সর্দি_কন্যা, পর্ব (৭)

#সর্দি_কন্যা, পর্ব (৭)
#রোকসানা_রাহমান

ছুটির দিন। সারা সকাল ঘুমে কাটিয়ে বিছানা ছেড়েছি। আড়মোরা ভেঙে ব্রাশ হাতে নিলাম। পেস্ট বের করব তখনই মা পেছনে এসে দাঁড়ালেন। আমি ব্রাশ পানিতে ভিজিয়ে বললাম,
” কিছু বলবে, আম্মু? ”

মা উত্তর দিলেন না। দূর থেকেই সরু চোখে চেয়ে রইলেন। আমি তখন দাঁত ঘষতে ব্যস্ত। উপরনিচ ঘষে ক্ষান্ত হলাম। মুখে পানি ভরে মায়ের দিকে তাকালাম। চোখের ইশারায় আগের প্রশ্নটাই করতে তিনি একটু এগিয়ে আসলেন। সরাসরি বললেন,
” উষ্মার তো পরীক্ষা শেষ। এবার বিয়ের তারিখ ঠিক করি? ”

আমি থতমত খেলাম। মুখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল আমার অনিচ্ছায়। মা আরেকটু এগিয়ে এসে বললেন,
” নাজুকে কল দিয়ে ডাকব নাকি আমরাই যাব? ”

আমি নিজেকে ধাতস্থ করলাম। পুনরায় মুখে পানি ভরার জন্য কলের নিচে হাত রাখলাম। বললাম,
” এত তাড়াহুড়ার কী আছে, আম্মু? আমরা এখনও নিজেদের ভালো করে জানতে পারিনি। আরেকটু সময় দেও। আমি নিজেই তোমাকে বিয়ের কথা জানাব। ”

আমার মায়ের মুখের রঙ বদলে গেল। দাঁড়ানোর ভঙ্গি বদলে গেল। কণ্ঠ থেকে ক্রোধ ঝরে পড়ল,
” আর কত জানবি? চার মাস ধরে তো এই এক কথায় বলে যাচ্ছিস! ”

আমি মুখ ধোয়া থামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, এর মধ্যে চার মাস চলে গেছে! সময় এত দ্রুত যাচ্ছে কবে থেকে?

মা এবার ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। আমার দিকে কড়া নজর দিয়ে বলল,
” চার মাসে কী কী জানলি, বল দেখি আমাকে। ”

আমি মায়ের দিকে চোরা চোখে তাকালাম। জবাবে কী বলব ভাবছি। কী কী জানা তো দূর সামান্য খোঁজখবরও নেওয়া হয়নি। শরিয়তপুর ছেড়ে আসার পর উষ্মা ভারি বিরক্ত হয়ে সেঁটে গিয়েছিল মস্তিষ্কে। চিন্তা-ভাবনা থেকে তাড়ানোর জন্য কত কিছুই না করলাম! এত সহজে ও দ্রুত ভুলে যাব বুঝতেই পারিনি। মা জিজ্ঞেস না করলে হয়তো কোনো দিন মনেও পড়ত না।

মা আমার নীরবতা সহ্য করতে পারলেন না। ভীষণ চটে গেলেন। ধমক দিয়ে বললেন,
” চুপ করে আছিস কেন? বল কী কী জানলি। ”

আমিও নীরবতা ভেঙে রয়ে-সয়ে বললাম,
” তেমন কিছু নয়, আম্মু। সেজন্যই তো বলছি আরও সময় দেও। ”

আমি হাতে তোয়ালে নিয়ে বিছানার উপর বসলাম। মাও আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার চোখের চাহনি আগের মতোই। বললেন,
” তোরা দেখা করছিস কোথায়? ”

আমি ভারি চিন্তায় পড়ে গেলাম। কোন জায়গার নাম বলব? মেয়েটা তো কাছেপিঠে কোথাও থাকে না যে চাইলেই একটা স্থানের নাম বলে দেব! মিথ্যা বলতে গিয়ে যদি ধরা পড়ি? তাই বললাম,
” আমরা দেখা করছি না। ”
” তাহলে জানাশোনা কিভাবে হচ্ছে? ”

