শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা
১৯তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
লাইফগার্ডরা খুব কষ্টে মেয়েটাকে তুলে এনেছে। কথাটা শুনতেই বুক কেঁপে উঠে শান্তের। দম বন্ধ হয়ে আসছে শান্তের। এতোটা ভয় কখনোই পায় নি সে। পা জোড়া বালিতে আটকে গেছে যেনো ভয়ে। এগোতেই চাচ্ছে না। খুব কষ্টে এগিয়ে যায় শান্ত। ভিড় ঠেলে মেয়েটার কাছে যেতেই দেখে নীল শাড়ি পড়া এক নারীকে মাত্র তীরে আনা হয়েছে। এমবুলেন্স কল করা হয়েছে। মেয়েটার অবস্থা খুব সূচনীয়। মেয়েটির মুখ দেখেই ধপ করে বালিতে বসে পড়ে শান্ত। ছেলেরা সাধারণত ভেঙ্গে পড়ে না। শান্তের মতো ছেলেরা তো নয় ই। কিন্তু আজ যেনো সে নিজের মাঝেই নেই। খুব কষ্ট হচ্ছে, উত্তেজনায় হৃদয় যেনো ফেটে যাবে। ভিড়ের ভেতর মুখটা দেখা যাচ্ছিলো না মেয়েটির। আঁচল এক অংশ দেখতে পাচ্ছিলো শান্ত। তাই ভয়টা গাঢ় হয়ে উঠেছিলো। রীতিমতো বুকটা লাফাচ্ছিলো তার। দম আটকে যাচ্ছিলো। গলার কাছের দলা পাকিয়ে যাচ্ছিলো অনুভূতিগুলো। কারণ নবনীতাও নীল শাড়ি পড়েছিলো। মুখ না দেখা অবদি সে শুধু একটা দোয়া করছিলো। মেয়েটি যেনো নবনীতা না হয়। মুখ দেখার পর বুক চিরে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস বের হলো। বুকের ভেতরে উঠা ঝড় হুট করেই থেমে গেলো। মেয়েটি নবনীতা হয়। তবুও তার হাত পা এখনো কাঁপছে। মানুষ জন ভাবলো শান্ত বোধ হয় মেয়েটির কেউ। তারা শান্তনা দিতে লাগলো শান্তকে। এম্বুলেন্স এলে সবাই ধরে ধরে মেয়েটিকে উঠিয়ে দেয়। এতো সময় পর মেয়েটির স্বামী এসে পৌছিয়েছে। তার অবস্থা করুন। চোখ মুখ ফুলে গিয়েছে। শান্ত অবাক নয়নে ছেলেটির কর্মকান্ড দেখছে। মধ্যবয়স্ক একটা ছেলে এতো লোকের মাঝে হাউমাউ করে কাঁদছে, পাগলামী করছে। কারণ তার ভালোবাসার মানুষটি মৃত্যুর সাথে লড়ছে। মেয়েটির বয়স কতোই বা হবে, বাইশ তেইশ; নবনীতার মতোই বয়স। অথচ সেই মেয়েটার জীবন প্রদীপ নিভতে চলেছে। শান্ত এখনো সেই যুবকের দিকেই তাকিয়ে আছে। কারণ যুবকটির মাঝে সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। কিছুক্ষণ পূর্বে যখন সে ভেবেছিলো সাগরে ভেসে যাওয়া মেয়েটি হয়তো নবনীতা,তার অবস্থাও ঠিক এমন ই হচ্ছিলো। তবে কি সে নবনীতাকে ভালোবেসে ফেলেছে। হয়তো, না হয়তো না; সে নবনীতাকে ভালোবেসে ফেলেছে। ভালোবাসাটা খুব অদ্ভুত, কখন কার প্রতি জন্মায়, বলাটা খুব কঠিন। কোনো কারণ প্রয়োজন হয় না, এই ভালোবাসতে। নবনীতা শান্তকে সর্বদাই আকর্ষণ করতো, কিন্তু তার প্রতি অনুভূতিগুলো ছিলো বিক্ষিপ্ত। শান্ত এই অনুভূতিগুলো আজ বুঝতে পারছে। সেদিন যখন নবনীতা শপিং মলে হারিয়ে যায় তখন ও শান্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু সেই উত্তেজনার কারণটা ঠিক ঠাহর করতে পারে নি সে। তার পারছে, পারছে বলেই হয়তো বিক্ষিপ্ত অনুভূতিগুলোকে সাজাতে পারছে। কেউ একজন শান্তকে বলেছিলো,
