ভার্সিটির ক্যাম্পাসে নতুন স্টুডেন্টদের র্যাগিং করা হচ্ছে। বাইকে আয়েস করে বসে সবটা উপভোগ করছে ইসরাফ। যেখানে ভার্সিটির বড় ভাইদের উচিত নতুন স্টুডেন্টদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কী না সেটা দেখা। সেখানে সে নিজেই মেয়েদের জঘন্য ভাবে ইভ*টি*জিন করছে। মুখের সি*গা*রেটটা নামিয়ে ধীর কণ্ঠস্বরে বলে,
-এই মেয়ে তুমি তো দেখছি ভীষণ বেয়াদপ! জানো না বড়দের কথা শুনতে হয়? দ্রুত আমাদের নেচে দেখাও।
এতক্ষনে সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি ভয়ে কান্না করে দিয়েছে। আশেপাশে তাকিয়ে সরমে মাথা নিচু করে ফেলে। কান্নারত্ব কণ্ঠে বলে,
-ভাইয়া আমি নাচতে পারিনা। প্লিজ আমাকে যেতে দিন। প্লিজ ভাইয়া।
ইসরাফ লোলুপ দৃষ্টিতে মেয়েটির পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরোক্ষ করে নেয়। সিগারেটের পোড়া ঠোঁটে আঙ্গুল বুলিয়ে কিছু বলতে নেবে আচমকা এক শক্ত হাতের থাপ্পড় এসে পরে তার গালে। উপস্থিত সকলেই আশ্চর্য ও ভীত হয়ে যায়। ইসরাফ রক্ত লাল চোখে চড় মারা ব্যক্তিটির পানে চোখ স্থির করে। যেখানে কোনো ছেলের সাধ্য নেই তাকে মারার সেখানে একটা মেয়ে এসে তাকে সপাটে চড় মেরে বসলো!
নিশ্চিত ভঙ্গিতে বুকে দু’হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে আনাবিয়া। সবাই যে তাকে অবাক হয়ে দেখছে সেদিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই। ইসরাফের বন্ধুরা রেগে কিছু বলতে নেবে তার আগেই ইসরাফ হাতের ইশারায় তাঁদের চুপ থাকতে বলে। চোয়াল শক্ত করে আনাবিয়ার উদ্দেশ্যে বলে,
-নাম কী তোমার? আর কোন ইয়ারের?
-আনাবিয়া। প্রথম বর্ষের স্টুডেন্ট আমি। এখন আমাকেও র্যাগিং করবেন নাকি?
-মেয়ে চেনো আমাকে?
-পাঁচ মিনিট আগে চেনতাম না তবে এখন চিনেছি।
-রিয়েলি?
ঠোঁট কামড়ে হাসে ইসরাফ। তার নিজেকে নিজেরই আহাম্মক আহাম্মক মনে হচ্ছে! এক পুঁচকে মেয়ে তাকে চড় মেরেছে আবার গলা উঁচু করে কথা বলছে!
-সিনিয়র ভাই বা বোনদের কাজ জুনিয়রদের সাহায্য করা। না কি অমানুষের মতো এভাবে মেয়েদের ইজ্জতে হাত দেওয়া! বড় হয়েছেন, বয়সও হয়তো আপনার আমার থেকে বেশি, তবে দুঃখের বিষয় আপনার মা বাবা আপনাকে মানুষ করতে পারেনি।
ইসরাফের রাগ হলো না একটুও। বরং সে বিস্ময়বিমূঢ়। আজ পর্যন্ত যে কয়টা মেয়ে তার জীবনে এসেছে সবগুলোই ন্যাকার রানী ছিল। এইরকম তেজি মেয়ের সাথে পরিচত এই প্রথমই হলো বোধহয়! বাঁকা হেসে ইসরাফ বলে,
-আই এম ইমপ্রেস! জাস্ট ইমপ্রেস।
-আশা করি এখন থেকে মেয়েদের আর জ্বালাবেন না। নিজের আপন বোনের নজরে দেখার প্রয়াস করবেন।
-ওকে মেনে নিলাম তোমার কথা। সবাইকে বোনের নজরে দেখবো শুধু তোমাকে বউয়ের। ঠিক আছে না?
