স্বপ্নচারিণী,পর্ব- ২৬,২৭ শেষ পর্ব

স্বপ্নচারিণী,পর্ব- ২৬,২৭ শেষ পর্ব
সামান্তা সিমি
পর্ব_২৬

ঘোমটা টা হালকা একটু তুলে দেখার চেষ্টা করল আসলে হচ্ছে টা কি।
সামনের দৃশ্যটা দেখে হতভম্ব হয়ে গেল যূথী।
নিশান ড্রয়ার থেকে সিগারেট নিয়ে বারান্দার দিকে যাচ্ছে। গায়ে ধূসর রঙের একটা টি-শার্ট আর পরনে ব্ল্যাক কালারের ট্রাউজার্স।
বাসর রাতে বউ রেখে কেউ সিগারেট খেতে যায় এটা যূথীর জানা ছিল না।বিয়ের পাঞ্জাবিও খুলে ফেলেছে।রাগে যূথীর শরীর জ্বলে যাচ্ছে। যার জন্য সেজেগুজে বসে আছে সেই মানুষটাই তাঁকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দূরে গিয়ে বসে আছে।এই লোক নাকি তাঁকে ভালোবাসে।কেমন ভালোবাসা এটা!অভিমানে যূথীর প্রায় কান্না আসার উপক্রম।
বিছানায় ছড়িয়ে থাকা গোলাপের পাপড়ি গুলো হাত দিয়ে ফেলে দিল।খাটে লাগানো ফুলগুলোকে টেনে ছিড়ে ফেলতে মন চাইছে।
বিছানা থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরল।থমকে গেল যূথী।
বউ সাজে নিজেকে দেখে নিজেই মোহিত হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের তাড়াহুড়োয় তখন ভালোভাবে দেখার সুযোগই হয় নি।খয়েরি রঙয়ের লেহেঙ্গায় কি সুন্দর দেখাচ্ছে তাঁকে।সারা শরীর গয়নায় ঝলমল করছে।লজ্জা পেয়ে গেল যূথী।নিজের প্রশংসা কেউ নিজেই করছে এরকম হয়েছে কখনো!
ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠতেই তা আবার মিলিয়ে গেল।এত সাজগোজ করে কি লাভ হলো!যার জন্য সেজেছে সে তো চোখ তুলেও দেখেনি।
ড্রেসিং টেবিলের পাশ থেকে লাগেজ নিয়ে খুলতেই দেখল শাড়ি দিয়ে ঠাসা।দেখলেই বুঝা যায় শাড়ি গুলো বেশ দামি।বড়মা বলেছিল এগুলো নাকি নিশান ভাইয়া নিজের পছন্দমত কিনে এনেছে।মুখ ভেংচালো যূথী।সব নাটক! সব ঢং!

ভাঙাচুরা মন নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে রওনা হলো সে।হাতে লাল রঙের একটা শাড়ি।অনেকক্ষণ থেকেই লেহেঙ্গাটা গায়ে ফুটছে।আর ভারী মেকাপের কারণে তো দম বন্ধ হয়ে আসছে তাঁর।তাই একেবারে গোসল শেষ করেই বেরিয়ে আসলো।
রুমে কেউ নেই।তাঁর মানে নিশান ভাইয়া এখনো বারান্দায়। থাকুক বারান্দায়। যূথী ওখানে একদমই যাবে না।চুপচাপ ঘুমিয়ে পরবে এখন।

যাবে না যাবে না করেও যূথী বারান্দায় একবার উঁকি দিল।নিশান আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে।
গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল যূথী।

“—ঘুমাবেন না?”

