স্বপ্নচারিণী,পর্ব- ২০,২১,২২

স্বপ্নচারিণী,পর্ব- ২০,২১,২২
সামান্তা সিমি

পর্ব_২০

হাতের টাওয়ালটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে নিশান এগিয়ে গেল।
“—আমার রাগ উঠিও না যূথী।যা বলছি শুনো।”

যূথী ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল সে নিশানের কথা শুনতে নারাজ।

“—আমি আপনার সাথে এই রুমে থাকব না নিশান ভাইয়া।আমাকে যেতে দিন দয়া করে।”

“—এই রুমে থাকতে সমস্যা কোথায়?বউ তুমি আমার।এখন থেকে প্রতিদিনই এই রুমে থাকতে হবে তোমায়।”

“—কিসের বউ! জোর করে সকলের অমতে বিয়ে করেছেন আমায়।”

“—জোর করে হোক আর যাই হোক বিয়ে তো করেছি।সেই হিসেবে তুমি বউ আমার।”

যূথী রাগে দিশেহারা হয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরছে।সে জানে নিশানের সাথে কথায় পারবে না।তাঁকে এত জ্বালাতন করে লোকটা কি শান্তি পায় কে জানে!

“—ঠোঁটের উপর অত্যাচার করছো কেনো? এগুলো কিন্তু আমার জিনিস। ”

নিশানের কথা শুনে যূথীর কানদুটো গরম হয়ে উঠল।বিয়ে হতে না হতেই লাগামহীন কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছে।
নিশানের মুখে এখনো মৃদু হাসি ঝুলছে।যূথী একবার চোখ রাঙিয়ে সেদিকে তাকিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে বিছানার এক সাইডে শুয়ে পরল।মনে মনে নিশানকে উদ্দেশ্য করে অসংখ্য গালি ছুড়ছে।সামনাসামনি বলার সাহস তো নেই।তাই এভাবেই নিজের রাগ মিটানোর চেষ্টা করছে।
নিশান লাইট অফ করে যূথীর থেকে কয়েক হাত গ্যাপ রেখে শুয়ে পরল।

ঘুম আসছে না যূথীর।কিভাবে ঘুম আসবে! রাক্ষসের সাথে এক বিছানায় ঘুমানো যায় নাকি।যূথী ভয়ে ভয়ে একটু পর পর পেছনে ফিরে দেখার চেষ্টা করছে নিশান ঘুমিয়ে নাকি জেগে আছে।তাঁর মনে ক্ষীণ সন্দেহ যদি নিশান ভাইয়া অধিকার ফলাতে আসে!তখন বাধা দিলেও কি লোকটা শুনবে! হয়তোবা বলতে পারে তুমি আমার বউ।তোমার উপর অধিকার আছে আমার।এসব আকাশ-পাতাল ভেবে যূথী ছটফট করছে।
পরক্ষণেই নিজের মনকে বুঝালো সে যা ভাবছে তা কখনোই হবে না।নিশান ভাইয়াকে এক বিন্দু হলেও চিনে সে।আর যাইহোক এই কাজটা কখনোই করবে না।
শেষবারের মত নিশানের দিকে তাকিয়ে ঘাড় ঘোরাতেই ঘটল একটা অঘটন।ব্যালেন্স রাখতে না পেরে ধপাস করে বিছানা থেকে ফ্লোরে পরে গেল যূথী। ব্যথা পেয়ে সামান্য চিৎকার দিয়ে উঠল।
রাতের অন্ধকারে এমন আওয়াজ শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল নিশান।সারাদিনের ক্লান্তিতে মাত্রই তাঁর চোখটা লেগে আসছিল।
টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দেখে যূথী বিছানায় নেই।কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে ফ্লোরে বসে আছে।হতভম্ব হয়ে গেল নিশান।এই পাগল মেয়েটাকে নিয়ে সে যাবে কোথায়!নিশ্চয়ই বিছানার সাইডে যেতে যেতে নিচে পরে গেছে।

নিশান বেড থেকে নামতে নামতে দাঁত কটমট করে বলল,
“—ব্যথা পেয়েছো?

যূথী মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল ব্যথা পায় নি।কিন্তু তাঁর গলা ফাটিয়ে কাঁদতে মন চাইছে।এমন বেকায়দায় পরলে ব্যথা না পেয়ে কেউ কি আরাম পাবে! তাঁর কোমড়ের হাড়গোড় বোধ হয় সব পাউডার হয়ে গেছে।

নিশান ঝট করে যূথীকে কোলে নিয়ে বিছানার মাঝখানে শুইয়ে দিল।যূথীকে কিছু বলার সুযোগই দিল না।আলো নিভিয়ে একহাত দিয়ে জড়িয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল।ফ্রিজড্ হয়ে গেছে যূথী।হাত-পা প্রচন্ড গতিতে কাঁপছে।শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।এগুলো বোধ হয় হার্টঅ্যাটাক হওয়ার পূর্ব লক্ষণ।

“—প্লিজ ছা…ছাড়ুন।কেমন যেন লা..লাগছে আমার।”

যূথীর ভীত গলা নিশানকে স্পর্শ করল না।সে যেমনভাবে শুয়ে ছিল তেমনভাবেই রইল।

“—আজকের পর থেকে এভাবেই ঘুমাতে হবে।অভ্যাস করে নাও।”

শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যূথীর।লোকটার গা থেকে কেমন একটা পুরুষালি গন্ধ আসছে।মাথা ঝিমঝিম করছে তাঁর।সারারাত এভাবে থাকলে সে নির্ঘাত সকাল হতে হতে প্যারালাইজড্ রোগীর মত হয়ে যাবে।
যূথী একটু নড়াচড়া করে উঠতেই ধমক লাগালো নিশান।
“—আমি কিন্তু বারান্দা থেকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেব।চুপচাপ ঘুমাও আর আমাকেও ঘুমাতে দাও।অনেক টায়ার্ড আমি।”

