সে ধর্ষক
পর্ব০১
লেখা: শাহিদা হক শাপলা
আজকেও তনু’র পাজামায় রক্তের দাগ দেখে আঁতকে উঠলো মৌমিতা। কয়দিন পরপরই এই জিনিসটা ওর চোখে পড়ছে। বিষয়টা মৌমিতাকে খুব ভাবাচ্ছে। এমনকি রাতের বেলা ঘুমাতে গেলেও ওর চোখে ভেসে উঠছে তনু’র রক্তভেজা পাজামা। ওটুকু একটা নয় বছর বয়সী বাচ্চা মেয়ের এমনটা কেন হবে? আর এ বিষয়টাই বা কীভাবে আলোচনা করা যেতে পারে এইটুকু একটা মেয়ের সাথে? তবুও বিষয়টা জানতে হবে। এটা একদমই এড়িয়ে যাবার মতো বিষয় নয়। মৌমিতা তনুকে ডাকলো, ”এদিকে আয় দেখি তনু।”
তনু এলো। নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাবভাব মোটেও স্বাভাবিক লাগলো না মৌমিতার কাছে। মৌমিতা ভেবে বললো, “তুই কী কী শিখলি স্কুলে গিয়ে?”
তনু কথা বলছে না।
”আচ্ছা, ঋতুস্রাব কী তা বলতে পারবি?”
তনু ফ্যালফ্যাল করে তাকালো যেন এমন অদ্ভুত শব্দ কখনোই শুনে নাই। মৌমিতা সংকোচবোধ করলো। এইটুকু একটা বাচ্চা মেয়েকে ও এসব কী বলছে!? ঋতুস্রাব কী -এটা জানার মতন বয়স তো ওর এখনো হয় নাই। তাহলে এ কীসের দাগ কয়দিন পরপরই দেখা যাচ্ছে ওর পাজামায়? ওকে কেউ physically abuse করছে নাতো!? কিন্তু এমন কাজ এ বাসায় কে করবে? মৌমিতার কোনো ভাই নেই। সিরাজ ব্যতীত আর কোনো বাইরের পুরুষ এ বাসায় আসে না বললেই চলে। সিরাজের সাথে মৌমিতার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। কাবিন হয়ে গেছে। ছয়মাস পর উঠিয়ে নিবে।
মৌমিতা আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করলো যে, ইদানীং তনু একদমই চুপচাপ থাকে। পাঁচটা প্রশ্ন করলে একটার জবাব দিলে দেয়! আর বাকি চারটা প্রশ্নেরই কোনো জবাব দেয় না। চুপচাপ তাকিয়ে থাকে কিংবা মাথা নত করে রাখে। কিন্তু তনু তো মোটেও এমন নয়!
তনু মৌমিতার খালামণি’র মেয়ে। ওকে জন্ম দেবার সময় খালামণি মারা যান। সেই থেকে তনু মৌমিতাদের পরিবারের সদস্য হয়েই আছে। মৌমিতার মা-ই ওকে বড়ো করেছে। মৌমিতার সাথে তনু সারাক্ষণই আঠার মতো লেগে থাকতো। সারাক্ষণই এটা ওটা প্রশ্ন করতো। মৌমিতাকে ছাড়া ও কিছুই বুঝে না। ওর পুরো পৃথিবীটাই যেন মৌমিতা। এই বাচ্চা মেয়েটা ওদের সারা বাড়ি মাথায় তুলে রাখতো। সারাক্ষণ ইঁদুরের মতো হুটহাট ছুটাছুটি করে বেড়াতো সারাবাড়িময়। সিরাজ এলে ওর কোলে বসে ওর আনা আইসক্রীম খেতো। সেই তনু এখন এতটা চুপচাপ কেন হলো? এমনকি ওর প্রাণের আপু মৌমিতার সাথেও কেন কথা বলছে না? মৌমিতা দৃঢ়মনে সিদ্ধান্ত নিলো, বিষয়টা নিয়ে ও ওর মতো করে তদন্ত চালাবে কয়দিন। রাতের বেলা সবাই ঘুমাতে গেলে পুরো বাড়ি অন্ধকার হয়ে যায় যখন, তখনও ও তনু’র রুমের