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল নিশান।যূথীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে আবার সামনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল যেন কিছুই শুনতে পায় নি।
ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে আছে যূথী।নিশানের ভাব-গতিক সে ঠাওর করতে পারছে না।

“—ঠিক আছে।আপনি না হয় বারান্দাতেই থাকেন আজ।আর বিরক্ত করব না আমি।গুডনাইট। ”

রাগে গজগজ করতে করতে যূথী রুমে আসল।ধপ করে বসে পরল বিছানায়।রাগে মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তাঁর।এ কেমন ব্যবহার নিশান ভাইয়ার! কিছু বলছেও না কিছু শুনছেও না।শুধু মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে।
মস্ত বড় একটা হাই তুলল যূথী।এতক্ষণে টের পেল ঘুমে তাঁর চোখ জ্বালা করছে।বিয়ে উপলক্ষে এ কয়েকদিন তো কম ধকল যায় নি।
যূথী বালিশে মাথা রাখতে যাবে সেই মুহূর্তে রুমে নিশানের আগমন। চোখগুলো লাল হয়ে আছে। নিশ্চয়ই সিগারেট খাওয়ার কারণে এই অবস্থা। নিশানকে দেখতে পেয়েই যূথী আবার সটান হয়ে বসে পরল।
রুমের সব লাইটগুলো নিভিয়ে দিল নিশান।মোমবাতির হলদে আভায় চারদিক ঝলমল করছে।শুভ্র রঙের দেয়ালে রুমের আসবাবপত্র গুলোর অদ্ভুত অদ্ভুত ছায়া তৈরি হয়েছে।
যূথী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে নিশানের দিকে।এই রহস্যময় লোকটার রসহ্যের কূল কিনারা সে কখনো খুঁজে পায় নি।এখনো পাচ্ছে না।
নিশান হালকা ধাক্কা দিয়ে যূথীকে ফেলে দিল বিছানায়।
দুই দিকে হাতে ভর দিয়ে একটু ঝুকে এল।
যূথী কিছু বলছে না।রক্তশূণ্য মুখে চেয়ে আছে শুধু।নিশান যূথীর কপালে ছড়িয়ে থাকা এলো চুলগুলো ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিল।তৎক্ষনাৎ চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল যূথী।

“— রাগ করেছো আমার সাথে?এই যে তোমাকে রেখে আমি বারান্দায় গিয়ে বসে আছি! কি করব বলো!তোমাকে বউ সাজে দেখে যে আমি তোমাতেই আটকে গেছি।কিছু ভালো লাগছে না আমার।তোমার কাছে আসতেও যে আমার নার্ভাস লাগছে।বুঝতে পারছো কি বলছি?নাফিজ ইমতিয়াজ নিশানের নার্ভাস লাগছে।খুব হাস্যকর না কথাটা?কিন্তু এটাই সত্যি। তাই তো তখন রুমে এসে আমি তোমাকে দেখেই সিগারেট নিয়ে বারান্দায় চলে গেছি।”

নিশানের এমন ঘোর লাগা কথা শুনে যূথীর সব চিন্তা ভাবনা কুন্ডলী পাকিয়ে আসছে।এতদিন হার্ট অ্যাটাক হতে গিয়েও হয় নি।আজ নির্ঘাত অঘটন ঘটেই যাবে।নিশানের চোখের দিকে তাকানোর সাহসও নেই তাঁর। এখনো দুচোখ বন্ধ করে আছে।

“—আমার দিকে তাকাও যূথী।আমাকে কি আজ খুন করে ফেলার প্ল্যান করেছো?কিছুক্ষণ আগে লাল টকটকে শাড়ি পড়ে ভেজা চুলে আমার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছো।ভাবতে পারছো আমার অবস্থাটা তখন কি হয়েছিল?এটা কি ঠিক করলে?
জানো যেদিন বাগানে সাফার সাথে দৌড়াতে দেখেছিলাম তোমাকে সেদিন আমার ঘুম উধাও হয়ে গেছিল।নিজেকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে তুমি আমার বোনেদের বয়সী।ওঁদের যে নজরে দেখি তোমাকেও সেই জায়গাটায় রাখতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি।দিন দিন আসক্তি বেড়েই চলেছে তোমার প্রতি।তোমাকে বলেছিলাম অনেক টাইম দেব। কিন্তু পারছি না আমি।তোমাকে কাছে চাই।খুব কাছে।যতটা কাছে পেলে কেউ তোমাকে আমার থেকে দূরে নিতে পারবে না।তুমি শুধু আমার যূথী।”

