শুভ্র_রঙের_প্রেম
পার্ট:০৭
#রুবাইদা_হৃদি
অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পর থেকেই একরাশ মন খারাপ নিয়ে বসে আছি গুটিশুটি মেরে ৷ চুপ করে বসে সামনে থাকা চিরকুটের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে আছি ৷ অচেনা মানুষটার জন্য বড্ড কষ্ট হচ্ছে ৷ শেষ সময়টুকু আমার মাথায় ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে ৷ মাথায় ব্যাথা করছে ৷ সেই মানুষটা স্নিগ্ধ স্যার..! যদি হয়ে থাকেন তাহলে লুকোচুরি কেন?? নানা প্রশ্নে জর্জরিত মনের কোঠায় ৷ পাশেই নীতি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ৷ কোথায় থেকে কোকিল ডাকতেই চমকে উঠি আমি ৷ সেই সাথে ফজরের আজানের সুর ভেসে আসে ৷ তার মানে আজ বসন্ত৷ হঠাৎ করেই তীব্র মন খারাপ কেটে যায় কোকিলের মিষ্টি সুরে ৷ আমি বেড থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই ৷ ভোরের আলো ফুঁটে নি এখনো চারদিকে আবছা অন্ধকারে হলের পাশের লাল লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল গুলো অন্ধকারে থোকা থোকা হয়ে নিদারুণ ভাবে ফুঁটে আছে ৷ হালকা কুয়াশায় মোড়ানো ভোরটা অতিরিক্ত সুন্দর ৷ আমি রুমে ফিরে গিয়ে শালটা জড়িয়ে বেরিয়ে যাই কৃষ্ণচূড়ার গাছের নিচে ৷
গাছের নিচে কেও একজন দাঁড়িয়ে আছেন ৷ তাকে দেখে ভয় পেয়েও হাফ ছেড়ে সামনে এগিয়ে যাই ৷ মৃদু ঠান্ডায় কাঁপানো ভাব চলে এসেছে ৷ কেঁপে উঠা ঠোঁটে সামনে মানুষটিকে বললাম, ‘ভোররাতে এখানে আসার কারণ কী ?? ‘
–‘ বসন্তের আগমণে শুভ্রতায় ঘেরা সুন্দর সকালের প্রথম ভালোবাসার প্রহর গুনতে৷ ‘
আমি চমকে উঠে আবছা আলোয় দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখলাম৷ ব্রাইট কালারের শার্ট পড়ে হাতা ফোল্ড করে দাঁড়িয়ে আছেন স্নিগ্ধ স্যার ৷ ধূসর আলোতে তাকে ভোরের স্নিগ্ধ পুরুষের খেতাব দেওয়ার ইচ্ছা হচ্ছে আমার ৷ আমি শীতল কন্ঠে আবার বললাম, ‘ কাওকে খোজার জন্য এসেছেন?? ‘
উনি নিজের চুল গুলোতে আঙুল চালিয়ে বললেন,
–‘ যাকে খোজার ছিলো সে এসে গেছে ৷ ‘
–‘ মানে?? ‘ আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করতেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
–‘ বসন্ত এসে গেছে ৷ ‘
আমি এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছি ৷ উনি পেছনে ঘুরে মিষ্টি সুরে বললেন, ‘ ভালোবাসা আর বসন্তের নতুন প্রহর দেখবে?? ‘
আমি ছোট ছোট চোখে করে তাকিয়ে আছি ৷ হেলে থাকা কৃষ্ণচূড়ার ডালের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন উনি হাত বাড়িয়ে কিছু কৃষ্ণচূড়া ছিড়লেন আমার দিকে বাঁড়িয়ে দিয়ে বললেন,
–‘ সংরক্ষিত ভালোবাসার উপহার ৷ ‘
আমি বিষ্ময় নিয়ে হাত বাড়িয়ে ফুল গুলো নিলাম ৷ বিন্দু বিন্দু শিশির মুক্তোর মতো পরে আছে লাল রাঙা ফুলের উপর ৷ আঙুলের ডগায় ছোঁয়া লাগতেই আনন্দে মন নেচে উঠে ৷ আমার চোখে-মুখে খুশিরা উঁপচে পড়ছে ৷ কেও একজন স্নিগ্ধ চোখে সেই খুশি উপভোগ করছে সেটা আমি খেয়াল না করেই ঝলমলে গলায় বললাম,
