গল্পঃ #সোনালী [০২]
রোজান খেয়াল করলো তার ভাবনা এলোমেলো হওয়ার সাথে সাথে দৌঁড়ে আসা মানুষটাও থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। রোজান পিঠের দাগগুলো থেকে চোখ সরিয়ে যেই চুলের দিকে নজর দিবে, তখনি মেয়েটা ঘাড় ফিরিয়ে রোজানের দিকে তাকালো। রোজান তবুও দৃষ্টি ফেরালোনা, সে লক্ষ্য করছে মেয়েটার চোখের রঙ হালকা নীলাভ, সামনের একগুচ্ছ চুল সোনালী! কিন্তু পেছন থেকে ফুল গুঁজে থাকা খোঁপার জন্য চুলের রঙ নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেওয়া যাচ্ছিলোনা৷ তবে সামনে থেকে দেখে ভেতরের সবগুলো চুল যে কালো সেটা নিঃসন্দেহে আঁচ করা যাচ্ছে। এমনকি মেয়েটা দিয়ালী নামক মহিলা কথা অনুযায়ী তেমন ধবধবে ফর্সাও নয়, শুধু মেকাপ করার কারণে অনেক ফর্সা দেখাচ্ছে! তবে কি তার চোখে লেন্স? আর জন্মদাগ?
এটা ভাবতে ভাবতেই তৎক্ষনাৎ রোজান ফোন খুলে ইন্দোনেশিয়ার মানচিত্রের সাথে এই দাগের তুলনামূলক ধারণা নিতে উদ্যত হলো, তখনি খেয়াল করলো মেয়েটা তার দিকে এগিয়ে আসছে! মানচিত্রের একটা চিত্র ইতোমধ্যে সে দেখে আরো ঘাবড়ে গেলো, এই মানচিত্রের মতো অদ্ভুত জন্মদাগ কখনো হতে পারে নাকি? দিয়ালী কি পাগল? এমন ছড়ানো ছিটানো দাগ মানুষের কি করে হবে? তখনি সেই মেয়েটা রোজানের পাশ ঘেঁষে নিচে বসে গেলো, রোজান খেয়াল করে দেখলো মেঝে থেকে সে কিছু উঠাচ্ছে!
দৌঁড়ে যাওয়ার সময় শাড়ী থেকে একটা পিন খুলে মেঝেতে পড়ে গেছে। মেয়েটা সেটাই তুলতে এসেছে।
এদিকে রোজানকে আবারও তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা মিটমিটিয়ে লজ্জা পাওয়ার মতো করে হাসলো। রোজান খুব দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিলো। যা ভেবেছিলো তা একদম না, এই মেয়ে দিয়ালীর মেয়ে হতেই পারেনা। কি জানি হয়তো সেই মেয়ে ১৭ বছর আগেই মারা গিয়েছিল । নিজের ভেতরে ভেতরে রোজান উচ্চারণ করলো, রোজান ঠান্ডা হও, সেই মেয়েকে তুমি পাবেনা, এভাবে যেই সেই মেয়ের দিকে তাকিয়ে বড় বিপদে পড়বে! এই মেয়েটার দৃষ্টিও সুবিধার না।
সেই বিয়েতে রোজান যতক্ষণ অবস্থান করেছিলো, সেই আকাশী রঙের শাড়ীকন্যাকে এদিক ওদিক থেকে শুধু উঁকিঝুকি দিতে দেখেছে। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোজান যেন এখান থেকে ছুটে পালাতে চাচ্ছিলো। অবশেষে দুই ঘন্টা পরে খাওয়াদাওয়া করেই নানা ছলে সে যখন সেখান থেকে বেরুতে পারলো তখন যেন তার দম ফিরে আসলো!
‘
এক সপ্তাহ পরের কথা,
রোজান খুব রাগী চেহেরায় অফিসে কর্মরত জুয়েল পাল’কে ডেকে বললো,
‘ আপনার সহকর্মী যে শামিম, উনি কোথায়? দুইদিন ধরে আসেন না। কার থেকে ছুটি নিয়েছে?