“ভালোবাসা একটা রোগ, এই স্পর্শকাতর অনুভূতিটা অদেখা ভাইরাসের মতো। অজান্তে, মনের অগোচরেই মনে বিস্তারলাভ করবে। যখন সিম্পটোমগুলো প্রকাশ পাবে, তখন তুমি বুঝতে পারবে তোমার প্রেমরোগ হয়েছে। এই রোগের ঔষধ নেই, থাকলে কোনো মানুষ প্রেমে পড়তো না।“
শান্ত হাটুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। নবনীতাকে খুঁজতে হবে তার। তার শ্যামলীর অভিমান ভাঙ্গাতে হবে। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সি বিচ তন্ন তন্ন করে খোঁজার পর ও নবনীতাকে খুঁজে পেলো না শান্ত। এই এক সমস্যা কক্সবাজারের। একত্রে না থেকে একবার দলচ্যুত হলেই হারিয়ে যেতে হয়। নবনীতার কাছে মোবাইল ও নেই, যে শান্ত তার সাথে ফোনে যোগাযোগ করবে। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে যখন হোটেলের দিকে পা বাড়ালো শান্ত। তখন সে ব্যর্থ সৈনিক। হয়তো যুদ্ধে পরাজিত হলেও নিজেকে এতোটা অসহায় লাগতো না তার। সারাদিনে কিছুই পেটে পড়ে নি তার। হাত পা অসাড় হয়ে এসেছে। হতেলে যেতেই ইচ্ছে হচ্ছে না, কিন্তু হোটেলে যেতে হবে। একটু ফ্রেশ হয়ে থানায় যাবে, মিসিং রিপোর্ট লিখতে। হোটেলের কাছে আসতেই শান্তের পা আটকে যায়। মূহুর্তেই চোখ ভিজে আসে। এতোক্ষণ যে ভয়, চিন্তাগুলো মনে মাঝে পুষে রেখেছিলো একত্রে সব কিছু নয়নে এসে ভিড় করেছে। হোটেলের ঠিক সামনে নবনীতা দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখ ফুলে গিয়েছে, হয়তো খুব কেঁদেছিলো মেয়েটা। মুখে ক্লান্তির ছাঁপ স্পষ্ট। হয়তো তার ও কিছু খাওয়া হয় নি। নবনীতা ছলছল নয়নে শান্তের দিকে তাকালো। নবনীতাকে পেয়ে বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো শান্তের। নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না সে। ছুটে গিয়ে বাহুবেষ্টনীতে নিলো নবনীতাকে। যতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে সে হারিয়ে যাবে না, ততটাই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অশ্রু ছেড়ে দিলো সে। শান্তের এমন তড়িৎ গতিতে জড়িয়ে ধরাতে ঈষৎ কেঁপে উঠে নবনীতা। কিন্তু কিছু মূহুর্তবাদেই সে শান্ত হয়ে যায়। মিশে থাকে তার দাঁড়িওয়ালা হনুমানের বুকের সাথে। অজানা কারণেই খুব শান্তি লাগছে নবনীতার। হয়তো শান্তের হৃদস্পন্দনটুকু অনুভব হচ্ছে তার। সারাটা দিন উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটেছে সে। ছুটেছে তার শ্যামলীকে খুঁজতে। ছুটেছে নিজের শ্যামলীর অভিমানের ঘড়াটা ভাঙ্গতে। নবনীতাকে বুকে মিশিয়ে কাঁপা স্বরে বললো,
