে খেলতে লাগল।
পুরো বিচ খালি তখন। চঞ্চলতার চাঞ্চল্য জাওয়াদ ছাড়া কেউ দেখল না। জাওয়াদ ধীর পায়ে ওর দিকে এসে দাঁড়াল। বলল,
‘ জাস্ট পাঁচ মিনিট। এর বেশি থাকতে পারবে না তুমি। পাঁচ মিনিট পরেই হোটেলে ফিরে যাব আমরা।’
মুশরাফা সমুদ্রের এক চটা পানি জাওয়াদের দিকে মেরে বলল,
‘ আসার পর যাওয়ার কথা বলতে নেই। এখন আসুন। আমার কাছে এসে বসুন। আমার এই নতুন অভিজ্ঞতাকে প্রেমে রাঙিয়ে দিন।’
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে মুশরাফাকে। মেয়েটার মুখে নিকাব নেই। উৎফুল্ল মুখে হাসি হাসি ভাব। একটু আগেই বৃষ্টিতে ভেজার জন্য মুখ ফুলাল। এখন বৃষ্টি পেয়ে আবার হাসছে। এই মেয়ে এত বৃষ্টি পাগল কেন?
জাওয়াদ হাতে থাকা ব্যাগটা বালিতে রাখল। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ওর দিক। পাশে বসে ওর হাতে পরে থাকা ওয়ারপ্রুফ স্মার্ট ওয়াচের আলো জ্বালিয়ে বলল,
‘এখন বাজে আটটা পাঁচ, ঠিক আটটা দশে তুমি হোটেলের দিকে পা বাড়াবে। আমি সময় গুনছি।’
মুশরাফা কিছু বলল না। জাওয়াদের পিঠে পিঠ লাগিয়ে বসল। আলতো সরে বলল,
‘ডোন্ট টক, ক্লোজ ইউর আইস। এন্ড ফিল দ্যা মোমেন্ট।’
বলে নিজে চোখ বন্ধ করে আকাশ পানে তাকাল। আকাশ ঝরা বৃষ্টি, ঢেউ খেলানো সমুদ্র, তার মাঝে বসা এক যুগল। প্রেম ছিল দুজনের মনে। একজনের প্রকাশ হলো আচরণে, অন্যজনের বন্ধ চোখের হাসিতে। অনুভব কিন্তু দুজনেই করেছে, উৎফুল্ল কেবল একজনই হয়েছে।
কিছুক্ষণের জন্য পৃথিবীটা যেন শান্ত হয়ে গেল। প্রেমের বাতাস বয়ে গেল কেবল। স্বর্ণাভ এক সুখানুভূতিতে জুড়িয়ে গেল মন প্রাণ।
এভাবেই কেটে গেল কিছুক্ষণ, অনেকক্ষণ। আকস্মিক আকাশ ডাকল বিকট শব্দে। ঘোর কাটল জাওয়াদের, মুশরাফা তখনো অভিভূত।
জাওয়াদের সময়জ্ঞান হলো। চট করে সময় দেখল। পাঁচ মিনিটের জায়গায় পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেছে। এতক্ষণ স্থবির ছিল! নিজেই অবাক হলো। উঠে দাঁড়াল। মুশরাফার দিকে তাকিয়ে ওর স্থবির পেল। জাওয়াদ ধীর স্বরে বলল,
‘ এবার ফিরে চলো।’
মুশরাফা চমকে তাকাল। কিছু বলতে গেল। জাওয়াদ হাত ধরে দাঁড় করিয়ে বলল,
‘আর এক মুহুর্ত নয়। চলো।’
‘ আর কিছুক্ষণ পরে যাই?’