জুয়েল খুব সহজ ভঙ্গিতে একটা অদ্ভুত কারণের কথা রোজানকে জানালো।
সেটা শুনে রোজান রাগে গড়বড় করে শামিমের কাছে ফোন লাগালো, কল ধরতেই বললো,
‘ বিয়ে হয়নি, বাগদান হয়নি, আর আপনি কিনা এমন একটা মেয়ের এক্সিডেন্টের খবর শুনে সূদুর এলাকায় চলে গেলেন? আমি চাইলেই এখন আপনাকে চাকরি থেকে বিতাড়িত করতে পারি,জানেন সেটা?
টগবগে রাগী নতুন বসের এই কথা শুনেও ফোনের ওপাশ থেকে শক্ত গলায় জবাব এলো,
‘ জ্বী স্যার তা চাইলেই পারেন ! তবে আমার কাছে চাকরির চেয়েও আমার ভালোবাসার খারাপ সময়ে পাশে থাকাকে জরুরী বলে বোধ করছি।
জবাব শুনে কিছুটা ক্ষুব্ধ হলেও রোজান’ তার অফিসের একজন নিয়মিত কর্মচারী শামিমের উপর রাগটা সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে পারলোনা।
হাসতে হাসতেই রোজান জবাব দিলো,
‘ আপনার চাকরি চলে গেছে! শুধু এই কথাটা একবার আপনার প্রিয়কে জানিয়ে দেখুন, আপনার যত্নশীলতার তুড়ি মেরে আপনাকে বিদেয় করবে। ক্যারিয়ার মজবুত না হলে ভালোবাসা হলো উড়ন্ত মেঘ, চরম গতিতে সে জায়গা প্রস্থান করে আপন দিশা খুঁজবে ! তাছাড়া পরবর্তীতে কোথাও চাকরি না হলে কোন সাহসে তাকে পেতে তার পরিবারের সামনে দাঁড়াবেন শুনি?
শামিম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
‘ এসব আমাকে কেন বলছেন স্যার? আপনার জায়গাটা তো ভীষণ শক্ত আর গম্ভীর, সেখানে আমাকে আপনার নীতিবাক্য শোনানোর প্রয়োজন নেই। চাইলেই বিনা নোটিশে চাকরি থেকে বের করে দিতে পারেন।
বলেই শামিম বিরাট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোন কেটে দিলো। সে রোজানকে ভালো করেই চেনে, যা বলেছে তাই করতে চলেছে। কেননা সে পরশু হঠাৎই কিছু না বলে তার প্রেমিকা মায়া’র এক্সিডেন্টের কথা শুনে ছুটে এসেছে। আজকেও সে ফেরার সাহস পাচ্ছেনা, কেননা মায়ার অবস্থা ভীষণ আশংকাজনক। লুকোচুরি করে বিভিন্ন পরিচয় দিয়ে হাসপাতালে মায়াকে দেখতে যায়, কিছুটা দূরে একটা হোটেলে থাকা খাওয়া করছে। এতো দূর যাওয়ার ব্যপারে তার মা-বাবাও জানেনা, শুধু বলেছে এক কাছের বন্ধু অসুস্থ এবং সে তার পাশে আছে।
শামিম বিছানার উপর মোবাইলটা রেখে মাথায় চেপে ধরে বসলো। টাকাও ফুরিয়ে যাচ্ছে! এখানকার থাকা-খাওয়ায় অনেক টাকার দরকার হচ্ছে । তার উপর এখন আবার চাকরি চলে গেলে সে কি করবে? এদিকে তার মায়া! সারা শরীরে যার ব্যান্ডেজের আবরণ, তার পিটপিট চোখ তো কেবল তাকে দেখার আশাতেই বসে থাকে ! সে স্বচক্ষে দেখেছে এতো কঠিন অবস্থাতেও মায়া তাকে দেখে কতটা খুশি হয়েছে, প্রবল সাহস সঞ্চার করেছে।
মায়ার অবস্থা এখনো জটিল । তাহলে কি করে তাকে ফেলে যাবে সে? সে-ই বা ঢাকায় ফিরে থাকবে কীভাবে?
তার পুরো ঘোরের মধ্যে ফোনের রিং বেজে ওঠলো। চোখ ঘুরিয়ে দেখলো তার রোজান আবার ফোন দিয়েছে! এই মাস তো প্রায় শেষ, শেষ বেতনটা বুঝে আনার জন্যই কি আবার ফোন দিলো?
