শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা ২০তম_পর্ব

শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা
২০তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

নবনীতা মাথা নাড়িয়ে বাসার কলিংবেল চাপলো। দরজা খুললো সায়মা। বসার ঘরে যেতেই পা জোড়া আটকে গেলো নবনীতার। হৃদস্পন্দন লাগাম ছাড়া হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীটা হুট করেই যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো তার। অতীতের একটা অধ্যায় বিনা ওয়ার্নিং এ সামনে চলে এলো তার। মুখ ফসকেই বেরিয়ে গেলো,
“নীলয়”

নবনীতার দৃষ্টি বসার ঘরের সাদা সোফাটার উপর। কারণ সেখানেই বসে রয়েছে নীলয়। বিশ দিন পর দেখছে নীলয়কে, বিশটা দিন। শেষ দেখেছিলো তাদের বিয়ের সন্ধ্যায়। নবনীতার মনে হলো, নীলয় একটু ও বদলায় নি। ঠিক সেই সন্ধ্যায় যেমন দেখেছিলো আজ ও ঠিক তেমন ই রয়েছে। সেই চোখ, সেই মুখমন্ডল, সেই চাহনী, সেই কন্ঠ। বদলেছে শুধু নীলয়ের হৃদয়টা। রঙ্গ বদলেছে সে। নীল ভালোবাসার মুখোশটা ছিড়ে ধূসর প্রতারকের চিত্ত বেড়িয়ে এসেছে। সুন্দর হৃদয়ের আড়ালে থাকা কুৎসিত চিন্তাধারারটা উঁকি দিয়েছে। যা বদলে দিয়েছে তাদের সম্পর্ক। নীলয়ের দেওয়া সেই কদম ফুলের পাপড়ি গুলো এখনো শুকায় নি, রয়েছে নবনীতার ডাইরি এর কোনো ছেড়া পাতার আড়ালে, অথচ সেই নীলয়টাই বদলে গেছে। ভুল বুঝে নবনীতাকে অসহায় করে চলে গিয়েছিলো সে। সেদিনের এক একটা উক্তি বিষের ন্যায় লেগেছিলো নবনীতার কানে। শুধু ভালোবাসার দোহাই দিয়ে তাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে নি। সেদিন তাকে সজোরে ঠাস করে চড় বসালে হয়তো সেই অপমানের একটা হিল্লে হতো। নবনীতা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কাপুরুষটাকে দেখছে, সরু চাহনীতে। কি সুন্দর, হেসে কথা বলছে সে। আচ্ছা কোন মুখে এই বাড়িতে এসেছে সে? সে কি জানে না? জানে না এখন এখানে নবনীতা থাকে? এখানে এলে নবনীতার সাথে দেখা হবে?

উবার ভাড়া দিয়ে বাসায় ঢুকে শান্ত। নবনীতাকে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয় শান্ত। প্রথমে বুঝতে না পারলেও যখন এগিয়ে ভেতরে যেয় তখন নবনীতার থমকে থাকাটা বুঝতে পারে সে। মূহুর্তেই চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে যায় তার। নীলয় হেনা বেগমের সাথে কথা বলছে। সায়মা রান্নাঘরে গিয়েছে। নাস্তা বানাতে হবে। এর মাঝে “ছোট চাচা” বলেই ছুটে আসে স্নেহা। ছুটে শান্তের কোমড় আকড়ে ধরে। এতক্ষণে হেনা বেগমের দৃষ্টি যায় ছেলে বউ এর দিকে। উঠে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। গদগদ কন্ঠে বলে,
“তোমাদের না পরশু ফেরার কথা ছিলো?”
“সাগরের অবস্থা ভালো নেই, ঝড় উঠেছে। তাই ফিরে আসা।“

নবনীতা এখনো স্থির দাঁড়িয়ে আছে। নীলয়ের হাস্যজ্জ্বল মুখখানা নিমিষেই ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে। নবনীতার দিকে ভুত দেখার মতো চেয়ে আছে সে। শান্ত একবার নবনীতার মুখশ্রীর দিকে চোখ বুলালো, তারপর উচ্ছ্বাসিত ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরলো নীলয়কে। তারপর অবাক কন্ঠে বললো,
“তোকে এখানে দেখবো কখনোই ভাবি নি, কেমন চলছে দিনকাল?”