জাওয়াদ বালির দিকে হেটে এলো। প্লাস্টিকের ব্যাগটা খুলতে খুলতে এগিয়ে গেল ওর দিকে। বলল,
‘আর কিছুক্ষণ থাকলে আজ বাসায় নয় হাসপাতালে যেতে হবে। কোন কথা নয়,,চলো।’
ভাজ ব্যাগটা খুলতেই দেখা গেল,,ওটা ব্যাগ নয় একটা রেইনকোট ছিল। যার ভেতর একটা বড়ো পকেটে আছে। ভাজ করে সেই পকেটেই ঢুকিয়ে রাখতে হয়। দেখতে প্লাস্টিকের ব্যাগের মতো মনে হয়। জাওয়াদ ওটা মুশরাফার হাতে দিয়ে বলল,
‘ এটা পরে নাও। ‘
মুশরাফা নিজের দিকে তাকাল। বিদ্যুতের আলোয় দেখা গেল কাপড় ভিজে গায়ের সাথে মিশে গেছে। সতর সরে গেছে। বিচ খালি হলেও হোটেলের গ্র্যান্ড ফ্লোরে মানুষ আছে। জাওয়াদ চাইছেনা, ওকে পর্দা ছাড়া ওভাবে কেউ দেখুক। এটাকে বোধহয় পর্দার পুরোপুরি সাপোর্ট বলে। নিজ থেকেই উৎসাহিত করছে! মুশরাফার কী যে ভালো লাগল! রেইনকোট পরে নিকাব টানল মুখে। এখন একবারে শরীর বুঝা যাচ্ছে না। খুশিমনে হোটেলের দিকে হাঁটা ধরল। জাওয়াদের হাত ধরে এগুতে এগুতে বলল,
‘এভাবে কখনো বৃষ্টি বিলাস করা হয়নি। জাযাকাল্লাহু খায়রান। আমাকে সুযোগ করে দেয়ার বিনিময়ে আল্লাহ আপনাকে অনেক অনেক পুরষ্কার দিক।’
কী সুন্দর দোয়া! কত মানুষকে উপকার করেছে, কেউ এত সুন্দর দোয়া করে নি। এমন দোয়ার জন্য বোধহয় সব করা যায়। আনমনেই হেসে ফেলল জাওয়াদ। উত্তরে কিছু বলল না। হাতের বাধন শক্ত করল কেবল। তারপর প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ধীর স্বরে বলল,
‘আজই শেষ। আর কখনো যেন তোমাকে বৃষ্টি ভিজতে না দেখি। ‘
হোটেলে ফিরে চেঞ্জ করে এসেই সর্দির আঁচ পেল মুশরাফা। জাওয়াদ রাগ রাগ চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ আবার যাবে? যাও বালিশ, কাঁথা নিয়ে যাও। বিচে গিয়ে কাঁথামুডে ঘুমাও?’
মুশরাফা ব্যাগ থেকে একটা কৌটা বের করল। তারপর খুলে কালো কিছু মুখে নিল। চিবিয়ে কৌতুকের সুরে বলল,
‘ যতই ভ্রু কুঁচকান, রাগ ঝাড়েন। আমি কিন্তু জানি, আপনি যে আড়ালে আবডালে আপনার বউয়ের বেশ খেয়াল রাখেন। ‘
জাওয়াদ বিরক্তির ভান করল। তারপর প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ভ্রু কুঁচকাল,
‘কী খাচ্ছো এগুলো?’
মুশরাফা বলল, ‘কালোজিরা। আপনি ও একটু খান।’ জাওয়াদের কাছে এনে দিল কৌটা। জাওয়াদ বলল,
‘ কালোজিরা কেন খাব?’
মুশরাফা হেসে বলল, ‘ “কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কালিজিরায় মৃত্যু ব্যতীত সব রোগের নিরাময় আছে। (ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৪৪৮) ”
মনে বিশ্বাস নিয়ে খান, দেখবেন অসুস্থ অনুভবটা চলে গেছে।’
নতুন কথা শুনল জাওয়াদ। ভ্রু কুঁচকাল ও, ‘সিরিয়াসলি! ‘
মুশরাফা আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, ‘আমার ইসলামে মিথ্যা নেই। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামে জীবনের সব দিকের কথা বলা হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান এখান যা গবেষণা করে বের করেছে, চৌদ্দ’শ বছর আগে আল্লাহ তার রাসূল এর মাধ্যেমে সেই বিজ্ঞানের কথা বলেছেন। কুরআন হাদিসে আছে। বিশ্বাস না হলে ইন্টারনেট সার্চ করে দেখুন, আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞান কালোজিরার সম্পর্কে কী বলে?’