আনাবিয়া কিছু না বলেই সরে যেতে নেয় কিন্ত ইসরাফ তার পথ আটকায়। দৃঢ় কণ্ঠস্বরে বলে,
-তোমাকে আমার মনে ধরেছে।
-এখানে এতশত মেয়ে থাকতেও আপনার আমাকেই মনে ধরলো ইসরাফ শেখ? নাকি থাপ্পড়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এখন ভালোবাসার অভিনয় করবেন কোনটা?
কলো রঙের বোরখায় আবৃত্ত মেয়েটির প্রশ্ন শুনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায় ইসরাফ। মুখে তার কঠোরতার ছাপ। গাল ভর্তি দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
-মেয়ে তো অনেক দেখেছি। তবে পবিত্র ও তেজি রূপ এই প্রথমেই নজরে পরলো।
-পবিত্র! আমাকে তো আপনি এখন পযন্ত দেখেনও নি। শুধু চড় খেয়েই প্রেমে পরে গেলেন?
-প্রেমে পরতে হলে বুঝি মুখশ্রীর দর্শনের প্রয়োজন হয়!
-বর্তমান যুগে তো হয়।
-আমার প্রয়োজন নেই।
-ওয়েল, অন্য কোনো মেয়ের ওপর ট্রাই করুন আশা রাখি সে পটে যাবে।
-তোমার এই নজরকারা এটিটিউড! মাশাআল্লাহ! আমার ভিতরটা একদম পুড়িয়ে ছারখার করে দিলো।
নেকাবের আড়ালে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে আনাবিয়া কিছুক্ষন ইসরাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। এক রহস্যময় হাসি দিয়ে কিছু না বলেই দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যায়। ইসরাফ আনাবিয়ার যাওয়ার দিকে এক ধেনে তাকিয়ে থাকে। অস্পষ্ট স্বরে বিড়বিড় করে বলে,
-আপনাকে যে আমার হতে হবে আনাবিয়া। আমার অশুভ নজর যেহেতু আপনার ওপর পড়েছে সেহেতু আপনাকে নিজের না করে আর ছাড়ছি না।
-আনাবিয়া , এই আনাবিয়া মেয়ে একটু দাঁড়াও।
আনাবিয়া দিলরাবার ডাক শুনে থেমে যায়। দিলরাবা আনাবিয়ার ক্লাসমেট। হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে কিছুক্ষন জোরে জোরে শ্বাস নেয় মেয়েটি। আনাবিয়া প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দিলরাবার দিকে। দিলরাবা স্বাবাভিক হয়ে বলে,
-ইসরাফ তোমাকে কী বলল?
-শুনে কী করবে?
-না বলো না শুনি?
-প্রপোস করেছে আমাকে।
-সত্যি তোমার থাপ্পড় খেয়ে সে তোমার প্রেমে পরে গেলো! তুমি কী বললে?
-সাফ মানা করে দিয়েছি।
-কী বলো! ইনকার করে দিলে তুমি! ইসরাফের সাথে কলেজের সব মেয়ে রিলেশনে যেতে যায়। সেখানে তুমিই একমাত্র মেয়ে যে ওকে রিজেক্ট করেছে। অবিশ্বাস!
-স্বাভাবিক। অন্যসব মেয়েদের মতো যে আমার হতে হবে এইরকম কোথায়ও লেখা নেই।
-সাহসী মেয়ে তুমি আনাবিয়া! তাই তো ইসরাফের মুখের ওপর ‘না’ বলতে পেরেছো।
-আসছি আমি।
-ওকে, পরে কথা হবে।
আনাবিয়া প্রতিউত্তর দিলো না। বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো। আনাবিয়ার চলে যাওয়া দেখে ইসরাফ এগিয়ে এলো দিলরাবার কাছে। দিলরাবা আচমকা ইসরাফকে দেখে ঢোক গিলে। ভীত চোখ ছোট ছোট হয়ে যায়। ইসরাফ হালকা হাসার চেষ্টা করে দিলরাবাকে জিজ্ঞেস করে,
-মেয়েটার নাম আনাবিয়া রাইট?
