স্বপ্নচারিণী,পর্ব_৭
সামান্তা সিমি
যূথী খালি পায়ে সবুজ ঘাস মাড়িয়ে বাগানের দিকে এগিয়ে গেল।দূর থেকে যত না সুন্দর লাগছিল কাছে এসে মনে হচ্ছে সে কোনো ফুলের রাজ্যে এসে পরেছে।এখনো বাড়িতে কারো সাড়াশব্দ নেই।তারমানে কেউ ঘুম থেকে উঠে নি।
যূথী চারপাশে ভালোভাবে তাকাল। না কেউ নেই।
অতি সন্তপর্ণে সে গাছ থেকে একটা গোলাপ ফুল তুলে ফেলল।গোলাপের ঘ্রাণ তাঁকে পাগল করে দিচ্ছে।
যূথী ফুলটাকে সুন্দর করে তাঁর কানের পাশে খোলা চুলের গভীরে ঢুকিয়ে দিল।
* নিশান সূর্য উঠার সাথে সাথেই ঘুম থেকে উঠে পরেছিল।সকালের খোলা বাতাসে এক্সারসাইজ দিয়েই তাঁর দিন শুরু হয়।
কানে হেডফোন লাগিয়ে সে বারান্দায় রানিং মেশিনে এক্সারসাইজ করে যাচ্ছে।
সেই মুহূর্তে নিশানের চোখ গেল বাগানে ফুল গাছের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা যূথীর দিকে।
রানিং মেশিন বন্ধ করে সে একটু সামনে এগিয়ে গেল।ভুল দেখছে না তো! এত সকালে এই মেয়ে কোত্থেকে আসবে?
নিশানের চোখ আবার যূথীর উপর আটকে গেল।সকালের আলোয় মেয়েটাকে কতটা শান্ত স্নিগ্ধ লাগছে! তার উপর চুলে আবার ফুল গুঁজেছে।
এতগুলো ফুলের মাঝে যূথীকেও যেন একটা ফুটন্ত ফুল লাগছে।
নিশান জোর করে তাঁর চোখ অন্যদিকে ফেরাতে চাইল।কিন্তু পারল না।কোনো এক অদৃশ্য বন্ধন যেন চোখ দুটোকে চুম্বকের মত টেনে যূথীর উপর নিয়ে ফেলছে। এ কোথায় ফেঁসে গেল নিশান?
* যূথী নিচু হয়ে একটা একটা ফুলের গায়ে স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে।সূর্য এখন তাঁর সবটা আলো বাগানের উপর ছড়িয়ে দিয়েছে। আশেপাশের পরিবেশটা যূথীর কাছে খুবই মনোরম লাগছে।
সামনে তাকাতেই দেখে মিঠু চাচা বাগানে পানি দেওয়ার জন্য পাইপ নিয়ে এগিয়ে আসছে।
যূথীকে দেখতে পেয়ে মিঠু চাচা কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল,
—এত সকালে এইখানে কি করো মামণি?