যূথী আর কোনো শব্দ করার সাহস পেল না।মরার মত সারারাত নিশানের বাহুডোরে বন্দী হয়ে রইল।



ভোর হতেই নিশানের ঘুম ভেঙে গেল।আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই পাশে ঘুমিয়ে থাকা যূথীর দিকে নজর গেল।এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল নিশানের মুখে।এই মেয়েটা তাঁর বউ।হ্যাঁ! তাঁর জীবনসঙ্গী।
পৃথিবীর সমস্ত সুখ সে এই মেয়েটার পায়ে এনে দিবে।যা-ই ঘটে যাক তাঁর হাতটা কখনোই ছেড়ে দেবে না।
গতকাল রাতে সে যূথীকে বলেছিল যা করেছে ভেবে চিন্তেই করেছে।আসলে ব্যপারটা তা না।হুট করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া।দিনের পর দিন সকলে তাঁর বিয়ে নিয়ে প্রত্যক্ষভাবে পরোক্ষভাবে এত চাপ দিচ্ছিল যে হঠাৎ করেই যূথীকে বিয়ে করার চিন্তাটা মাথায় এল।অবশ্য একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে।তাঁর আর যূথীর সম্পর্কটা হয়তোবা কেউই মেনে নিত না।সকলকে মানানোর জন্য অনেক কাঠ-খড় পুড়াতে হত।সেইদিক থেকে বিয়েটা হয়ে যাওয়াতে ভালোই হয়েছে।এখন যূথীকে হারানোর ভয় একদমই নেই।
নিশান যূথীর কপালে পরে থাকা ছোট চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দিল।নিচু হয়ে টুপ করে ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে নিল।হালকা কেঁপে উঠল যূথী।বড্ড আদুরে লাগছে মেয়েটাকে! মুচকি হেসে বিছানা থেকে নেমে গেল নিশান।

_____________

কলেজের ক্যাম্পাসে একটা গাছের নিচে মন খারাপ করে বসে আছে যূথী।রুমে থাকলে এতক্ষণে কেঁদে কেটে একাকার করে ফেলত।এখানে আশেপাশে ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে তাই চোখের জল বহু কষ্টে আটকে রাখছে।আজ সকালে সে একতলায় নামতেই চাইছিল না।শুধুমাত্র নিশানের কারণে বাধ্য হয়ে ডাইনিং টেবিলে নাস্তা খেতে গিয়েছিল।
মনে প্রচন্ড ভয় কাজ করছিল।এখনই বুঝি সবাই তাঁর উপর হামলে পরবে।বকাঝকা শুরু করবে।কিন্তু এমন কিছুই হয়নি।সবার মুখ ছিল থমথমে।কেউ কোনো কথা বলছিল না। ডাইনিং টেবিলে বড় আব্বুকে দেখেনি।ভাগ্যিস ছিল না।নাহলে যূথী আতঙ্কে মাথা ঘুরে ওখানেই পরে যেত।
যূথী আড়চোখে একবার নিশানের দিকে তাকিয়েছিল।এত বড় ব্লান্ডার করে বসে আছে অথচ মুখ দেখে তা বোঝার উপায় নেই।আরামসে খেয়ে চলেছে।মাঝেমাঝে ফোনে কারো সাথে কথা বলছিল আবার মাঝেমধ্যে যূথীর দিকে চোখ রাঙিয়ে জলদি খাওয়ার জন্য ইশারা করছিল।আর এদিকে যূথীর গলা দিয়ে খাবার নামছিল না।
বড়’মা হয়তোবা আজকেই বাড়ি ফিরবে।এসব কাহিনি দেখে না জানি তাঁকে বাড়ি থেকেই বের করে দেয়।
এসব আকাশ-কুসুম চিন্তা করতে করতে যূথীর মাথাটা ব্যথায় ছিড়ে যাচ্ছে।
দূর থেকে মনীষা এবং নীলিমা’কে আসতে দেখে যূথীর আরো কান্না পেয়ে গেল।ওরা কি এখন তাঁকে কথা শুনাতে আসছে নাকি।এতগুলো ছেলেমেয়ের সামনে যদি কোনো অপমানজনক কথা বলে বসে তাহলে তাঁর অবস্থাটা কি হবে!
যূথী ওদের দেখেও না দেখার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে রইল।

“—যূথী তুমি ক্লাস না করে এখানে বসে আছো যে? তোমার ক্লাস নেই এখন?”

মনীষা’র কথা শুনে কিছুটা অবাক হলো যূথী।মেয়েটা তো আগের মতই স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে।সে তো ভেবেছিল উল্টোটা হবে।

“—না এমনিই বসে আছি।ভালো লাগছিল না।”

দুইবোন যূথীর দুইপাশের খালি জায়গাটায় বসে পরল।নীলিমা যূথীর কাঁধে হাত রেখে কিছু একটা বলতে নিতেই যূথী কাঁদকাঁদ হয়ে বলতে লাগল,

“—বিশ্বাস করো আমি এসবের কিছুই জানতাম না।নিশান ভাইয়া এমন কাজ করে বসবে তা আমি কখনই ভাবি নি।তোমরা তো আমাকে চেনো।কখনো কি নিশান ভাইয়ার সাথে কোনো অদ্ভুত আচরণ করতে দেখেছো আমায়?”

