সুপ্ত_অনুরাগে-২৮

#সুপ্ত_অনুরাগে-২৮
#প্রভা_আফরিন

দিনটা গুমোট। রোদ, বৃষ্টি, বাতাস কোনোটার অস্তিত্ব প্রকট নয়। ভ্যাপসা গরম ছুটেছে। নিভন্ত সূর্যের ম্লান দিনে অপুদের বাড়ি মুখোরিত। বাড়িতে আজ সকলে উপস্থিত। এমনকি দুলাভাইয়ের উপস্থিতিতেও কাজু বাড়িতে আছে। অনেক দিন পর দুই শালা-দুলাভাই একসঙ্গে বাড়িতে উপস্থিত। উপলক্ষ্য শিমুলের জন্মদিন। আজ রাতে ভালোমন্দ খাবারের আয়োজন করা হচ্ছে। শিমুলের বন্ধুবান্ধবসহ কিছু নিকটাত্মীয়ও উপস্থিত থাকবে।

আনিসুল সাহেব দুদিন ধরে চুপচাপ। কারো সঙ্গে বাক্যালাপ করছেন না। যেচে পড়ে কেউও উনার সঙ্গে কথোপকথনে এগিয়ে আসছে না দরকার ব্যতীত। সাধারণত আনিসুল সাহেব রেগে থাকলে বাড়ির সকলেই কিছুটা সংকুচিত হয়ে পড়ে। উনাকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু পরিবারের ছোটো সদস্যের জন্মদিনের কারণেই বোধহয় আনিসুল সাহেব মেজাজ ঠান্ডা রেখেছেন।

কাজু আজ লুঙ্গি পরেছে। সঙ্গে স্যান্ডো গেঞ্জি। বসার ঘরে আনিসুল সাহেব বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। কাজু বুক ফুলিয়ে ড্রইংরুমে আসতেই তিনি ভ্রু যুগল একত্রিত করে, বাঁকা চোখে তাকালেন। অত্যন্ত শীতল কণ্ঠে বললেন,
“আজ হঠাৎ লুঙ্গি পরেছিস কেন?”
কাজু ফুরফুরে মেজাজে লুঙ্গি নাচিয়ে বলল,
“যা গরম পড়েছে, তাতে লুঙিই আরাম দেয়। নিচ দিয়ে ভালো হাওয়া চলাচল করে। আপনিও পাজামা খুলে লুঙ্গি পরে নিতে পারেন, দুলাভাই। লুঙ্গি রাগী মানুষদের জন্য উপকারী। নিচ দিয়ে হাওয়া চলাচল করলে ওপর দিয়ে ঠান্ডা থাকবে। আই মিন মেজাজ ঠান্ডা থাকবে। অবশ্য লুঙ্গি সামলানোর একটা ব্যাপার আছে। আপনি তো বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন। পাজামার ফিতাতেও শুনেছি গিট লাগিয়ে ফেলেন।”
আনিসুল সাহেব চোয়াল শক্ত করে ফেললেন।চ্যাচিয়ে বললেন,
“জাহেদা, তোমার ভাইকে দুচোখের সামনে থেকে সরতে বলো। আজকের দিনে কোনো ঝামেলা চাইছি না।”
কাজু ঢোক গিলে, লুঙ্গি উঁচিয়ে তৎক্ষনাৎ সেখান থেকে সরে গেল।

খানিকক্ষণ বাদে আনিসুল সাহেব অপুকে ডাকলেন। অপু শিমুলের জন্য কেক ডেকোরেট করতে ব্যস্ত ছিল। ছুটে এসে ব্যস্ত গলায় বলল,
“ডেকেছিলে বাবা?”
“তন্ময়ের ফুপাতো ভাইকে তুই কীভাবে চিনিস?”
এমন সময় এহেন প্রশ্নে অপু ভড়কে গেল। বাবার অত্যাধিক শীতল কণ্ঠ শ্রবণ করে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল মুহূর্তেই। অপু ইতস্তত করে বলল,
“বলেছিলাম না একবার এক্সিডেন্ট করা এক বাইক চালককে হেল্প করেছিলাম, সুপ্ত মানে তন্ময়ের ফুপাতো ভাই-ই সেই লোক।”
“এটুকুই পরিচয়?”
অপু মৌন রইল। জাহেদা বেগম পাশ থেকে ক্ষীণ স্বরে জানতে চাইলেন,
“হঠাৎ ওদের প্রসঙ্গ আসছে কেন?”
আনিসুল সাহেব মেয়ের দিকে শীতল দৃষ্টিপাত করে বললেন,
“অপুর জন্য সম্বন্ধ এসেছিল। তন্ময়ের ফুপুর ছেলের জন্য।”