আমি সাথে সাথে জানালাম,
” ফোনে। ”

মা শান্ত হওয়ার বদলে আরও বেশি অশান্ত হয়ে পড়লেন। ক্রোধে ফেটে পড়ে বললেন,
” চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব। আমাকে মিথ্যা বলা? ”

আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলাম। ঘাবড়ে তাকালাম মায়ের দিকে। তবে কি মা সব জেনে গেছে? কিন্তু কিভাবে? আমি তো কিছু বলিনি। তাহলে কি উষ্মা বলেছে? মুহূর্তে আমার রক্ত গরম হয়ে গেল। মায়ের না দেওয়া চড়টা উষ্মাকে দিতে ইচ্ছে হলো।

মায়ের ক্রোধান্বিত ধ্বনি বাজল আবার,
” এতদিন তাহলে মিথ্যে বলেই আমাকে ভুলিয়েছিস? ”

আমি মাকে শান্ত করতে চাইলাম। কাঁধ চেপে ধরতে তিনি সরে গেলেন। কটমট চোখে চেয়ে বললেন,
” উষ্মা তো ফোনই ব্যবহার করে না। অন্য ফোন দিয়েও কারো সাথে কথা বলে না। ”

আমি একটু থামলাম। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম। প্রশ্ন করলাম,
” কেন? ”
” ওর সমস্যা হয়। ”
” কী সমস্যা? ”
” জানি না৷ ”

আমি আরও গভীরে না গিয়ে সুযোগটাকে কাজে লাগাতে বললাম,
” অন্য কারও সাথে বললে সমস্যা হয়, আম্মু। আমি অন্য কেউ না। ”

মা কিছু একটা বলতে চাইলে আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম,
” উষ্মার সাথে আমার রোজ ফোনে কথা হয়। অন্য ফোন থেকে নয়, নিজের ফোন থেকে। আমি গিফট করেছি। ”

মায়ের চোখ ছানাবড়! অল্পক্ষণের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেললেন বুঝি। বেশ কিছুক্ষণ পর সুধালেন,
” সত্যি? ”

আমি মাথা নেড়ে বললাম,
” হ্যাঁ। ”

আনন্দে মায়ের চোখ-মুখ ঝলমলিয়ে উঠল। গলায় স্নেহের সুর এলো,
” এত বেলা করে কেউ ঘুম থেকে উঠে? এখন নাস্তা খাবি নাকি দুপুরের খাবার? ”

আমি হালকা হেসে বললাম,
” তোমার যেটা ইচ্ছে হয় দেও। ”

____________
আমার খাওয়া অর্ধেক হতে মা পাশের চেয়ারটায় বসলেন। বললেন,
” তোকে না জানিয়ে আমি একটা কাজ করে ফেলছি। ”

আমি নিরুদ্বেগে জানতে চাইলাম,
” কী কাজ? ”
” উষ্মাকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছি। ”

আমার খাবার গলায় আটকে গেল। চোখ বড় বড় করে তাকালে তিনি অপরাধীর মতো বললেন,
” আমি ভেবেছিলাম, তোরা আমাকে মিথ্যা বলছিস। তোদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই, তাই নাজুকে কল করে বলেছি উষ্মাকে কয়েকদিনের জন্য পাঠিয়ে দিতে। দেখা-সাক্ষাৎ নাহলে চেনাজানা হবে কীভাবে? ”

আমি আটকে যাওয়া খাবারটুকু গিললাম অতিকষ্টে। মা পানি এগিয়ে ধরে বললেন,
” মানছি, আমি ভুল ভেবেছিলাম কিন্তু পুরোপুরি নয়। শুধু ফোনে কথা বলে কি সব হয়? মাঝে মাঝে দেখা-সাক্ষাৎও তো করা উচিত। ”