যূথীর কথা শুনে দুইবোন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
মনীষা বলল,

“—রিল্যাক্স যূথী।আমরা কি তোমাকে কিছু বলেছি?এখানে তোমার কোনো দোষ নেই।আমরা তো বুঝতেই পারিনি নিশান ভাইয়া কবে কখন তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছে।কালকে ভাইয়ার কথাবার্তায় স্পষ্ট বুঝে গেছি ভাইয়া কতটা ভালোবাসে তোমায়। আর কালকের ঘটনাটায় আমরা বেশি একটা অবাক হইনি।ভাইয়াকে তো চিনি।অন্য পাঁচটা মানুষ যে কাজটা সোজা পথে করে ও সেটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নিজের মন মত করে।কেউ বাঁধা দিতে লেগেই রেগে ফায়ার।”

“—কিন্তু মনীষা বাড়ির লোকজনদের কথাটা একবার ভাবো।ওরা সকলে খুব আপসেট।তাঁদের আশা ছিল বাড়ির বড় ছেলের জন্য ভালো শিক্ষিত মেয়ে খুঁজে তারপর বিয়ে দিবে।ইতিমধ্যে মেয়েও ঠিক করে ফেলেছিল।আর সেখানে উনি এমন একটা কাজ করে বসলেন।আমি কখনোই উনার যোগ্য হতে পারব না মনীষা।আমার না আছে রূপ আর না আমি শিক্ষিত।”

নীলিমা অনেকটা ধমকের সুরে বলল,
“—থামো তো।এই যূগে এসেও তুমি সেই পুরোনো দিনের ধ্যান-ধারণা নিয়ে পরে আছো!ভাইয়ার ভালোবাসাকে তুমি রূপ দিয়ে মাপতে চাইছো!আর রইল বাকি শিক্ষিত হওয়া।তুমি মাত্রই অনার্সে পড়ছো।অনেকটা পথ বাকি।তুমিও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে।আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভাইয়া তোমাকে সর্বোপুরি সাহায্য করবে।বাড়ির লোকদের নিয়ে টেনশন করার কিছু নেই।যেখানে নিশান ভাইয়া আছে সেখানে তুমি সারাক্ষণ চিল মুডে থাকতে পারো।দেখবে ভাইয়া সবটা সামলে নেবে।ইউ নো ভাইয়া ইজ আ জিনিয়াস ম্যান।”

দুই বোনের কথা শুনে যূথীর চোখে পানি আসার উপক্রম। ওরা কত ম্যাচিউরড্।সবকিছু কত সুন্দরভাবে ব্যাখা করে দিল।কিন্তু তবুও যূথীর চিন্তা দূর হচ্ছে না।মনে একটা ভয় দানা বেঁধে আছে।মাথা ঠান্ডা রাখতে গেলে মন অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠে।আর মনকে বুঝাতে গেলে মাথার ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়।সে বোধ হয় পাগল হয়ে যাবে কয়েকদিনের মধ্যে।



সন্ধ্যায় নীলুফা চৌধুরী বাড়ি ফিরে সমস্ত ঘটনা শুনে আশ্চর্যের সপ্তম আকাশে উঠে গেলেন।তাঁর ছেলে যে একগুঁয়ে স্বভাবের তা তিনি জানেন।কিন্তু তাই বলে এই কান্ড করে বসবে!তিনি ভেবে রেখেছিলেন ধীরে সুস্থে তাঁর স্বামীর কানে প্রথমে নিশান আর যূথীর ব্যপারটা তুলবেন।হয়তোবা শুরুতে মানত না কিন্তু বিশ্বাস ছিল তিনি ঠিক মানিয়ে নিতে পারবেন।কিন্তু ঘটনা তো উল্টো হয়ে গেল।নিশান যে কেনো এটা করতে গেল!নিশানের বাবা’র দোষ তো এখানে দেখতে পাচ্ছেন না।ছেলে এমন কাজ করে বসলে রাগারাগি তো করবেই।তাঁর স্বামীও যে হুটহাট মাথা গরম হয়ে যাওয়া মানুষদের দলের মধ্যে আছে।
নীলুফা চৌধুরী কারো সাথে এই ব্যপারে কোনো কথা বললেন না।এমনকি যূথীর সাথেও দেখা করলেন না।অপেক্ষা করছেন নিশান কখন বাড়িতে পৌঁছে।

রাত দশটা’য় বাড়ি ফিরল নিশান।খবর পেয়েই নীলুফা চৌধুরী ছেলের সাথে দেখা করতে ছুটলেন।
নিশান ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মা’কে দেখে থেমে গেল।
নীলুফা চৌধুরী কিছুটা কর্কশ গলায় বলে উঠলেন,

“—এসব কি শুনছি নিশান?” একটু কি ধৈর্য্য ধরে থাকা যেত না?আমার উপর বিশ্বাস ছিল না তোর?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের টাওয়ালটা রেখে নিশান এগিয়ে আসলো।মা’য়ের কাঁধে হাত রেখে কোমল গলায় বলল,

“—মা তুমি এটা ভেবে বসে আছো যে বাবা তোমার কথায় আমার ভালোবাসাকে মেনে নেবে তাই তো!ভুল ভাবছো তুমি।বাবা মাহবুব আঙ্কেলের মেয়ের সাথে আমায় বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছে।আশা করি তোমাকে এই খবরটা কেউ দেয়নি যে কাল বাবা মাহবুব আঙ্কেল এবং তাঁর মেয়েকে এই বাড়িতে ইনভাইট করেছিল।কি জন্য জানো? বিয়ের কথা পাকা করার জন্য।এসব দেখে তখনই যূথীকে বিয়ে করার চিন্তাটা মাথায় চলে আসলো।”

নিশানের কথা শুনে চমকে উঠলেন নীলুফা চৌধুরী। সত্যিই তো এই কথাটা কেউ তাঁকে বলেনি।তিনি তাহলে ঠিকই ভেবেছেন।তাঁর ছেলে এমনি এমনি এই কাজটা করেনি।যা হওয়ার হয়ে গেছে।এখন এগুলো কথা বলে লাভ নেই।বাড়ির লোকদের কিভাবে হ্যান্ডেল করা যায় সেটাই ভাবতে হবে।

“—যূথীকে একটু ডেকে দাও তো মা।ওঁকে বলেছিলাম অফিস থেকে এসে যেন এই রুমে পাই।কিন্তু সে বোধ হয় নিজের রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে।ওর খবর আছে আজকে।”