নিশানের কথাগুলো যূথীর হৃদয়কে স্পর্শ করে যাচ্ছে। কারোর কথাও কি এত ভালোবাসাময় হতে পারে?কেউ তাঁকে এমন গভীরভাবে ভালোবাসবে তা কখনোই ভাবে নি।সত্যিই এত সুখ তাঁর ভাগ্যে আছে!
হালকা কাঁপছে যূথী।চোখ খুলতেই দেখে নিশান তাঁর দিকে মায়াবী চোখে তাকিয়ে আছে। যেই চোখে খেলা করছে এক সমুদ্র ভালোবাসা। সবটুকুই যূথীর জন্য।যূথী এই ভালোবাসায় সারাজীবন ডুবে থাকতে চায়।হাত বাড়িয়ে নিশানের গালে হাত ছোঁয়ালো যূথী।কম্পিত গলায় বলে উঠল,

“—আমি শুধু আপনার।আর কারো নয়।আমিও যে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি নিশান।”

নিশানের ধৈর্য্যের বাঁধ শেষ।আর বিলম্ব না করে যূথীর ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করে দিল।ধীরে ধীরে সেই স্পর্শ হতে লাগল গভীর থেকে গভীরতর।
রাত বাড়ার সাথে আকাশের চাঁদের আলোও ফিকে হয়ে আসলো।রুমের মোমবাতিগুলো প্রায় নিভু নিভু।মোমবাতির মৃদু আলো আর বাইরের আবছা অন্ধকারে রুমের পরিবেশটা এক অন্যরকম রূপ ধারণ করেছে।

______________________

রিসিপশনের অনুষ্ঠানে যূথী সেজে উঠেছে অপরূপ এক সাজে।গায়ে দামি শাড়ি আর সোনায় বাঁধানো গয়না।বাড়ির ভেতরে আনাচে কানাচে চিকচিক করছে নানা রঙের লাইটের আলো।এ যেন কোনো রূপকথার প্রাসাদ আর যূথী সেই প্রাসাদের রানী।
অন্যদিকে নিশানও কোনো অংশে কম নয়।ডার্ক ব্লু স্যুট বুটে সকলের নজর কেঁড়ে নিচ্ছে সে।
বাড়ির পরিবেশ লোকে লোকারণ্য। সকলের কলহাস্যে আবহাওয়া মুখরিত।
লতিফা বেগম যূথী আর নিশানের বিয়ের চার-পাঁচ দিন আগেই এসেছিলেন।দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছেন যূথীকে।মেয়েটার মুখ খুশিতে আলোড়িত। দেখলেও চোখ জুড়িয়ে যায়।অবশেষে যূথীর কষ্টের দিনগুলো শেষ হলো।তিনি মন থেকে দোয়া করছেন ওঁরা দুজন যেন সুখী হয়।

নিশানের ফোনে কল আসতেই সে বেরিয়ে গেল।সকলে অনেক চেষ্টা করেছে বাঁধা দেওয়ার।কিন্তু নিশান শুনেনি।অফিসে নাকি তাঁর খুব জরুরি কোনো কাজ রয়ে গেছে।
এদিকে কাপল পিক তোলার জন্য নিশানের ডাক পরেছে।মনীষা ভাইকে খুঁজতে এসে দেখে সে অনেকক্ষণ আগেই চলে গেছে।ব্যস মুখ অন্ধকার হয়ে গেল সবার।

প্রায় ঘন্টা খানেক পর বাড়ি ফিরল নিশান।ততক্ষণে বাড়ি প্রায় ফাঁকা।যূথী এখনো ফুলে সাজানো সোফাটায় ঠায় বসে আছে।তাঁকে ঘিরে আছে মনীষারা।কাপল পিক না তুলে নাকি ওঁরা ছাড়বে না।সারাদিনের ধকলে তাঁর শরীর খুবই ক্লান্ত। কিন্তু কি আর করা।মেয়েগুলো তো বড্ড জেদি।অবশেষে ছবি তুলেই ক্ষান্ত হলো তিনবোন।