—এই একটু হাঁটতে বের হয়েছি চাচা।আমাকে পাইপটা দিন আমি পানি দিচ্ছি।
দাঁত দিয়ে জিভ কেটে মিঠু চাচা বলে উঠল,
—না মামণি।এইটা তোমার কাজ না।বাড়ির কেউ দেখলে আমারে অনেক কথা শুনাইব।
—কেউ দেখবে না।সবাই এখন ঘুমে।দাও আমায়।
যূথী অনেকটা জোর করেই পাইপটা নিয়ে আনমনে গান গাইতে গাইতে পানি দিতে লাগল।মিঠু চাচা কাঁচি নিয়ে গাছের নিচের আগাছা পরিষ্কারে ব্যস্ত হয়ে পরেছে।
একজোড়া প্রজাপতি ফুলের উপর বসতেই যূথীর মুখে হাসি ফুটে উঠল।সে প্রজাপতি খুব ভালোবাসে।তার উপর এমন রঙ বেরঙের হলে তো কথাই নেই।
হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতেই প্রজাপতি দুটো ফুড়ুৎ করে আকাশে উঠে গেল।
যূথীও উপরের দিকে তাকাল কিন্তু বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা নিশানের দিকে চোখ পরতে মুহূর্তেই তাঁর মুখের হাসি উবে গেল।
নিশানের গায়ে হাতকাটা একটা হোয়াইট গেঞ্জি যেটা অর্ধেক ঘামে ভিজে আছে।লোকটার বলিষ্ঠ বাহু বুকেও ঘামের বিন্দু বিন্দু কণা জমে আছে।
যূথী কখনো কোনো ছেলের এমন রূপ দেখেনি।তাঁর চেতনা তাঁকে বলছে এই মুহূর্তে চোখ বন্ধ করে এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।কিন্তু পা দুটো যেন অসার হয়ে গেছে।যূথীও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিশানের দিকে।
“—আরে আরে মামণি এইটা কি করতাছো? আমারে ভিজাও কেন? পাইপটা সরাও তাড়াতাড়ি! ”
মিঠু চাচার এমন চেঁচানো কন্ঠ শুনে হুঁশ ফিরল যূথীর।সে যে কখন পানির পাইপটা ফুল গাছে থেকে সরিয়ে মিঠু চাচার উপর দিয়ে দিয়েছে খেয়াল নেই।
যূথী আবার বারান্দার দিকে তাকালো।নিশান এখনো একই ভাবে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।
—আমি দুঃখিত চাচা।
এটা বলেই যূথী পানির পাইপ ফেলে দিয়ে এক দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।রুমে এসে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পরল।
বালিশে মুখ গুঁজে রেখেছে যূথী।একটু আগের ঘটনাটা কি ছিল এটা? নির্লজ্জের মত সে নিশান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল! উনি এখন কি না কি ভাববে।সকাল সকাল মাইন্ড ফ্রেস করার জন্য বাগানে গিয়েছে উল্টে এমন একটা লজ্জাকর ঘটনা ঘটে গেল।যূথী মনে মনে ঠিক করে নিল আজকের পর থেকে নিশান ভাইয়ার সামনে কোনোমতেই যাওয়া যাবে না।
_________________
থালার আকারের বিশাল একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে।নিঃসন্দেহে রাতের এই সৌন্দর্য ছুয়ে যাবে সকলের মনে।পূর্ণিমার এমন অপরূপ চাঁদের আলো দেখে যে কেউই বলে উঠবে -“বাহ্! চমৎকার তো!”
কিন্তু আশেপাশের এই সৌন্দর্য স্পর্শ করছে না নিশানকে।তাঁর হৃদয়ে আগুন জ্বলছে। এর কারণ একমাত্র যূথী।
হাতে ড্রিংকসের বোতল নিয়ে ছাদে বসে আছে নিশান।আজ অনেকদিন পর এই জিনিসটা হাতে নিয়েছে।কিন্তু তবুও তাঁর মাথা ঠান্ডা হচ্ছে না।অফিসের কাজেও ঠিকমতো মন বসাতে পারেনি।তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছিল।ভেবেছিল খাওয়ার সময় ডাইনিং টেবিলে যূথীর দেখা পাবে।কিন্তু মেয়েটার ছায়াও দেখেনি সেখানে।নিশ্চিত সকালের ঘটনার কারণে তাঁর সামনে আসতে ইতস্তত বোধ করছে।
তখন যূথীকে দেখতে না পেয়ে মাথাটা আরো বিগড়ে গেছে।নিশান অনেক ভেবে চিন্তেও কোনো যুক্তি বের করতে পারে নি।একটা পিচ্চি মেয়ের এত ক্ষমতা যে নিশানকে কাবু করে ফেলল? তবে কি সে যূথীকে ভালোবেসে ফেলেছে? কিন্তু এ ভালোবাসার পরিণতি কি?