ছেলের কথায় মুচকি হাসলেন নীলুফা চৌধুরী। হাসতে হাসতেই বললেন,

“—তুই আর মানুষ হবি না।আচ্ছা যূথীকে পাঠিয়ে দিব।বাড়িতে এসে এখনো দেখা করিনি ওর সাথে।তুই ফ্রেশ হয়ে আয়।আমি যাচ্ছি। ”

চলবে…………

স্বপ্নচারিণী
সামান্তা সিমি
পর্ব_২১

গুটিগুটি পায়ে যূথী নিশানের রুমের সামনে এলো।উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে কেউ নেই।ওয়াশরুম থেকে পানির আওয়াজ শুনে বুঝতে পারল নিশান ফ্রেশ হতে গেছে।যূথী দরজা ধরেই দাঁড়িয়ে রইল।ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে না।
নিশান ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে যূথী চেহারায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।দম ফাটানো হাসি পাচ্ছে নিশানের।মেয়েটার চেহারা এই মুহূর্তে দেখতে কার্টুনের মত ট্যারাবাঁকা লাগছে।
কোনোরকমে হাসি চেপে নিশান গম্ভীর গলায় বলল,

“—তোমাকে বলেছিলাম বাড়ি আসার পর যেন রুমে দেখি।কোথায় ছিলে এতক্ষণ! ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো।ভেতরে আসো।”

যূথী নিচের দিকে তাকিয়ে রুমে প্রবেশ করল।নিশান তাঁর গলায় ঝুলানো টাওয়ালটা যূথীর হাতে দিয়ে কিছু একটা ইশারা করল।যূথী কিছুই বুঝতে না পেরে প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে আছে।

“— চুল মুছে দাও।”

নিশানের কথা শুনে যূথীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল।এই লোক তাঁকে চুল মুছে দিতে বলছে!
যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন সে নিশান ভাইয়ার আজব আজব কর্মকান্ডের সাথে পরিচিত হচ্ছে।

“—পারব না আমি।আপনি কি বাচ্চা নাকি।আপনার দুইটা হাত আছে না! ওইগুলো কাজে লাগান।”

“—বেশি বকবক না করে যা বলছি করো।নাহলে…”

যূথী মুখ ভেঙচিয়ে বলল,
“—সবসময় আমাকে হুমকি দিবেন তা তো হবে না! এখন আর আপনার হুমকি’কে আমি ভয় পাই না।”

হু হা করে হেসে উঠল নিশান।যূথী চমকে নিশানের দিকে তাকাল।লোকটার হাসির আওয়াজ যূথীর কানে মধুর এক ঝংকারের মত লাগছে।কখনো এত জোরে হাসতে দেখেনি নিশান ভাইয়া’কে।ইস! ছেলেদের হাসির শব্দ কি এত সুন্দর হওয়া উচিত!

“—চিন্তা ভাবনা শেষ হলে আমার চুল মুছে দাও। চুলের পানিতে আমার শরীর ভিজে যাচ্ছে। নাহলে পরে কিন্তু তোমাকে শরীরও মুছে দিতে হবে।”

যূথীর ঘোর কাটতেই দেখে নিশান দুষ্টু চোখে তারই দিকে চেয়ে আছে।লজ্জা পেয়ে গেল যূথী।নিশান ভাইয়ার চোখের দিকে তাকালেই মনে হয় তাঁর মনের কথাগুলোও যেন লোকটা লাইন বাই লাইন পড়ে নিচ্ছে।

টাওয়াল নিয়ে নিশানের চুলে হাত দিতে গিয়েই যূথী বুঝতে পারল সামনে দাঁড়ানো লোকটা থেকে সে কতটা পিচ্চি। পা উঁচু করেও ভালোভাবে নাগাল পাচ্ছে না।যূথীর অবস্থা দেখে ঠোঁট টিপে হাসছে নিশান।সেদিকে নজর দিতেই যূথীর কাছে সব স্পষ্ট হয়ে গেল।তার মানে এই শয়তান লোকটা ইচ্ছে করেই তাঁকে এই কাজটা করতে দিয়েছে।
শেষমেষ বিরক্ত হয়ে যূথী বলল,

“—এরকম টাওয়ারের মত দাঁড়িয়ে থাকলে আমি কি করে মুছবো!এত লম্বা কেনো আপনি?”

“—তোমার তো গর্ব করা উচিত। এত হ্যান্ডসাম একটা বর পেয়েছো।তা না করে জিজ্ঞেস করছো এত লম্বা কেনো!”

রাগে ফুৃঁসছে যূথী।এই লোকটাকে সে কখনো কথায় হারাতে পারে না।এমন পাল্টা জবাব দেয় যে তার বদলে যূথী অন্য কিছু বলার সুযোগও পায় না।
নিশান যূথীর হাত থেকে টাওয়ালটা টেনে নিয়ে বলল,

“—তোমার দ্বারা হবে না কিছুই।শুধু একটা কাজই পারো তুমি।সারাদিন ভীতু একটা চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে।”

যূথী চোখ রাঙিয়ে তাকালো নিশানের দিকে।
“—আপনি আমাকে অপমান করছেন নিশান ভাইয়া?কি পেয়েছেন আপনি?যখন মন চাইবে……..”

“—গুলি করে তোমার মাথার খুলি উড়িয়ে দিব।নিজের জামাইকে ভাইয়া ডাকছো!কালকে বলেছো আমি কিচ্ছু বলিনি।আজকের পর থেকে ভাইয়া ডাক শুনলে অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে যাব।”

যূথী মুখ ভার করে ফেলল।আজকাল নিশান ভাইয়া পান থেকে চুন খসলেই তাঁকে গুলি, থানা, অ্যারেস্ট এসবের ভয় দেখায়।সে কি শুধু শুধু লোকটাকে রাক্ষস বলে নাকি!নিজের চারপাশে এমন এক দেয়াল তৈরি করে রাখে যে কেউ তার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারে না।কাছে গেলেই আতঙ্কে অস্থির হয়ে থাকতে হয়।যেটা যূথী এখন অনুভব করছে।নিশানের ওমন ভয়াবহ ধমক শুনে চোখ তুলে তাকানোরও সাহস পাচ্ছে না।সে ভাইয়া ডাকবে না তো কি ডাকবে!সকলের সামনে নিশান নিশান বলে চেঁচাবে নাকি।সে আগেও ভাইয়া ডাকত এখনো ভাইয়া ডাকবে। এটাই ফাইনাল ডিসিশান।
ভাইয়া ডাকে ফোবিয়া থাকলে বিয়ে করেছে কেনো তাঁকে!ওই ঐশী মেয়েটাকে বিয়ে করলেই পারত।তাহলে বাড়িতে আর এত ঝামেলা হত না।
ঝামেলার কথা মনে হতেই যূথীর নিশানের বাবা’র চেহারাটা চোখে ভেসে উঠল।তিনি তো এখনও নিশান ভাইয়ার উপর প্রচন্ড রেগে আছে।তিনি কি কখনো এই বিয়েটা মেনে নেবে! যূথীর মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল।



রাতে ডিনার করে নিজের রুমে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে যূথী।আজ ডাইনিং টেবিলে যায় নি সে।ওখানে সবার সামনে বসে ভাত খাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারে না। বিশেষ করে বড় আব্বু’র কথা মনে পরতেই ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যায়।
ভাগ্যিস বড়মা তাঁকে এখানে এসে খাইয়ে দিয়ে গেছে।নাহলে নিশান নামক বদ লোকটা তাঁকে হিড়হিড় করে টেনে নিচে নিয়ে যেত।তাঁর তো কোনো ভয়ডর নেই।এমনভাবে চলাফেরা করছে যেন কিছুই হয় নি।কি ধাতু দিয়ে তৈরি উনি!
হঠাৎ করেই একটা কথা মনে পরতে যূথীর চিন্তা দ্বিগুণ বেড়ে গেল।কাল তো নিশান ভাইয়া বলেছে এখন থেকে উনার রুমে ঘুমাতে হবে।কিন্তু আজ তো সে কিছুতেই ওই রুমে যাবে না।মরে গেলেও না।লোকটা কাছে আসলেই তাঁর কেমন যেন উথাল-পাতাল অবস্থা হয়ে যায়।গতকাল রাতটা আধোঘুমে আধো জাগরণে কাটিয়েছে।
এই রুমে আসার সময় একবার নিশানের রুমে উঁকি দিয়ে দেখেছে লোকটা ফাইলপত্র নিয়ে ব্যস্ত।কাজ শেষ হলে নিশ্চয়ই যূথীকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে আসবে।কি করা যায় এখন!
যূথী হাতের নখ কামড়াচ্ছে আর রুমের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পায়চারি করছে।একটা বুদ্ধি তো বের করতে হবেই।হঠাৎ যূথীর মুখে হাসি ফুটে উঠল।এই চিন্তাটা আগে কেনো মাথায় আসলো না!যূথী তড়িঘড়ি করে রুমের দরজাটা ভেজিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।



নীলিমা ঘুমিয়ে পরেছে অনেকক্ষণ আগেই।মনীষাও বিছানায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জানালার থাই গ্লাসের লক আটকাতেই দরজার খটখট শব্দ হলো।ভ্রু কুচকে ফেলল মনীষা। এত রাতে আবার কে আসলো।নিশ্চয়ই বিদীষা।এই মেয়েটারই রাতের বেলা হুটহাট এই রুমে আসার অভ্যাস আছে।
মনীষা দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল।বিদীষা নয়।যূথী কাঁচুমাচু মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“—কি হলো যূথী! এখনো ঘুমাও নি?”

যূথী আমতাআমতা করে উত্তর দিল,
“—আসলে…মনীষা..আমি কি তোমাদের সাথে ঘুমাতে পারি?আজ তোমাদের সাথে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে।”

“—আশ্চর্য! ঘুমাতে মন চাইলে ঘুমাবে।এত হেসিটেট করার কি আছে!কিন্তু ভাইয়া…..”

মনীষাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই যূথী বলল,
“—আচ্ছা তাহলে সরে দাঁড়াও।রুমে ঢুকি।আমার না খুব ঘুম পাচ্ছে। ”

মনীষা ঈষৎ সন্দেহের দৃষ্টিতে যূথীর দিকে তাকিয়ে আছে।যূথীর তো এখন ভাইয়ার রুমে থাকার কথা।তাহলে এখানে কি করছে।
যূথী বিছানায় যেতেই মোবাইলে টুং করে আওয়াজ হলো।হাতে নিয়ে দেখে নিশানের মেসেজ।

‘হোয়্যার আর ইউ?’

প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে যূথীর।নিশ্চয়ই নিশান ভাইয়া তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে রুমে গিয়ে পায় নি।এবার লোকটাকে ভালোমত জব্দ করা গেছে।সবসময় তাঁকেই কেনো হেনস্তা করবে!এবার তো যূথী জিতে গেল।মুখভর্তি হাসি নিয়ে যূথী ঘুমিয়ে পরল।

মাত্রই চোখে ঘুম জড়িয়ে এসেছে তখনই মনীষার ডাকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল যূথী।ঘুমের কারণে অন্ধকার দেখছে চোখে।

“—কি ব্যপার মনীষা?ডাকলে কেনো?”