শামিম রিসিভ করে মোবাইলটা কানে ঠেকালো। কানে ধরতেই শুনতে পেলো রোজান হাসতে হাসতে বলছে,
‘ আপনার চাকরি যাচ্ছে না জবাব শামিম হায়দার । আপনার অবস্থানটা আমি বুঝতে পেরেছি। আগলে রাখুন ভালোবাসাকে, যত্নের অভাবে হারিয়ে যেন না যায়। আচ্ছা, আপনি তো মনে হয় এখন বাইরে বাইরে থাকছেন,তাইনা? আমাকে ঠিকানা বলুন তো, আমি আসবো, শুনেছি জায়গাটা পাহাড়ি বনজঙ্গল, আর সবুজে ঘেরা।আপনার সাথে ওখানে কয়েকটা দিন কাটাবো । আমি বাবার অনুপস্থিতিতে এসব দায়দায়িত্বের ঝামেলায় বোর হয়ে গেছি।
ওহহো এখন তো মাত্র সকাল এগারোটা বাজে! আমি তৈরি হচ্ছি তাহলে এখনি হ্যাঁ!
শামিম ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে ধন্যবাদ বলার আগেই রোজান হাসতে হাসতে লাইন কেটে দিলো।
সে অবাক হয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে! সে এসব কি শুনছে? সে তার স্যারের মধ্যকার কথাটার মধ্যে স্পষ্ট থমথমে ভাব লক্ষ্য করেছে। সে ভেবেই নিয়েছিলো তার চাকরি চলে যেতে চলেছে। এমনকি এটাও তার জানার বাইরে নয় যে রোজান এমনিতে খুব ভালো হলেও কাজের ক্ষেত্রে সচেতন এবং কাজে অবহেলার ব্যপারে বেশ বদরাগী। কিন্তু হঠাৎ এমন মিইয়ে গেলো কেন? ভালোবাসাকে আগলে রাখার কথাটা যেন উনার জীবনের চরম বাস্তবতা থেকে তিনি উচ্চারণ করেছেন! উনার সাথে কিছু হয়েছিল কি?
কি জানি ! কিন্তু শামিমের ভেতরটা এখন বেশ উৎফুল্ল। দু’দিকেই সব ঠিক আছে!
টাকার প্রয়োজন হলেও এখন বস থেকে ধার নিতে পারবে, পরবর্তীতে বেতন থেকে না হয় কেটে দিবে।
শামিম ভাবছে রোজান সাহেব আসলে এই রকম রুমে থাকবে কিনা! নাহলে তো আরো ভালো রুম বুক করতে হবে।
শামিম এবং রোজান প্রায় সমবয়সী, তবুও শামিমের কাছে রোজানকে সবসময় সম্মানিত এবং বড় মনে হয়। এমন একটা ভাবেই দেখে এসেছে বলে হয়তো। এমনকি রোজানও অফিসের সব স্টাফদের সাথে সম্মানের সঙ্গে আপনি সম্বোধনে কথা বলে।
সন্ধ্যার দিকে রোজান আসলো। শামিম রোজানকে এগিয়ে আনতে অনেক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছে। আসতেই দৌঁড়ে গিয়ে হালকা নতজানু হয়ে বললো,
‘ আসুন স্যার।
রোজান গাড়ী থেকে নেমে শামিমের কাঁধ ছুঁয়ে বললো,
‘ এই ছেলে আমরা এখন অফিসের বাইরে আছি! তোমার বস না আপাতত। এখন বন্ধুর মত থাকলেই আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগবে!
বলেই শামিমের কাঁধে হাত রাখলো। শামিমের কেমন যেন সবকিছু গড়বড় লাগছে। সে প্রথমবার আগুণের মতো মানুষটার স্নিগ্ধ কোমল শান্ত চোখ দুটো কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছে। এ যেন অকল্পনীয় সুন্দরতম দৃশ্য ! তার উপর বন্ধুত্বের কি লোভনীয় সুযোগ! অজান্তেই শামিমের চোখ দুটো খুশির প্রবণতায় জলে চিকচিক করে উঠলো।
‘
পরেরদিন খুব সকালে রোজান শামিমকে ডেকে বললো,
‘ চলো বের হবো ! সেখান থেকে ঘুরাঘুরি করে রুমে ফেরার সময় মায়াকে দেখতে যাবো।
শামিম হাসিমুখে ফ্রেশ হয়ে দ্রুততার সাথে তৈরি হলো।
এর আগে শামিমের এখানে আসার পেছনের কারণ শুধুই মায়াকে দেখা ছিল। তাই অন্য দিকে তার নজর ছিল না। আজকেই সে প্রথম রোজানের সাথে বের হয়েছে এখানকার প্রকৃতি উপভোগ করতে!
