সর্দি_কন্যা,পর্ব (৩)

#সর্দি_কন্যা,পর্ব (৩)
#রোকসানা_রাহমান

আমি বসা অবস্থায় খাটের নিচে উঁকি দিতেই চোখদুটো ছানাবড় হলো। সীমাহীন বিস্ময় ঝরে পড়ল কণ্ঠ থেকে,
” তুমি! ”

উষ্মা চোরের মতো তাকাল। গোলগাল মুখটায় ভয়ের আভা প্রকাশ পেয়ে হারিয়ে গেল। আমি অধৈর্য্য হয়ে আবার বললাম,
” কখন এসেছ? ”

উষ্মা আমাকে ছাপিয়ে রুমের দিকে উঁকি দিল। বের হওয়ার জন্য নড়তেই খাটের তলার সাথে মাথাটা বাড়ি লাগল। নিচু স্বরে ‘ আহ! ‘ শব্দ করলে আমি বললাম,
” লাগল নাকি? খাটের নিচে কী করছ? ”

উষ্মা নড়াচড়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকাল। ফিসফিস করে বলল,
” লুকিয়েছি। ”

আমি কৌতূহলে জিজ্ঞেস করলাম,
” কেন? ”
” আম্মুকে ঠাণ্ডা করার জন্য। ”
” বুঝিনি। ”

উষ্মা বেশ উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা বলতে চাইলে আবারও মাথা গিয়ে লাগল খাটে। আমি সতর্ক করে বললাম,
” সাবধানে বসো। ”

উষ্মা বামহাতে মাথাটা ডলতে ডলতে আসন ধরে বসল। দারুন উৎসাহ নিয়ে বলল,
” বৃষ্টির জন্য আমার ফিরতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল। গ্রামে ঢুকতেই আমার বান্ধুবী মিতার সাথে দেখা। ওর মুখ থেকে শুনলাম আমি বাসায় ফিরতে দেরি করছিলাম দেখে আম্মু নাকি কলেজে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে জানতে পারে আমি আজ কলেজে যাইনি। ওদের অনেক বকাঝকা করে। বলে আসে, আমি বাড়ি ফিরলেই চ্যালাকাঠ পিঠে ভাঙবে। পা কেটে দেবে। চুল পুড়িয়ে দিবে। খাটের পায়ার সাথে হাত-পা বেঁধে রাখবে। পড়ালেখা বন্ধ! ”

আমি বিস্ফারিত চোখে বললাম,
” কী বলছ এসব! নাজু আন্টি সত্যি এমন করে? মুখ দেখে বুঝাই যায় না। ”

আমার কথা শুনে সে ভীষণ আনন্দ পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে হাসল। একটু থেমে বলল,
” মাথা গরম হয়ে গেলে আরও অনেক কিছু করে। তো যেটা বলছিলাম, মিতার মুখ থেকে সবটা শোনার পর আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। বাড়িতে ফেরার সাহস পাই না৷ তার মধ্যে আব্বাও বাসায় নেই, সন্ধ্যায় ফিরবে। আমাকে বাঁচাবে কে? এদিকে দুইবার বৃষ্টিতে ভিজে আবার শুকিয়ে গেছি। জামা পাল্টানো দরকার! পুরো শরীর বরফ হয়ে আছে। ক্ষুধাও লাগছে। আপনার কাছে যাওয়া-আসা করতে করতে আমার জমানো টাকা শেষ! কোনো উপায় না পেয়ে আমি বাড়ির দিকেই হাঁটা ধরলাম। চুপিচুপি উঠোনে ঢুকে দেখলাম আম্মু বাসায় নেই। কোথাও একটা গেছে। সে সুযোগে আমি ভাত খেলাম। জামা পাল্টালাম। কিছুক্ষণ পরই আম্মুর গলা পেলাম। ভয়ে আমি দৌড়ে খাটের তলায় লুকায়। তার একটু পরে আব্বু আসে। আমি সাহস পেয়ে বের হব তখন শুনি আম্মু কাঁদছে আর বলছে, আমি নাকি হারিয়ে গেছি। যে করেই হোক খুঁজে এনে দিতে। মসজিদে জিলিপি দেবে এমন মানতও করে ফেলছে। আমি তো খুব খুশি! বুঝে গেলাম আম্মুর রাগ কমাতে হলে আমাকে হারিয়েই থাকতে হবে। তাই আর বের হয়নি। ঠিক করেছি, মাঝরাতে বের হব। যাতে আমাকে দেখেই….”