নীলয় এখনো অন্যমনস্ক হয়েই দাঁড়িয়ে আছে। শান্ত তাকে জড়িয়ে ধরেছে, কথা বলছে তার যেনো খেয়াল নেই। তার দৃষ্টি নবনীতার দিকে। হলুদ শাড়িতে তার নীতু দাঁড়িয়ে আছে। আগে বলে বলেও হলুদ শাড়ি পড়াতে রাজি করাতে পারতো না নীলয়। নবনীতার বরাবর ই হলুদ রঙ্গটা অপছন্দ ছিলো। অথচ আজ সেই হলুদ শাড়িতেই দাঁড়িয়ে আছে নবনীতা। নীলয়কে নির্বিকার দেখে শান্ত ঈষৎ ধাক্কা দেয় তাকে, তারপর জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় হারিয়ে গেলি?”
“না…নাহ, কিছু না। আসলে মাস্টার্সের একটা এক্সাম পড়ে গিয়েছে। তাই ঢাকায় ফেরা। বড়মার সাথে দেখা হয় না অনেক দিন। তাই আসা। আসলে কাউকে না বলেই তো চলে গিয়েছিলাম।“
“এটা ঠিক, আমার বিয়েতে তোকে খুব মিস করেছি।“

শান্তের কথাটা শুনে ভ্রু কুচকে আসে নবনীতার। অন্য দিকে হেনা বেগমের মুখে স্মিত প্রসন্নতা দেখা যায়। ছেলেটা এতোদিনে তার ছাচে গড়ে উঠছে। কিভাবে মানুষকে ঠেস দিয়ে তার জ্বালার উপর নুন ছেটাতে হয় ভালোই জানে সে। শান্ত এবার হেনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে,
“মা, খুব ক্লান্ত লাগছে। নবনীতাও ক্লান্ত। ফ্রেশ হয়ে এসে গল্প করছি।“
“শিওর।“
“নীলয়, তুই কিন্তু খেয়ে যাবি। মার সাথে গল্প কর, আমি তোর ভাবিকে নিয়ে উপরে গেলাম।“

নীলয়কে কথাটা বলেই নবনীতার হাতটা শক্ত করে ধরে শান্ত। তারপর নীলয়ের সামনে দিয়ে তাকে নিয়ে যায় নিজের রুমে। নীলয় শুধু নীরব দর্শকের মতো দেখে যায়। নবনীতা কিছু বলে না, শুধু কাঠের পুতুলের মতো শান্তের পিছু পিছু চলে যায়। যতক্ষণ নবনীতার শাড়ির আঁচল টুকু দেখা যায় ততক্ষণ অবধি নীলয় তাকে দেখে যায়। কেউ ঠিক বলেছিলো,
“ভালোবাসাকে হারালে কষ্ট লাগে না, কিন্তু সেই ভালোবাসাকে অন্য কারোর আলিঙ্গনে দেখাটা যেনো সর্বাধিক কষ্টের। আর সেই তৃতীয় ব্যক্তি যদি নিজের ভাই হয় তবে তো কথাই নেই। কষ্ট টু দ্যা পাওয়ার ইনফিনিটি।“