অপু রুদ্ধশ্বাসে তাকায়। সুপ্তের বাড়ি থেকে সম্বন্ধ এসেছে! মনের মাঝে তানপুরা বেজে ওঠে। সে উদগ্রীব হয়ে তাকায় বাবার দিকে। জাহেদা বেগম অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন,
“তন্ময় মানা করেছে বলে এখন তাদের আত্মীয় সম্বন্ধ করতে চাইছে? আমার তো ওই পরিবারের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ রাখার ইচ্ছে নেই।”
আনিসুল সাহেব মাথা নেড়ে বললেন,
“আমারও ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ওরা খুব করে বললেন। তোমার মেয়েরও নাকি ভালো খাতির ওদের ছেলের সাথে। তাই খোঁজ নিলাম।”

অপু মাথা নত করে রাখে। তার বুকের ভেতরটা দুরুদুরু কাঁপছে। জাহেদা বেগম কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলেন,
“খোঁজ নিয়ে কী জানলে?”
“জানলাম ছেলের বাবা-মা ডিভোর্সি। ছেলে ছোটো থেকেই তার বাবার কাছে বড়ো হয়েছে। হয়েছেও উশৃংখল স্বভাবের। এক্সিডেন্টের পর থেকে তোমার মেয়ের পেছনে পড়েছে। তাকে ফলো করত, ডিস্টার্ব করত। অথচ তোমার মেয়ে আমাদের কিছুই জানায়নি। উল্টে আশকারা দিয়েছে। তারচেয়েও বড়ো কথা ছেলের মা, ভদ্রমহিলা ডিভোর্সের পরও প্রাক্তন স্বামীর বাড়ি যাতায়াত করেন। এমন বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। মানা করে দিয়েছি।”
এরপর অপুর দিকে ফিরে আনিসুল সাহেব তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি হেনে বললেন,
“তোর থেকে অন্তত আমি এমনটা আশা করিনি। এখন তো মনে হচ্ছে তন্ময়ের পরিবার এসব জেনেই বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে। ছিঃ ওদের কাছে কতটা ছোটো হতে হলো!”
অপু দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না সামলায়। বলতে চায়,
“বাবা আমার কথাটা শোনো…”
আনিসুল সাহেব হাত উঠিয়ে অপুকে থামালেন। রুক্ষ স্বরে বললেন,
“আমাকে যেন এই বিষয়ে আর একটা কথাও বলতে না হয়। ছোটো ভাইয়ের জন্মদিন। আত্মীয় স্বজন আসবে। পরিবেশ ভালো রাখার দায়িত্ব তোদের।”

অপুর চোখ ফেটে জল গড়ায়। টলতে থাকা পায়ে ছুটে যায় নিজের ঘরে। সুপ্তের বাড়ি থেকে আসার সপ্তাহখানিক পেরিয়েছে। লোকটা শেষ চেষ্টা করার আশ্বাস নিয়ে ফিরে গিয়েছিল। এরপর দুজনের ফোনে কথা হয়েছিল কয়েকবার। কতটা উচ্ছ্বাস ছিল অপুর মাঝে। অথচ ভত দুদিন থেকে সুপ্ত আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। অপু কিছুটা চিন্তিত হলেও বিশেষ ভাবেনি। তবে অপুর এখন তার চেয়েও বড়ো দুঃখ হলো বাবা শুধু খোঁজ নেওয়ার ওপর ভিত্তি করে মানা করে দিলো? একবার তার সঙ্গে কথা বলল না, কথা শুনলও না! অপু সুপ্তের ফোনে কল করল। গতকাল থেকে ফোন বন্ধ। প্রত্যাখান পেয়েই কী সুপ্ত তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে? অপু আধঘন্টা পর পর সুপ্তের ফোনে কল করতে লাগল। প্রতিবারই বেসুরো শব্দ জানান দেয় ওপাশের মানুষটা মনঃকষ্ট নিয়ে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাচ্ছে।

দুপুর ছাড়িয়ে বিকেল গড়ায়। বাড়িতে আত্মীয় আসতে শুরু করেছে। সময়ের সঙ্গে অপুর উদ্বিগ্নতা বৃদ্ধি পায়। যোগাযোগ করার কোনো মাধ্যম না পেয়ে অবশেষে তন্ময়ের কাছে ফোন করে সে। তন্ময় ফোন রিসিভ করতে বেশি সময় নিল না। স্মিত হেসে বলল,
“কী ব্যাপার? ফুলের হঠাৎ আমাকে মনে পড়ল?”
“সরি তন্ময়। আসলে গতকাল থেকে সুপ্তের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। উনি ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। আমার কাছে তো আর কোনো ওয়ে নেই যোগাযোগের। আপনি কী একটু…”
“বুঝেছি। তুমি চিন্তা কোরোনা। আমি খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি।”

অপু ফোন কেটে ঘরময় পায়চারী করতে থাকে। জানালার কাছে গিয়ে তাকিয়ে থাকে পথের দিকে। একসময় সুপ্ত পথের ধারের দোকানে বসে থাকলে অপুর তা সবচেয়ে বিরক্তিকর দৃশ্য বলে মনে হতো। কে জানত সেই বিরক্তিকর দৃশ্য ও দৃশ্যের অন্তর্গত মানুষটা একসময় মনের মাঝে সন্তর্পণে জায়গা করে নেবে? অপুর চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসে। পাঁচ মিনিট বাদেই তন্ময় কল ব্যাক করল। অপু সেকেন্ড ব্যয় না করে রিসিভ করে। তন্ময় কিছুটা চিন্তিত গলায় বলল,
“ফুল, সুপ্ত তো বাড়িতে নেই। গতকাল ভোরে নাকি রাজশাহী চলে গেছে।”
“রাজশাহী! কিন্তু হঠাৎ কেন?”
“ওখানে নাকি চাকরি পেয়েছে। আঙ্কেল ওকে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু তোমাদের বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য নাকচ করে দেওয়ার পর ওকে আর কিছুতেই আটকানো গেল না। মামনি, আঙ্কেল সুপ্তের চিন্তায় খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।”
অপু ফোন কানে রেখেই হু হু করে কেঁদে উঠল। সে কী এবার সুপ্তকে চিরতরে হারিয়ে ফেলল? তন্ময় ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল,
“আহা! কেঁদো না। আমাকে বলো তোমাদের মাঝে সব ঠিক আছে?”
“ঠিকই তো ছিল। হুট করেই জানলাম উনারা প্রস্তাব পাঠিয়েছেন আর বাবাও নাকচ করে দিয়েছেন। আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। এরপর থেকে উনার সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না।”
“আচ্ছা, তুমি শান্ত হও। দেখছি এদিকটা।”

অপু ফোন রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কাজু দরজার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সে দৃশ্য দেখে ছুটে এলো। অপুকে টেনে তুলে জানতে চাইল,
“এই অপু? কী হয়েছে? ম’রা কান্না জুড়েছিস কেন?”
অপু মামার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ও মামা, বাবাকে মানাও না প্লিজ! আমি সুপ্তকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না।”
কাজুর কপালে ভাজ পড়ে। চিন্তিত গলায় বলে,
“ব্যাপারটা কী? খুলে বল তো।”
_______________

জন্মদিনের আমেজে ভাটা পড়েছে। বাড়ির অবস্থা থমথমে। একমাত্র শিমুল ছাড়া বাকি সকলের চোখে-মুখে চিন্তা, হতাশা, উদ্বেগ। শিমুল ও তার সমবয়সী বন্ধুবান্ধব হৈ হৈ করে জন্মদিন উদযাপন করেছে। অপু শুধু কেক কাটার সময় নামমাত্র উপস্থিত ছিল। অতিথিরা চলে যাওয়ার পর সবকিছু গুছিয়ে উঠতে রাত গড়াল অনেকটা। বাড়ির সকলেই ক্লান্ত। আনিসুল সাহেব ঘর থেকে ডাকলেন,
“জাহেদা, এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও।”

পানি নিয়ে ঢুকল বেলী। তার পাঁচমাস চলছে। পেট খানিকটা স্ফিত হয়েছে। বেলীর ঠোঁটে এই মুহূর্তে জিতে যাওয়ার দাম্ভিক হাসি। অপুর প্রেম প্রকাশে তাকে কত কিছুই না করতে হয়েছে। এমনকি বাবার সঙ্গে ঝামেলা পর্যন্ত হয়ে গেছে। শেষমেষ তো সত্যিটা সামনে এলোই। বেলী সত্যি প্রমাণিত হলো। সে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এবার আমাকে বিশ্বাস হলো তো? বুঝলে তো তোমার আদরের অপুও ধোয়া তুলসীপাতা নয়। অথচ দোষ শুধু আমাকেই দাও।”

আনিসুল সাহেবের মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিল। অপুর প্রতি উনার বিশ্বাস ধাক্কা খেয়েছে। সন্তানদের অধঃপতনে মনঃকষ্টে ভুগছিলেন। এরই মাঝে বেলীর কথায় তিনি মেজাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারালেন। পানির গ্লাস ধাক্কা দিয়ে ফেলে হুংকার দিয়ে বললেন,
“অন্যের দোষ মেলে ধরে নিজের দোষ লুকানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। আসলে ব্যর্থতা আমারই, কোনো মেয়েকেই সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি। একজন তো বিগড়ে গিয়েছিলই এবার পরেরটাও অর্ধেক বিগড়ে গেছে। দূর হ চোখের সামনে থেকে। তোদের কাউকে দেখতে চাই না আমি।”

আনিসুল সাহেবের চিৎকারে জাহেদা বেগম ছুটে এলেন। বেলী অপমানে থমথমে মুখ নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় ফ্লোরে পড়ে থাকা কাচ ভাঙা পানিতে পা পিছলে উপুর হয়ে পড়ে গেল। গলা ছিটকে বেরুলো আর্তনাদ। কাচের টুকরো চামড়া ভেদ করতে সক্ষম হলো মুহূর্তেই। গলগল করে র’ক্তের স্রোত বয়ে গেল ফ্লোরে। জাহেদা বেগম গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলেন। ছুটে এলো কাজু, আজিজ, অপু ও শিমুল। বেলীর অবস্থা দেখে সকলের মাথা ঘুরে ওঠার জোগাড়। কান্নার শব্দ ছড়িয়ে গেল ঘরময়। আজিজ ও কাজু ধরাধরি করে বেলীকে তুলে নিল ফ্লোর থেকে। অ্যাম্বুলেন্স আসতে সময় বয়ে যাবে বলে নিজেরাই ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। আনিসুল সাহেব পুরোটা সময় জড়মানব হয়ে ছিলেন। ফ্লোরে বেলীর গায়ের র’ক্ত পড়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে আনিসুল সাহেবের দেহ কাঁপে। জাহেদা বেগম রাগে, ঘৃণায় চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
“খুশি হয়েছো? হয়েছো না খুশি? মেয়েদের দেখতে চাইছিলে না। দেখো আল্লাহ সাথে সাথে তোমার মনোবাঞ্ছা পূরণ করে দিলো। আমার অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটাকে মে’রে ফেলতে চাইলে? খু’নি, খু’নি তুমি!”

জাহেদা বেগম গলা ছেড়ে কাঁদেন। আনিসুল সাহেব মূর্তির ন্যায় নিঃসাড় হয়ে পড়ে রইলেন। কাজু এলো খানিক বাদে। বেলীকে এডমিট করা হয়েছে। ডাক্তার প্রাথমিকভাবে মিসক্যারেজ হয়ে যাওয়ার ভয় করছেন। আজিজ ও অপুকে রেখে টাকার ব্যবস্থা করতে কাজুকে বাড়ি আসতে হলো। আনিসুল সাহেব তাকে দেখে প্রথম কথা বললেন। জানতে চাইলেন,
“বেলী কেমন আছে?”

কাজু সে প্রশ্ন শুনেই ক্ষে’পে গেল। তাচ্ছিল্য করে বলল,
“আপনার কী তা জানার আদৌ দরকার আছে, দুলাভাই? মেয়েটাকে তো মা’রতেই চাইছিলেন।”
“আমি মা’রতে চাইনি।”
“দুই বছর আগে করা এক ভুলের জন্য মেয়েটাকে আপনি সব সময় দূরছাই করে গেছেন। সন্তানের সঙ্গে ইগো দেখিয়েছেন। আরেহ সন্তানরা কী পেট থেকে ভালোমন্দের শিক্ষা নিয়ে বেরোবে? নাকি বড়োদের মতো অভিজ্ঞতা তাদের মাঝে আগেই ইনস্টল হয়ে থাকবে? মেয়েরা ভুল করে ফেলেছে বলে আপনিও ভুল করবেন? আসলে আপনি র’ক্ত’মাং’সের সন্তান জন্ম দিলেও তাদের চালাতে চেয়েছেন পুতুলের মতো। তাদের জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছেন। তাদের ইচ্ছেটা পর্যন্ত জানতে চাননি। যেই না একজন আপনার নিয়মের বাইরে গেল অমনিই আঁতে ঘা লাগল। মেয়ে হয়ে গেল শত্রু। আপনার শত্রু নিধন হচ্ছে, খুশি হোন।”

আনিসুল সাহেব ফ্যাকাসে মুখে কাজুর দিকে তাকিয়ে আছেন। ভঙ্গুর গলায় বললেন,
“মুখ সামলে কথা বল, কাজু। বেলী আমার মেয়ে। তার নিধন আমি চাইনি।”
কাজু দমে গেল না। চ্যাচিয়ে উঠে বলল,
“দিনের পর দিন মেয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার সময় মনে ছিল না বেলী আপনার মেয়ে? এবার নিশ্চয়ই আপনার শত্রুর তালিকায় অপুর নামটাও উঠে গেল। মেয়েটা একজনকে পছন্দ করেছে। পালিয়ে যায়নি, মুখে চুনকালিও দেয়নি। বরং পরিবারের ওপর ভরসা করেছে। সেই পছন্দের মানুষ যখন সম্বন্ধ পাঠাল সেটাও আপনার পছন্দ হলো না। মেয়ের কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে বাতিল করে দিলেন। অপু যদি ভুল মানুষকেই পছন্দ করত আপনি একবার তার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলে বোঝাতে পারতেন। কিন্তু আপনি সেসবের ধারেকাছেও যাননি। হুকুম জারি করেই শেষ। এমনকি পূর্বের বিয়েটাতেও অপুর মত আছে কিনা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও বোধ করেননি। অথচ আপনি এ যুগের শিক্ষিত বাবা। আরেহ যে সংসার করবে, সারাজীবন আরেকজন মানুষের সাথে কাটাবে তার সিদ্ধান্তের কোনো দাম নেই? মেয়ে কী চো’র-বা’ট’পার ধরে এনেছিল? আপনার বড়ো জামাই যখন চাকরির বাজারে লড়াই করে ভেঙে পড়ছিল আপনি সামান্য পরামর্শ দিয়েও তাকে সাহায্য করেননি। আর সুপ্ত অর্থাৎ যে ছেলের বাবা-মায়ের সম্পর্ক দিয়ে আপনি তাকে বিচার করেছেন, সেই ছেলে আপনার বড়ো জামাইয়ের যোগ্যতার ব্যবহার করে তাকে চাকরির সুযোগ দিয়েছে। ভাগ্যিস সবাই আপনার মতো বাবা-মায়ের সম্পর্ক দিয়ে সন্তানকে বিচার করে না। অবশ্য যদি বলেন মেয়ের সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো তার হয়ে সংসার আপনি করে দেবেন তাহলে নিজের পছন্দে বিয়ে দিতেই পারেন।”

আনিসুল সাহেব স্তব্ধ মুখে বসে আছেন। কাজু তাচ্ছিল্য করে বলল,
“দুলাভাই, আপনি কী কখনো খেয়াল করেছেন আপনার সন্তানেরা আপনার সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারে না। মনের কথা নিঃসংকোচে বলতে পারে না। আপনার উপস্থিতিতে তারা গুটিয়ে থাকে। তারা আপনার সঙ্গে হাসতেও পারে না, আপনার কোলে মাথা রেখে কাঁদতেও পারে না। আপনি তাদের কাছে সুপ্রিম কোর্টের মতো। যার আদেশ চুড়ান্ত ও শির ধার্য। এমনকি আমার বুবু বিয়ের এত বছর পরও আপনার ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। প্রেশারের ঔষধ খায় দুইবেলা। আপনি সংসারকে আদর্শময় বানাতে গিয়ে আসলে এক ত্রা’সের রাজত্ব সৃষ্টি করে রেখেছেন।”

আনিসুল সাহেব ছেলের দিকে তাকালেন। শিমুলের মুখ ভয়ে সাদা কাগজের মতো হয়ে আছে। সিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মায়ের পেছনে। ভয়ে কাঁপছে ছেলেটা। তাকালেন জাহেদা বেগমের দিকে। বিয়ের আঠাশ বছরে এই প্রথম স্ত্রীর চোখে ঘৃণা দেখতে পেলেন তিনি। আনিসুল সাহেব দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন র’ক্তা’ক্ত মেঝেতে। আস্তে আস্তে দুচোখে আঁধার নেমে এলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here