“—দেখো না যূথী বোতলে পানি নেই।তখন আনতে ভুলে গেছি।এখন একা একা নিচে যেতে ভয় লাগছে।তুমি একটু সাথে আসো প্লিজ।নীলিমাকে ডেকে লাভ নেই।ভুমিকম্প আসলেও সে ঘুম থেকে উঠবে না।”

হেলতে দুলতে যূথী মনীষার পিছন পিছন এগিয়ে চলছে।দুএকবার হোঁচট খেতে গিয়েও সামলে নিয়েছে।একটু ভালোভাবে চোখ মেলতেই দেখে মনীষা দাঁড়িয়ে পরেছে।সামনের বন্ধ দরজাটায় নক করছে।
যূথী হাই তুলে বলল,

“—পানি আনতে না গিয়ে কোথায় এলে মনীষা? কার রুমে যাচ্ছো?”

“—তোমার বরের।”

চমকে উঠল যূথী। এটা তো নিশান ভাইয়ার গলা।মুহূর্তেই চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেল।
একি! সে তো নিশান ভাইয়ার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে। আর ওই তো নিশান ভাইয়া দরজা খুলে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ তো ঘুমের কারণে কিছুই খেয়াল করেনি।মনীষার দিকে তাকাতেই দেখে মুখে বিশ্বজয় করা হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।তারমানে এই মেয়েটা ট্রিকস খাটিয়ে তাঁকে নিশান ভাইয়ার রুমের সামনে নিয়ে এসেছে।

“—স্যরি যূথী।তোমাকে এখানে আনতে বাধ্য হলাম আমি।ভাইয়া বলেছে এই কাজটা করতে পারলে আমাকে নতুন ল্যাপটপ কিনে দেবে।এতবড় অফার ইগনোর করার সাধ্য আমার নেই।হিহিহি।এখন যাই আমি।টাটা।”

কথাটা বলেই উল্টোদিকে হাঁটা দিল মনীষা। যূথী এখনো বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারেনি।কি হচ্ছে এসব?
নিশান একটান দিয়ে যূথীকে রুমে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দিল।

“—আমার সাথে চালাকি?দেখলে তো কিভাবে তোমার চালাকির গলায় দড়ি পরিয়ে দিলাম!”

ভ্রু নাচিয়ে কথাগুলো বলল নিশান।ঠোঁটে ঝুলছে বাঁকা হাসি।রাগে যূথীর শিরা-উপশিরা গুলো ফেটে যাচ্ছে। ইনি কি মানুষ না অন্য কিছু!

“—আমার এই রুমে ঘুম আসে না।শুনতে পেয়েছেন?”

“—আস্তে কথা বলো যূথী।চিল্লাচ্ছো কেনো।তোমার ঘুম না আসলে আমি কি করব।আমার তো বউ ছাড়া ঘুম আসে না ”

“—ন্যাকামো করছেন আমার সাথে?ঢং! বউ ছাড়া ঘুম আসে না!”

ধপধপ পা ফেলে যূথী বিছানায় গিয়ে উল্টোদিক হয়ে শুয়ে পরল।নিশান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যূথীর কান্ড দেখে হাসি আর চেপে রাখতে পারছে না।
যূথীকে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে যূথীর গলায় মুখ গুঁজে দিল।
বিছানার চাদর খামচে ধরল যূথী।নিশানের দাঁড়ি গুলো ফুটছে ওঁর গলায়।একজোড়া উষ্ণ ঠোঁটের বিচরণ টের পাচ্ছে সে। তাঁর মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এ কেমন অনুভূতি! মনের গহীনে এলোমেলো হাওয়া বইছে। যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে তাঁকে।যূথী চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিশানের চুল খামচে ধরল।
তখনই নিশানের গলার আওয়াজ শোনা গেল।

“—ভয় পেয়ো না যূথী।যথেষ্ট টাইম দেব তোমায়।ঘুমিয়ে পরো।”

চলবে……….

স্বপ্নচারিণী
সামান্তা_সিমি
পর্ব_২২

দুপুরের মধ্যভাগ এখন।মাথার উপর গনগনে সূর্য। তার তীব্র তেজে মানুষের শোচনীয় অবস্থা। রাস্তাঘাটে তৃষ্ণায় লোকজনের বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে।
মনীষা এবং নীলিমা ঘর্মাক্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে।গরমে তাঁদের বেহাল দশা।এসি গাড়ি দিয়ে চলাচল করেও এই অবস্থা তাহলে সাধারণ মানুষদের না জানি কি হাল!
দুইবোন শুকনো মুখে ড্রয়িংরুমের সোফায় ধপাস করে বসে পরল।
কয়েকহাত দূরে ডাইনিং টেবিলে সদ্য ফ্রিজ থেকে নামানো ঠান্ডা পানির বোতল দেখা যাচ্ছে। বোতলের গায়ে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা।দুইজন উৎসুক চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে।উঠে গিয়ে যে বোতল থেকে পানি খাবে সেই শক্তিও যেন নেই।
সিড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে নীলুফা চৌধুরী সবটাই দেখলেন।পানির বোতল নিয়ে ওঁদের সামনে যেতেই ওঁরা ক্লান্ত গলায় বলল,

“—থ্যাংকস বড়মা।”

ঠান্ডা পানি খেয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল ওঁরা।দুইজন সোফায় গা এলিয়ে দিল।

“—যূথী কোথায় বড়মা?ওঁর খবর আছে আজ।আমাদের না বলে কেনো চলে আসলো?আমরা কতক্ষণ ওঁর জন্য গেইটে দাঁড়িয়ে ছিলাম।”

নীলিমার কথা শুনে নীলুফা চৌধুরী অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন।মনীষা সেই দৃষ্টি লক্ষ্য করে বলে উঠল,

“—তুমি বাঁধা দিবে না কিন্তু। ওঁকে আজ অনেক বকবো।”

“—কি যা তা বলছিস!যূথী কখন বাড়ি আসলো।বিগত একঘন্টা ধরে আমি ড্রয়িংরুমেই আছি।কই ওঁকে আসতে দেখিনি তো!”