তাদের গাড়ী লোকালয় ছেড়ে অরণ্যে ছুটলো। বেশ
কিছুক্ষণ তারা গাড়ীতে বসেই আশপাশ দেখলো, একটা সময় রোজান নেমে পড়লো। আর শামিমকে বললো,
‘ এটা খুব গভীর জঙ্গল, নিশ্চয়ই হরেক রকম প্রাণীরা এখানে বাস করে। আমি ভেতরের সব প্রাণীদের দেখতে চাই শামিম।
শামিম অদ্ভুত ভয় ভয় চোখে বললো,
‘ এতো খুব সকাল! এখনো আশেপাশে মানুষের চলাচল শুরু হয়নি। যদি ভয়ানক কোনো জন্তুর থাবায় পড়ি?
রোজান হাসতে হাসতে গাড়ীর এক কোণে রাখা একটা ব্যাগ থেকে ড্রোন বের করে বললো,
‘ তোমার থেকে আমি বেশি ভয় পাচ্ছি জানো? কিন্তু আমরা তো ভেতরে যাবোনা। আমার মা-বাবার একমাত্র অবলম্বন আমি, জন্তু গিলে ফেললে হবে নাকি? ওরা একা হয়ে যাবেনা? চলো এখান থেকেই দেখি, ফোনের স্ক্রিনে । আর এদিকে দু একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে, ভয় নেই।
শামিম হেসে বললো,
‘ ওহহ বাঁচালেন! আচ্ছা এখান থেকেই দেখি।
শামিম শুরু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। অসংখ্যবার ড্রোন উড়তে দেখেছে সে, কিন্তু কাছ থেকে এই জিনিসটা তার প্রথম দেখা হলো।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ড্রোন ছেড়ে দেওয়া হলো! রিমোট কন্ট্রোল করছে রোজান নিজেই। তার পেছন থেকে শামিম এদিক ওদিক নিতে বলছে! গাছপালা এত বেশি যে ভেতরে কিছু দেখাই যাচ্ছিলোনা। আবার তাদের মনে হচ্ছে জায়গাটাকে অজান্তেই ভয়ানক ভাবছে, ভেতরে হয়তো তেমন ভয়ানক কিছু নেই।
এক পর্যায়ে শামিম শুনলো গাড়ীতে তার ফোন বাজছে। নিশ্চয়ই তার মায়া ফোন দিয়েছে। শামিম রোজানকে ছেড়ে গাড়ী থেকে ফোনটা নিলো আর একটু সরে গিয়ে কথা বলতে লাগলো।
বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেই
ড্রোনের রিমোট হাতে রোজান চিৎকার করে বলে উঠলো,
‘ ড্রোনের মধ্যে একটা বিশালাকৃতির প্রজাপতি দেখতে পাচ্ছি ! শামিম জলদি আসো।
বিশাল আকৃতির প্রজাপতির কথা শুনে শামিম তার ফোনটা পকেটে রেখে দৌড়ে আসলো । আর এসে ড্রোনের রিমোটে যুক্ত ফোনের স্ক্রিনে লক্ষ্য করে রোজানের দিকে তাকালো। বেশ বিচলিত চাহনি তার! নিজের হাত তারাহুরো করে বাড়িয়ে বললো, এটা কোথায়? এটা কোনো নদী! তার পাড়ে এক মেয়ে পানি তুলছে! জুম করুন স্যার, এমন অদ্ভুত জায়গায় এই মেয়ে একা কি করছে?
রোজান চোখ পিটপিট করে বললো,
‘ আর কতো জুম করবো? স্পষ্ট দেখতে গেলে তো ড্রোনকে আরো সামনে এবং নিচে নামাতে হবে। মেয়েটা যদি ভয় পায়?
‘ তা ঠিক। মেয়েটা ভয় পেতে পারে।
রোজান চিন্তিত চোখে বললো,
‘ আমাদের থেকে ড্রোনটা প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে। কি নদী এটা? আমরা যেতে পারবো?
