শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা
২১তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
লাইব্রেরিটা তিনতালায় হওয়ায়, জনশুণ্য সিড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছিলো নবনীতা। দোতালায় পিনপতন নীরবতা, হঠাৎ হ্যাচকা টান অনুভব করে নবনীতা। কেউ তাকে টেনে বিল্ডিং এর এক ফাঁকা ক্লাসরুমগুলোর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দুপুরে ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ায় এখানে কাকপক্ষীর ও দেখা নেই। আকর্ষিক ভাবে ঘটনাগুলো ঘটে যাওয়ায় ঠিক কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে বুঝে উঠে না নবনীতা। সে চিৎকার করলেও কেউ তার চিৎকার শুনবে না। এখন লান্স টাইম, তাই বিল্ডিং এ কেউ নেই। পাশে কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে, নতুন বিল্ডিং উঠছে ফাইন আর্টস এর। এখন শ্রমিকেরাও খেতে গিয়েছে। নবনীতার বুকে উথাল পাথাল করছে। ভয় হচ্ছে। একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে এনে লোকটি তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে। নবনীতার কাঁধের ব্যাগটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নবনীতা এবার কিছুটা শান্ত হয়। এতোক্ষণ লোকটির মুখ দেখতে পারছিলো না। কিন্তু যখন তার মুখোমুখি দাঁড়ালো সে, নবনীতার মুখটা শক্ত হয়ে যায়, রুদ্র কন্ঠে বলে,
“এসব কি ফাজলামি হচ্ছে নীলয়?”
নীলয় নির্বিকার, সে এখনো নবনীতার বাহু শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে। শুধু সরু দৃষ্টিতে নবনীতার দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিন শান্তদের বাসায় ও সে সরু দৃষ্টিতেই তাকিয়ে ছিলো নবনীতার দিকে। শান্ত যখন নবনীতাকে নিয়ে আহ্লাদি রঙ্গ করছিলো তখনো নীলয় নির্বিকার ই ছিলো। আজ পাঁচদিন পর সে এরুপ আচারণ করবে সেটা কল্পনাও করে নি নবনীতা। নবনীতা একটা ব্যাপার লক্ষ করলো, তার নীলয়কে দেখে প্রচুর মেজাজ খারাপ লাগছে। এই ব্যাপারটা সেদিন ও লক্ষ্য করেছিলো নবনীতা। যতটুকু সময় নীলয় তার সামনে বসে ছিলো এক অজানা বিরক্তি তাকে ঘিরে ছিলো। এতোটা বিতৃষ্ণা হয়তো এই ইহজীবনে তার কোনো কালেই হয় নি। হয়তো নীলয়ের প্রতি সুপ্ত ঘৃণা কাজ করছে, সেকারনে এই সুন্দর মুখটাকেও সহ্য হচ্ছে না। নবনীতা নিজেকে ছাড়াতে উদ্গ্রীব হয়ে উঠলো। নীলয়ের হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর প্রচেষ্টা করলো কিন্তু পেরে উঠলো না। নীলয় অনড়, এবার নবনীতা বাধ্য হয়ে বললো,
“নীলয়, কি অসভ্যতামি হচ্ছে? তুমি যদি এখন না সরে যাও আমি কিন্তু চিৎকার করবো।“
“কে শুনবে?”
এতো সময় বাদে নীলয় মুখ খুললো। নির্বিকার বেপোরোয়া ভঙ্গিতেই কথাটা বললো নীলয়। কিন্তু নীলয়ের কন্ঠ শুনে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্তের স্রোত বয়ে গেলো নবনীতার। গাটা হিম ধরে আসছে। এই নীলয়কে সে চিনে না, এই চাহনী তার অচেনা। বুকটা হুট করেই কেঁপে উঠলো। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো নবনীতা,
“কি চাও তুমি?”
“উত্তর”
“কিসের উত্তর?”
“কেনো বিয়ে করলে তুমি শান্ত ভাইয়াকে? সবাই থাকতে শান্ত ভাইয়াই কেনো?”
নীলয়ের প্রশ্নটা শুনে তাচ্ছিল্ল্যের হাসি হাসে নবনীতা। নীলয়কে দেখে হাসি পাচ্ছে নবনীতার। একটা মানুষ কতোটা নিচে নামলে এরুপ প্রশ্ন করতে পারে। নবনীতার হাসি সহ্য হলো না নীলয়ের। কঠোর কন্ঠে বললো,
“কি হলো উত্তর দিচ্ছো না কেনো? কেনো শান্ত ভাইয়াকে ব্যে করলে তুমি? টাকার লোভে? নাকি আমার উপর প্রতিশোধ নিতে?”
নীলয়ের প্রশ্ন শুনে এবার শব্দ করেই হেসে উঠে নবনীতা, মৃদু হাসির ঝংকারে ঈষৎ কেঁপে উঠে ফাঁকা ক্লাসরুম। কি স্নিগ্ধ হাসি। নীলয় চেয়ে রয়, নবনীতার দিকে। এবার হাসি থামিয়ে নবনীতা বলে,
“আমার হাসি পাচ্ছে নীলয়, সত্যি হাসি পাচ্ছে। একটা মানুষ এতো প্যাথেটিক হতে পারে? তোমার কি মনে হয়, সবার জীবনের লক্ষ্য হয় টাকা নয়তো প্রতিশোধ? আর কিসের প্রতিশোধ নিবো বলোতো? আমি তো সেদিন ই ক্ষমা করে দিয়েছিলাম তোমাকে। তাহলে কিসের প্রতিশোধ। একটা কাপুরুষের উপর প্রতিশোধ নিতে আমার গায়ে বাধে। আর শান্তকে বিয়ে করার কথা বলছো, হ্যা আমি করেছি তাকে বিয়ে। কারণ তার সাথেই আমার জোড়া লেখা। আর আমি খুব সুখে আছি, ভাগ্যিস সেই সন্ধ্যা তার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। একজন লিবারেল চিন্তার মানুষকে আমি পেয়েছি। আমাদের মাঝে কিছুই কমন না, সব আনকমন। শুধু তাই নয়, তার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ছিলো অপ্রীতিকর। তবুও আজ আমি সুখী। তার উত্তর শুনবে? কারন সে আমাকে বিশ্বাস করে। মাত্র কয়েকদিনের চেনায় সে আমাকে বিশ্বাস করে, আমাকে আগলে রাখে। একটা কথা মাথায় রাখবে, পৃথিবীর ঘটমান সব কিছুর কারণ থাকে না, মাঝে মাঝে বিনা কারণে অনেক কিছুই হয়ে যায়। পেয়েছো উত্তর?“
নীলয় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অজান্তেই ছেড়ে দেয় নবনীতার কাঁধ। নবনীতার শীতল কন্ঠের কথাগুলো তার পৌরষত্বকে আঘাত করে। নবনীতা বদলে গেছে, এক মাসে নবনীতা বদলে গেছে। এখন সে তার নীতু নেই। সেই কোমল, শান্ত নীতু। যাকে এক জোড়া কদম ফুল দিলেই হেসে উঠতো। নীলয়ের কাছ থেকে ছাড়া পেতেই ব্যাগটা মাটি থেকে তুলে নবনীতা। আর এক মূহুর্ত এখানে থাকবে না সে। নবনীতা যেতে ধরলেই নীলয় বলে উঠে,
“কিন্তু বিশ্বাস ভাঙ্গলে সম্পর্ক যে ভেঙ্গে যায় নবনীতা। শান্ত ভাইয়া এতোও মহান পুরুষ নন, যিনি সব জেনেও তোমার সাথে সংসার করবে। বড়মার কথা তার কাছে বেদবাক্য। যদি সে তোমাকে বিয়েও করে থাকে সেটা শুধুমাত্র বড়মার কথায়। যে মানুষটাকে নিয়ে এতো বড়াই করছো, যেদিন সে বুঝতে পারবে তুমি কলুষিত, সেদিন সেই মানুষটাই তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে। কিভাবে প্রমান করবে তুমি তোমার পবিত্রতা?”
কথাটা শুনতেই মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো নবনীতার। ঘুরেই ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো নীলয়ের গালে। চড় টা অনেক আগেই মারা উচিত ছিলো, নবনীতা অনেক ধৈর্য্য ধরেছিলো। ভেবেছিলো নীলয় হয়তো তার ভুলটা বুঝবে। কিন্তু না সে মাত্রার পর মাত্রা ছাড়াচ্ছে। নবনীতার আকর্ষিক চড়ে, নীলয়ের কপালের শিরা ফুলে উঠে। রাগে তার শরীর কাঁপছে। একটা সামান্য নারীর হাতে চড়টা মেনে নিতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার। ঝাঝালো স্বরে বলে উঠে,
“তুমি, আমার গায়ে হাত তুললে?”
“হ্যা, তুললাম। এই চড়টা তোমার পাওনা ছিলো। এতোটা নীচু চিন্তার মানুষের সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো ভাবতেই ঘৃণা করে। আর একটা কথা শুনে রাখো, শান্ত তোমার মতো নীচু মনের নয়। তার কাছে শুধু শরীরটাই সব কিছু নয়। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও।“
নবনীতা এক মূহুর্ত দেরী না করে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। নীলয় সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তার মাথায় আগুন জ্বলছে। এর একটা হিল্লে না করে যেনো শান্তি নেই তার। সেও দেখতে চায় নবনীতার এই অহংকার কতো সময় টিকে।
_______________________________________________________________
রাত নয়টা,
শান্ত ঘরের কলিং বেল টিপে। আজ ফিরতে ফিরতে একটু দেরি ই হয়ে গিয়েছে। অসম্পূর্ণ কাজ গুলোর সমাপ্তি টানতে হয়েছে তার। তাই সময়ের দিকে খেয়াল ছিলো না তার। দরজাটা খুলেন হেনা বেগম। তার মুখখানা থমথমে। তিনি দরজা খুলেই ভেতরে চলে যান। মার মুখ দেখে শান্তের মনে প্রশ্ন জাগে, তাই টাইটা ঢিল করতে করতে বলে,
“কিছু হয়েছি কি মা?”
হেনা বেগম উত্তর দেন না। শুধু জিজ্ঞেস করেন,
“চা খাবে?”
“কফি হলে ভালো হতো।“
“বেশ আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।“
বলেই রান্নাঘরের দিকে চলে যান। রিপনের মা, তাদের পুরোনো কাজের লোককে গিয়ে বলেন,
“এক কাপ কফি করো, রিপনের মা। শান্ত খাবে।“
হেনা বেগমের আচারণ দেখে বুঝতে পারি রইলো না শান্তের, কিছু একটা বিরাট ঘটনা ঘটেছে। তখন ই দেখা মিলে সায়মার, স্নেহার কান ধরে অকারণে টানছে সে। সায়মার কোনো কাজের কোনো কারণ থাকে না। মাঝে মাঝে নিজের গুরুত্ব বোঝাতে মেয়েকে অহেতুক বকাঝকা করে অথবা মারুফের সামনে ন্যাকা কান্না কাঁদে। তাই সেদিকে নজর না দিয়ে শান্ত তাকে জিজ্ঞেস করলো,
“ভাবী, কিছু কি হয়েছে? মায়ের মুখটা কেমন শুকনো লাগলো?”
শান্তের প্রশ্নে সে স্নেহার কান ছেড়ে দেয়। তারপর লম্বা মুখটা আরোও ঝুলিয়ে বললো,
“কি আবার হবে? তোমার বউ, সেই বিকেল থেকে ঘরবন্দি হয়ে আছে। মা রিপনের মাকে দিয়ে দুবার ডেকেছিলোও কিন্তু উত্তর দেয় নি। সেটা নিয়েই হয়তো মন খারাপ। নিজের পছন্দের বউ বলে কথা।“
সায়মা আবার স্নেহার কাছে কুস্তাকুস্তি শুরু করলো। শান্ত এক মূহুর্ত দেনবনরি না করে নিজের রুমে গেলো। রুমের দরজা লাগানো। দুবার টোকা দিতেই দরজা খুলে দিলো নবনীতা। দরজা খুলে চলে গেলো সে চলে গেলো বারান্দায়। নবনীতার চোখ মুখ ফুলে রয়েছে। নবনীতার মূর্ছা যাওয়া মুখটা দেখে অস্থির হয়ে উঠে শান্ত। কোথাও যেনো ঝড় উঠেছে, অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করতে সে নবনীতার কাছে যায়, ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“নবনীতা, তুমি ঠিক আছো তো?”
শান্তের প্রশ্নে কি যেনো আছে, মেয়েটা হু হু করে কেঁদে উঠলো। নবনীতার এমন কান্না দেখে আলতো হাতে তার গালে হাত রাখলো শান্ত। ব্যাস্ত কন্ঠে বললো,
“কি হয়েছে? কাঁদছো কেনো?”
“মানুষ এতোটা নিচু কেনো হয় বলুন তো?”
হিচকি তুলে কথাটা বলে নবনীতা। এর পর ধীরে ধীরে নীলয়ের সাথে ঘটে যাওয়া সকল কথা খুলে বলে সে শান্তকে। নীলয়ের স্পর্ধা দেখে অবাক হচ্ছে শান্ত। এতোটা উদ্ধত কাজ কিভাবে করেছে সে। শান্তের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে, কিন্তু নবনীতার সামনে তা প্রকাশ করবে না। শীতল কন্ঠে বলে,
“মানুষ পেয়াজের মতো নবনীতা, তাদের প্রতিটা পরদে নতুন রুপ বের হয়। তুমি নীলয়ের সামান্য পরিবর্তনে এতোটা আহত হচ্ছো, এমন কত নীলয় এই সমাজে ঘুরে বেড়ায়। যার হিসেব তুমি করতেও পারবে না।“
নবনীতা চুপ করে হিচকি তুলতে থাকে। শান্ত আলতো হাতে তার চোখ মুছিয়ে দেয়, কপালে কপাল ঠেকায়। তারপর বলে,
“আমার বিশ্বাস এতো ঠুংকো নয় নবনীতা, আর আমি আমার কথা রাখতে জানি। তাই এই উটকো কথায় কান দিও না।“
শান্তের কথাটা যেনো নবনীতার বুকে শীতল পরশ বুলিয়ে যায়। এক উষ্ণ ওম ছুয়ে যায় মনের ব্যালকানিতে। হুট করেই শান্তের হাতের দিকে নজর যায় নবনীতার। খানিকটা অস্থির হয়ে বলে,
“আপনি ব্যাথা কিভাবে পেলেন?…………
চলবে