সভ্যতার_সভ্য,ষষ্ঠাংশ
NishchupSpriha
পরের দিন সকাল সাড়ে নয়টার পর সভ্য বাসায় এলো। আমি তখন মাম্মাম আর ছোটমার রান্না করা খাবার টেস্ট করছি। ও এসে কিছুক্ষণ পর রান্না ঘরে উঁকি দিল। আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম।
সভ্যকে এভাবে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখে মাম্মাম প্রশ্ন করলো,
— ‘কি ব্যাপার সভ্য? কিছু লাগবে নাকি?’
সভ্য মাথা চুলকে জবাব দিলো,
— ‘না.. মানে.. হ্যাঁ বড়মা, আমার খিদে পেয়েছে।’
এবার ছোটমা প্রশ্ন করলো,
— ‘বন্ধুর বাড়ি থেকে না খেয়ে এসেছিস?’
— ‘না খেয়ে আসবো কেন? আন্টি তো জোর করে আমাকে প্রচুর খাবার খাইয়েছে।’
— ‘তাহলে যে আবার খেতে চাচ্ছিস?’
— ‘দৌড়াদৌড়ি করে খিদে পেয়ে গেছে।’
— ‘এইসময় তুই কোথায় দৌড়াদৌড়ি করলি?’
— ‘উফ মামণি! তুমি এত প্রশ্ন করো কেন? খিদা লাগছে বলছি খেতে দিলে দাও না দিলে বলে দাও যে দিবো না।’
— ‘এই কি বললি?? আবার বল দেখি। তুই আমার সাথে এভাবে কথা বললি?’
এবার মাম্মাম বললো,
— ‘আহ্! আফিয়া, তুই চুপ কর তো। ছেলেটার খিদে পেয়েছে আর তুই কিনা আজেবাজে কথা শুরু করেছিস?’
ছোটমা অবাক হয়ে বললো,
— ‘আমি আজেবাজে কথা বলছি? আমি?’
মাম্মাম বিনা দ্বিধায় বললো,
— ‘হুম, তুই। তুই ছাড়া আর কাকে বলবো? শুধু শুধু আমার ছেলেকে জ্বালাচ্ছিস।’
তারপর সভ্যকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— ‘যা বাবা তুই টেবিলে যেয়ে বস। আমি খাবারটা গরম করে সভ্যতাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
আমি এতক্ষণ নিরবদর্শকের ভূমিকায় ছিলাম।
মাম্মামের কথা শুনে সাথে সাথে বলে উঠলাম,
— ‘পারবো না আমি। তোমার ছেলের খাবার তুমি দিয়ে আসো।’
আমার কথা শুনে সভ্য আমার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো আর মাম্মাম আমাকে শাসনের ভজ্ঞিতে বললো,
— ‘থাপ্পড় দিয়ে তোর এপাশের গাল ওপাশে করবো বেয়াদপ মেয়ে। বড়দের মুখের উপর কথা তাই না? দিন দিন বেয়াদপ হচ্ছিস??’
আমি কিছু বলার আগে ছোটমা আমার পক্ষ নিয়ে প্রতিবাদ করে বলে উঠলো,
— ‘কেনো ভাবি? তুমি কেনো আমার মেয়েকে মারবে? ও বড়দের মুখের উপর কথা বলে আর তোমার ছেলে কি?? তোমার ছেলেও তো নিজের মায়ের মুখে মুখে তর্ক করে। ফাজিল ছেলে একটা। সভ্যতা বেশ করেছে। ও কেনো এই ফাজিল ছেলেটাকে খাবার দিতে যাবে? তোমার ছেলে তুমি নিজে যেয়ে খাবার দাও যাও।’
তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— ‘সভ্যতা, মা আমার আয় তোকে একটু কেক দেই। খেয়ে বল তো কেমন হয়েছে।’
এবার সভ্য আহত স্বরে বললো,
— ‘মামণি খিদে পেয়েছে আমার! আর তুমি কিনা ওকে খেতে বলছো? আমি বাসায় এসেছি থেকে দেখছি তোমার মেয়ে একটার পর একটা খাচ্ছে তো খাচ্ছেই! দেখতে তো পাটকাঠির মতো… এত খায় কিভাবে?’
