স্বপ্নচারিণী,পর্ব_১৯
সামান্তা সিমি
“—বিয়ে করব।আর সেটা এখনই।
নিশানের এমন কথায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সকলে আরেক দফা অবাক হলো।মফিজ চৌধুরী ভাবছেন অতিরিক্ত কাজের প্রেশারে তাঁর ছেলের মাথাটা বোধ হয় গরম হয়ে উঠেছে।বেঁচে থাকতে এই ছেলের আরো কত কান্ড যে দেখতে হবে কে জানে।
“—নিশান তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি অস্বাভাবিক কথাবার্তা বলছো?
“—অস্বাভাবিক কিছু তো আমি দেখতে পাচ্ছি না বাবা।
“—রাত এগারোটায় তুমি কাজি নিয়ে এসে বলছো বিয়ে করবে এটাকে তুমি স্বাভাবিক বলছো! বিয়ে করার এতই তাড়া থাকলে দেরি করে আসলে কেনো।মাহবুব আলম তাঁর মেয়েকে নিয়ে আরো আধাঘন্টা আগে বেরিয়ে গেছে।”
নিশান চোয়াল শক্ত করে বলল,
“—আমি কি একবারও বলেছি মাহবুব আলমের মেয়েকে বিয়ে করার জন্য কাজি নিয়ে এসেছি?”
“—তাঁর মানে? কাকে বিয়ে করতে চাও তুমি?”
সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসল নিশান।হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“—যূথীকে।”
বজ্রাহতের মত সবাই তাকিয়ে আছে নিশানের দিকে।যূথী এতক্ষণ নীলিামর সাথেই দাঁড়িয়ে ছিল।একটু আগের বলা কথাটা শুনে তাঁর চোখ বড় বড় হয়ে গেল।মাথা ভনভন করে ঘুরছে।এসব কি বলছে নিশান ভাইয়া! ঢোক গিলতেই বুঝতে পারল গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।আতঙ্কে নীলিমার হাত খামচে ধরল যূথী।
মফিজ চৌধুরী হুঙ্কার ছেড়ে বললেন,
“—কিসব উদ্ভট কথাবার্তা বলছো তুমি?পাগল হয়ে গেছো নাকি আমাদেরকে পাগল ভাবছো?”
নিশান শান্ত গলায় উত্তর দিল,
“—এখানে চিৎকার করার কিছু নেই বাবা।যূথীকে আমি বিয়ে করব।আমি শুধু এটাই বলেছি।”
“—তুমি আমাদেরকে না জানিয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত কিভাবে নিতে পারো?আমাদের মতামত জানারও প্রয়োজন মনে করো নি!আমি ঐশীর সাথে তোমার বিয়ে নিয়ে কথা বলার জন্য মাহবুব আলমকে ডেকেছি বাড়িতে।সব জানার পরেও তুমি কাজি নিয়ে এসেছো যূথীকে বিয়ে করবে বলে?”
“—তোমাদেরকে না জানিয়ে এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি এরজন্য আমি খুবই দুঃখিত।আর সাথে এটাও জানিয়ে রাখছি যূথীকে আমি ভালোবাসি এবং ওঁকে এই মুহূর্তেই বিয়ে করব।”
মফিজ চৌধুরী কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলেন।ড্রয়িংরুমে উপস্থিত বাকিরাও মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।ভয়ে কাঠ হয়ে আছে ওঁরা সাথে অবাকও।নিশানের এই রূপ তাঁদের অপরিচিত।যে ছেলেকে এতদিন তাঁরা অনুভূতি শূণ্য মানুষ বলে জেনে এসেছে সেই ছেলে বলছে কাউকে ভালোবাসে।একটা মানুষের এতটা পরিবর্তন কি করে হতে পারে!