শামিম বাম হাত দিয়ে রোজানের মাথায় হাত রেখে বললো,
‘ ওখানে যাওয়ার আগেই মারা যাওয়ার সম্ভবনা আছে স্যার, না না আমার মায়া’র তাহলে কি হবে? আমার ভয় লাগছে। আমি ফিরে যাচ্ছি , চাকরি গেলে গেছে!
রোজান শামিমকে চেপে ধরে বললো,
‘ এই স্যার স্যার ডাকা বন্ধ কর! এখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাবোনা,এখানকার সবার মতামত নিয়েই যাবো। আর যদি এটা ভয়ানক জায়গা হয় মেয়েটা কি করে থাকছে হ্যাঁ?
শামিম ভয়ে ভীত হয়ে আছে। রোজান ফোনের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে বলে উঠলো,
‘ দেখ এই মেয়েটার হাঁটু অব্দি সোনালী চুলেরা সকালের রোদে কেমন চিকচিক করছে।
বাক্যটা উচ্চারণ করার সাথে সাথেই রোজান থেমে গেলো। তার বুক ঢিপঢিপ করছে, সোনালী চুল!
এদিকে শামিম ভয়েই আর তাকাচ্ছেইনা। রোজান মেয়েটাকে আরো কাছ থেকে দেখতে ড্রোনটা আরো এগিয়ে নিলো, এবং ধিরে ধিরে নিচে নামাতে লাগলো। মেয়েটা পানির একটা কলস পূর্ণ করছিলো, সাথে একটা পিতলের জগও আছে,সেটাতে পানি ভরার সময়ই সে চকিত নজরে উপরে উড়ন্ত অদ্ভুত জিনিসটা দেখলো। দ্রুততার সাথে সে হাত বাড়িয়ে কলসি আর আধপূর্ণ জগ নিয়ে ছুটে পালালো।
আর রোজানের চোখ যেন ওখানেই আঁটকে গেলো, যখন মেয়েটা উপরে ড্রোনের বরাবর তাকিয়েছিলো।
মুখের সবকিছু অস্পষ্ট হলেও সে তাকে অনেকটাই দেখে নিয়েছে। মেয়েটা একদম ফর্সা যে এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। মুখের অবয়বে এটা সম্পূর্ণ বলা যায় এই মেয়ে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্যের সাথে যায়না, সে ভীনদেশী! হতে পারে এই সেই মেয়ে!
এখন শুধু তার চোখের রঙ আর জন্মদাগের বিষয়টা কাছ থেকে দেখতে ও জানতে পারলেই রোজান নিশ্চিত হবে। অবশ্য মিস দিয়ালী দেশের কোনো জায়গায় খোঁজ নেওয়ার ব্যপারে কোনো ত্রুটি রাখেনি। বড় বড় বিজনেস ম্যানদের কর্মচারী থেকে শুরু করে অলিতে গলিতে সব দোকান, ফুটপাতে তিনি মেয়ের সন্ধানের জন্য ব্যকুল হয়ে ছুটেছেন। লোকালয়ে থাকলে এই মেয়েকে কবেই তারা খুঁজে পেয়ে যেতো। এমন অদ্ভুত জায়গায় থাকার জন্যই কি কেউ খুঁজে পায়না? এবার তার ধারণা কি সত্যি হবে?
এদিকে সে ড্রোনকে অনেক নিচে নামিয়ে ফেলার জন্যই মেয়েটাকে এতো তাড়াতাড়ি হারালো। এখন কীভাবে খুঁজে পাবে এই সোনালী চুলের মেয়েকে?
শামিমের ভীত চেহেরার দিকে তাকিয়ে রোজান দৃষ্টি বাঁকালো আর দৌঁড়ে দূরের ছোট একটা কুটিরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে ডাকলো,
‘ ভেতরে কেউ আছেন? প্লিজ সাহায্য করুন!
একটা আধ বয়সী লোক বন্দুক হাতে বের হয়ে বললো,
‘ হাঙ্গামা করলে এক্কেরে গুলি কইরা উড়াইয়া দিম।
রোজান হাত বাড়িয়ে শান্ত হওয়ার অনুরোধ করে বললো,
‘ আসলে আমরা ঘুরতে এসেছি। প্লিজ ছবির এই জায়গাটায় যাওয়ার উপায় বলুন!