নীলয় বুকের বা পাশে এক অসহনীয় ব্যাথা অনুভব করলো। নীলয়ের ফ্যাকাসে মুখটা দেখতে অজানা কারণেই ভালো লাগছে হেনা বেগমের। ব্যাপারটা পৈশাচিক। কিন্তু তবুও এক আনন্দ অনুভব হচ্ছে। নীলয়ের প্রতি বিন্দুমাত্র সিম্প্যাথি কাজ করছে না তার। দাঁত থাকতে যে দাঁতের মূল্য বুঝে না, তার সাথে এমনটাই হওয়া শ্রেয়। নীলয় কে দিশেহারা দেখে হেনা বেগম বলেন,
“নবনীতাকে দেখে অবাক হচ্ছো? হবার ই কথা। যে সন্ধ্যায় তুমি নবনীতাকে ফেলে চলে গিয়েছিলে, ঠিক সেই সন্ধ্যা আমি শান্তের সাথে নবনীতার বিয়েটা দেই। তোমার মুড সুইং এর দায় তো আমি কিংবা প্রিয়া নিবো না। মেয়েটাও ভেঙ্গে গিয়েছিলো। সেলিম ভাইয়ের শরীর ভেঙ্গে পড়েছিলো। একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে গেলে ঠিক কি পরিস্থিতির শিকার হতে হয়, তা তো তোমার জানা নেই। তাই শান্ত এবং নবনীতার বিয়েটা। আলহামদুলিল্লাহ, নবনীতা এখন স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। দেখো না, হানিমুন সেড়ে ফিরলো তারা।“

হেনা বেগমের কথাগুলো বিষের মতো লাগছে নীলয়ের কাছে। কেনো যেনো মনটা বিষিয়ে উঠেছে। প্রতিহিংসা নামক স্ফুলিংগ তার বুকে অগ্নিকান্ডের সূচনা করছে, ছাই চাপা আগুনের লেলিহান শিখাটা ধপ করেই জ্বলে উঠেছে। তার মনে হচ্ছে নবনীতা থাকে ঠকিয়েছে। যদি তা নাই হয়, তবে কেনো বিয়ে করলো সে শান্তকে, আর্থিক দিক থেকে শান্ত তার থেকে স্বচ্ছল। স্বচ্ছলতা দেখে মন গলে গিয়েছে নবনীতার। নয়তো যে মেয়ে নীলয় নীলয় করে মুখে ফেনা তুলে দিতো, সে আজ শান্তের সাথে দিব্যি সংসার করে যাচ্ছে। এই এক মানুষের সমস্যা, নিজের কৃত কর্মের ফলের জন্য ও অন্য কাউকে দোষ দিবে; সত্য টা মানতে নারাজ তারা। নীলয় তখন নবনীতার সাথে সকল সম্পর্কের ইতি টেনেছিলো তখন তার মনে একটি বার ও প্রশ্ন জাগে নি, নবনীতার কি হবে? কিভাবে নিজেকে সামলাবে নবনীতা। কিন্তু আজ তাকে হাসিখুশি থাকতে দেখে ঈর্ষা হচ্ছে তার। নীলয়ের কপালের রগটা লাগাচ্ছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রিত রাখছে সে। হেনা বেগম তার কাধে হাত রাখেন। ধীর স্বরে বলেন,
“আজ খেয়ে তারপর যাবে, আমি রুমে যাচ্ছি। বাতের ব্যাথার জন্য বসে থাকাটা অসহনীয় লাগছে।“

রুমে এসে কথা না বলে ওয়াশরুমে চলে যায় শান্ত। নবনীতা ঘরের থমথমে আবহাওয়ার সাথে পরিচিত। শান্ত খুব রেগে গেলে কথা থামিয়ে দেয়। আজ ও তাই হচ্ছে। সে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। শান্তের এই রাগের উৎস নীলয় এটা বেশ ভালো ভাবেই টের পাচ্ছে নবনীতা। এবং ইচ্ছে করে নিজেদের সম্পর্কের, নিজেকের মাঝের প্রণয়কে শো অফ করছে সে। নবনীতার কাছে শান্তের এই বাচ্চামি কাজ গুলো কেনো যেনো খুব ভালো লাগছে। সকল পুরুষের মাঝে একটা শিশু লুকিয়ে থাকে, শান্তের শিশুটি আজ বেরিয়েছে। মিনিট বিশেক বাদে একটা সাদা টিশার্ট এবং কালো থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে বেরিয়ে আসে শান্ত। চোখটা লাল হয়ে আছে। হয়তো এই পুরোটা সময় ঠান্ডা পানিতেই ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো সে। নবনীতা তার পাশ কাটিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করতে নিলে সে হিনহিনে কন্ঠে বলে উঠে,
“ওই বাস্টার্ডটাকে এখনো ভুলতে পারো নি তাই না?”