দুইবোন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।যূথী কি তাহলে কলেজে রয়ে গেল।এতক্ষণে হয়তোবা তাঁদের খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেছে।

“—বড়মা যূথী মনে হয় কলেজে আছে।আমাদেরকে খুঁজে না পেয়ে চলে আসবে নিশ্চয়ই। দাঁড়াও ওঁকে একটা কল দেই।”

যূথীর ফোন বন্ধ। নীলিমা বেশ কয়েকবার ট্রাই করল।ফলাফল শূন্য।
মনীষা সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বলল,

“—চিন্তা করো না বড়মা।ও এখনই এসে যাবে।হয়তোবা কলেজে কোনো কাজে আটকে পরেছে।”

“—ঠিক আছে।তোরা হাত-মুখ ধুয়ে আয়।আমি খাবার দিচ্ছি।ততক্ষণে যূথীও এসে যাবে।”
দুইবোন মাথা দুলিয়ে উপরে চলে গেল।



একঘন্টা পার হয়ে গেছে।যূথীর বাড়ি ফেরার কোনো নাম গন্ধ নেই।নীলুফা চৌধুরী চিন্তিত মুখে মেইন ডোরের দিকে তাকিয়ে আছেন। এত দেরি হচ্ছে কেনো মেয়েটার!ফোনও ধরছে না।এমন তো কখনো করে না।বিথী চৌধুরী বারবার বলছে,

“—চিন্তা করো না আপা।এসে যাবে।আর সে-ই বা কেমন মেয়ে।কোনো কাজ থাকলে ফোন করে বলে দিলেই হয়।তা না করে ফোন বন্ধ করে রেখেছে।সব দায়িত্ব জ্ঞানহীনের মত কাজকর্ম।”

নীলুফা চৌধুরী কোনো উত্তর দিলেন না।মনীষা এবং নীলিমা হাতে পার্স নিয়ে নিচে আসল।ওঁরা দুজনও খুব অশান্তিতে আছে।যূথী তো ঢাকার রাস্তাঘাট কিছুই চেনে না।একা একা আবার অন্য কোথাও চলে যায় নি তো!

“—বড়মা, আমি আর মনীষা একবার কলেজে দেখে আসি।তুমি দুশ্চিন্তা করো না কেমন।”

নীলুফা চৌধুরী মাথা তুলে তাকালেন।তিনি মনে মনে খুব ভয় পেয়ে আছেন।আবার রাগও হচ্ছে খুব।এমন বোকার মত কাজ কেউ করে! যূথী তো জানে টাইমমত বাড়ি না ফিরলে তাঁর বড়মা কতটা চিন্তিত থাকে।এরপরেও ফোন বন্ধ করে রাখলো কেনো।আজ আসুক বাড়িতে।ঠিকমতো কয়েকটা বকা দিয়ে দেবে।

“— তোরা একা যাস না।একটু অপেক্ষা কর।আমি কাপড়টা পাল্টে আসি।আমিও যাব।”

নীলুফা চৌধুরী দ্রুত পায়ে উপরে উঠে গেলেন।
মনীষা শেষবারের মত যূথীর নম্বরে কল করল।আগের মতই মিষ্টি গলার একটা মেয়ে বলছে ‘এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব না।’
ফোনের ওপাশের মেয়েটার মিষ্টি গলাটাও যেন বিষের মত লাগছে মনীষার কাছে।মেয়েটার গলা চিপে ধরতে পারলে শান্তি লাগত।



কলেজ ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে আছে ওঁরা তিনজন।আশেপাশে কোনো ছেলেমেয়ে দেখা যাচ্ছে না।ওঁরা ভালোভাবে পুরো ক্যাম্পাস খুঁজে নিয়েছে।কিন্তু যূথী কোথাও নেই।কলেজের বাইরের আঙিনায়ও চক্কর দিয়েছে কয়েকবার।
নীলুফা চৌধুরী’র মুখ শুকিয়ে আসছে।কলেজে না থাকলে মেয়েটা গেল কোথায়।আর কোথায় খুঁজবে।
তখনই নীলিমার ফোন বেজে উঠল। ফোনের আওয়াজে তিনজনের চোখ চকচক করে উঠল।হয়তোবা যূথী কল দিয়েছে।
ফোনের স্ক্রিনে ‘নিশান ভাইয়া’ নামটা দেখে তিনজনই হতাশ হয়ে গেল।নীলিমা কল রিসিভ করতেই নিশানের ধমক মিশ্রিত কন্ঠ শোনা গেল।

“—যূথী কোথায়?ওর ফোন বন্ধ কেনো?সে কোন কাজে ব্যস্ত যে ফোন বন্ধ করে রাখতে হবে?ওঁকে বল আজ বাড়িতে এসে দফারফা করব আমি।”

নীলিমা করুণ চোখে বড়মা’র দিকে তাকালো।নিশান ভাইয়াকে কি এখনই সবটা বলে দেয়া উচিত!নাকি আরো কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে দেখবে।
নীলুফা চৌধুরী ইশারায় না করতেই নীলিমা আমতাআমতা করে বলল,

“—আ..আসলে ভাইয়া।কলেজ থেকে আসার পর যূথীর খুব মাথা ব্যথা করছিল।তাই ঘুমিয়ে পরেছে।ওর ফোনে বোধ হয় চার্জও নেই।তাই…”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিশান বলল,
“—ঠিক আছে।ঘুম থেকে উঠলে বলবি আমাকে কল দিতে।অপেক্ষা করব আমি।”

ফোন রাখতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই।নিশানকে এখন কিছু বললেই অযথা চেঁচামেচি শুরু করবে।তার চেয়ে ভালো যূথীর বান্ধবীদের বাসায় খোঁজ নেওয়া যাক।
নীলুফা চৌধুরী মনীষা এবং নীলিমা নিয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে পরলেন।