সামনে লুকিয়ে লুকিয়ে টহল দিতে থাকে। বেশ কয়েকদিন এটা করার পরও কোনো সুরাহা পাওয়া গেল না। তনু’র রুমে ও কাউকেই ঢুকতে দেখলো না এ কয়দিনে। তবুও ওর সন্দেহ কাটছে না। সেদিন রাতে খেয়ে-দেয়ে সবাই ঘুমিয়ে যাবার পর ও সরাসরি তনু’র রুমে ঢুকলো। লাইট অন করলো। টেবিলের উপর বাড়ির কাজের নীল কাভারের খাতাটা পড়ে আছে। তনু ঘুমায় চুপচাপ। পাজামা হাঁটু পর্যন্ত উঠে আছে। হাফ হাতা গেঞ্জিটা নাভীর উপরে উঠে যাওয়ায় ছোট্ট পেটটা দেখা যাচ্ছে। কী পবিত্র! মৌমিতার চোখে জল চলে আসে। একটা শিশুর সাথে এই জঘন্য কাজটা কে করে? আদৌ করে? না-কি সবই ওর ভ্রম বা ভুল ধারণা? কিন্তু এভাবে এরকম সন্দেহ ভেতরে বয়ে তনুকে ছেড়ে ওর যেতে ইচ্ছে করলো না। ডেকে তুললো তনুকে। ”চল্, আজ থেকে তুই আমার ঘরে ঘুমাবি। এই ঘরে তোকে আর একা একা ঘুমাতে হবে না।” তনু ঘুম ঘুম চোখে মৌমিতার হাত ধরে ওর রুমে চললো।
তনু খাটের একপাশে নিশ্চিন্তে ঘুমায়। মৌমিতা’র মাথা থেকে চিন্তা সরে না। ও ওর বড়ো আপাকে ফোন করে পুরো ব্যাপারটা জানালো। বড়ো আপা ওকে সবটা সত্যভাবে যাচাই করে বা প্রমাণ করে পরে বিষয়টা নিয়ে ভাবার পরামর্শ দিলেন। ”কেবলমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে এটাকে বড়ো করা যাবে না।” সেইথেকে মৌমিতা প্রমাণ আয়ত্ত করার সূত্রগুলো খুঁজতে লাগলো। এই কয়দিনের পুরো ঘটনাগুলো চিহ্ন এঁকে এঁকে মাথাতে গুছিয়ে নিলো–
”এ কয়দিনের মধ্যে আমাদের বাসায় দুইজন পুরুষ এসেছেন। –মা অসুস্থ থাকার রাতে রেস্টুরেন্ট থেকে ওয়েটার এসে আমাদের রাতের খাবার দিয়ে গিয়েছিল;
আর সিরাজ এসেছিল মোট সাতদিন। কিন্তু!! ওয়েটার তো দরজার ওপার থেকে খাবারটা দিয়েই চলে গিয়েছিল। সে তো ঘরে আসেই নি। আবার দারোয়ানও সুযোগ পেলেই ‘চোর, চোর’ বলে ঘরে ঢুকে, উপর তলায় আসে। যদিও কখনো চোর আসতে দেখি নি। কিন্তু সে তো কোনো রুমেরই ভেতরে ঢুকতো না। রুমগুলোতে একটু উঁকি মেরেই চলে যেতো। তাহলে কী সিরাজ?”
তনুকে যেভাবেই হোক পুলিশের সাহায্য নিয়ে মেডিকেল টেস্ট করাতে হবে। তনুর সাথে সত্যিই খারাপ কিছু ঘটেছে কি-না সেটার প্রমাণ সহকারে সত্যতা যাচাই করতে পারলেই বাকি কাজটুকু সহজ হবে।
আর এ ব্যাপারে একজনই ওকে সবচে’ বেশি সাহায্য করতে পারে। তিনি হলেন ওর বাবা ইমরুল সাহেব। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া, বাজার করা আর অবসরে বই পড়া বা টিভি দেখা –এটুকুই বর্তমানে ইমরুল সাহেবের দৈনন্দিন কাজ-কর্ম। ইমরুল সাহেব বই পড়ছিলেন। মৌমিতা বললো, ”আব্বু , তোমার একজন পুলিশ অফিসার বন্ধু আমাদের থানায় ছিলেন। উনার ফোন নাম্বারটা দিবে?”