উষ্মা কথা শেষ করতে পারল না। প্রচণ্ড শব্দে হাঁচি দিতে গিয়ে মাথায় আবারও বাড়ি খেল। ব্যথা উপেক্ষা করে নাকসহ মুখ চেপে ধরল দুই হাতে। মাথা অনেকটা নামিয়ে বলল,
” টিস্যু দিন। ”

আমার কৌতূহল মিটে গেল। নাক-মুখ কুঁচকে অন্যদিকে ঘুরে বললাম,
” আমি কি টিস্যুর কারখানা যে সারাক্ষণ টিস্যু মজুদ থাকবে? ”
উষ্মা এক হাতে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসল। কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকল অল্পক্ষণ। তারপরেই জোর করে আমার হাতায় নাক মুছে বলল,
” টিস্যু মজুদ করার জন্য কারখানা হতে হয় না, ভদ্রলোক হতে হয়। শহরে থেকে এটুকু শিখেননি? ছি! ”

_____________
রাতে খেতে বসে আম্মুকে বললাম,
” আমি ঢাকা ফিরব। ”

আম্মু আঁতকে উঠে বলল,
” এত রাতে? কেন? ”

আমি উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেলাম না। উষ্মা রান্নাঘরে হাজির হলো সালাম নিয়ে,
” আসসালামু আলাইকুম। আপনারা সকলে ভালো আছেন? ”

আম্মুর মনোযোগ চলে গেল উষ্মার দিকে। হাত দিয়ে টেনে পাশে বসাল। বামহাতে মুখ হাতিয়ে বলল,
” অনেক বড় হয়ে গেছিস! ”

উষ্মা লাজুক হাসল। আম্মুর হাতে আরেক চামচ ভাত তুলে দিয়ে বলল,
” আপনি অনেক শুকিয়ে গেছেন। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেন না, তাই না? ”

আমি খাওয়া বন্ধ করে তাদের কথাবার্তা শুনছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম মায়ের চোখ ছলছল হয়ে আসল। সে অবস্থায় আমাকে বলল,
” উষ্মা খুব ভালো গান গায়, শুনবি? ”

আমি হ্যাঁ- না কিছুই বলতে পারলাম না। আম্মু উষ্মার দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল,
” একটা গান শোনাত মা। ”

উষ্মাও গান শুরু করে দিল। যেন আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। গান শেষ হতে মা খুব প্রশংসা করে আমাকে জিজ্ঞেস করল,
” কী দারুন কণ্ঠ তাই না রে? একদম মন শান্ত করার মতো। ”

আমি কটমটে চাইলাম উষ্মার দিকে। দাঁত চিবিয়ে বললাম,
” জঘন্য! আমার ভাত খাওয়ার রুচিই নষ্ট করে দিছে। কেউ যে এত খারাপ গান গাইতে পারে উষ্মাকে না দেখলে জানাই হতো না। ”

আমি ভাত ছেড়ে উঠে পড়লাম। গটগট শব্দে রুমে ফিরে আসলাম। মোবাইল আর মানিব্যাগ নিয়ে ঢাকার উদ্যেশ্য বের হব তখনই উষ্মা পথ আটকে দাঁড়াল। কঠিন স্বরে বলল,
” আন্টিকে কষ্ট দিলেন কেন? ”