জাওয়াদ একরাশ কৌতুহল নিয়েই গুগলে ‘কালোজিরার গুণাগুণ’ লিখে সার্চ দিল। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে,
‘ কালোজিরের মধ্যে রয়েছে নাইজেলোন, থাইমোকিনোন, লিনোলিক অ্যাসিড, ওলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিংক, ম্যাগনেশিয়াম ,ফসফেট, সেলেনিয়াম, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-বি ২, নায়াসিন, ভিটামিন-সি, ফসফরাস, কার্বোহাইড্রেট। দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে কালোজিরা। যে কোনও জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেহকে প্রস্তুত করে তোলে এবং সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি করে। কালোজিরাকে মানবদেহের নানা রোগের প্রতিষেধক এবং প্রতিরোধক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এজন্য একে সকল রোগের মহাঔষধও বলা হয়ে থাকে।
জাওয়াদ যেন বিস্ময়ের চূড়ায় পৌঁছল। ইসলামে যে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও আছে তা ও জানতো না। মুশরাফার কথার মিল পেল। এটা কত আশ্চর্যজনক তথ্য হতে পারে যে তথ্য আজকালকার চিকিৎসাবিজ্ঞান দিচ্ছে তা চৌদ্দ’শ বছর আগে কুরআন হাদিসে লিপিবদ্ধ হয়েছে! আজ যেন ইসলামের নতুন একটা দিক দেখতে পেল ও। মানুষ জ্বর সর্দি অনুভব করলে ‘নাপা, প্যারাসিটামল খায়। আর এই মেয়ে হাদিস দেখে কালোজিরা খাচ্ছে! কালোজিরার সাইড ইফেক্ট নেই, কিন্তু ওষুধের আছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, সামান্য অসুখে ওষুধ নয়। এতে হিতে বিপরীত হিতে পারে। ইসলাম সুন্দর। সুন্দর তার দিক গুলোও। সাথে ইসলাম মানা মেয়েটাও। জাওয়াদ হাসল। বলল,
‘দাও, দেখি আমাকে ও একটু খাই। ‘
সেও খেল একটুখানি। মুশরাফা হাসল কেবল। কাউকে ইসলামের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে ভালো লাগে ওর। ব্যাগ গুছিয়ে নামাজ পড়ে নিল দুজন। ন’টা নাগাদ বেরিয়ে পড়ল। সাড়ে ন’টার বাস। বৃষ্টির জন্য দশটা নাগাদ আসল। জাওয়াদ প্রথমে এসি বাস নিয়েছিল, পরে কীভেবে আবার নন এসি বাস নিল। মুশরাফা তখন হেসে বলল,
‘ আমার ঠান্ডা লাগবে না।’
জাওয়াদ বলল,
‘এসি বাসের গুমোট পরিবেশে বৃষ্টিস্নাত ভ্রমণ উপভোগ্য হয়না। এইজন্যই এসি বাস নিচ্ছি না। সবসময় সব কিছু নিজের দিকে টানো কেন?’
মুশরাফা তাও হাসল। সিটে গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
‘ একটা স্ত্রীর জন্য সবচেয়ে আনন্দদায়ক ব্যাপার হলো, তার স্বামীর পক্ষ থেকে প্রাধান্যতা পাওয়া। আর সবচেয়ে সুন্দর উপহার হলো,সম্মান। আমার জীবনে আনন্দদায়ক ব্যাপারটা এসে গেছে।’
মুশরাফার স্বরটা সুখে মাখা। ওর স্বরে তাও কিসের যেন বিষাদ পেল জাওয়াদ। না কি ওর মনের ভুল! মুশরাফার স্বর যেন বলল, আপনার আমাকে সম্মান দেয়াও উচিত। আপনি আমাকে সম্মান দেন না। ব্যাপারটা গায়ে লাগল ওর।
বাস চলতে শুরু করেছে। জাওয়াদ হালকা জানালা খুলে দিল। বৃষ্টির ঝিরিঝিরি শব্দ আসছে। মুশরাফা জানালার বাইরে তাকাল। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দেখা যায়, বৃষ্টির নৃত্য বৃষ্টিস্নাত শহরের কোলে বাসের এগিয়ে যাওয়া। হিমেল হাওয়ার সাথে বৃষ্টি চটা এসে পড়ছে মুখে, কানে আসছে ঝিরিঝিরি শব্দ। কী সুন্দর পরিবেশ! একটা বৃষ্টিপ্রেমীর জন্য এর চেয়ে সুন্দর পরিবেশ দুটি নেই।
ভেতরের লাইট ও নেভানো। মুশরাফা জাওয়াদের কাধে মাথা রেখে বাইরে তাকিয়ে রইল। উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,
‘ আসোলেই বৃষ্টিস্নাত পরিবেশে ভ্রমণের অন্যরকম আনন্দ। জাযাকাল্লাহু খায়রান।’
জাওয়াদ বাইরের দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে বলল, ‘বৃষ্টি থামার পরে হিমেল হাওয়া বয়ে যাবে। তখন জানালা খুলে দেখো, অনুভূতি ষোলকলা পূর্ণ হবে। এখন ঘুমাও। ভোরে উঠে যেও। ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশের সকাল হওয়াটা দেখতে সুন্দর। ‘
মুশরাফা আবেগে ভেসে গেল। উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘আপনার জন্য আমার শুধু দোয়া আসছে। অনেক অনেক সব সুন্দরতম দোয়া। কী করব?’