লোকটা এগিয়ে এসে ফোনের ছবির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ অওও তোমরা মৌয়াল হাবিলের ওইহানে যাইবার চাও? কিন্তু এই নদী পার হইবার আগেই যে হাবিল তোমারারে তীর ছুইড়া মাইরা ফালাইবো! ওইহানে যাওন বারণ!
রোজান চিন্তিত চোখে বললো,
‘ কি সমস্যা গেলে?
লোকটা হাসতে হাসতে বললো,
‘ আমি জসিম, এইহানে থাইকাও আইজকা থামাত যাইতে পারলাম না। আর তোমরা কোনহানকার নবাবজাদা হা? ক্যান যাইতে দেয়না, হেইডা অই নিজেই জানে।
রোজান আস্তে আস্তে বললো,
‘ যদি নদীরপাড় পর্যন্ত যাই?
জসিম লোকটা এবার মাথা নেড়ে বললো,
‘ তা পারো। তয় হাবিল দেখবার পারলে খব্বর আছে। নজরে রাইখো, আর সাবধানে যাইয়ো, ভয়ংকর সাপ বিচ্ছু, হিংস্র শেয়াল, এমনও হতে পারে চিতা বাঘের কবলেও পড়বার পারো। দুইবার আমিও চিতাবাঘ দেখছি।
রোজান এবার ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে বললো,
‘ আমাদের সাথে আসুন না! আপনার বন্দুক আর একটা লাঠি নিয়ে। বিনিময়ে আপনাকে ৫০ হাজার টাকা দিবো।
এতো টাকার কথা শুনে জসিম চমকে উঠলো। সে বুঝতে পারলো এই লোক আসলেই নবাবজাদা!
সে হাসতে হাসতে বললো,
‘ দাঁড়াও দরজায় তালাডা দিয়া আহি।
‘
তারা তিনজন একসাথে হাঁটছে। জসিম বন্দুক আর লাঠি নিয়ে আগে আগে যাচ্ছে। এই বন্দুকটা জসিম কীভাবে পেলো কে জানে ! তবে ওকে দেখে মনে হচ্ছে এটা সাথে থাকলে সে কোনো প্রাণীকে ভয় পায়না। বুক ফুলিয়ে হাঁটছে সে।
রোজান ততক্ষণে ড্রোনটাকে নিজের কাছে এনে নিয়েছে। এখন হাঁটছে তার ফোনে সেই মেয়েটার ঝাপসা মুখ বারবার করে দেখছে। রোজান জীবনে প্রথমবার এমন সুন্দর চকচকে লম্বা সোনালী চুল দেখেছে। সোনালী চুল খুঁজতে অনেক মেয়েদের লম্বা আধ কালো চুল, চুল কিংবা রঙ করা হরেক রকম চুল দেখলেও এতো চোখ ধাঁধানো সোনালী চুল সে আগে দেখেনি। চুলগুলোও ক্যামেরায় স্পষ্ট ধরা পড়েছে।
দেড় কিলোমিটার পাড়ি দেওয়াটা শুনতে যেমন দূর মনে হয়েছিলো কিন্তু যেতে তার একটুও অনূভব হয়নি। বরং তারা প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখতে দেখতে উঁচু নিচু পথ পেরিয়ে দ্রুতই পৌঁছে গেলো সেই কাঙ্খিত নদীর পাড়। কিন্তু সেই সোনালী প্রজাপতির দেখা নেই! তারা এদিক ওদিক যাচ্ছে। এর মধ্যে জসিমের ধমক খাবে জেনেও তাকে জিজ্ঞাসা করেছে,
’ নদী পার হওয়ার জন্য কোনো নৌকা পাওয়া যাবে?
পাড়টা অবশ্য দূর থেকে দেখা যায়, কিন্তু পার হওয়ার কোনো রাস্তা নেই। জসিম বললো,
‘ হাবিল এখানে নৌকা ভিড়তে দেয়না।
ঘন্টাখানেক চলে যেতেই জসিম সুযোগ নিয়ে বিরবির করে বললো,
‘ এতো সময় থাকতে পারুম না। মেলা কাজ আমার।
রোজান অসহায় চোখ করে বললো,
‘ আরো দশ হাজার বাড়িয়ে দিবো ।
এভাবে আরো এক ঘন্টা চলে গেলো। এক ঘন্টা যায় আর জসিম এভাবে ১০ হাজার করে বাড়াচ্ছে। ৪ ঘন্টা পেরুনোর সময় জসিম বললো,
‘ জবর খিদা পাইছে, এমনে আর থাকন যায়না। আমারে যাইতে দাও, আমার আর বেশি টাহা লাগবনা বাপ। যেডি হয়েছে এডিই দেও দেহি।
শেষবার রোজান অনুরোধ করে বললো,
‘ এক লক্ষ টাকা মিল করেই নিবেন । আরেকটু থাকেন প্লিজ।
যেন এটাই শেষ ভরসা! ভেতরে ভেতরে শুধু বলছে,
, প্লিজ একবার দেখা দাও! একবার!