নিশানের অনেক আগেই রুমে এসেছে যূথী।ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছে তাঁর।সাজানো-গোছানো বিছানাটা দেখে যূথী আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না।দৌড়ে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

রুমে এসে নিশান দেখে যূথী গভীর ঘুমে।মৃদু হাসল সে।মেয়েটা চেঞ্জও করেনি।এই ভারী ভারী অর্নামেন্টস নিয়ে সারারাত থাকবে কিভাবে।
নিশান কাছে গিয়ে একে একে সব গয়না খুলে দিল।যূথীকে ঠিক করে বালিশে শুইয়ে দিল।
আজ নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে নিশানের।ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দ বোধ হয় একেই বলে।

চলবে….

স্বপ্নচারিণী
সামান্তা সিমি
পর্ব_২৭ (শেষ পর্ব)

বাবা-মা’য়ের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে যূথী।চোখের কোনে নোনা জল।জন্মদাত্রী মা’য়ের চেহারা শত চেষ্টা করেও মনে করতে পারছে না।কিন্তু যে মা তাঁকে লালন-পালন করে অসীম ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছে সেই মা’য়ের হাসিমাখা মুখটা চোখে ভাসছে।কি মিষ্টি ছিল সেই মুখ!

চোখের জল মুছে পেছনে ফিরতেই যূথীর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে নিশান দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে লোকটাকে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।গায়ে কালো রঙের শার্ট,পরনে জিন্স।চোখে সানগ্লাস। কালো রঙটা যেন গায়ে ফুটে রয়েছে।এই লোকটি তাঁর বর ভাবতেই মনে একধরনের মাতাল হাওয়া বয়ে যায়।
এই মুহূর্তে যূথীর মা’য়ের বলা কিছু কথা মনে পড়ছে।তাঁর মা’য়ের খুব ইচ্ছে ছিল ভালো একটা ছেলের সাথে তাঁর বিয়ে দেওয়া।দিনরাত আল্লাহর কাছে এটাই দোয়া করত।কিন্তু আল্লাহ তো তাঁর মায়ের সেই আশাটাও পূরণ করে দিয়েছে।মা কি দূরে থেকেও এই খবরটা জানতে পেরেছে?
আজ সকালে হঠাৎ করেই নিশান রেডি হতে বলেছিল।কোথায় নাকি নিয়ে যাবে।যূথী অনেকবার জানার প্রয়াস করেছিল।কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে।

গ্রামের রাস্তা দিয়ে গাড়ি ঢুকতেই যূথী প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল।তাহলে এটাই ছিল নিশানের প্ল্যান।আজ কতগুলো মাস পর সে নিজ গ্রামে পা রেখেছে।কৃতজ্ঞতা ভরা চোখে যূথী কিছুক্ষণ নিশানের দিকে তাকিয়ে ছিল।তার বদলে নিশান সুমিষ্ট একটি হাসি উপহার দিয়েছে।

যূথী কাছে আসতেই ফোন থেকে চোখ তুলে নিশান বলল,

“—উঠো গাড়িতে।”

“—এখন কোথায় যাব আমরা?

“—ঢাকা ব্যাক করব।”

যূথী অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল,
“—না না।প্লিজ আরো কয়েক ঘন্টা থাকি।কত্তদিন পর গ্রামে এসেছি বুঝতে পারছেন?আমি কিছুক্ষণ রাস্তায় রাস্তায় হাঁটব তারপর চেনা জানা সবার সাথে দেখা করব।”

“—হোয়্যাট!এই কড়া রোদের মধ্যে তুমি রাস্তায় হেঁটে বেড়াবে! নেভার।এক্ষুনি গাড়িতে উঠো।”

“—এমন করছেন কেনো আপনি?আপনাকে তো আর হাঁটতে বলিনি।আপনি থাকুন এখানে।আমি একাই যাব।”

“—যূথী মার কিন্তু একটাও মাটিতে পরবে না।জলদি উঠো।”

মুখ ভেঙচালো যূথী।শখ কত।তাঁকে নাকি মারবে।এতই সোজা!
“—আমি যাচ্ছি। কিছুক্ষণ ঘুরে-ফিরে আবার চলে আসব।”