হঠাৎই নিশানের ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসির রেখা ফুটে উঠল।ড্রিংকসের বোতলে একটা চুমুক দিয়ে বলতে লাগল,
—খুব বড় একটা ব্লান্ডার করে ফেলেছো যূথী! ইউ হ্যাভ টু পে ফর ইট।এখন দেখো শুধু তোমার সাথে কি কি ঘটতে থাকে!
ছাদের এককোণে ড্রিংকসের বোতলটা ফেলে টলতে টলতে সিড়ি দিয়ে নেমে গেল নিশান।
———————-
পার্কের একটা বেঞ্চে বসে আছে মনীষা, বিদীষা,নীলিমা এবং যূথী।ওরা দুপুর থেকেই প্ল্যান করছিল আজ বিকেলে ঘুরতে বের হবে।বড়দের থেকে পারমিশন নিয়ে চারজন চলে এসেছে পার্কে।
প্রত্যেকের হাতে একটা করে কোণ আইসক্রিম। কিন্তু যূথী তাঁর আইসক্রিম হাতে নিয়ে কাচুমাচু মুখে বসে আছে।অনেকক্ষণ আগেই তাঁর আইসক্রিম অর্ধেক গলে মাটিতে পরে গেছে। সেদিকে ওর খেয়ালই নেই।
আজ বিকেলে পার্কে আসার সময় যত অঘটন ঘটল।মনীষা আর নীলিমা যূথীকে জোর করে জিন্স এবং টপস্ পরিয়ে দিয়েছে।যূথী বারবার না করেছিল।কিন্তু শুনেনি ওরা। পার্কে আসার পর থেকেই সে ভীষণ অস্বস্তিতে পরে গেছে।একবার বাম হাতে একবার ডান হাতে টপস্ টাকে টেনে নিচে নামানোর চেষ্টা করছে।
যূথীর এমন অসহায় চেহারা লক্ষ্য করে মনীষা বলল,
—ইস্ যূথী! এরকম টানাটানি করো না।তুমি নিজেও জানো না কতটা সুন্দর লাগছে তোমাকে।
যূূথী ঠোট উল্টে উত্তর দিল,
—দেখো আশেপাশের মানুষ কিভাবে তাকাচ্ছে আমার দিকে।
—কোথায় তাকাচ্ছে? আমি তো দেখতে পাচ্ছি না।
যূথী নিজেও জানে কেউ তাঁকে দেখছে না।কিন্তু তবু তাঁর খুব বিরক্তবোধ হচ্ছে। আজকের পর থেকে এমন পোশাক সে আর কখনোই পরবে না।
হঠাৎই বিদীষা খুব জোরে “ওহ্ নো!” বলে চিৎকার করে উঠল।এমন চিৎকার শুনে সবার রীতিমত ভয় পাওয়ার অবস্থা।
—মনীষা আপু! ওটা নিশান ভাইয়ার গাড়ি না?
বিদীষার কথা শুনে মনীষা রাস্তার দিকে ভালোভাবে তাকাল।হ্যাঁ এটা নিশানেরই গাড়ি।মনীষাও বেশ ভয় পেয়ে গেল।ভাবছে নিশান ভাইয়া এখানে আসার কারণ কি?
বাকীদের আশ্বস্ত করে মনীষা বলল,
—রিল্যাক্স গার্লস্। ভাইয়া যদি কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে বলবি ঘুরতে এসেছি।সত্যি কথাই বলে দিব।
চারজন উৎসুক চোখে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে।ওরা ভালোই বুঝতে পারছে গাড়িটা ওদের লক্ষ্য করেই এগিয়ে আসছে।
ডার্ক ব্লু কালারের গাড়িটা থেমে যেতেই নিশান বেরিয়ে আসলো।ক্ষিপ্র গতিতে সে এগিয়ে আসছে।নিশানের এমন রূপ দেখে চারজন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
নিশান ওদের সামনে এসে দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করল,
—কি করছিস এখানে?