-জজজি।
-চেনো তুমি তাকে?
-মোটামুটি চিনি।
-কাইন্ডলি আমাকে একটু ওর ইনফরমেশনটা দিতে পারবে? প্লিজ।
-আমি তো আসলে বেশিকিছু জানি না,,,,,,,
-যতটুকু জানো ততটুকই বলো?
“ওর পুরো নাম আনাবিয়া সাবরিন। ঢাকায় ধানমন্ডিতে ও ওর খালার বাসায় থাকে। ভার্সিটিতে নতুন এসেছে। প্রথম বর্ষের স্টুডেন্ট। পর্দা করে। এখন পযন্ত ওর মুখশ্রী আমিও দেখতে পারিনি। শুনেছি কোনো এক কারণে আনাবিয়ার ওর পরিবারের সাথে সম্পর্ক নেই। এইটুকুই আমি জানি।
-অসংখ্য ধন্যবাদ। ডেটস ইস এনাফ ফর মি।
তুফানের মতো এসেছিলো ইসরাফ হাওয়ার মতো চলে গেলো! এখনও আশ্চর্য হয়ে দিলরাবা ইসরাফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েরা যেমন এই ছেলের ওপর ক্রাশ খায় তেমনই আবার ভয়ও পায়। কলেজের বড় ভাই ব্রাদার্স হলো ইসরাফ। দাপট জানো একটু বেশিই!
__________________
-আনা মা এসেছিস?
জুতোজোড়া খুলতে খুলতে আনাবিয়া বলে,
-হ্যাঁ খালামনি এসেছি।
-যাও দ্রুত শাওয়ার নিয়ে এসো। আমি খাবার গরম করছি।
-ঠিক আছে।
নিজ রুম এসে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলে আনাবিয়া। ধীর পায়ে ভিতরে যেয়ে বিছানায় বসে পরে। অগোছালো হয়ে আছে পুরো কামরা। এটা যে কার কাজ বুঝতে অসুবিধা হলো না আনাবিয়ার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।
🌸🌸
এমপি ইরান শেখের বাড়ির বাহিরে রিপোর্টসদের ভীড় জমেছে। দেহরক্ষীরা তাঁদের ভিতরে আসতে দিচ্ছে না। বাহির থেকে চেঁচামেচি শুনে দালান থেকে বেরিয়ে আসে মধ্যবয়সের একজন নারী। সবুজ রঙের জামদানি শাড়ী গায়ে জড়ানো। কানে, গলায়, হাতে স্বর্ণের জানো অভাব নেই! মুখের ভাবভঙ্গি একদম গম্ভীর ও কঠোর। শাড়ী আঁচল পিঠে জড়িয়ে আঙিনায় এসে দাঁড়ায়। দেহরক্ষীদের উদ্দেশ্যে বলে,
-তাঁদের ভিতরে আসতে দেওয়া হোক।
হুড়মুড়িয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে কয়েকজন রিপোর্টস। দু’দিন আগে যে নারীর জন্মদাতা মারা গেলো সেই নারীর এতো সাজগোজ! বিস্মিত হয়ে রিপোর্টসরা চোখ বুলাচ্ছে। স্মুখীন দাঁড়ানো রমণী রুক্ষ কণ্ঠস্বরে বলে,
-এবার বলুন কোন জরুরি কাজের উদ্দেশ্যে এই অসময়ে আমাদের বাড়িতে হাজির?
-ম্যাম, দু’দিন আগে এমপির বাবা এরফান শেখ মৃত্যুবরণ করলেন। সে নাকি আত্ম*হত্যা করেছে? এটা কী সত্যি? যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে কেনো আত্ম*হত্যা করলেন?