নিশান চোখ লাল করে তাকাল।কিন্তু যূথী তা পাত্তা না দিয়ে অলরেডি হাঁটা শুরু করে দিয়েছে।অগত্যা নিশানও যূথীর সাথে গেল।বউকে সে একা কিছুতেই ছাড়বে না।

বুকভরে জোরে শ্বাস নিল যূথী।মাটির গন্ধ নাকে লাগছে।এ যেন এক অন্যরকম সুখ।
যূথীদের বাড়ির সামনে এসেই সে থমকে দাঁড়িয়ে গেল।চোখের সামনে ভেসে উঠছে হাজারো স্মৃতি।
ভাঙাচোরা বাড়িটার চেহারা এখন আরো দুর্দশাগ্রস্ত।এ জায়গাটার সাথে তাঁর জন্মের সম্পর্ক,নাড়ীর সম্পর্ক।
যূথীর চোখে পানি লক্ষ্য করে নিশান তীব্র গলায় বলল,

“—এরজন্য এসেছো এখানে?দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদার জন্য এসেছো?”

“—কি করব! পুরনো দিনের কথাগুলো মনে পড়ছে।”

“—যে জিনিস তোমার চোখের জল ঝরায় তা আমি তোমায় মনে করতে দিব না।”

যূথী কিছু বলল না।শুধু কৌতূহল পূর্ণ চোখে তাকিয়ে রইল।এই অদ্ভুত লোকের যত আশ্চর্যজনক কথাবার্তা।



ঢাকা ফিরতে ফিরতে ওঁদের সন্ধ্যা হয়ে গেল।যূথী কিছুটা মুখ ফুলিয়ে রেখেছে।সে কতবার করে বলেছিল গ্রামের পরিচিত মানুষ গুলোর সাথে দেখা করে আসবে।নিশান রাজি হয়নি।এমনকি লতিফা চাচীর বাড়িও যেতে দেয় নি।নিজের খালামণির সাথে তো অন্তত দেখা করা উচিত ছিল।যূথী কিছু বলতে যেতেই বিরাট এক ধমক দিয়ে দিল।এরপর থেকেই সে মুখ কালো করে রেখেছে।

যূথী বাড়ির ভেতর ঢুকতেই দেখে ড্রয়িংরুমে একজন মহিলা বসে আছে।পাশেই নীলুফা চৌধুরী। যূথী কখনো এই মহিলাটাকে এ বাড়িতে দেখেনি।
সে মেইন ডোরের সামনে এখনো দাঁড়িয়ে আছে।মহিলাটার সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না।চেহারায় কেমন কঠোর কঠোর ভাব।মা’য়ের বয়সী মহিলাদের চেহারা এমন হলে একটুও মানায় না।তাঁদের মুখ হবে অসম্ভব কোমলতায় ভরা যাতে দেখলেই শান্তি লাগবে।কিন্তু সোফায় বসা ওই মহিলার মধ্যে এরকম কিছুই নেই।

“—ওমা যূথী! তুমি কখন এলে?আর ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?এসো। ”

যূথী ধীর পায়ে বড়মার কাছে গিয়ে বসল।কঠোর মহিলা এখন যূথীর দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যূথী ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছে। মহিলার উদ্দেশ্যটা কি!এমনভাবে তাঁকে পরখ করছে যেন সে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামী।

“—নিশান কোথায় যূথী?সে কি আবার অফিসে গেছে?”