আমি পানি খাওয়া শেষ করলে মা আবার বললেন,
” তুই তো ফ্রি আছিস। একটু এগিয়ে নিয়ে আয় না, বাবা। ”

আমি চেয়ার ছেড়ে সটাং দাঁড়িয়ে পড়লাম। চিৎকার করে ‘ না ‘ বলতে চেয়েও বললাম,
” ঠিক আছে, আম্মু। কতদূর আছে, তুমি জেনে আমাকে জানিয়ে দিও। ”
” তুই জেনে নে। ”
” আমি কিভাবে জানব? ”

মা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন। স্বাভাবিকভাবেই বললেন,
” ফোন করে। তুই তো বললি, ওর কাছে নাকি ফোন আছে। ”

আমি আবারও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বললাম,
” ও হয়তো ফোন ফেলে আসছে। সকাল থেকেই বন্ধ পাচ্ছি। ”

মা চিন্তিত বদনে বললেন,
” বলিস কী! এখন মেয়েটা একা একা কিভাবে আসবে? রাস্তাঘাট তো একদমই চেনে না। হারিয়ে যায় যদি? ”

আমি থমথমে চোখে চাইলাম মায়ের দিকে। নীরবে বললাম, ‘ ও সব চিনে। ‘

________

উষ্মাকে খুঁজে পেতে আমার খুব একটা সমস্যা হলো না। হাঁচির শব্দ শুনেই তার উপস্থিতি টের পেলাম। রাস্তার এক কিনারে দাঁড়িয়ে সিএনজি ঠিক করছিল। আমি হেঁটে গেলাম। দরাদরি বন্ধ করতে বললাম,
” উঠে বসো। ”

আমার হঠাৎ আগমনে উষ্মা একটুও ঘাবড়াল না। স্বাভাবিকভঙ্গিতেই আমার পাশে বসল। সিএনজি ছুটে চললে সে বলল,
” আপনি অনেক মিথ্যা বলেন? ”

আমি অপ্রস্তুত হলাম। রাগ নিয়ে বললাম,
” মিথ্যা বলব কেন? ”

উষ্মা জোর দিয়ে বলল,
” বলেছেন। অনেকগুলো মিথ্যা বলেছেন। নাহলে চার মাস আন্টিকে সামলেছেন কী করে? ”

আমি অন্য প্রসঙ্গ বদলাতে বললাম,
” তুমি নাকি ফোনে কথা বলো না? ”
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”

উষ্মা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। আমি খেয়াল করলাম তার গালে লজ্জা রঙ! ভ্রূ উঁচিয়ে বললাম,
” উত্তর দেবে কি? ”

উষ্মা লাজুক কণ্ঠে বলল,
” সুড়সুড়ি লাগে। ”
” সুড়সুড়ি! হঠাৎ সুড়সুড়ি আসল কোথা থেকে? আমি জানতে চেয়েছি ফোনে কথা বলতে কী সমস্যা? ”
” ওটাই তো বললাম। ”

আমি তখনও উষ্মার কথার মানে বুঝতে পারছিলাম না। বোকা চোখে চেয়ে থাকলে সে বুঝিয়ে দিল,
” ফোনে কথা বলতে গেলে আমার সুড়সুড়ি লাগে। মনে হয় কেউ আমার কানে কানে কথা বলছে। আমার তো কানে সুড়সুড়ি! ”

আমার চোয়াল ঝুলে পড়ল। নিষ্পলকে চেয়ে থাকলাম উষ্মার লাজুক মুখটায়। মনে মনে ভাবছি, কানেও সুড়সুড়ি হয়? সেই সুড়সুড়িও আবার ফোনে কথা বলার সময় পায়! জগতের সকল আশ্চর্যজনক ব্যাপারগুলো নিয়েই কি এই মেয়ে জন্মেছে?

আমার ভাবনার সুতো কাটল উষ্মার হাঁচির শব্দে। আমি ভয়ে ও ঘেন্নায় একটু দূরে চেপে গেলে সে বলল,
” এটা সর্দির হাঁচি না, এলার্জির। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here