-বাবার ডে*থব*ডিকে পোস্টমর্টেম করতে নেওয়া হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই জেনে যাবেন সবটা। এখন এভাবেই আমাদের বাড়িতে শোকের ছায়া শুধু শুধু আরো শোক বাড়িয়েন না।
-ম্যাম একবার জাস্ট ইরান স্যারকে আসতে বলুন। আমাদের তার সাথে কিছু কথা আছে।
-আমি,,,,,,,
-ইরান শেখকে ছাড়া কী আপনাদের নিউজ চলে না? প্রতিদিনই কেনো ইরান শেখকে থাকতে হবে?
রিপোর্টসরা সকলেই রমণীর পিছনে তাকায়। পেন্টের পকেটে দুইহাত গুঁজে দালানের দরজার স্মুখীন দাঁড়িয়ে আছে ইরান শেখ। ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পরে রিপোর্টসরা। ইরান এগিয়ে এসে হাত উঁচু করে থামিয়ে দেয় সবাইকে। পুরুষালি ভরাট কণ্ঠে বলে,
-আজকের জন্য সমাপ্ত। এখন আসতে পারেন আপনারা।
-কিন্তু স্য,,,,,,,,,,
ইরানের পানে তাকিয়ে আর কিছু বললো না রিপোর্টসরা। তারা সকলেই ইরানের রাগের প্রতি অবগত। তাই এক এক করে বেরিয়ে যায় সদর দরজা দিয়ে। ইরান পুনরায় বাড়ির ভিতরে ঢুকতে নেবে তখনই পিছনে থেকে তাকে উদ্দেশ্য করে ডাক দেয় রমণী। ইরান নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরে।
-কিছু বলবেন আপা?
-দেখছো ইরান কী হচ্ছে এইসব? বর্তমানে ব্রেকিংনিউজই এটা! তোমাকে হাজারবার বললাম আর যাই হোক নিজের চরিত্রকে স্ট্রং রাখো কিন্তু তুমি কতবড় একটি দুর্ঘটনা করে দিলে!
-আপনি এসব নিয়ে একদম মাথা ঘামাবেন না আপা। যেভাবে হাওয়ার মতো খবর ছড়াচ্ছে ঠিক সেভাবেই আবার থেমেও যাবে।
-সবকিছু এতো সহজে নিও না।
-উম জেসিকা এসেছে?
-হ্যাঁ, কিছুক্ষন আগেই এসেছে।
-ঠিক আছে।
ইরান আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির ভিতরে চলে যায়। দাঁড়িয়ে থাকা রমণী হলো ইরানের বড় বোন তনুসফা শেখ। বয়স ৪৫ এর কোঠায় পরেছে। স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর বাবার বাসায়ই থাকে। তার নিজস্ব ব্যবসা আছে। বাড়িতে সাধারণত তারই হুকুম চলে। এক মেয়ে আছে তার। লন্ডন গিয়েছিল স্টাডি কমপ্লিট করতে। আজ সকালেই বাংলাদেশে ব্যাক করেছে।
এই রমণীর অহংকারই জানো অলংকার! মাটিতে পা পরে না অহংকারে। তার মতে, “বাঁচতে হলে ধনী হয়েই বাঁচ নাহয় মরে যাও!”
__________________🌸
দুপুরে খাওয়ার পর্ব ঢুকিয়ে নিজ রুমে আসে আনাবিয়া। বিছানা থেকে ফোন হাতে নিয়ে বেলকনিতে চলে যায়। তাঁদের ফ্ল্যাটটা দুইতালায়। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আনাবিয়া গলিতে চলাচল করা মানুষদের দেখতে থাকে। দুপুর সময় গলিটা একদম নির্জন হয়ে যায়। এক দুইজন মানুষ যায় আসে। ডানপাশে তাকাতেই আনাবিয়ার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। পরিহিত ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। তাঁদের বাসার ঠিক নিচে ইসরাফ দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে তাকিয়ে সবটা পরোক্ষ করছে ছেলেটা। আনাবিয়া অবাক হয়নি। সে জানতো ইসরাফ তাকে ঠিক খুঁজে বের করে ফেলবে। হলোও তাই!