যূথীর চোখে পানি টলমল করছে।আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে সে বোধ হয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।শরীরের স্নায়ুতন্ত্রগুলো কাজ করছে না ঠিকমত।নীলিমা যূথীর অবস্থা বুঝতে পেরে ওঁকে একহাতে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে।
মফিজ চৌধুরী কঠোর গলায় বলে উঠলেন,
“—তোমার এই সিদ্ধান্ত অন্য কেউ মানুক কিন্তু আমি মানবো না।যে মেয়ের বাড়ি-ঘরের কোনো ঠিকানা নেই,মা-বাবা নেই তাঁকে আমি ছেলের বউ হিসেবে কখনোই গ্রহণ করব না।”
এতক্ষণ পর্যন্ত নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করতে পারলেও এবার নিশান মেজাজ হারিয়ে ফেলল।হাতে থাকা কাঁচের গ্লাসটা মাটিতে ছুড়ে গর্জে উঠে বলল,
“—তুমি মানো বা না মানো এতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।যূথীর বাড়ি ঘর দিয়ে তো আমার কোনো কাজ নেই।যূথীর মা-বাবা’কে তো আমার দরকার নেই।আমার যূথীকে হলেই চলবে।বিয়েটা আমি যূথীকেই করব।”
মফিজ চৌধুরী থমথমে মুখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।অন্যদিকে কাজি লোকটা হা করে সব কিছু দেখছে।এমন কাহিনী সে জীবনেও দেখেনি।বড়লোকদের যতসব বর বড় কারবার।মনে মনে মুখ ভেঙচালো সে।
কিছুক্ষণ থেমে নিশান এবার বলল,
“—কাম হেয়ার যূথী।
যূথীর ভেতরের আত্নাটা লাফিয়ে উঠল।সে মনে মনে সবসময় চাইত যে তাঁকে নিয়ে যেন এই বাড়িতে কখনো কোনো ঝামেলা না হয়।কিন্তু ঝামলো তো নিজ পায়ে হেঁটে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।কি করবে এখন!
“—কি বলছি শুনতে পাচ্ছো না! এখানে আসো।”
যূথী চমকে নিশানের দিকে তাকালো।লোকটার চোখেমুখে অজস্র রাগের আভাস।রক্তিম চোখগুলো যেন যূথীকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে।কেনো এরকম পাগলামি করছে নিশান ভাইয়া!উনি কি বুঝতে পারছেন না যে উনার করা একটা ভুলের কারণে এই পরিবারে কি কি দুর্যোগ নেমে আসতে পারে!
যূথী কম্পিত গলায় বলে বসল,
“—আমি আপনাকে বিয়ে করব না।”
নিশান আগের চেয়েও জোর গলায় বলল,
“—তোমাকে আমি অপশন দেইনি বিয়ে করবে কি করবে না।তোমাকে বলেছি এখানে আসতে।চুপচাপ সোফায় বসো।একটা টু শব্দ করলে তোমার অবস্থা যে আমি কি করব নিজেও জানি না।”
‘
‘
‘
সকলের উপস্থিতিতে যূথী এবং নিশানের বিয়েটা হয়ে গেল।কাজি হাসিমুখে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে বিদায় নিচ্ছে।বড় লোকদের যতসব বড় বড় কারবার এই কথাটা সে মনে মনে আরো একবার উচ্চারণ করে নিল।
যূথী মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছে।গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে তাঁর জীবন এভাবে মোড় নিবে এটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি।চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।আগামী দিনগুলো না জানি কি ভয়াবহ হয়।বাড়ির প্রত্যকেটা মানুষের তোপের মুখে পরতে হবে তাঁকে।বড়মা কত ভালোবেসে এখানে নিয়ে এসেছে।এখন বড়মা’র সামনে মুখ দেখাবে কি করে!
“—রুমে চলো।এরকম অসহায়ের মত বসে আছো কেনো?”