আমি এড়িয়ে যেতে গিয়েও প্রশ্ন করে বসলাম,
” কোন আন্টি? ”
” আপনার মা। ”
” আমি কেন মাকে কষ্ট দেব? ”
” দিয়েছেন তো। ”
” কখন? ”
” একটু আগে। ”
” কিভাবে? ”
” আমার গলাকে খারাপ বলে। ”

আমি বুঝতে পারিনি এমনভাবে তাকালে সে বুঝিয়ে দিল,
” আমার গানের গলা আন্টির পছন্দ। আপনি তার পছন্দকে জঘন্য বলেছেন। তাই আন্টি কষ্ট পেয়েছে। ”
” আম্মু তোমাকে এমন বলেছে? ”

উষ্মা আত্মবিশ্বাসে বলল,
” বলতে হবে কেন? মুখ দেখেই বুঝেছি। ”

বলতে বলতে আমার হাত থেকে ফোন ও মানিব্যাগ কেড়ে নিল উষ্মা। পালিয়ে যেতে যেতে বলল,
” যতক্ষণ না আন্টিকে বলছেন, আমার গানের গলা সুন্দর ততক্ষণ এগুলো পাবেন না। ”

আমি দৌড়েও তাকে ধরতে পারলাম না। কোথায় যেন হারিয়ে গেল! মায়ের কাছে নালিশ দিতে গিয়ে পেলাম না। নাজু আন্টিকে নিয়ে কারও সাথে দেখা করতে গিয়েছে। বাবা ক্লান্ত দেখে বের হয়নি। উষ্মার বাবার সাথে গল্প করছে। আমি রাগ লুকিয়ে বাবার পাশে বসলাম। সময় বুঝে বললাম,
” আব্বু, কিছু টাকা দেও তো। ”

আব্বু বিনা প্রশ্নেই পকেটে হাত দিল। গল্প থামিয়ে দুই পকেট হাতিয়ে হেসে ফেলল। সহাস্যে বলল,
” উষ্মা বলল, এদিকে নাকি খুব চুরি হচ্ছে! জানালার শিক কেটে, মাটি খুঁড়ে সব লুটে নিচ্ছে। তাই আমার মোবাইল, টাকা-পয়সা উষ্মা সরিয়ে রেখেছে। তুই ও কে ডেকে নিয়ে আয়, আমি বলছি তোকে টাকা দিতে। ”

আমার বসে থাকা রাগটা আবার ফুঁসে উঠল। বিরক্তে ঠোঁট শক্ত হয়ে আসল। এত খারাপ মেয়ে মানুষ হয়! আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না এই মেয়ে আমার আম্মুর বান্ধুবীর মেয়ে।

” তোকে যেতে হবে না। দাঁড়া আমি ডাকছি। ”
” লাগবে না। ”

আমি ধপধপ পা ফেলে আবারও নিজের রুমে ফিরে আসলাম। ঘরময় পায়চারি করতে করতে বিড়বিড় করছি, কী করব এখন? খালি হাতে ঢাকায় ফিরব কী করে? মোবাইলও তো নেই যে কারও সাথে যোগাযোগ করব। উষ্মার বাবার কাছে চাইব? ছি! ছি! ছি! এসব আমি কী ভাবছি? মেয়েটা আমাকে এভাবে অপদস্ত করছে? কোণঠাসা করছে? তার কথামতো চলতে বাধ্য করছে! কিছুতেই শুনব না। কিছুতেই মানব না।

আমি আবার রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। উষ্মাকে খুঁজে বের করতে হবে। করতেই হবে! আমার জিনিস আমি নিয়ে ছাড়ব। প্রয়োজনে কানের নিচে কয়েকটা লাগাব। বেয়াদব! কার সাথে কী আচরণ করতে হয় জানে না। ম্যানারলেস!

উষ্মাকে খুঁজতে খুঁজতে রাস্তায় চলে এসেছি। কোনদিকে যাব ভাবতেই মেঘ গুড়ুমগুড়ুম ছন্দ তুলল। আমি আকাশের দিকে তাকাতেই মুখের মধ্যে ঠাণ্ডা পানির স্পর্শ পেলাম।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here