খানদানি পরিবারের বিগড়ে যাওয়া সন্তান ইসরাফ। অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ছে সে। ভার্সিটিতে যেমন তার সুনাম আছে তেমনই দুর্নামেরও অভাব নেই। গুন্ডামি, মারামারি, মেয়েবাজ সব কিছুতেই দু কদম এগিয়ে চলে। অবশ্য পড়াশোনায়ও বেশ ভালো। ভার্সিটির প্রফেসররাও ভয়ে কিছু বলতে পারে না ইসরাফকে। আনাবিয়ার জানামতে অনেক মেয়ের সাথেই ইসরাফের গভীর প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল। এখন আবার তার পিছনে পরেছে। সত্যি কী পিছনে পরেছে নাকি আনাবিয়া ইচ্ছেকৃত ভাবেই ইসরাফকে নিজের পিছনে বাজিয়েছে!
-আনা? আনা মা বেলকনিতে?
খালার ডাক শুনে রুমে আসে আনাবিয়া। একটা চায়ের কাপের মতো গ্লাস ধরিয়ে দেয় আনাবিয়ার হাতে। হালকা হাসে আনাবিয়া। খালাকে বিছানায় বসিয়ে দেয়। তার পাশেই নিজে বসে পরে। আনাবিয়া খালা (জয়তি) বলে,
-তোর গ্রীন টি। জলদি শেষ করে ফেল।
-জানো খালামুনি আমি আজ কাকে দেখেছি?
-কাকে দেখেছিস মা?
নিশ্চুপ হয়ে যায় আনাবিয়া। একমনে গ্রীন টির দিকে তাকিয়ে থাকে। এক চুমুক দিয়ে কাপটা কিনারে রাখে। হাঁটুর ওপর রাখা হাত দুটো অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। জয়তি চিন্তিত হলো না। এরকমটা আনাবিয়ার সাথে সবসময়ই হয়। জয়তির মতে কাঠের পুতুল হলো আনাবিয়া। যে জি*ন্দা আছে ঠিকই কিন্তু কোনো প্রাণ নেই! নীরবতা কাটিয়ে কাঁপাকাঁপা কণ্ঠস্বরে আনাবিয়া বলে,
-খুব জলদিই তুমি আমার মুখে হাসি দেখতে পাবে। শ*ত্রু যে আমার হাতের মুঠোয় এসে খেলা করছে খালামুনি! আমার ভিতরের আগুনে জ্বা*লিয়ে পু*ড়ে একদম জি*ন্দালা*শ বানিয়ে দেবো তাকে। দেন, পুনরায় নিজ দেশে পাড়ি জমাবো আমি।
-আমাকে একা করে চলে যাবি? তোকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো মা?
-আমি এই দেশে কেনো এসেছি এটা তুমি ভালো করেই জানো খালামুনি। নিজের মিথ্যে পরিচয় রটিয়েছি! তবে আমি আসবো তোমাদের সাথে দেখা করতে।
-আমি চাই সৃষ্টিকর্তা এমন কিছু চমৎকার করুক যাতে তোর আর রাশিয়া যাওয়া না হয়।
-সিরিয়াসলি! আতিয়া এসেছে?
জয়তির হাসি হাসি মুখটা চুপসে যায়। গোমড়া মুখ করে বলে,
-এসেছে। দরজা লাগিয়ে নিজ রুমে বসে আছে। দিনে দিনে মেয়েটার যে কী হচ্ছে!
-এটা কোনো সমস্যা নয় খালামুনি। আতিয়া জাস্ট হেট মি। ও নিজ বাবা মায়ের ভালোবাসা অন্য কারো সাথে শেয়ার করতে চায় না। আই ট্রাই সো মাচ টু টক্ উইথ হার বাট সি ডিডনট টক্ উইথ মে। লাইক এ অ্যাংরিবার্ড!