“—না বড়মা! উনি বাগানে আছেন।কে যেন ফোন দিয়েছে।কথা বলছে।”

“—আচ্ছা উনাকে তো তুমি চিনো না।উনি হচ্ছেন নিশানের দূর সম্পর্কের চাচী।অনেকদিন পর বাড়িতে এসেছে।সালাম করো।”

যূথী সালাম করার পরও মহিলার ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হলো না।
এবার নীলুফা চৌধুরী বললেন,
“—মিতা আপা! এ হচ্ছে যূথী।আমাদের নিশানের স্ত্রী। ”

যূথী আড়চোখে নিশানের চাচীর দিকে তাকালো।মহিলার দৃষ্টি আগের চেয়ে আরো কঠিন হয়ে গেছে।
হঠাৎই রূঢ় কন্ঠে বলল,

“—তোমার ছেলের বউ তোমাকে এখনো বড়মা কেনো ডাকছে নীলুফা?শ্বাশুড়িকে তো বড়মা ডাকতে শুনিনি কখনো।”

নীলুফা চৌধুরী আমতাআমতা করে বলল,
“—আসলে আপা অনেকদিনের অভ্যাস তো।এটা সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে।”

“—সবই বুঝলাম নীলুফা। তবে আমি আশা করেছিলাম নিশানের বউ নিশানের মতই হবে।তোমাদের পরিবারে তো সবাই ফর্সা।সেই তুলনায় এই মেয়ে তো ভিন্ন।মেয়েটার বুদ্ধি বেশ ভালোই।প্ল্যান খাটিয়ে এ বাড়ির বড় বউয়ের আসনে বসে গেছে। ”

যূথী মাথা নিচু করে ফেলল।সে আগে থেকেই বুঝেছিল এই মহিলা বেশি সুবিধার না।মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছে তাঁকে।শেষের কথাটায় খুব আঘাত পেয়েছে সে।ঠোঁট চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।কেউ চোখের জল দেখে ফেললে খুবই লজ্জার ব্যপার হবে।

নীলুফা চৌধুরী’র মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। তাঁর বাড়িতে এসে কেউ তাঁর ছেলের বউকে অপমান করে যাবে এটা তিনি মানতে পারছেন না।তিনি কিছু বলতে নিবেন তখনই নিশানের ভারী গলা শোনা গেল।

“—যূথী যদি প্ল্যান করে বাড়ির বউ হয়ে থাকে তাহলে তাই।আপনার তো এতে কোনো সমস্যা নেই।সমালোচনা করে কি লাভ হচ্ছে আপনার?কেউ সেলারি দেয় আপনাকে?আমার বউ ফর্সা নাকি কালো এটা নিয়েও ভাবতে হবে না।যূথীকে আমি ভালোবাসি। আমার কাছে এটাই সত্যি। ওঁর হাত ধরেই আমি সারাজীবন কাটিয়ে দিতে চাই।আপনি তো আপনার ছেলের জন্য ফর্সা বউ এনেছেন।সে তো আপনাকে দু পয়সারও দাম দেয় না।অন্যেরটা না দেখে নিজের চরকায় তেল দিন।আপনিও খুশি আমরাও খুশি।”

মিতা রাহমান তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন।এত অপমান জনক কথা আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারে নি তাঁকে।তিনি ভুলটা কি বলেছেন?যা ঠিক মনে হয়েছে সেটাই ওঁদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

“—তুমি আমার সাথে অভদ্রের মত ব্যবহার করছো নিশান!কিসের এত দেমাগ তোমাদের?টাকার গরম দেখাও?টাকা আমােদরও কিছু কম নেই।এখানে আমি আর এক মুহূর্তও থাকব না।”

নিশান সহজ গলায় বলল,
“—আমার বউকে অপমান করে এমনিতেই অনেক অন্যায় করে ফেলেছেন। আমিই আপনাকে চলে যেতে বলতাম।এখন যেহেতু নিজে থেকেই যেতে চাইছেন সেটা খুবই ভালো কথা।আর আসবেন না কখনো আমাদের বাড়িতে। ”

মিতা রাহমানের মুখ রাগে থমথম করছে।আর কিছু না বলে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন।

“—তুমি এখানে বসে আছো কেনো!যাও রুমে যাও।”

নিশানের ধমকে কিছুটা কেঁপে উঠল যূথী।সে কি দোষ করল বুঝতে পারছে না।
চোখের কোণা দিয়ে একবার নিশানের দিকে তাকিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠে গেল।



রাতে নিশান রুমে এসে দেখে যূথী শুকনো মুখে বসে আছে।
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“—কি হয়েছে?”

যূথী কোনো উত্তর দিল না।এমন ভাব করছে যেন রুমে কেউই নেই।উঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল।

“—আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি যূথী! কিছু বলছো না কেনো।”
যূথী এবার কিছুটা রাগী গলায় বলল,
“—আপনার সাথে কোনো কথা নেই আমার।যখন তখন আমাকে ধমকাবেন,বকবেন।কি পেয়েছেন আপনি!ওই সময় বড়মার সামনেও ধমক দিয়েছেন আমায়।”

“—তো!”

“—তো মানে?আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে এক্কেবারে নির্দোষ আপনি।কিছুই করেননি।শুনে রাখুন আমি আর কখনো আপনার সাথে কথা বলব না।আপনিও বলতে আসবেন না।”

“—তাই!”

নিশান যূথীর হাত টেনে কাছে নিয়ে আসলো।যূথী ছটফট করছে ছাড়া পাওয়ার জন্য। কিন্তু লাভ হচ্ছে না।হঠাৎ করেই নিশান যূথীর গলায় একটা কামড় বসিয়ে দিল।

“—আহ্! কি করছেন!ছাড়ুন আমাকে।”

“—আমার সাথে কথা না বললে এটা ননস্টপ চলতেই থাকবে।রাজি আছো?”

কথা বলতে বলতে নিশান আরো কয়েকটা কামড় বসিয়ে দিল।যূথী হড়বড় করে বলে উঠল।
“—আচ্ছা আচ্ছা কথা বলব আমি।এবার তো ছাড়ুন।চামড়া ছিড়ে ফেলবেন নাকি!”

মুচকি হেসে নিশান বলল,
“—বুদ্ধিমতী মেয়ে।”

“—আপনি আমার সাথে রাগ করতে পারবেন আর আমি করলেই দোষ?রাগ উঠলে তো আপনার চোখের দিকেই তাকানো যায় না।এমন মনে হয় যেন কাঁচা চিবিয়ে খাবেন।আমি এই নিয়ে কিছু বলি আপনাকে?তাহলে আমার সাথে এরকম জুলুম করেন কেনো?আমার কি একটুও রাগ করার অধিকার নেই?”

ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল নিশান।
“—না নেই।তোমার সাথে যা ইচ্ছা করব।রাগলে ধমকাবো,মাথা গরম হলে বকব।তবে যতটুকু রাগ দেখাব তার থেকেও বেশি ভালোবাসবো।আর তোমার কাজ হচ্ছে আমি রাগলে আদর দিয়ে সেই রাগ ভাঙিয়ে দেওয়া।গট ইট?”

“—বয়েই গেছে আমার।হুহ্!

যূথী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলার দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল।কেমন লাল লাল দাগ হয়ে আছে।
“—এই আপনি কি করলেন এটা?আর একটু হলে তো রক্তক্ষরণ হয়ে যেত।শুধু শুধু কি আর আপনাকে রাক্ষস বলি?”

নিশান পেছনে দাঁড়িয়ে যূথীকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল।নিমিষেই শান্ত হয়ে গেল যূথী।এতক্ষণের রাগ গুলো যেন কোথায় গায়েব হয়ে গেছে।
যূথীর কানের কাছে নিশান ফিসফিস করে বলল,

“—ভালোবাসি যূথী।”

যূথীর মুখে প্রশস্ত হাসির রেখা দেখা গেল।
“—আমিও ভালোবাসি। খুব খুব।

__________________________

কেটে গেছে অনেকগুলো দিন।একটা বছর।সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই চলছে।হাসি আনন্দে খুব ভালোই কাটছে যূথীর সময়গুলো।তবে নিশান আগের মতই আছে।যখন রাগ উঠে তখন ভয়ে যূথীকে তটস্থ থাকতে হয়।কারণ ঘরের বাইরে কাউকে কিছু না বললেও ঘরের ভেতরে এসে সব রাগ তাঁর উপরেই ঝাড়ে।আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই নিশানের মেজাজ ঠিক হয়ে যায়।সেই মুহূর্তে যূথী আরো ভয়ে থাকে।কারণ তখন নিশান বিভিন্ন বাহানায় জ্বালিয়ে মারে তাঁকে।