শেষ ঘন্টাটা প্রায় শেষ হতে চলেছে, শামিমও তাড়া দিচ্ছে, তারও মায়াকে দেখতে যেতে হবে। কিন্তু রোজান চোখ বন্ধ শুধু বিরবির করছে, ভীনদেশী রাজকন্যা প্লিজ চলে আসো আবার, প্লিজ!
হঠাৎ শামিম রোজানকে নেড়ে বললো,
‘ স্যার চোখ বন্ধ করে বলতে থাকলে তো এসে সে চলে যাবে! কীভাবে দেখবেন? খুলে দেখুন সে আসছে, ওই যে দূরে দেখা যায়।
খুশিতে গদগদ হয়ে রোজান চোখ খুলেই দেখলো কিছু কাপড় হাতে নিয়ে নদীর ওই দিকের পাড়েই আসছে! তার অবয়ব ভীষণ ছোট দেখাচ্ছে, অনেক দূর!
জসিমের কথায় তারা একটা গাছের আড়ালে চলে গেলো।সেখান থেকেই তারা মেয়েটার আগমন লক্ষ্য করতে থাকলো। এদিকে রোজান জসিমকে অন্যদিক ফিরে বসে থাকতে থাকার বিনিময়ে আরো ২০ হাজার টাকা দিবে বললো। আর শামিম নিজে থেকেই অন্যদিকে ফিরে আছে। রোজান না বললেও ওরা বুঝতে পারছে সে কি বলতে চাইছে।
ধিরে ধিরে মেয়েটা এগিয়ে আসলো। কাঠের তক্তার উপর রেখে কয়েকটা কাপড় কাঁচলো। এগুলো পানিতে ধুয়ে, হাত দিয়ে মুড়িয়ে পানি ঝড়ালো। তারপর এগুলো বাহুতে তুলে যেই সে উঠতে যাবে। রোজান আড়াল থেকে বেড়িয়ে মুখের দুপাশে হাত রেখে হাঁক ছেড়ে বললো,
‘ এইইইইইই মেয়ে! তোমার নাম কি?
মেয়েটা চলেই যাচ্ছিলো, কিন্তু বাতাসের তোড়ে রোজানের আওয়াজটা বেশ জোরেই তার কানে প্রতিধ্বনি তুললো। সে ফিরে তাকানোর আগেই দেখলো দেখলো তার বাবা লাঠি হাতে এদিকেই দৌঁড়ে আসছে আর বলছে,
‘ সোনালী তুই বাড়ি যা। আমি দেখতাছি এই পাড়ে কোন ছ্যাড়া!
রোজান মুখে হাত দিয়ে পেছনে তাকালো। ওরা যেন ওকে রেখেই পালিয়ে যাবে যাবে ভাব! সে এতো জোরেই ডেকে ফেললো যে এই ডাক সোনালীর বাবার কানেও পৌঁছেছে! এখন কি উনি নদী সাঁতরে তাদের আক্রমণ করবে নাকি?
তবে ওই লোকের মুখে সোনালী নাম শুনে রোজান অবাক হয়ে গেছে! মেয়েটার সত্যিকার নামও তাহলে সোনালী?
এদিকে সোনালীর বাবার খালি গা দেখেও তো বুঝা যাচ্ছে লোকটা বেশ সবল হলেও কুচকুচে কালো, তাহলে তার ঘরে এমন সুন্দর মেয়ে কি করে?! নিশ্চয়ই রোজানের ভেতরকার সায় আর মিথ্যে হতে পারেনা। সে যে করেই হোক ওই মেয়ের কাছে পৌঁছবেই! রোজান ভেতরে ভেতরে কথাটা বললো!
কিন্তু এই মূহুর্তে তাকে যে পালাতে হবে..
চলবে…….
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার