#সুপ্ত_অনুরাগে-১৬,১৭
#প্রভা_আফরিন
[১৬]
বেলী অপুর কীর্তিকলাপ ফাঁস করতে চাইল তন্ময়রা আসার পরদিন। মায়ের কাছে তন্ময়ের কন্টাক্ট নম্বর পেয়েই বেলীর মাথায় ভিন্ন চিন্তা খেলে গেল। একে তো তারা বাবার বন্ধুর পরিবার। কিছুটা সম্মান ও হৃদ্যতার স্থান দুই পরিবারের মাঝেই আছে। তারওপর দুই পরিবারের আচরণ দেখে মনে হলো বিয়েটা নির্দ্বিধায় ফাইনাল হবে। এমন মোক্ষম সময়ে অপুর প্রণয়লীলা ফাঁ’স হলে ব্যাপারটা কতটা ইফেক্ট ফেলবে তা আর বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে না। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে বেলী তন্ময়ের ওয়াটসঅ্যাপ নম্বরে একটি ফাইল সেন্ড করে ঘুমিয়ে গেল। কাজ অর্ধেকটা এটাতেই হওয়ার কথা। বাকিটা বাবার সাথে বুঝবে।
সকালে আনিসুল সাহেব অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। বেলীকে রুমে দেখেই গম্ভীর হয়ে গেলেন। বেলী নিচু গলায় বলল,
“তোমার সাথে অপুর ব্যাপারে কথা ছিল বাবা।”
আনিসুল সাহেব কোনো উত্তর দিলেন না। বেলীর দিকে তাকালেনও না। ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফাইলপত্র গুছাতে লাগলেন। বেলীর রাগ হলো। একটু পর এই অহংকারী মুখটার কী পরিণতি হবে ভাবতেই নিজেকে সংবরণ করে নিল। পুনরায় বলল,
“আমি জানি তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছুক নও। কিন্তু কথাটা দরকারী। অপুর বিয়ে ফাইনাল হওয়ার আগেই তোমাদের কিছু জানতে হবে।”
আনিসুল সাহেব এবার দৃষ্টি দিলেন বড়ো কন্যার প্রতি। কিন্তু মুখে কোনো শব্দ উচ্চারণ করলেন না। বেলী বলল,
“অপুকে তোমরা খুবই সরল মনে করো তাইনা? কিন্তু ও তোমাদের থেকে অনেক কিছু লুকিয়েছে।”
বেলী ফোন বাড়িয়ে দিলো। আনিসুল সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,
“ফোনে কী? ভণিতা না করে সরাসরি বল।”
“অপু তোমাদের চোখের সামনে থেকেই দিনরাত প্রেম করে বেড়াচ্ছে। রাত-বিরেতে সবার ঘুমের সুযোগে বাইরে দেখা করতে যায়। ফোনে সারাক্ষণ লেগেই থাকে। অথচ আমি বিয়ে করায় তোমাদের মান চলে গেছে। অপু যে বাড়িতে বসেই অ’শ্লী’লতা ছড়াচ্ছে তাতে কী মান বাড়ছে?”
আনিসুল সাহেব গর্জে উঠলেন,
“কী বলছিস তোর মাথা ঠিক আছে?”
“মুখের কথা তো বিশ্বাস করবে না। আমি তোমার চির অবিশ্বাসের পাত্রী কিনা! বিশ্বস্ত মেয়ে আড়ালে কী করেছে নিজের চোখেই দেখো।”
আনিসুল সাহেব রাগত ভঙ্গিতে ফোন হাতে নিয়ে মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন। পরক্ষণেই আবারো চ্যাচিয়ে উঠলেন,
“ফাজলামো করার জায়গা পাস না?”
“এতসবের পরও তোমার ফাজলামি মনে হচ্ছে বাবা? অপুর কীর্তিকলাপ দেখেও?”
আনিসুল সাহেব ফোনের স্ক্রিন বেলীর দিকে ঘোরালেন। তাতে বাচ্চাদের ছবি ভেসে উঠেছে। বেলী যারপরনাই চমকে উঠল। ফোন কেড়ে নিয়ে ভালোমতো স্ক্রল করে দেখল তার ও আজিজের কিছু চ্যাটিং এর স্ক্রিনশট ও বাচ্চাদের ছবি দিয়ে ফোল্ডারটা সাজানো। অথচ সে নিজের হাতে অপুর ফোন থেকে সব কনভারসেশন, ফোনকলের প্রমান, স্ক্রিনরেকর্ড সহ নিয়ে ফোল্ডারটা ক্রিয়েট করেছিল। বাবার রোষাগ্নি দৃষ্টি ও এতবড়ো প্রমাণ লোপাট হওয়ায় ভড়কে গিয়ে বেলীর হাত কেঁপে উঠছে। সে বারবার চেক করে দেখছে ফোল্ডারটা অন্য কোথাও আছে কিনা। কিন্তু কোথাও নেই।
আনিসুল সাহেব পুনরায় চ্যাচিয়ে উঠলেন,
“জাহেদা? তোমার হিং’সায় অন্ধ হওয়া মেয়েকে আমার সামনে থেকে সরে যেতে বলো। নিজে যে পথে হেঁটেছে বাকিদেরও সেই পর্যায়ে নামাতে উঠেপড়ে লেগেছে।”
বেলী আকুতি করে বলল,
“বিশ্বাস করো বাবা, আমি নিজের চোখে অপুকে মাঝরাতে বাইরে থেকে ফিরতে দেখেছি। আর ম্যাসেজ…”
“একদম চুপ!”
স্বামীর চিৎকারে জাহেদা বেগম ছুটে এলেন রুমে। ছুটে এলো অপু ও আজিজ। তারা কেউই কিছু বুঝতে পারল না। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝতে পেরে বেলী তৎক্ষনাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে হুলুস্থুল লেগে গেল। আজিজ বেলীকে কোলে তুলে রুমে ছেড়ে বেরিয়ে যায়। অপু ডাক্তারকে ফোন করে। জাহেদা বেগম কিছু বুঝতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়েন,
“তোমার এত রাগ মেয়েটার প্রতি? চ্যাচামেচি করে ওকে অসুস্থ করে দিলে? মেয়েটা তো শুধু তোমার ভালোবাসা চাইতেই ছুটে আসে।”
আনিসুল সাহেব বেলীর অসুস্থতায় সামান্যতম বিচলিত হলেন কিনা বোঝা গেল না। তিনি দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,
“ওই মেয়ের হয়ে আর একটা কথা বললে জিভ টেনে ছিড়ে নেব। বের হও রুম থেকে।”
জাহেদা বেগম ঘৃণ্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছুটে গেলেন বেলীর রুমে। অপু শুধু দাঁড়িয়ে রইল দরজার সামনে। আনিসুল সাহেব খাটে বসলেন। কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। তা দেখে অপু এসি অন করে পানি এগিয়ে দিলো বাবার দিকে। আনিসুল সাহেব পানি পান করে দরাজ স্বরে ডাকলেন,
“অপু?”
“জি বাবা।”
“আমার ঠিক করা পাত্রের সঙ্গে বিয়ে করতে তোর কোনো আপত্তি আছে?”
অপু মাথা নুইয়ে রইল। উত্তর খুঁজল মনের কাছে। আছে কী? কয়েক মুহূর্ত থমকে থেকে উত্তর দিলো,
“তোমার সিদ্ধান্তে আমার কোনো আপত্তি নেই বাবা।”
আনিসুল সাহেব প্রসন্ন হলেন। অপুর কোমল মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে রাগ, উত্তেজনা ধীরে ধীরে কমে গেল। অপু ছুটে নিজের ঘরে চলে গেল। বুকের ভেতরটা এত জ্ব’লছে কেন তার? ঢক ঢক করে পানি খেয়েও সে জ্ব’লুনি কমানো গেল না। বরং সময়ের সাথে চোখদুটিও জ্ব’লতে শুরু করল। অপু সব দিক থেকে সুপ্তের ফোন নম্বরটা ব্লক করে দিলো।
ডাক্তার বেলীকে চেকাপ করে সাধারণ দুর্বলতা ভেবে কিছু সাপ্লিমেন্ট প্রেসক্রাইব করে গেলেন। আজিজ মাথার পাশে বসে আছে। জাহেদা রান্নাঘরে ছুটেছে মেয়ের জন্য ফল কেটে আনতে। বেলীর মাথায় তখন পাহাড়সম ভাবনা। নিজের এতদিনের পরিকল্পনা এভাবে মাঠে মা’রা যাবে সে কস্মিনকালেও ভাবেনি। আজিজকে বলল,
“আমাকে একটু একা থাকতে দেবে, প্লিজ?”
আজিজ দ্বিরুক্তি করল না। প্রেসক্রিপশন নিয়ে নিঃশব্দে রুম থেকে বিদায় নিতেই বেলী তড়িঘড়ি করে ওয়াটসঅ্যাপ-এ ঢুকল। ফোন থেকে ডিলিট হলেও ফাইলটা সেখানে নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু না। তন্ময়ের আইডিটাই লিস্ট থেকে গায়েব। বেলী বিমূঢ় হয়ে রইল। এক রাতের ব্যবধানে ডিলিট কী করে হলো? কে করল? তন্ময় কী ফাইলটা সিন করেছিল? বেলী দুহাতে মাথা চেপে ধরে। উত্তেজনায় ভুল হয়ে গেছে। বাবাকে দেখানোর আগে নিজে আরেকবার চেক করে নেওয়া উচিৎ ছিল। বাবার সঙ্গে দূরত্বটা আরেকদফা বেড়ে গেল।
______________
সকাল থেকে দিনটা মেঘলা। পরিবেশ গুমোট, আকাশে পুঞ্জিভূত মেঘের পসরা। বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা প্রবল। ঝরের আগে যেমন প্রকৃতি থমথমে থাকে ঠিক তেমনটাই হয়ে আছে। সুপ্তের মেজাজ আজ আকাশের মতোই থমথমে। ক্ষণে ক্ষণে ভারী শ্বাস নির্গত হচ্ছে বুকের পাজর বেয়ে। নিশ্বাসে ভাদ্র মাসের রুক্ষ বনের দাবানলের ছোঁয়া। অপরাজিতা তাকে আবারো ব্লক করেছে। একেতো দুটো দিন ধরে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করছে, তারওপর আজ সকালে দেখল ব্লক। মেয়েটা পেয়েছেটা কী তাকে? আশকারা দিচ্ছে বলে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে?
ধপ করে পাশে কেউ বসতেই সোফাটা আন্দোলিত হলো। সুপ্তের তিক্ততা আরেকটু বাড়িয়ে তন্ময় দাঁত কেলিয়ে হাসল।
“বাংলাদেশী মেয়েরা এখন আর আগের মতো লাজুক নেই বুঝলি ভাই। ভাবলাম পাত্রী আমার দিকে চোখ তুলেই তাকাতে পারবে না। দুই গাল, কান লাল হয়ে থাকবে। গলা কাঁপবে। হাতটা যখন ধরতে চাইব নার্ভাসনেসে বুদ হয়ে থাকবে। কিন্তু না, মেয়েতো আমাকে পাত্তাই দিলো না। কোথায় বিদেশী জামাই হয়ে ভাব দেখাব ভেবে গর্বে বুক ফুলিয়ে হাঁটছিলাম, একেবারে ছাতি ফুটো করে দিলো!”
সুপ্ত ভ্রু কুচকাল। ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,
“বাহ! মেয়েটাতো ইন্টারেস্টিং!”
“নট মেয়ে। কল হার ভাবী।”
“ফাইনাল হয়ে গেছে?”
“উহু, তবে হলো বলে। ওকে একটা নিকনেম দিয়েছি শুনবি?”
সুপ্ত বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুই কী জানিস তুই একটা বাঁচাল?”
“নাহ, তোর কানের ছিদ্র ছোটো।”
“ইডিয়েট!”
সুপ্ত বাইকের চাবিটা পকেটে গুজে বেরিয়ে যেতে নিলে তন্ময় চ্যাচিয়ে উঠল,
“আরে কই যাস?”
“জাহান্নামে, যাবি?”
“নাহ বাবা। বউ বাচ্চা না বানিয়ে ওই পথে যাচ্ছি না।”
তন্ময় সুপ্তের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল। বৈশাখী এসে তন্ময়ের মাথায় চাপড় দিলেন,
“কেন রাগাস আমার ছেলেটাকে?”
তন্ময় বৈশাখীকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী সুরে বলে,
“তোমার ছেলে বোকা, তাই ভালো লাগে।”
খানিক্ষণ বাদে তন্ময় অপুকে ম্যাসেজ করল,
“ফুল, তোমাদের এলাকায় ভালো কফিশপ কোথায় আছে?”
অপু ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল। রিক্সায় বসে ম্যাসেজটা দেখে ভ্রু কুচকালো। রিপ্লাই দিলো,
“অবশ্যই।”
“আমাকে একটু চিনিয়ে দেবে?”
অপুর মুখাবয়ব গম্ভীর হলো। হতাশ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো অজান্তেই। লোকটা ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। সে সরাসরি বলল,
“কবে দেখা করতে চান?”
“হা হা! তুমি চাইলে আজই।”
“উহুম, কাল।”
“আমি অপেক্ষায় থাকব, ফুল।”
“আর আপনি কা’টা।” ম্যাসেজটা করতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করল অপু। কী হচ্ছে তার সাথে। জীবনটা এত জটিল হলো কেন? রিক্সা থেকে নামতেই অবশ্য অপুর ভাবনা বদলে গেল। আসল কাটা তার ভাটার মতো চোখ নিয়ে অপুকেই দেখছে।
চলবে…
#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[১৭]
সুপ্ত আঙুলের ডগায় বাইকের চাবি ঘোরাচ্ছে। জ্বলজ্বলে দৃষ্টি সম্মুখের ল্যাভেন্ডার কালার হাটু ছুঁই ছুঁই টপ পরা দীঘল দেহের মেয়েটির দিকে। অপু সুপ্তকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে চাইলে সুপ্ত সরাসরি তার চলার গতি রোধ করে দাঁড়াল। নিগূঢ় চাহনিতে পরখ করে নিল অপুর ঘাবড়ানো মুখশ্রীর ছোটো ছোটো ঘামের বিন্দুটুকুও। অপু মুখ তুলে চাইল। দৃষ্টি এক সুতোয় মিলিত হলো ক্ষণিকের জন্য। অপু সে তীব্র চাহনির সামনে টিকতে না পেরে নজর ঝোকায়। স্তিমিত সুরে বলে,
“পথ ছাড়ুন।”
“বাইকে ওঠো।”
“মানে?”
“আমি সরাসরি কথা বলতে চাইছি। আশাকরি সেই সুযোগটা তুমি আমায় দেবে।”
“সুযোগ আশা করলেই আমি দিয়ে দেব? একটু বেশিই চিপ ভেবে ফেলছেন না আমাকে?”
“তুমি একটু বেশিই হার্ট করছো না আমাকে?”
“তার জন্য আপনিই দায়ী।”
“কে দায়ী সেটাই তো বুঝতে চাইছিরে মেয়ে। বাইকে ওঠো।”
“না।” অপু দৃঢ় গলায় বলল।
“মেয়েরা যতই নরম স্বভাবের হোক না কেন, জন্মগতভাবে ঘাড়ের রগ একটা বাঁকা হবেই, তাইনা? জীবনেও কোনোকিছু সোজাভাবে মানতে চাইবে না।”
অপু সে কথার উত্তর না দিয়ে আশেপাশে তাকাল। সুপ্ত তেরছা হেসে ঝুকে এলো তার মুখের ওপর। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
“হাত ধরে টেনে ওঠাব? কোলে তুলে? ইউ নো, আমার মধ্যে সেটুকু এবিলিটি ঠেসে ঠেসে আছে।”
মেঘাচ্ছন্ন আকাশে গুরুম গুরুম ঘনঘটা। বাতাস বইতে শুরু করেছে। অনেকদিন অনাবৃষ্টির ফলে বাতাসে স্নিগ্ধতার চেয়ে ধুলোর পরিমানই বেশি। তাতে মিশে আছে আগাম বৃষ্টি বৃষ্টি গন্ধ। সুপ্ত অপেক্ষা না করে শক্ত করে অপুর হাতটা ধরে হেঁটে গেল বাইকের কাছে। মেঘলা আকাশের ছায়ার নিচে অপু সহসাই কোনো বিরোধ করতে পারল না। বরং বিরোধ করল নিজের সংকল্পের বিরুদ্ধে। সুপ্ত যখন বাইক স্টার্ট দিলো, অজান্তেই ভরসার হাত ছুঁয়ে দিলো তার কাঁধ। সুপ্তের মনে হলো কাঁধে এক পশলা শিশির এসে ছুঁয়ে গেল। বাতাসের দাপটে খেলে গেল শিহরণ। এমন মসৃণ ও সাবধানতা অবলম্বন করে বোধহয় সে কখনোই বাইক চালায়নি। বাইক শহর ছেড়ে বেরোতেই বৃষ্টি নামল ঝমঝমিয়ে। সুপ্ত পথের ধারে বাইক থামিয়ে অপুর হাত ধরে ছুটে গেল টিনের ছাউনিঘেরা টঙের দোকানে। বৃষ্টি বিধায় দোকানে কাস্টমার নেই। বৃষ্টিভেজা দুটি কাস্টমার পেয়ে দোকানির হাসি কান ছুঁয়ে গেল। সুপ্ত বলল,
“মামা, গরম গরম চা দাও দুইকাপ। চিনি দিয়ো বেশি করে। ম্যাডামের মুখে মিষ্টত্বের বড়োই অভাব।”
অপু কটমট করে তাকাল। সেই চাহনির বিপরীতে মিষ্টি হাসল সুপ্ত। অপু এই প্রথম কাছ থেকে মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করল, লোকটার হাসিতে একটা অমায়িক সৌন্দর্য আছে। খোচা খোচা দাড়িতে বৃষ্টির জলবিন্ধ পুঞ্জিভূত হয়ে আছে। শ্বেতকায় মুখটা তাতে আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সুপ্ত ভ্রু নাচাতেই অপু অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামাল।
টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টি। হাতে চায়ের কাপ। সম্মুখে বৃষ্টিস্নাত পিচঢালা পথ। অপুর খুব ভিজতে ইচ্ছে হয়। পিচঢালা রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটতে ইচ্ছে হয়। মনের জমানো সকল ক্লেদ, বিষাদ ধুয়ে দিতে সাধ হয়। তার মনে কেন এমন অবারিত বৃষ্টি নামে না? ভাবনায় বুদ হয়ে চায়ে চুমুক বসাল অপু। সঙ্গে সঙ্গে জিভ পুড়ে গেল। সুপ্ত নিজের চায়ের কাপ বেঞ্চিতে নামিয়ে অপুর কাপটা কেড়ে নিল। মাথা ঝাকিয়ে বলল,
“বৃষ্টি দেখলে দার্শনিক হয়ে যাওয়া মেয়েদের জন্মগত স্বভাব।”
অপু শান্ত দৃষ্টিতে দেখল সুপ্ত তার চায়ে ফু দিয়ে উষ্ণতা কমানোর চেষ্টা করছে। অপু বাধা দিলো না। বরং সময়টা সে বিবেকের অলক্ষ্যে ছেড়ে দিলো। সুপ্তের ঠান্ডা করে দেওয়া চায়ে নির্দ্বিধায় চুমুক দিয়ে সে আবারো বৃষ্টি দেখতে লাগল। সুপ্ত বলল,
“দোকানিটা ফরিদ মিয়া হলে আজ কী যে খুশি হতো! বিয়ের পর কিন্তু ওর দোকানের চা খেতে হুটহাট বেরিয়ে পড়ব আমরা।”
অপুর স্বভাবের স্নিগ্ধতায় ভাটা পড়ল তখনই। আবারো বিয়ে শব্দটা মাথায় কিলবিল করে উঠল। দৃষ্টিতে ভর করা অপার মুগ্ধতায় বিষন্নতা ছেয়ে গেল মুহূর্তেই। চায়ে পুনর্বার চুমুক দেওয়ার সাধ জাগল না। এক ঝাক বৃষ্টি ঝরিয়ে আকাশ এখন কিছুটা ক্লান্ত, বিশ্রামে মগ্ন। সেই বিশ্রামের সুযোগে সুপ্ত অপুকে নিয়ে ছুটল হাইওয়ে ধরে। গন্তব্য শেষ হলো নির্জন ব্রিজে। দুপাশে বিস্তীর্ণ জলরাশি, ঢেউয়ের তালে দুলছে রুপালি জলধারা। উড়ে আসছে বেসামাল হাওয়া। সুপ্ত প্রাণভরে বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধ টেনে নেয়। উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে,
“তোমার বৃষ্টি পছন্দ নাকি রোদ্দুর?”
“কুয়াশামাখা ভোরের সকাল।”
“শিউলি ফুল?”
“পছন্দ।”
“শিশির?”
“খুব।”
“আমি?”
“অসহ্য!”
উত্তরে সুপ্ত হেসে ফেলল। মলিন স্বরে বলল,
“এড়াচ্ছো কেন? আমি কী তোমার উপেক্ষা আদৌ ডিজার্ভ করি অপরাজিতা?”
অপু ঢোক গিলে কণ্ঠের কোমলতা শুষে নিল।
“পাত্তা পাওয়ার আকাঙ্খাই বা কেন করছেন? একদিন ফোন ধরেছি কী ধরিনি, ছাদে উঠেছি কী উঠিনি তাতেই পেয়ে বসতে চাইছেন?”
“পেয়ে বসলে এখনো এই ফর্মালিটিটুকু করতাম না। কারণ আমি চোখের ভাষা পড়তে জানি।”
“তাহলে চোখের ভাষা শিক্ষার স্কুল খুলে বসুন গিয়ে। আমাকে কেন জ্বা’লাচ্ছেন?”
“ঘরে মূর্খ রেখে জাতিকে শিক্ষিত করতে ছুটলে তো হবে না। আগে ঘরের মানুষকে চোখের ভাষা বুঝতে শেখাতে হবে।”
সুপ্তের পালটা উত্তরে অপুর মুখে কাঠিন্যের ছায়া গাঢ় হয়। কিছুটা সময় দম আটকে রেখে বলে ওঠে,
“আমার আশা ছেড়ে দিন। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।”
“কিন্তু আমি তো প্রস্তাব পাঠাইনি।”
সুপ্তের হেয়ালিতে অপুর রাগ বাড়ে। কিছুটা কর্কশ সুরে বলে,
“কেন? আপনি ছাড়া কী বঙ্গদেশে আমার জন্য পাত্র জুটবে না?”
“পাত্র জুটতেই পারে। কিন্তু স্বামী তো একজনই, আর সেটা আমি।”
“সেটা আপনার অলীক কল্পনা। অলরেডি পাত্র ফাইনাল হয়ে গেছে।”
সুপ্ত অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ধীরে ধীরে তার শ্বেতকায় মুখটা র’ক্তা’ভ হয়ে উঠছে। দৃষ্টি হলো তী’রের চেয়েও তী’ক্ষ্ণ। ছোটো করে জানতে চাইল,
“তোমার মত আছে?”
“বাবার মতই আমার মত।”
ঝটকায় অপুর দুই বাহু সুপ্তের হস্তগত হলো। অপু ভড়কে গিয়ে দুহাত ঠেকাল সুপ্তের বুকে। হৃৎপিণ্ডে ছড়াল অস্থিরতা। হিসহিসিয়ে উঠল সুপ্তের গম্ভীর কন্ঠস্বর,
“কেন? তোমার লাইফটা কি তোমার বাপ লিড করে? তোমার স্বাচ্ছন্দ্য, মানসিকতা, অনুভূতি কি তিনি ফিল করে? নাকি সংসারটা উনি করবে যে উনার কথায় বিয়ে হবে?”
“বাবাকে অসম্মান করে কোনো কথা বলবেন না। উনার মূল্য আমার নিজের জীবনেও চেয়েও বেশি।”
“আর আমি? এতসবের মাঝে আমার কোনো স্থান নেই? এই যে অসহ্য লোকটার সঙ্গে দূরে চলে এসেছো, তার হাতের মাঝে রয়েছো তা কোন ভরসায়? নিজেকে প্রশ্ন করেছো?”
অপু সংকুচিত হয়ে রইল। কণ্ঠ রোধ হয়েছে অস্বস্তিতে। সুপ্তের নিঃশ্বাসের তীব্রতা যেন জ্বা’লিয়ে দিতে চাইছে মুখখানি। সুপ্ত অপুকে পরখ করে ছেড়ে দিলো। অনেকটা সময় কেউ কোনো কথা বলল না। মেঘ কেটে কমলাটে সূর্যরশ্মি ছড়াচ্ছে জলের বুকে। ঝিলমিল করছে নদী। সুপ্ত বলল,
“বাবার মত-ই তোমার মত তাইতো? আমি যাব প্রস্তাব নিয়ে।”
“কোন যোগ্যতায় যাবেন? আপনার মনে হয় বাবা আমাকে বেকার, বোহেমিয়ান ছেলের হাতে তুলে দেবে? নাকি নিজের বাবার টাকার জোর দেখাবেন? আমার বাবার কাছে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ নয় বরং অর্জিত যোগ্যতার মূল্য বেশি। এবং আপনার তা নেই।”
“অপরাজিতা, তুমি আমায় অপমান করছ!”
“শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি।”
“ফাইন।”
দুজনের মাঝে আর একটা শব্দও উচ্চারিত হলো না। সুপ্ত বাইকে বসে চাবি ঘোরাল। অপু তখনো সিমেন্টের থাম ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। সুপ্ত চোয়াল শক্ত করে দুবার হর্ন দিতেই অপু গুটিগুটি পায়ে বাইকে গিয়ে উঠল। এবার আর কাঁধে হাত রাখল না। পিছনে শক্ত করে ধরে রইল। সুপ্তও এবার মসৃণ ড্রাইভ করল না। সে ঝড়ের বেগে বাইক টেনে অপুকে ক্যাম্পাসের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। অপু স্থানুবৎ হয়ে রইল অনেকটা সময়। তার তো খুশি হওয়ার কথা। অথচ হতে পারছে না।
________________
অপু বাড়ি ফিরে দেখল ড্রইংরুমে মিষ্টিমুখর। আজিজ চাকরি পেয়েছে। আগেরটার তুলনায় বেশ ভালো, স্যালারিও বেশি। সেই সুবাদে ক্ষীরমোহন ও রসকদম এনেছে সে। অপুকে দেখেই আজিজ পেয়ালা হাতে এগিয়ে গিয়ে জোর করে এক টুকরো রসকদম খাইয়ে দিলো। বলল,
“আমার লাকি চার্ম শালিকা। এই মিষ্টি সবার আগে তোমার প্রাপ্য।”
অপু বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঞ্চিত করে। আজিজ শব্দহীনভাবে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
“সুপ্ত হেল্প করেছে। ইউ আর লাকি টু হ্যাভ দ্যাট কাইন্ড হার্টেড ম্যান। প্লিজ! ওকে ছেড়ো না।”
মিষ্টিটা অপুর গলায় আটকে গেল। একটু আগেই সে লোকটাকে বেকারত্বের খোটা দিয়ে এসেছে। পাল্টা উত্তরটা এভাবে অপেক্ষা করছে কে জানত? মানুষটা তাকে জয় করতে এসে তার আশেপাশের মানুষগুলোকেও আপন করে নিচ্ছে।
আজিজ অপুর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে। ভাগ্যিস সে অবগত। নয়তো বেলী যা করতে যাচ্ছিল তাতে এক বিরাট বিশৃঙ্খলা বেধে যেত। মাঝখান দিয়ে অপু ফেঁ’সে যেত। আজিজ ভাবল বেলীকে এ বাড়ি থেকে নিয়ে চলে যাবে। শ্বাশুড়িকে বলল,
“এবার বেলীকে নিয়ে যেতে চাই, আম্মা। অনেকগুলো দিন কষ্ট দিলাম আপনাদের।”
আজিজের কণ্ঠে আজ আর সেই মিনমিনে ভাবটা নেই। বেকারত্বে মুখ গুজে, চোখ নামিয়ে চলা মানুষটা যেন আবারো হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে শুরু করেছে। বেলীর ঠোঁটের হাসিও সরছে না। অন্তত বাপের বাড়িতে তাকে আর মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে চলতে হবে না। জাহেদা বেগম জামাইয়ের প্রস্তাবে খুশি হলেন না। বললেন,
“বাড়িতে ফেরত যাবে?”
“নাহ, অফিসের কাছে একটা বাসা ভাড়া করব ভাবছি।”
“তোমার মনে হয় এই অবস্থায় একা একটা ভাড়া বাসায় মেয়েকে পাঠাব আমি? বাচ্চা হওয়া অবধি বেলী আমার কাছেই থাকবে। তুমি একটু এডজাস্ট করে চলো।”
বেলীকে সকালের ঘটনাটি স্থির হতে দেয়নি এক মুহূর্তের জন্য। সে এখনো বুঝতে পারছে না ফোন থেকে ফোল্ডারটি ডিলিট কী করে হলো। সে তী’ক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অপুর দিকে তাকিয়ে আছে৷ অপু বেলীর দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে ছুটে নিজের রুমে চলে গেল।
চলবে..