-তোর ইংরেজি গুলো আমার মাথার ওপর দিয়ে যায়। একদম ইংরেজদের মতো ইংলিশ বলিস!
-এটাই তো আমার ভাষা। জানো খালামুনি এই বাংলা বলতে বলতে আমার এখন নিজেকে নিজেরই বাঙালী বাঙালী মনে হয়!
আনাবিয়ার কথা শুনে হাসতে লাগলো জয়তি। আনাবিয়া শান্ত ভঙ্গিতে বসে রইলো। তখনই হঠাৎ কিছু পরার আওয়াজ আসে। জয়তি আর আনাবিয়া একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ী করল।
নিজ কামরায় বসে কিছু জরুরি ফাইল চেক করছে ইরান। পুরো কামরাটা রাজকীয় ছোঁয়ায় মিশ্রিত। ধবধবে সাদা রঙে, রুমের দেয়াল থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি আসবাবপত্র। জালানা দিয়ে আসা বাতাসে বড় শুভ্র রঙের পর্দা উড়ছে। ইরানের মন মস্তিক এখন সম্পূর্ণ কাজে। ঠক ঠক আওয়াজ করে রুমে প্রবেশ করে তনুসফা। ইরানের সেদিকে কোনো ধেন নেই। তনুসফা বিরক্ত হয়। একটু উঁচু গলার স্বরে বলে,
-ইরান কিছু কথা ছিল আমার।
-বলুন?
ফাইলে চোখে রেখেই কথাখানা বললো ইরান। তনুসফা বড় একটি নিঃশাস নিয়ে বলে,
-সেদিন আমি যে মেয়েকে দেখতে গিয়েছিলাম আজ তার পরিবার আসবে সন্ধ্যার পর।
-তোহ?
-তুমি বাসায় থেকো।
-হোয়ায়?
-আর কতকাল অবিবাহিত থাকবে তুমি? তোমার জন্য ছোটর পথও আটকে আছে। তোমার ভাগ্নিরও কয়দিন পর বিয়ে হবে সেখানে বড় মামারই এখন পর্যন্ত বিয়ে হয়নি! বিষয়টা ভালো দেখায় না ইরান।
-সঠিক সময় হোক আমি বিয়ে করব।
-কবে আসবে তোমার সেই সঠিক সময়? ৩৫ বছর তো হয়ে গেলো! ধীরে ধীরে আরো বয়স বাড়বে তখন এই বুড়োকে কে বিয়ে করবে? বলো আমাকে একটু?
চোখ থেকে চশমা রেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় ইরান। গায়ের আটস্যাট হয়ে লেগে আছে সাদা রঙের পাঞ্জাবী। গম্ভীর হয়ে বলে,
-আমার বয়স নিয়ে আমার কোনোরকম মাথাব্যাথা নেই। তাছাড়াও আমার মতে, যে নারীর ভাগ্যে আমি আছি সে নারী রাজ কপাল নিয়ে জন্মেছে।
-সেটা আমিও জানি। তবুও বিয়ে তো করতে হবে। শেখ বাড়ি গুছিয়ে রাখতে হলে বড় ছেলের বউ হিসেবে একজন খাঁটি বাঙালী নারীর অত্যাধিক প্রয়োজন।
ইরান কোনো জবাব দিলো না। তনুসফা দীর্ঘশ্বাস ফেলে করুণ কণ্ঠস্বরে বলে,
-আপাদত আমার খুব বেশি চিন্তা হচ্ছে ইরান। যদি পুলিশরা বুঝে ফেলে এরফান শেখের মৃত্যু কোনো আত্ম*হত্যা ছিল না খু*ন ছিল। তাহলে কী হবে?
-ইরান শেখ অপূর্ণ কাজ করে না আপা। আপনি চিন্তা করবেন না একদম।
-তবুও,,,,
-একজন অত্যাচারীর বেঁচে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁদের জন্য মৃত্যুই শ্রেয়।
>>>>চলবে?
#সে_প্রেমিক_নয়
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#সূচনা_পর্ব