আজ যূথীর সবচেয়ে আনন্দের দিন।বিকেল থেকেই রুমে বসে আছে।মনে প্রচন্ড উত্তেজনা কাজ করছে।কিভাবে সে ওই মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে?কিভাবে কথাটা বলবে!কথাটা শোনার পর লোকটার মুখের এক্সপ্রেশনটা কেমন হবে?অন্তত এর জন্য হলেও কথাটা যূথীকে বলতেই হবে।
হঠাৎই রুমে নীলিমার আগমন।তাঁর চেহারা আনন্দে ঝলমল করছে।

“—যূথী! বাড়ির সবাই খুব খুশি।বিশেষ করে বড় আব্বুর উত্তেজনা দেখার মত।তুমি ভাইয়াকে খবরটা জানিয়েছো?”

“—না।”

“—এখনো জানাও নি! বড়মা বলেছে তুমি নিজে ভাইয়াকে ফোন দিতে।দেখবে ভাইয়া সবকিছু ফেলে বাড়িতে ছুটে আসবে।”

যূথী লজ্জিত হয়ে বলল,
“—নীলিমা আমি চাইছি খবরটা তোমার ভাইয়াকে সরাসরি বলব।একান্তে,নিরিবিলিতে! ”

“—বাহ্! দারুণ প্ল্যান করেছো তো।দাঁড়াও আমি সবাইকে বলে আসি কেউ যেন ভাইয়াকে আগে থেকে কিছু না বলে।”


রাত প্রায় নয়টার দিকে বাড়ি ফিরল নিশান। ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সবাই তাঁকে দেখে নিচুস্বরে হাসছে।নিশান দেখেও না দেখার ভান করে উপরে চলে গেল।

রুমে ঢুকতেই দেখে চারদিক অন্ধকারে ঘিরে আছে।ব্যাপার কি! যূথী কি রুমে নেই?নিচেও তো দেখল না।
বারান্দা থেকে কিছু একটার আওয়াজ পেতেই নিশান সেখানে গেল।

“—তুমি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছো কেনো যূথী?”

যূথী কোনো উত্তর না দিয়ে নিশানের হাত ধরে কাছে নিয়ে আসলো।
“—চুপ কেনো?”

নিশানের চোখে চোখ রেখে যূথী বলে উঠল,
“—আমাদের ভালোবাসা’র অংশ পৃথিবীতে আসতে চলেছে নিশান।আপনি বাবা হবেন আর আমি মা।”

স্তব্ধ হয়ে গেছে নিশান।কি বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না।
দূরের লাইটের আলোয় যূথী দেখতে পেল নিশানের চোখে জল চিকচিক করছে।মৃদু হাসল যূথী।সে জানে এটা নিশানের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। তাই আবার বলল,
“—আপনি বাবা হবেন নিশান।”

নিশান যূথীকে শক্ত করে বুৃকে জড়িয়ে নিল।তাঁর মন চাইছে এই মেয়েটাকে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলতে।

“—তুমি জানো না যূথী এই মুহূর্তে আমার মনে কি চলছে।বাকি মানুষদের মত আমি খুশি আনন্দের বর্ণনা দিতে পারি না।শুধু এটুকুই বলব আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজটা আজ তুমি দিলে।তুমি কিচ্ছু চিন্তা করবে না।একদম ভয় পাবে না। আমি আছি তোমার সাথে।সবসময় থাকব।”

“—আপনি আমার পাশে থাকলে আমি কখনোই ভয় পাই না।সারাজীবন আমাকে এমনভাবেই ভালোবাসবেন প্লিজ।আপনি ছাড়া আমি অচল।”

নিশান ঘোরলাগা কন্ঠে বলল,

“—আমার স্বপনচারিনী! ”

যূথী মুচকি হেসে নিশানকে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল।
__________________________
(সমাপ্ত)

1 COMMENT

  1. Tomar golpo gulor positive ending amar khub bhalo lage.. golpo positive hole durer sopno dekhte bhalo lage..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here