“আমি আগে বিশ্বাস করতাম না ভালোবাসায়, বিশ্বাস করতাম না পাগলামীতে, বিশ্বাস করতাম না কারোর জন্মানো অবাধ অনুভূতিকে। ভাবতাম সব নিছক কাব্যিক কথা। নিছক মানুষের কল্পনা, বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলা। কিন্তু আর অনুভব করেছি। অনুভূতি বাধ ছাড়ালে দম আটকে আসে, এই অনুভূতির পরিচয় আজ পেয়েছি। তুমি হীনা আমার বিবর্ণ জীবনের ঝলক পেয়েছি। আমি নামক স্বত্তাটি যে অসহায় হয়ে পারে আজ বুঝতে পেরেছে। একটা উপকার করো আমাকে, কখনো আমাকে ফেলে যেও না। আমি সত্যি পারবো না সামলাতে।“
শান্ত এর আকুতি ফিরিয়ে দেবার জো নেই নবনীতার। সে তাই নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো আলতো হাতে শান্তএর পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো সে। সময় কেঁটে যাচ্ছে, কালো মেঘেরা আবার দল পাকিয়েছে। বৃষ্টি শুরু হবে, ভালোবাসার স্নিগ্ধ পরশ ছুয়ে যাবে পর্যটন নগরীতে।
নবনীতার মুখোমুখি বসে রয়েছে শান্ত। শান্ত ধীরে ধীরে সব খুলে বললো নবনীতাকে। শান্তের সব কথাগুলো নবনীতা শান্ত হয়ে শুনলো। তখন হুট করেই মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিলো তার। তাই তখন শান্তের কোনো এক্সপ্লেনেশন ই তার মস্তিষ্ক শুনতে রাজি ছিলো না। এখন যখন মাথাটা একটু শান্ত হলো এখন শান্তের প্রতিটা কাজ ই যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে তার। সব কিছু খুলে বলার পর শান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। নবনীতার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে সে এগিয়ে গিয়ে নবনীতার সামনে হাটু গেড়ে বসলো। আলতো হাতে তার হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিলো। তারপর কোমল স্বরে বললো,
“যা কিছু হয়ে যাক, আমি কখনোই তোমাকে অবিশ্বাস করি নি নবনীতা। আমি শুধু সত্যিটা জানতে চেয়েছি। আমি আগেও বলেছি। তোমাকে কাউকে কিছু প্রমাণ করতে হবে না। আমার ই ভুল হয়েছিলো। যখন তুমি চাইছিলে না, তখন আমার আগানো উচিত ই হয় নি। ভুলটা আমার ছিলো। আর কেনো ভয় পাচ্ছো তুমি, আমি তো আছি। আমি থাকবো। চিরটাকাল, যতদিন শ্বাস চলবে। আমি থাকবো। একটু বিশ্বাস করে দেখ“
“আমার যে নিজের উপর ই বিশ্বাস হচ্ছে না, শান্ত। অন্য কেউ কি বিশ্বাস করবে।“
“আমি তো করছি, আমি তো করছি তোমাকে বিশ্বাস। তুমি এই ভয়টাকে নিজেকে গ্রাস করতে দিও না। যা হয়েছে তা কেবল ই অতীত। কোন অপ্রিয় জিনিস তোমাকে ছুতে পারবে না। আমি এই সব ভিডিও ডিলেট করে দিবো। সব ইনভেস্টিগেশন থামিয়ে দিবো। তুমি না চাইলে কিছু হবে না।“
নবনীতা নত মস্তকে বসে রইলো। সে কাঁদছে। অজানা কারণে বুকটা ভারী হয়ে এসেছে। শান্ত উঠে গিয়ে পাশে বসে নবনীতার। কাঁধ আগলে বুকে নেয় তার শ্যামলীকে। শান্তের বেষ্টনীতে মন্দ লাগছে না, আরেকবার শান্তকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় নবনীতার। লোকটির মাঝে কিছু একটা ব্যাপার আছে। একই সাথে তাকে বিরক্তিকর এবং ভালো লাগে নবনীতার। শান্ত নবনীতাকে সব বললেও তাকে যে একটি লোক ফলো করছে সেটা বেশ সুন্দর করে লুকিয়ে গিয়েছে। কারণ অহেতুক কথাটা বলে নবনীতাকে ভয় দিতে চাচ্ছিলো না শান্ত। এতোকাল নবনীতাকে যে ফলো করেছে সে শান্তের লোক ছিলো কথাটা জেনে বেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে সে, তাই আবার তাকে একটা ভয়ের মাঝে রাখবে না শান্ত। কিছু কথা গোপন থাকাটাই শ্রেয়। তার শ্যামলীকে তার অগোচরেই সামলে রাখবে শান্ত। কিছু কথা অজানাই থাক।