সন্ধ্যা মিলাবার কিছুক্ষণ আগে তিনজন হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেন।তাঁদের মুখে আশঙ্কার ছায়া।কোথাও খুঁজে পায়নি যূথীকে।
কিছুক্ষণ পরই বাহিরে অন্ধকার নেমে আসবে।বাড়ির সকলে ভয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে।
নীলুফা চৌধুরী কোনো উপায় না পেয়ে স্বামীকে ফোন দিলেন।সব ঘটনা বলতেই মফিজ চৌধুরী ঠান্ডা গলায় বললেন,

“—নিশানকে খবর দাও নি কেনো।ওঁকে তো সবার প্রথমে খবর দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।”

স্বামীর কথাটা সহ্য হলো না নীলুফা চৌধুরী’র।কড়া গলায় বলে উঠলেন,

“—মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আর তুমি এখনও তোমার রাগ -অভিমান নিয়ে পরে আছো! কবে থেকে এত পাষাণ হলে।মেয়েটার সাথে আমার ছেলের জীবন জড়িয়ে আছে।যূথীর কিছু হলে আমি কিন্তু কাউকে ছাড়ব না।”

“—উত্তেজিত হচ্ছো কেনো নীলু।আমি দেখছি কি করা যায়।বেশি টেনশন করো না।প্রেশার বেড়ে যাবে তোমার।”

এই মুহূর্তে স্বামীর কথাগুলো খুবই বিষাক্ত মনে হচ্ছে। তিনি খট করে টেলিফোন রেখে দিলেন।
সবাই থমথমে মুখে বসে আছে ড্রয়িংরুমে। নীলুফা চৌধুরীর চোখ ছলছল করছে।কাল রাতেও তো মেয়েটাকে ভাত খাইয়ে দিয়েছে। এখন কোথায় কি অবস্থায় আছে কে জানে।নিশ্চয়ই ক্ষুধায় কাতর হয়ে থাকবে।
নীলিমার ফোনের ভাইব্রেশনে সকলের মনোযোগ সেদিকে চলে গেল।নিশান কল করেছে।নীলিমা কাঁপা হাতে রিসিভ করল।

“—হ্যালো ভাইয়া….!”

কথা সম্পন্ন হওয়ার আগেই নীলুফা চৌধুরী তড়িৎ গতিতে ফোনটা কেড়ে নিলেন।
“—নিশান তুই এই মুহূর্তে বাড়ি আয় বাবা।আমার মাথা কাজ করছে না কি করব।কোনো প্রশ্ন করবি না এখন।প্লিজ বাড়ি আয়।”
নিশানের উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোন রেখে দিলেন তিনি।মনীষা এগিয়ে গিয়ে তাঁর বড় মা’কে জড়িয়ে ধরল।

*

দশমিনিটের মাথায় বাড়ির মেইনডোর দিয়ে নিশানকে ঢুকতে দেখা গেল।নীলুফা চৌধুরী দৌড়ে এসে নিশানের হাত ঝাকিয়ে বলতে লাগলেন,
“—যূথীকে খুঁজে পাচ্ছি না নিশান।তুই কিছু কর।”

“—খুঁজে পাচ্ছো না মানে?নীলিমা তো বলেছিল যূথী ঘুমাচ্ছে। ”

নীলুফা চৌধুরী প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু খুলে বললেন।মুহূর্তেই নিশানের চেহারা পাল্টে গেল।যেখানে রাগ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না।চিল্লিয়ে বলে উঠল,

“—এই খবরটা আমাকে এখন বলছো?পাগল তোমরা?”

নীলুফা চৌধুরী ভয়ে ভয়ে বললেন,
“—তোর বাবাকে জানিয়েছি।মাহিরকেও কল করেছিলাম।সে বলেছে যূথীর কলেজে খোঁজ নিবে।”

গর্জে উঠল নিশান।
“—ওদেরকে জানিয়েছো আর আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না!ওঁদের ফোন দিয়ে বলে দাও কিচ্ছু করতে হবে না।আমার বউকে আমিই খুঁজে বের করব।যূথীকে না পাওয়া পর্যন্ত আমি বাড়ি ফিরব না”
বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেল নিশান।

__________________________

দুইদিন দুইরাত কেটে গেছে।নিশান যূথীকে নিয়ে এখনো বাড়ি ফিরেনি।নীলুফা চৌধুরী কাঁদতে কাঁদতে অস্থির।বাকিরা সবাই শুকনো মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সন্ধ্যা সাতটা বাজছে এখন।মফিজ চৌধুরী সিগারেট হাতে ছাদে বসে আছেন।তাঁর চোখে মুখে এক ধরনের বিষন্নতার ছাপ।সিগারেটটা টানতে ইচ্ছা করছে না আবার ফেলে দিতেও মায়া লাগছে।
তাঁর মনের ভেতর এক ধরনের যুদ্ধ চলছে।আজ দুইদিন হলো যূথী মেয়েটা বাড়ি নেই।সেই সাথে নিশানও লাপাত্তা। তিনি তো সর্বোপরি চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু মেয়েটাকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ।আজ সকাল থেকেই কেনো জানি যূথীর কথা ভাবতেই তাঁর মনটা ভার হয়ে আছে।গভীর মমতা বোধ করছেন মেয়েটার প্রতি।সেদিন রাগের বশে মেয়েটাকে কয়েকটা জঘন্য কথা বলে ফেলেছিলেন।শত হোক তাঁর পুত্রবধূ।
চমকে উঠলেন মফিজ চৌধুরী। নিজের অজান্তেই তিনি যে কখন যূথীকে তাঁর ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিয়েছেন তা টেরও পেলেন না।হঠাৎ করেই যূথীর জন্য তাঁর বুকটা হাহাকার করে উঠল।কোথায় আছে মেয়েটা।মফিজ চৌধুরী সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় সিগারেটে আরেকটা টান দিলেন।

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here