নিশানের ডাকে বাস্তবে ফিরল যূথী।কিছু বুঝে উঠার আগেই নিশান যূথীর হাত ধরে টেনে উপরে নিয়ে গেল।যূথী যেন রোবট হয়ে গেছে। তাঁকে যা করতে বলা হচ্ছে তাই করে যাচ্ছে।
দরজা বন্ধ করার শব্দে যূথী চমকে উঠল।চারদিকে তাকিয়ে দেখে এটা তাঁর রুম নয়।নিশানের রুম।হঠাৎ করে যূথীর রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।এতক্ষণ ড্রয়িংরুমে লজ্জায় ভয়ে কিছু বলতে পারেনি।
শুধুমাত্র এই লোকটার জন্য এসব ঝামেলা।এতদিন পর্যন্ত সবকিছু কত সুন্দরভাবে চলছিল।মাঝখান থেকে নিশান ভাইয়ার এই একটা কাজের জন্য যত গোলমাল বাঁধলো।
যূথী ছুটে নিশানের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল,
“—কেনো বিয়ে করেছেন আমাকে?বিয়েটা কি ছেলেখেলা পেয়েছেন?একবার আমার দিকটা ভেবে দেখেছেন?এখন সবাই তো ভাববে আমি বাড়ির ছেলেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছি।আপনাকে তো ভয়েও কেউ কিছু বলবে না।সকলে যখন আমাকে অপমান করে কথা বলবে তখন আপনি শান্তি পাবেন তাই তো! ঝোঁকের বশে বিয়েটা করেছেন।পরে যখন ভুল বুঝতে পারবেন তখন কি করবেন?”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামল যূথী।জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে।চোখের পানি ধরে রাখতে গিয়েও ব্যর্থ হলো সে।
নিশান স্থির চাহনি দিয়ে তাকিয়ে আছে যূথীর দিকে।হাত দিয়ে চোখের জলটা মুছে বলল,
“—শান্ত হও।আমি তোমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি।কেউ তোমাকে কিছু বলবে না।ভয় পেয়ো না।আর ঝোঁকের বশে বিয়ে করেছি মানে! আমি যা করেছি ভেবে চিন্তেই করেছি।বুঝো না কতটা ভালোবাসি তোমায়!”
নিশানের মুখে ভালোবাসি কথাটা শোনামাত্রই যূথী চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল।রুপকথার রাজকুমারদের মত দেখতে এই লোকটা তাঁকে ভালোবাসি বলছে।তাঁর জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে কি করত! আনন্দে লাফিয়ে উঠত নাকি কথাটা সবাইকে বলে বেড়াত।কিন্তু তাঁর তো ইচ্ছে করছে এই লোকটাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে।লোকটার বুকে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে কেনো এত জ্বালাতন করে তাঁকে।কেনো এমন মায়ায় জড়িয়ে ফেলছে।
যূথীর মনের অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে নিশান বলল,
“—একটু অপেক্ষা করো।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
যূথী চুপচাপ বিছানায় বসে আছে।কি থেকে কি হয়ে গেল।সবকিছু কেমন উলটপালট লাগছে তাঁর কাছে।ভাবতে গেলেই মাথাব্যথা শুরু হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে এই রুমে কেনো বসে আছে।এখানে তো কোনো কাজ নেই!
তখনই নিশান খালি গায়ে গলায় টাওয়াল ঝুলিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো।পড়নে চেক চেক নীল রংয়ের ট্রাউজার্স।
যূথী একবার সেদিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল।বিছানা থেকে উঠে দরজার কাছে যেতেই নিশান ধমকে উঠে বলল,
“—আমার পারমিশন ছাড়া কোথায় যাচ্ছো?”
যূথী শুকনো গলায় উত্তর দিল,
“—ঘুম পাচ্ছে। রুমে যাব।”
“—এটা কি রুম নয়?”
“—এটা আপনার রুম।আমি আমার রুমে যাচ্ছি। ”
নিশানের পাল্টা জবাব,
“—আজকের পর থেকে আমার তোমার বলতে কিছু নেই।সব আমাদের। কথাটা যেন মাথায় থাকে।এখন সাইলেন্ট মুডে বিছানায় শুয়ে পরো।”
নিশানের কথা শুনে বাজ পরল যূথীর মাথায়।কি বলছে এইলোক! তাঁকে কি এখন নিশান ভাইয়ার সাথে ঘুমাতে হবে নাকি।অসম্ভব! মরে গেলেও সে এটা করবে না।কি পেয়েছে এই লোক? যখন যা বলবে সেটাই মানতে হবে নাকি।কি মনে করে নিজেকে!
“—আমি আপনার সাথে ঘুমাব না।কখনোই না।”
হাতের টাওয়ালটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে নিশান এগিয়ে গেল।
“—আমার রাগ উঠিও না যূথী।যা বলছি শুনো।”
যূথী ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল সে নিশানের কথা শুনতে নারাজ।
চলবে……..