ওর বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল জাওয়াদ। বলল, ‘ ঘুমাও। ‘
ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশে ঘুম এলো নিমিষেই। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। জাওয়াদ জানালা টেনে দিল। মুশরাফাকে আগলে রাখতে গিয়ে একসময় নিজেও ঘুমিয়ে গেল। ভোরের দিকে ঘুম ভাঙল। জাওয়াদ ঘড়ি দেখল ৫টা ১০মিনিট বাজে। মুশরাফাকে জাগাল ও। মুশরাফা উঠেই বলল,
‘ নামাজের সময় হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। এখন গাড়ি থামাবে না, আর যেতে যেতে ও সকাল হয়ে যাবে। ওয়াক্ত পেরিয়ে যাবে। কী করা যায় বলো তো!’ জাওয়াদের স্বর চিন্তামাখা। মুশরাফা খানিক ভাবল। তারপর বলল,
‘ এমতাবস্থায় তায়াম্মুম করে এখানে বসেই নামাজ পড়তে হবে। ‘
জাওয়াদ তায়াম্মুমের নিয়ম জানে না। মুশরাফা শিখিয়ে দিল। তারপর বাসেই নামাজ পড়ে নিল। তখন চারদিকে আলো ফুটতে শুরু করেছে। জাওয়াদ জানালা খুলে দিল। বৃষ্টি নেই। এক ফালি ঠান্ডা বাতাস এসে গা ছুঁলো। মুশরাফা চোখ বন্ধ করে ফেলল। ধীরে ধীরে আলো ফুটল। হিমেল হাওয়ার ধূসর সকাল হলো। মুশরাফা মুগ্ধমনে উপভোগ করল।
ওরা বাসায় পৌঁছল সকাল আটটায়। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে গিয়েই আবার শুয়ে পড়ল জাওয়াদ। মায়মুনা ছেলেকে দেখে বেজায় খুশি। মুশরাফা না দেখার ভান করলেন। দশটা অবধি রুমেই থাকল মুশরাফা। দশটা বাজে জাওয়াদকে জাগাল। জাগিয়ে ভীত মনে বলল,
‘ মাকে শাড়ি দিয়ে আসবো?’
জাওয়াদ উঠে বসল। দিনটা শুক্রবার। সবাই বাসায়। জাওয়াদ কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। বসার ঘরে বাবাকে বসা পেল। পত্রিকা পড়ছেন। জাওয়ার বাবাকে কী যেন বলল, তারপর ফিরে এলো। মুশরাফার সামনে গিয়ে বলল,
‘ বাবাও আছে সেখানে। সবার গুলো নিয়ে যাও।’
মুশরাফা ধীর স্বরে বলল, ‘ভাইয়াদের..
জাওয়াদ ওকে থামিয়ে বলল, ‘ ওদের আমি দিব। তুমি মা, বাবা আর ভাবিকে দাও। যাও।’
মুশরাফা নার্ভাস হয়ে পড়ল, ‘আপনি ও আসুন। ‘
জাওয়াদ স্পষ্ট জানাল, ‘আমি কিন্তু আগেই বলেছি। তোমাদের বউ শ্বাশুড়ির ব্যাপারে আমি নেই। নিজে নিয়েছো, নিজে দাও। ‘
মুশরাফার ভয়ের মাত্রা বাড়ল। ও সবগুলো প্যাকেট হাতে নিল। তারপর এগুতে গিয়ে আবার থামল। ছুটে গেল ওয়াশরুমের দিকে। ফিরে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। এই অবেলায় কিসের নামাজ পড়ছে ও। মুশরাফার সালাম ফেরানোর অপেক্ষায় রইল। ফেরালেই জিজ্ঞেস করবে। মুশরাফা দীর্ঘ সময় নিয়ে ধীরস্থিরভাবে দুই রাকাত নামাজ পড়ল। সেজদায় অনেকক্ষণ কাটাল। তারপর সালাম ফেরাল। জাওয়াদ কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল না। আবার মনোযোগ দিয়ে কি যেন পড়তে লাগল। তারপর মোনাজাত করল। নামাজ গুছিয়ে উঠে দাঁড়াতেই জাওয়াদ প্রশ্ন করল,
‘এই অবেলায় কিসের নামাজ পড়লে তুমি?’