”রফিকের কথা বলছিস, মা?”
“হুম।”
“কিন্তু ও তো ক’মাস হলো চট্টগ্রামে বদলি হয়ে গেছে।”
“ও।”
”ওর ফোন নাম্বার দিয়ে কী করবি, মা?”
মৌমিতা কাজটা খুব গোপনে করতে চাচ্ছে তাই মিথ্যে করে বললো, ” আমি কিছু করব না, আব্বু। আমার এক বান্ধবীর দরকার।” ইমরুল সাহেব একটা আফসোসের নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার বই পড়ায় মনোনিবেশ করলেন।
মৌমিতা হতাশ হলো কিন্তু হাল ছাড়লো না। তনুকে নিয়ে তখনই থানায় এলো। একজন পুলিশ অফিসারকে সব খুলে বললো। অফিসার প্রথমে রাজি না হলেও অনেক অনুরোধের পর মেডিকেল টেস্ট করাতে সম্মতি দিলেন। সেদিনই তনুর মেডিকেল টেস্ট হলো। রিপোর্ট দিবে দুইদিন পর।
মৌমিতা এক ভয়ানক অস্থিরতায় প্রতিটা সেকেন্ড পার করছে। অপরদিকে সিরাজের মুখটা ওর চোখের সামনে ভাসছে। কোনো এক অজানা আশংকায় ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে ও। সিরাজকে ও নিজেই পছন্দ করেছে। ওর জন্যই সিরাজ আজ ওদের পরিবারের একজন। ওর জন্যই সিরাজ রাত-বিরাতে অবাধে ওদের বাসায় ঢোকার অনুমতি পেয়েছে। ওর সাথে যদি সিরাজের কাবিন না হতো , এতখানি অধিকার সিরাজ পেতো না।
সেই সিরাজ যদি হয় ধর্ষক? সেই সিরাজের জন্যই যদি একটা শিশু এতটা কষ্ট পেয়ে থাকে, তাহলে মৌমিতা কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। মৌমিতা মনে মনে সিদ্ধান্ত স্থির করে রাখলো যে, ওর পছন্দ করা মানুষটা যদি ধর্ষক হয়, তাহলে আত্মহত্যাই ওর শেষ রাস্তা। সিরাজকে ফোন দিয়ে সরাসরি এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতেও পারছে না। কেননা তদন্ত করতে গিয়ে ও আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করলো —
যেদিন যেদিন রাতে সিরাজ ওদের বাসায় এসেছে, ঠিক সেদিন ভোরেই ও তনু’র পাজামায় রক্তের দাগ দেখেছে। তাই এখন সিরাজকে বললেও সবটা বলা যাবে না।
নিজের থেকেও বেশি বিশ্বস্ত সিরাজই কি তবে সেই পশু? সেই বিশ্বাসঘাতক?
মাঝরাতে রুমের জানালার দিকে চোখ পড়তেই মৌমিতা দেখলো, কালো চাদরে সারা শরীর মোড়ানো একটা লোক ওদের গেইট দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। ও দ্রুত নিচে নেমে গেইটের কাছে গেল। উঁকি দিয়ে দেখলো রাস্তা পুরো ফাঁকা। দারোয়ান বড়ো বড়ো চোখ করে ওকে দেখছে। গেইটের বড়ো বড়ো দু’টো বাল্বের কড়া আলোয় দারোয়ানের চোখ দু’টো হায়েনার মতো ঠেকছে। মৌমিতা বিষয়টা খেয়াল করলো। কিন্তু কিছু বললো না। তনু’র ব্যাপারটা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কাউকে কিচ্ছুটি বুঝতে দেয়া যাবে না।
চলবে…..