রাতে অঝর ধারায় বর্ষণ হয়েছে। ভাদ্র মাসেও এমন বর্ষণ এ যেনো দূর্লভ ব্যাপার। এসি ঘরে ঠান্ডাটা যেনো আরও বেশি ছিলো। শান্তের ঘুম ভাঙ্গে ঠান্ডার কারণেই। চোখ খুলতেই নিজের বুকে লেপ্টে থাকা নবনীতার ঘুমন্ত মুখটা চোখে পড়ে তার। স্নিগ্ধ শ্যামা মুখখানা দেখেই মনটা ভালো হয়ে যায়। আজ ঢাকা ফিরবে তারা। কক্সবাজারটা ঘোরা আর হলো না। অন্য কোনো সময় না হয় ঘুরবে তারা। তবে একটা উপকার হয়েছে এই ট্যুরে। শান্তের আরোও নিকট চলে এসেছে নবনীতা। এখন নিজেদের একটা জোড়া মনে হচ্ছে তার। একটা সত্যিকারের দম্পতি। কথাটা ভাবতেই ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে শান্ত এর। ব্যালকনি থেকে কোমল প্রভা আলোকিত করছে ঠান্ডা ঘরটি। সূর্যের আলোকছটা খেলা করছে নবনীতার কোমল বাহুতে। শান্তের একটু হিংসে হলো। তার বউ এর দেহে কি সুন্দর অকপটে বিস্তার এই কিরণের। তাই তার ও ছুয়ে দিতে ইচ্ছে হলো নিজের শ্যামলীকে। নবনীতার কপালে আসা চুল গুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিলো সে। উষ্ণ অধর ছোঁয়ালো নবনীতার ললাটে। যেনো কিরণের সাথে তার এক অকথিত প্রতিযোগিতা চলছে। নবনীতা তখনো ঘুমে কাঁদা। শান্ত বিছানা ছাঁড়লো। ঢাকার অমিমাংশিত কাজ গুলো দ্রুত শেষ করতে হবে তাকে। নবনীতাকে নিজের করতে হলে আগে তাকে আঘাত করা বস্তুগুলোকে সমূলে শেষ করতে হবে। নয়তো মেয়েটির মনে নিজের জায়গাটা কখনোই করা হবে না। শান্ত নবনীতার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“শ্যামলী, কোনো কুচিন্তা তোমাকে ছুতে পারবে না। কোনো কুনজর তোমাকে দেখবে না। তুমি কেবল আমার ঘরের আলো হয়েই থাকবে। যাকে শুধু আমি দেখবো”
_______________________________________________________
রাত নয়টা,
বাসায় পৌছালো অবশেষে শান্ত এবং নবনীতা। টানা বারো ঘন্টা জার্নি। রাস্তায় এতো জ্যাম জানলে প্লেনে টিকেট কাঁটতো শান্ত। নবনীতার মাজা ধরে এসেছে। এখন রুমে গিয়েছে গা এলিয়ে দিবে সে। শান্ত উবার বিল দিতে দিতে বললো,
“তুমি ভেতরে যাও আমি আসছি”
নবনীতা মাথা নাড়িয়ে বাসার কলিংবেল চাপলো। দরজা খুললো সায়মা। বসার ঘরে যেতেই পা জোড়া আটকে গেলো নবনীতার। হৃদস্পন্দন লাগাম ছাড়া হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীটা হুট করেই যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো তার। অতীতের একটা অধ্যায় বিনা ওয়ার্নিং এ সামনে চলে এলো তার। মুখ ফসকেই বেরিয়ে গেলো,
“নীলয়………
চলবে