এমন প্রশ্ন শুনে মনীষা, বিদীষা এবং নীলিমা বেশ ঘাবড়ে গেল।ওরা নিশানের রাগের কোনো কারণ খুজে পাচ্ছে না।এর আগেও তো কতবার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়েছে তখন তো নিশান ভাইয়া এমন রিয়্যাক্ট করেনি!
নীলিমা আমতাআমতা করে বলার চেষ্টা করল,
—আ…আসলে ভাইয়া একটু ঘুরতে বের হয়েছি আর কি!
নীলিমার কথাকে পাত্তা না দিয়ে যূথীর দিকে আঙুল তাক করে নিশান বলে উঠল,
—ওকে এসব ড্রেস কেনো পরিয়েছিস?
চমকে উঠলো যূথী।নিশান আসার পর থেকে সে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল।একবারও নিশানের চোখে চোখ মেলায় নি।কিন্তু এমন একটা কথা শুনে একরাশ বিস্ময় নিয়ে সে উপরে তাকাল।নিশানও তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। একটু আগে নিশানের বলা কথাটা যেন যূথীর বোধগম্য হলো না।
বিদীষা আস্তে করে জবাব দিল,
—আসলে ভাইয়া আমরাও পরেছি তাই ভাবলাম আমাদের সাথে মিল রেখে যূথী আপুকেও পরিয়ে দিই।
—কমনসেন্সের অভাব তোদের? দেখতে পাচ্ছিস না সে আনইজি ফিল করছে এই পোশাকে? কোনো কথা না বলে চুপচাপ সব-কয়টা গাড়িতে গিয়ে উঠ।
নিশানের এমন ধমক মাখা কন্ঠ শুনে চারজন ধড়ফড় করে দাঁড়িয়ে গেল।কোনো দিকে না তাকিয়ে গাড়ির দিকে ছুটছে ওরা।এখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানেই ইজ্জতের ফালুদা হওয়া।আশেপাশের সবাই হা করে ওদের দেখছিল এতক্ষণ। কি অসম্মানের ব্যপার।
মনীষা,বিদীষা আর নীলিমা দৌড়ে গিয়ে পেছনের সিটে বসে পরল।বেচারি যূথী পরল বিপদে।সে কিছুতেই এই এটম বোম লোকটার পাশে বসতে পারবে না।যদি রেগে গিয়ে তাঁকে জানালা দিয়ে ছুড়ে বাইরে ফেলে দেয়?
নীলিমা ইশারায় যূথীকে সিটে বসে যাওয়ার জন্য বলছে।কিন্তু যূথী করুণ মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল।
নিশান যূথীকে পাশ কাটিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পরল।যখন দেখল যূথী একইভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তখন দাঁত কটমট করে বলে উঠল,
—তোমাকে গাড়িতে উঠার জন্য ইনভাইট করতে হবে?
যূথী তড়িৎ বেগে দরজার হাতল ধরে টানতে লাগল।কিন্তু খুলছে না।দুইহাতে সর্বশক্তি ব্যবহার করেও সে দরজা খুলতে পারছে না।
নিশান কয়েক সেকেন্ড শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল যূথীর দিকে।নিশানের এমন চাহনি দেখে যূথী ভয়ে ভয়ে বলল,
—খুলছে না দরজা।
মনে মনে দম ফাটানো হাসি পাচ্ছে নিশানের।ভয়ে মেয়েটার কপালে ঘাম ঝরছে।ভাবছে তাঁর লাইফলাইন তাঁকে এত ভয় পায়? তাহলে সারাজীবন তাঁর সাথে থাকবে কি করে?
গাড়ি থেকে বেরিয়ে নিশান যূথীর পাশে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল।
চলবে………..