মুশরাফা ধীর স্বরে বলল, ‘সালাতুল হাজতের নামাজ। যখন কেউ সাহায্য করতে পারে না, তখন মানুষের একমাত্র সাহায্যকারী হলেন মহান আল্লাহ। তিনিই পারেন মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। মানুষের বিপদ যত সহজ আর কঠিনই হোক না কেন, তিনি পারে মানুষকে তা থেকে রক্ষা করতে। এ ক্ষেত্রে অন্যতম মাধ্যম হলো বিপদ থেকে মুক্তি পেতে নামাজ পড়া। এ নামাজ ‘সালাতুল হাজত’ হিসেবে পরিচিত।’
মুশরাফা থামল তারপর আবার বলল,
“রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির আল্লাহর কাছে বা মানুষের কাছে কোনো প্রয়োজন দেখা দেয়, সে যেন উত্তমরূপে অজু করে দুই রাকাআত নফল নামাজ আদায় করে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করে এবং ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর দরুদ পাঠ করে।’ (তিরমিজি)”
জাওয়াদ অবাক হয়ে বলল, ‘এখন এই নামাজ পড়লে কেন তুমি?’
মুশরাফা ধীরে বলল, ‘এখন আমি ভীষণ ভীতগ্রস্থ। আমার আল্লাহর সাহায্য প্রয়োজন। ‘
বলে প্যাকেট গুলো হাতে নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াল। জাওয়াদ নতুন তথ্য জেনে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বসে রইল। নিজেকে ধাতস্থ করে উঠতেই দ্রুত পায়ে নিচে নামল।
মুশরাফার সামনে গিয়ে বলল,
‘ এ্যাই সত্যি করে বলো, তুমি আমার মায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে কোন অভিযোগ করেছো না কি! দেখো, আমার মা খুব ভালো মানুষ। হুট করেই অবুঝ হয়ে গেছেন। তিনি একদিন ভালোটা বুঝে যাবেন। তুমি বদদোয়া দিও না। দিলেও এখন আবার নামাজ পড়ে ফিরিয়ে নাও। মায়ের ক্ষতি হবে, প্লিজ!’ জাওয়াদ কেমন অনুনয় করে বলে উঠল।
ওকে এত নমনীয় হতে ইতঃপূর্বে দেখেনি মুশরাফা। মাকে বোধহয় একটু বেশিই ভালোবাসে লোকটা। মায়ের খারাপ ভাবতেই পারছে না। ওর অবুঝপনায় মুশরাফা হেসে ফেলল। বলল,
‘ আমি শুধু আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়েছি। সবার সামনে অপমানিত হওয়া থেকে বাঁচার জন্য দোয়া চেয়েছি। আর কিছুই না। আমি মায়ের নামে কোন অভিযোগ করিনি, বদদোয়াও দিইনি। ‘
জাওয়াদ আবার বলল, ‘সত্যিই তো! ‘
মুশরাফা বলল, ‘আমি মিথ্যা বলি না।’
মুশরাফা চলে গেল। জাওয়াদ ভীত মনে খাটে বসে পড়ল। বিড়বিড় করে বলল,
‘এই মেয়ের দোয়ার ভয়ে আমি একদিন শেষ হয়ে যাব। আল্লাহ, ও যদি বদদোয়া দিয়ে থাকে আজকের জন্য কবুল করো না। আমার মায়ের কোন ক্ষতি করো না। প্লিজ!’
চুপচাপ বসে রইল। কান পেতে শুনল বসার ঘরের সবার কথা। মনে মনে দোয়া করল, ‘মা বউ দুজনের একে অপরের কাছে যেন মান থাকে। ‘ ওর মন পড়ে রইল সেখানে। যেতে ইচ্ছে হলেও গেল না। গেলেই মা মনে করবেন বউয়ের চামচামি করছে। বউ শ্বাশুড়ির ব্যাপার ওরা বুঝুক। দেয়া নেয়া থেকে সম্পর্ক সহজ হোক।
চলবে..