সভ্যর কথা শুনে ছোটমা ওকে ধমকে বললো,
— ‘খবদার তুই আমার মেয়ের খাবারে নজর দিবি না।’
এবার মাম্মাম হুংকার দিয়ে ছোটমাকে বললো,
— ‘খবরদার আফিয়া, আমার ছেলের সাথে এভাবে কথা বলবি না।’
তারপর সভ্যকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— ‘যা বাবা তুই টেবিলে যা। আমি নিজে তোর খাবার গরম করে নিয়ে যাচ্ছি। কাউকে লাগবে না আমার ছেলের জন্য।’
সভ্য মুখ ভার করে আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বললো,
— ‘ওকে বড়মা। আমি যাচ্ছি।’
বলেই টেবিলে যেয়ে বসলো।
আর আমি তব্দা খেয়ে তাকায় আছি। কি হচ্ছে এসব?? মাম্মাম আর ছোটমা নিজের সন্তান রেখে অন্যেরটা নিয়ে ঝগড়া করছে? ইয়া খোদা!! কেমনে সম্ভব?
সন্ধ্যায় বাসায় গেস্ট দিয়ে ভর্তি হয়ে গেল। গেস্ট বলতে আমাদের আত্নীয়-স্বজন আর বাপি-মাম্মাম, ছোটমা-ছোটবাবার কয়েকজন কলিগ। আমার আর সভ্যর কিছু ফ্রেন্ড আর আমাদের কাজিন গ্রুপ।
আজকে শুধু বাপি-মাম্মামের পঁচিশতম ম্যারেজ অ্যানিভার্সারির পার্টি নয় তাদের সাথে ছোটমা-ছোটবাবারও বাইশতম ম্যারেজ অ্যানিভার্সারির পার্টি। কারণ তাদের অ্যানিভার্সারির সময় আমি বা সভ্য কেউই উপস্থিত ছিলাম না। যার ফলে আজকে তাদের দু’জনের অ্যানিভার্সারি বাপি-মাম্মামের সঙ্গে একসাথে পালন করা হচ্ছে। সাথে ছোটখাটো একটা ফ্যামিলি গেট টুগেদার।
আমি রেডি হয়ে নিচে এসে সভ্যকে দেখে পুরাই থ! ওকে দেখেই আমি আমার হার্টবিট মিস করলাম! আমার বয়ফ্রেন্ড এত বেশি সুদর্শন কেন?
কাকতালীয়ভাবে আমার আর সভ্যর পোষাকের রং মিলে গেছে। গতকাল বিকালে তো আমি ইচ্ছে করে ওর সাথে ম্যাচ করে পড়েছিলাম। কিন্তু এখন? এটা কি কাকতালীয়?
আমার পড়নে অফহোয়াট জমিনে সোনালী নকশার হাফ সিল্ক জামদানি আর সভ্যর পড়নে অফহোয়াট স্যুট আর সাদা শার্ট, হাতে সিলভার কালারের মেটাল বেল্টের রোলেক্স সাবমেরিনের রিস্টওয়াচ। ঝাঁকড়া কালো কুচকুচে চুলগুলো ছোট করে ছাটা।
আমি আর তাকালাম না। বেহায়া চোখ গুলোকে জোর করে অন্য দিকে ফিরালাম। এর থেকে বেশি দেখলে কোন অঘটন ঘটে যাবে..!
আমি মাম্মাম আর ছোটমার কাছে গেলাম। আজ তাদের দু’জনকেই চমৎকার অপূর্ব সুন্দরী লাগছে। দু’জনের কাউকেউ দেখে বুঝা যাবে না তারা চল্লিশোর্ধ্ব। তাদের দেখে মনে হচ্ছে কেবল তাদের বয়স ত্রিশের কোঠায়।
দু’জনের পড়নে গাঢ় লাল জমিনে উজ্জ্বল সোনালী জরিসুতার ভরাট কারুকাজ করা বেনারসি। তারা কেউই এই শাড়ি পড়বে না। তাদের কথা হচ্ছে, ‘আমরা বুড়ি হয়ে গেছি এখন কি এসব মানায়?’ আমি আর সভ্য জোর করে তাদের এই শাড়ি পড়িয়েছি। এই শাড়ি আমার আর সভ্যর তরফ থেকে পৃথিবীর দুইজন শ্রেষ্ঠ মায়ের জন্য সামান্য উপহার।
আমি মাম্মাম আর ছোটমার কাছে যেয়ে বললাম,
— ‘হেই লেডিস! ইউ টু লুক সো মাচ বিউটিফুল!’
মাম্মাম আর ছোটমা আমার কথা শুনে হেসে ফেলে বললো,
— ‘প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু এই প্রশংসা আমাদের নয় তোমার প্রাপ্য সোনা।’
সভ্য বলে উঠলো,
— ‘উঁহু! এটা তোমাদেরই প্রাপ্য। সত্যি আজ তোমাদের দু’জনকে চমৎকার লাগছে। চোখ ফেরানো দায়! পাপা আর বড়বাবা হার্ট অ্যার্টাক না করলেই হয়!’
সভ্য যে কখন এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে আমি বুঝতেই পারিনি। পাশে তাকিয়ে দেখি ও আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এত কাছ থেকে ওকে দেখে আমি আবার আমার হার্টবিট মিস করলাম! এই ছেলে এত হ্যান্ডসাম কেন কেন কেন?
সভ্যর কথা শুনে মাম্মাম সভ্যর কাঁধে আলতো চড় মেরে বললো,
— ‘এ্যাই ছেলে এ্যাই! আমরা তোর মা হই আর তুই আমাদের সাথে ফাজলামি করছিস?’
বলেই হেসে ফেললো।
মাম্মামের সাথে আমরাও হেসে ফেললাম।
বাপি এসে বললো,
— ‘কি ব্যাপার? কি নিয়ে এত হাসাহাসি হচ্ছে তোমাদের মাঝে?’
বাপি আর ছোটবাবা এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালো।
বাপি আর ছোটবাবার পড়নে কালো স্যুট সাদা শার্ট। দু’জনকে অসম্ভব সুদর্শন লাগছে।
আমি বললাম,
— ‘বাপি, ইউ লুক হ্যান্ডসাম এন্ড ছোটবাবা ইউ অলসো লুক গ্রেট।’
বাপি হেসে আমার মাথায় চুমু খেয়ে বললো,
— ‘থ্যাংক ইউ, মামণি। তোমাকেও চমৎকার সুন্দর লাগছে।’
আমি হেসে বললাম,
— ‘থ্যাংক ইউ, বাপি।’
ছোটবাবা বললো,
— ‘ইয়াং লেডি, ইউ লুক গর্জিয়াছ!’
ছোটবাবাকেও হেসে বললাম,
— ‘তোমাকেও ধন্যবাদ, ছোটবাবা।’
সভ্য মুখ করুণ করে বললো,
— ‘কেউ তো আমারো প্রশংসা কর! আমারো তো প্রশংসা শুনতে মন চায়! প্রশংসা শুনতে আমি অনেক ভালোবাসি।’
সভ্যর কথায় আমরা সবাই হেসে ফেললাম।
মাম্মাম হেসে হেসেই বললো,
— ‘আমার ছেলেকে আজকে রাজপুত্রর মতো লাগছে। কতজন রাজকন্যার যে আজ হার্টবিট মিস হয়েছে এবং হবে সেটা উপরওয়ালা জানে।’
মাম্মামের কথা শুনে আমি মনে মনে বললাম, ‘মাম্মাম, তোমার নিজের মেয়েই অলরেডি কয়েকবার মিস করে ফেলেছে!’
সভ্য হেসে ফেলে মাম্মামের কাঁধ জড়িয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে বললো,
— ‘ধন্যবাদ, বড়মা। কিন্তু এটা একটু বেশি হয়ে গেলো।’
সভ্যর কথায় বাপি বললো,
— ‘নো ইয়াং ম্যান, এটা মোটেও বেশি নয়। সত্যি আজ তোমাকে দারুণ সুদর্শন লাগছে।’
সভ্য হেসে বললো,
— ‘থ্যাংকস, বড়বাবা। ইউ অলসো লুক গ্রেট টুডে।’
বাপি হেসে বললো,
— ‘প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ তোমাকে।’
কেক কাটার পরে কাজিন গ্রুপ প্লাস সব সিনিয়র কাপলদের জন্য কাপল ডান্সের আয়োজন করা হয়েছে। ডান্স ফ্লোরে ছোটমা-ফাইয়াজ ভাইয়া, মাম্মাম-সভ্য, ছোটবাবা-রুশাপু এবং আমি ও বাপি কাপল হিসেবে গেলাম। বাপির ফোন কল আসায় উনি চলে গেলো। ধীরে ধীরে সিনিয়র সব কাপলরাই ডান্স ফ্লোর থেকে চলে গেলো।
আমি আর রুশাপু একপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। কোথা থেকে যেন সভ্য আর ফাইয়াজ ভাইয়া এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালো। এখনো অনেকেই ডান্স ফ্লোরে আছে। ফাইয়াজ ভাইয়া রুশাপুকে নিয়ে ডান্স ফ্লোরে চলে গেলো। এখন আমি আর সভ্য শুধু একা.. কেউ কিছু বলছি না। আমি যে কি বলবো সেটা খুঁজেও পেলাম না।
কিছুক্ষণ এভাবে নিরবতা কাটার পর ও আমার সামনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
— ‘উড ইউ লাইক টু ড্যান্স উইথ ইওর বয়ফ্রেন্ড, মিস. মুহসিনাত তানজীম সভ্যতা?’
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। কি বলবো আমি? অবশ্যই ‘হ্যাঁ’ বলবো! কিন্তু এই ‘হ্যাঁ’ বলার শক্তিই পেলাম না…
ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে.. ওর এই হাসি দেখেই আমি ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম।
ঘোরের মধ্যেই বললাম,
— ‘অফকোর্স মি. মুদাসি্র তানজীম সভ্য..’
===============
ডান্সের পর সভ্যকে আর কোথাও দেখিনি। ওকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে জুস কর্ণারের দিকে গেলাম। যেয়ে দেখি অসভ্যটা কতগুলো মেয়ের সাথে হা হা হি হি করছে। আর মেয়েগুলোও কেমন? একদম গায়ে ঢলে ঢলে পড়ছে..! পারলে সভ্যর কোলেই উঠে পড়ে! দেখেই আমার মেজাজ চটে গেলো। ডান্সের সময়টুকু বাদে আজ সারা দিন ও আমার সঙ্গে কথা বলেনি। আর এখন অন্য মেয়েদের সঙ্গে ঢলাঢলি চলছে?? আমি ওখান থেকে চলে এলাম আমার ফ্রেন্ডের কাছে।
রাতে গেস্ট চলে যাওয়ার পর বাড়ির বড়রা ডিনারে বসলো। আমাদের দূরের কিছু আত্নীয় আর কাজিনরা আছে। সভ্য আরো দেরিতে খাবে কাজিনদের সঙ্গেই। এজন্য আমিও বসে পড়লাম বড়দের সঙ্গেই।
খাওয়া শেষে ছোটমা বললো, ‘ছাদে যা বাচ্চারা সবাই ছাদেই আছে।’
আমি ছাদে যেয়ে আহাম্মক হয়ে গেলাম। এখানে ককটেল পার্টি হচ্ছে! আর সভ্য? ওর চারপাশে মৌমাছির মতো মেয়েরা ভনভন করছে! আমাদের সবার বড় আনিকা আপু ও-ও সভ্যর গায়ের সাথে ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। আর অসভ্যটা হেসে হেসে সবার প্রশংসা করছে। কই আজকে তো একবারও আমাকে বললো না আমাকে কেমন লাগছে? রাগে, দুঃক্ষে আমি রুমে এসে শাওয়ার নিয়ে শুয়ে পড়লাম।
কখন আমি ঘুমিয়েছি জানি না। কিন্তু আমার ঘুম ভাঙলো প্রচন্ড শ্বাস কষ্টে। রাত কয়টা বাজে আমি জানি না আমার মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আমি মারা যাবো। কিছুক্ষণের মাঝে যখন বুঝতে পারলাম কেউ আমাকে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে আর আমার মাথাটা তার বুকে, সাথে সাথে আমার কলিজা কেঁপে উঠলো। বাসা ভর্তি মানুষ! কার এত বড় সাহস আমার রুমে এসে আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরবে? বুঝতে পেরেই আমি ধাক্কানো শুরু করলাম নিজের থেকে সরানোর জন্য। কিন্তু হায়! একদম নড়াতে পারলাম না। আমি তবুও চেষ্টা করলাম নিজেকে ছাড়ানোর।
অন্ধকারের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং চেনা ঘুম জড়ানো অস্পষ্ট একটা স্বর বললো,
— ‘ডোন্ট মুভ, সুইটহার্ট! খুব ঘুম পেয়েছে আমার। ফাজিল গুলোর জ্বালায় একটুও ঘুমোতে পারিনি। কিছুক্ষণ আগেই তোমার কাছে এলাম আর এখন তুমিও বিরক্ত করছো? ঘুমোতে দাও আমাকে জান, খুব ঘুম পেয়েছে আমার।’
আমি থ! সভ্য!! তাও আবার আমার রুমে!! বাসা ভর্তি আমাদের সব আত্নীয়-স্বজন, কাজিন গ্যাং!! কখন কে দেখে ফেলে!!
আমি অস্থির হয়ে বললাম,
— ‘তোমার মাথা ঠিক আছে, সভ্য?? এখানে কি করছো তুমি?? কেউ দেখে ফেললে কি হবে তুমি জানো না??’
— ‘উঁহু, আমার মাথা ঠিক নেই। তিনটা না না প্রায় চারটা হাইকেন খেয়ে মাথাটা প্রচন্ড ধরে আছে। তুমি পারলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও, আমি ঘুমাই।’
আমার মেজাজ আবার চটে গেলো। আজকে সন্ধ্যার পর থেকে রাত পর্যন্ত ও যা যা করেছে আর এখন গিলে এসে ঢং করা হচ্ছে?
আমি রেগে গিয়ে বললাম,
— ‘ছাড়ো, আমাকে। তুমি এক্ষনি আমার রুম থেকে বেড়িয়ে যাবে। আজকে তুমি যা করেছো তারপরেও কোন সাহসে তুমি আমার কাছে আসো??’
— ‘এভাবে বলছো কেন? কি করেছি, আমি?’
— ‘কি করেছ তুমি জানো না, না?’
— ‘জান, এখন আমি তোমার বিরক্তিকর কোন লেকচার শুনতে চাচ্ছি না। দয়া করে চুপ করো। না হলে তোমাকে চুপ করানোর উপায় আমার জানা আছে। আমার মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে যাস্ট… এন্ড ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন আজকে আমি তেমন কিছুই করিনি। শুধু তোমার থেকে দূরে দূরে থেকেছি, তা না হলে নির্ঘাত কোন অঘটন ঘটে যেত। আজ সন্ধ্যায় তোমাকে দেখার পর থেকে আমার মাথা হ্যাং হয়ে ছিল। সেটা কি তুমি জানো?? আজ তোমাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছিল, সুইটহার্ট… ইউ লুক লাইক অ্যা কুইন অফ ফ্যেরি! তাই কোন ঝুঁকি নিতে চাইনি এবং এখন তোমাকে ছাড়ার তো কোন প্রশ্নই আসে না।’
বলেই আরো শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
আমার মনে হলো দম বন্ধ হয়ে এখনি মরে যাবো। আমি কোন রকমে বললাম,
— ‘সওভ্যওওও এক্ষনি আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে! মরে যাবো আমি! প্লিজ… ছাড়ো!’
আমার কথা শুনে সভ্য সাথে সাথে আমাকে ছেড়ে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে বললো,
— ‘উপ্স! আ’ম স্যরি জান। আ’ম স্যো স্যরি। তুমি ঠিক আছো তো? কিছু হয়নি তো তোমার??’
আমি হাপাতে হাপাতে বললাম,
— ‘ইয়াহ আ’ম গুড। কিন্তু আর একটু হলে আমি পটল তুলতে যেতাম।’
— ‘আ’ম স্যরি জান। এক্সট্রিমলি স্যরি।’
— ‘ইট’স ওকে। তুমি এখনি আমার রুম থেকে চলে যাবে।’
— ‘প্লিজ জান! একটু থাকি? অল্প একটু থাকবো। মাথাটা খুব ধরে আছে। ওদের জ্বালায় ঘুমোতে পারিনি।’
বলেই আবার আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
আমি রেগে যেয়ে বললাম,
— ‘পারবো না। ছাড়ো আমাকে। গিলতে কে বলেছে তোমাকে?? আমি বলেছিলাম?? আর তোমরা যে ককটেল পার্টি করলে সেটা বাপি বা ছোটবাবা জানে তো??’
— ‘মাথা খারাপ! বড়বাবা আর পাপা জানতে পারলে জুতা পিটা করবে আমাদের আর মামণি মানে তোমার শ্রদ্ধেয় ছোটমা তো ঝাড়ু নিয়ে আমার পিছনে দৌড়াবে।’
— ‘তখন বড়দের কেউ ছাদে গেলে কি হত??’
— ‘আমি জানি যে এত রাতে বড়রা কেউ ছাদে যাবে না। সবাই অনেক টায়ার্ড ছিল। আমি তো ভেবেছি তুমিও আসবে না।’
— ‘বাহ্! আমি যাবো না জন্য এই সুযোগে মেয়েদের সাথে নটরপটর করা হচ্ছিলো?’
— ‘বাজে বকবে না। আমি কারো সাথে কিছু করিনি। যার সাথে করতে চাই সে তো কিছুই করতে দেয় না।’
— ‘আমি বাজে বকি? আমি?? আমি নিজ চোখে দেখেছি তোমাকে।’
— ‘তুমি তো দেখবাই। তুমি তো সব সময়ই চোখে বেশি দেখো।’
— ‘আমি বেশি দেখি?? গুড আজকে সকালে আমি এই নিউজটা ছোটমার কানে দিচ্ছি।’
— ‘নো। কখনোই এই কাজ তুমি করবে না। সহৃদয় হও জান। এমন পাষাণ হয়ো না।’
— ‘আমি পাষাণ তাই তো? ওকে ফাইন এবার দেখবা পাষাণ কাকে বলে!’
— ‘আ’ম স্যরি সোনা। ইউ’ল নেভার ডু দ্যাট প্লিজ.. জান।’
— ‘হুঁহ্! ছাড়ো আমাকে।’
— ‘না। এখন তোমাকে ছাড়তে পারবো না তাহলে আমার মাথা আরো ছিড়ে যাবে। তুমি মাথায় হাত বুলিয়ে দাও যাস্ট ফর ফাইভ মিনিটস! আমি একটু ঘুমাই। প্লিজ জান!!!’
— ‘পারবো না আমি। দেখি সরো।’
— ‘প্লিজ জান! অনলি ফর ফাইভ মিনিটস! প্লিজ!!’
সভ্য এতবার করে বলছে যে শুনে আমার মায়া লেগে গেল।
আমি বললাম,
— ‘খুব মাথা ব্যথা করছে?’
— ‘হুঁ, জান প্রচুর… যাস্ট ছিড়ে যাচ্ছে মাথাটা।’
— ‘গিলছো কতটা?’
— ‘প্রায় চারটার মতো হাইনকেন। তিনটা ফুল আর একটার অর্ধেকরও বেশি।’
— ‘বাহ্! খুব ভালো। কে এনেছে এগুলো?’
— ‘রাদিবরা…’
— ‘অসভ্যগুলো সব একসাথে হয়েছো তাই না?? তা তুমি এখনো ঠিক আছো কিভাবে?’
— ‘আমি তো ঠিক নাই, জান। যাস্ট ছিড়ে যাচ্ছে মাথাটা।’
— ‘আচ্ছা দেখি সরো। আমাকে উঠতে দাও।’
— ‘উঁহু! তুমি মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।’
— ‘না উঠলে দিবো কিভাবে? দেখি সরো।’
— ‘না, এভাবেই দাও।’
— ‘এভাবে দেয়া যাবে না সভ্য। ছাড়ো আমাকে।’
সভ্য সরে যেতেই আমি উঠে বসলাম। ফোন হাতে নিয়ে দেখি প্রায় পাঁচটা বাজে।
আমাকে বিছানা থেকে নামতে দেখে ও বললো,
— ‘আই নিউ ইট।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
— ‘হোয়াট…?’
— ‘ইউ আর অ্যা গ্রেট পল্টিবাজ।’
— ‘সভ্য!! বাজে বকবে না। কি করেছি আমি?’
— ‘মাথায় হাত না বুলিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছো। তাহলে আমাকে মিথ্যা বললে কেনো?’
— ‘মার খেতে চাও আমার হাতে??’
— ‘যাও লাগবে না।’
বলেই ও বিছানা থেকে উঠতে ধরলো।
ওকে উঠতে দেখে আমি বললাম,
— ‘খবরদার সভ্য এক পা মেঝেতে ফেলবে না। চুপচাপ শুয়ে থাকো। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।’
— ‘কোথায় যাবে তুমি?’
— ‘সেটা তোমার না জানলেও হবে। চুপচাপ শুয়ে থাকো আমি আসছি।’
বলেই আমি নিচে রান্না ঘরে চলে এলাম।
টমেটো জুস, লেবুর রস আর আধচামচ চিনি মিশিয়ে সভ্যর জন্য হ্যাঙওভার ড্রিংক বানালাম।
সভ্যকে নিয়ে দিতেই ও বললো,
— ‘থ্যাংকস, জান। এটা আমার প্রয়োজন ছিল।’
আমি বসতেই ও আমার কোলে মাথা এলিয়ে দিলো। আমি ওর চুলে আঙ্গুল চালিয়ে দিতে থাকলাম।
সভ্য এবার ওর মুখ আমার পেটে গুঁজে দিয়ে ঘুমস্বরে বলে উঠলো,
— ‘থ্যাংকস, জান। আরএকটু দাও… আমি ঘুমাই।’
সভ্য কথা বলার সময় ওর গরম নিঃশ্বাস আমার পেটে পড়ছিল তখন মনে হচ্ছিলো আমি দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো। দম বন্ধকর একটা অনুভূতি! এটা জড়িয়ে ধরার থেকেও কষ্টকর! না কষ্টকর না আলাদা… সত্যি আলাদা একটা অনুভূতি! যা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই।
কিছুক্ষণের মাঝেই সভ্যর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো। প্রথমে ওর ভারী নিঃশ্বাস গুলো দম বন্ধকর ও সুড়সুড়ি লাগছিল পরে আস্তে আস্তে সয়ে গেল।
ছেলেটা কত সুন্দর করে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে! ওর নিঃশ্বাসই বলে দিচ্ছে ওর ঘুমটা কতটা শান্তির!
===============
এরপর দিন গুলো খুব দ্রুত চলে যেতে লাগলো। আমার ছুটি শেষে ভার্সিটিতে চলে এলাম। সভ্যও ওর ক্যাডেট কলেজে চলে গেলো। আমি আমার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আর সভ্য ওর পরিক্ষা নিয়ে।
সেদিনের পর আর আমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়নি….
দেখতে দেখতে সভ্যর টেস্ট তারপর এইচএসসি শেষ হয়ে গেলো। পরিক্ষা শেষেই ওর জন্মদিন কিন্তু আমি যেতে পারলাম না। তখন আমার পরিক্ষা ছিল। এটা নিয়ে সভ্য আমার সাথে কোন ঝগড়াঝাঁটি করেনি। বরং ও নিজেই আমাকে বলেছে, ‘মন খারাপ করো না, জান। জন্মদিন পরের বছর আবার আসবে। তুমি আগে তোমার পরিক্ষা দাও।’
সভ্য ওর জন্মদিনের পরেই ঢাকায় চলে এলো কোচিং এর জন্য।
সভ্যর ছোট থেকেই স্বপ্ন বুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার কিন্তু ও মেডিকেল কোচিং শুরু করলো। আমরা সবাই এত করে বলার পরেও ও শুনলো না। ও মেডিকেল কোচিংই করবে। এত বছরের স্বপ্ন বাদ দিয়ে হঠাৎ মেডিকেল কোচিং করার কি কারণ সেটাও বললো না। ছেলেটা যে কেনো এত তেড়িয়া আর জেদি!!
সভ্য কারো ‘না’ না শুনে মেডিকেল কোচিংই করলো।
সভ্যর রেজাল্ট ছিল তব্দা খাওয়ার মতো। এইচএসসি আর মেডিকেল দুটো রেজাল্টই তাক লাগিয়ে দিলো। এইচএসসিতে বোর্ড স্ট্যান্ড করে টপ টেনে এলো আর মেডিকেলে সারা বাংলাদেশের মধ্যে চৌদ্দতম হল।
সভ্য ওর মেডিকেলের রেজাল্ট পেয়েই আমাকে ফোন করলো।
বললো,
— ‘আর ইউ হ্যাপি, জান?’
আমি উচ্ছসিত গলায় বললাম,
— ‘ইয়াহ আই এম… অনেক অনেক অনেক হ্যাপি সভ্য…আ’ম প্রাউড অফ ইউ..!’
— ‘থ্যাংকস, সুইটহার্ট। এর সবকিছুই শুধু মাত্র তোমার জন্য।’
সভ্যর কথা শুনে আমি অবাক হয়ে বললাম,
— ‘মানে? কি বলছো?’
— ‘যা শুনছো তাই বলছি। আমার সব কিছু শুধু তোমার জন্য। শুধু মাত্র তোমার জন্যই মেডিকেলে পরিক্ষা দিয়েছি। কারণ আমার জানের ড্রিম ছিল মেডিকেল আর আমি সেটা পূরণ করবো না?? অসম্ভব!’
সভ্যর কথা শুনে আমি কিছুই বলতে পারিনি। কি বলবো?? কোন ভাষা খুঁজে পাইনি বলার মতো। একটা মানুষ একজনকে কতটা ভালোবাসলে এতটা ডেস্পারেট হতে পারে??? সভ্য আমাকে ভালোবাসে সেটা আমি জানতাম। কিন্তু কতটা ভালোবাসে সেটা আমি প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলাম।
সভ্য নিজেই আবার বললো,
— ‘জান, আমার টুয়েন্টি ফাস্ট বার্থডের পরের দিনই আমরা বিয়ে করে ফেলবো ওকে?’
অতি সুখ আর খুশিতে আমি কান্না করে ফেললাম। আমার ফ্রেন্ডরা বার বার আমাকে বলছিল যে কি হয়েছে? আমি কোন কথা বলতে পারিনি। আমি একদম স্পিচলেস ছিলাম!
তারপরের দিন গুলো দ্রুত যেতে লাগলো। সভ্যর ঢাকা মেডিকেলে হয়ে গেলো। আমাদের দুজনের খুশি কে দেখে!! আমরা সময় পেলেই দেখা করতাম। সভ্য যখন তখন আমার ভার্সিটিতে চলে আসতো। এভাবেই আমাদের দিন যাচ্ছিল।
আমাদের ফোর্থ অ্যানিভার্সারিতে আমাদের চরম ঝগড়া লেগে গেলো। ঝগড়ার কারণ হল একটা সিলি থিংগ! অ্যা কিস…। সভ্য আবার জেদ শুরু করলো চুমু নিয়ে। আমি এত বড় হওয়ার পরেও কেন যেন ক্লোজ হতে অনেক ভয় পাই। আমি নিজে থেকে চেষ্টা করার পরেও, না নিজে চুমু খেতে পেরেছি আর না ওকে খেতে দিয়েছি। এই বিষয়টা নিয়ে আমি নিজেও প্রচুর ডিস্টার্ব। আমি ওকে কিছু বলতেও পারছিলাম না। কি যে করবো আমি ভেবেই পাচ্ছিলাম না।
তারপর থেকেই আমাদের যোগাযোগ কমতে থাকলো। সভ্য আমার থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো।
ওর ফাস্ট ইয়ার থেকেই ওর এত এত বান্ধুবি আর বড় আপু হল যে আমি ভয় পাওয়া শুরু করলাম। দিন দিন এর সংখ্যা বাড়তেই থাকলো। সভ্যর আশেপাশে এত এত ভীর হতে শুরু করলো যে আমার অস্তিত্ব ধীরে ধীরে ম্লান হতে লাগলো। আমার ভয় আস্তে আস্তে বাস্তবের রূপ নিচ্ছিলো।
আর আমি?? আমি জীবনে প্রথমবারের মতো সভ্যকে হারানোর ভয় পেলাম। আমি ভয় পাওয়া শুরু করলাম আমি বুঝি সভ্যকে হারিয়ে ফেললাম। এই বুঝি সভ্য আমার থেকে দূরে চলে গেল।
সময় তার গতিতে যাচ্ছে আর আমাদের রিলেশন কেমন খাপছাড়া। সেই আগের মতো আর নেই। লাস্ট ঝগড়ার পর আমরা হাতে গোনা মাত্র কয়েকবার দেখা করেছি। আর কয়েক মাস পরে আমাদের ফিফথ অ্যানিভার্সারি অথচ আমার সাথে সভ্যর সব কিছু কেমন শেষের পথে!
………………………..
(চলব)