শান্তের এমন প্রশ্নে ঠিক কি উত্তর দেওয়া উচিত নবনীতার জানা নেই। তবে খুব হাসি পাচ্ছে। হিংসুটে লোকটার এমন বাচ্চামী প্রশ্নে যে কারোর হাসি পাবে। কিন্তু সে হাসলো না, বরং মুখে মেকি গাম্ভীর্য এনে বললো,
“নীলয় তো বাস্টার্ড নয়, তাকে বাস্টার্ড বলার যুক্তি আমি পেলাম না। বাস্টার্ড এর বদলে ইডিয়ট, গাধা, রাম ছাগল, হাদারাম, কাপুরুষ, এই বিশেষণ গুলো বেশ মানাবে।“
“আশ্চর্য আমি তোমাকে একটা সিরিয়াস প্রশ্ন করছি, আর তুমি বিশেষণ শেখাচ্ছো আমাকে? ফাজলামি করার সময় খুজে পেলে না।“
“আমি তো ফাজলামি করছিনা, ফাজলামি করলে আমি হাসতাম, আমি কি হাসছি?”
“নবনীতা??”
“বলুন”
“ধ্যাত”

বলেই ব্যালকনিতে চলে যায় শান্ত। মেয়েটা এতোটা অবুঝ কেনো বুঝে পায় না শান্ত। কোথায় তার জান আটকে আছে, নবনীতার প্রেমিক ফিরে এসেছে কথাটা ভাবলেই মাথায় আগুন জ্বলছে। আর মেয়েটা এখানে ফাজলামি করছে। সিগারেটে আগুন জ্বালিয়ে একের পর এক সুখটান দিয়েই যাচ্ছে শান্ত। এর মাঝে অনুভব করলো কেউ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শান্ত পেছনে না ফিরেই বললো,
“কি চাই?”
“কিছু বলতে চাই?”
“বলো।“
“আগে সিগারেটটা ফেলুন, বলছি।“

নবনীতার আকুতির সুর ফিরিয়ে দেবার মতো শক্ত শান্ত না, তার সিগারেট ফেলে তার দিকে তাকায় সে। তারপর হিনহিনে স্বরে বলে,
“এবার কি মহারাণী ভিক্টোরিয়া কথাটা বলবে?”
“কথাটা বেশি বড়ো না, ছোট একটা কথা। তা হলো, অহেতুক জ্বলবেন না। অতীত, অতীত ই হয়। সেটাকে বর্তমানে মিশিয়ে সেটাকে জলঘোলা করবেন না।“

বলেই নবনীতা ভেতরে চলে যায়। নবনীতার ঠান্ডা কন্ঠের বলা কথার মর্মার্থ বুঝতে দেরি হলো না শান্তের। নবনীতা চলে গেলে এক প্রশান্তির হাসির প্রলেপ ফুটে উঠে তার ঠোঁটে। তারপর বাহিরের দিকে তাকিয়ে প্রসন্নচিত্তে সিগারেটের জ্বলন্ত ধোয়া সেবন করে শান্ত। আজ আকাশটা যেনো পরিষ্কার লাগছে। চাঁদের পাশের তারাগুলো নেই। স্নিগ্ধ চন্দ্রিমা________________

ক্লাস শেষ হতে হতে প্রায় দেড় টা বেজে যায় নবনীতার। আড়াইটায় ল্যাব আছে। হাতে আছে এক ঘন্টা। খাওয়া শেষে লাইব্রেরির দিকে রওনা দেয় নবনীতা। এই সময়টা বিল্ডিং টা একেবারেই জনশুন্য থাকে, সবাই নিজ নিজ হোস্টেল কক্ষে বিশ্রাম নেয়, নয়তো ক্যান্টিনে সময় কাটায়। দুপুর দেড় টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত কেউ থাকে না বললেই চলে লাইব্রেরি বিল্ডিং এ। শুধু অফিসের কিছু মানুষ, তারাও ঘুমে ঢুলে। লাইব্রেরিটা তিনতালায় হওয়ায়, জনশুণ্য সিড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছিলো নবনীতা। দোতালায় পিনপতন নীরবতা, হঠাৎ…………

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here