‘ ধন্যবাদ স্যার ৷ ‘
–‘ সূর্যের প্রথম কিরণে নিজেকে রাঙাবে না?? ‘
আমি ফুল থেকে চোখ সরিয়ে সরাসরি উনার মুখের দিকে তাকালাম ৷ সে একদৃষ্টিতে আমার হাতে রাখা ফুলের দিকে তাকিয়ে আছেন ৷ আমি উৎকন্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘ আপনি এখানে কেন সেটা তো বললেন না?? ‘
–‘ I’m not obliged to answer your question. ‘
–‘ বাট হোয়াই স্যার ?? ‘
–‘ বারবার প্রশ্ন করো কেন?? আ’ম ইউর স্যার৷ রেস্পেক্ট মাই অপিনিয়ন৷ ‘
আস্ত একটা ইংরেজ ৷ আমি বিরবির করে বলতেই উনি ভ্রুকুটি করে বললেন, ‘ কিঁছু বললে?? ‘
আমি মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে সামনে পাঁ বাড়ালাম হালকা গাম্ভীর্য নিয়ে বললাম,
–‘ নাথিং স্যার৷ সূর্য ওঠার সময় হয়ে গেছে প্রায় ! ক্যাম্পাসের পূর্ব দিকে চলুন সুন্দর ভিউ পাওয়া যাবে ৷ ‘
পাশাপাশি আমি আর স্নিগ্ধ স্যার হেঁটে চলেছি ৷ অদ্ভুত শিহরণ দোলা দিয়ে যাচ্ছে ৷ লোকটা গম্ভীর আর স্বল্পভাষী তবে রোম্যান্টিক অনেক ৷ হি হি উনার বউ যদি জানে বসন্তের সকালে অচেনা রমণীর সাথে সূর্যের প্রথম কিরণকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে তাহলে নির্ঘাত চুল টেনে হাতে ধরিয়ে দিবে ৷ ভেবেই দমফাটা হাসি পেলো আমার ৷ আমাকে মিটিমিটি হাসতে দেখে ঘুরে তাকিয়ে কঁপাল কুঁচকে বললেন, ‘ কি হয়েছে হাসছো কেন??’
–‘ স্যার আপনি বিয়ে করেছেন?? ‘
আমার কথা শুনে কুঁচকানো কঁপাল আরো কুঁচকে ফেললেন উনি৷ তারপর স্বাভাবিক হয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
–‘ হ্যাঁ করেছি ৷ ‘
কথাটা কেমন বিতৃষ্ণাময় শোনালো আমার কাছে ৷ হঠাৎ করেই শব্দটা বড্ড ভারী ঠেকলো ৷ অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে আছি পূর্বদিকের একদম শেষ প্রান্তে ৷ কখন যে সূর্য উঁকি দিয়ে পৃথিবীরর কোলে নিজের অস্তিত্ব জানান দিলো সেটা আর দেখা হলো না ৷ কোমল আলো উনার চোখে মুখে লালাভ আভা ছড়াচ্ছে ৷ তারমানে উনি বিবাহিত?? ভাবতেই কেমন কষ্ট লাগলো ৷ চিরকুট আর শাড়ি তাহলে উনি দেননি?? আমার কেন হঠাৎ কষ্ট হচ্ছে?? কষ্টের কারণ অজানা তবে কষ্টাটা তীব্র বেদনাদায়ক ৷
__________
–‘ যাবি না?? ‘
–‘ তুই চলে যা প্লিজ৷ আমার কিছু ভালো লাগছে না ৷ ‘
উদাসীন উত্তর শুনে নীতি বিরক্তি নিয়ে তাকালো ৷ বসন্ত বরণের অনুষ্ঠানের জন্য ভার্সিটি বন্ধ কিন্তু বড় অনুষ্ঠান হবে মাঠপ্রান্তরে ৷ যেখানে, হাজারো রঙিন পোশাকের ভীড়ে বসন্তেকে সাদরে গ্রহণে মেতে উঠবে সবাই ৷ নীতি আমার হাত ধরে টেনে ঝাঁঝালো কন্ঠে আবার বলল,
–‘ তুই না গেলে আমিও যাবো না ৷ উদাস হয়ে ব্যার্থ প্রেমিকার মতো দীর্ঘশ্বাস ছাড়বো৷ ‘
— ‘ ওখানে রাহাত সাথে সবাই থাকবে চলে যা তুই ৷ বিরক্ত করিস না৷ ‘
–‘ কি হয়েছে বাবু?? ‘ নীতি আদুরে স্বরে বলতেই আমি ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বাইরে সেই কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকালাম ৷ ধীর কন্ঠে বললাম,
–‘ স্নিগ্ধ স্যার বিয়ে করেছেন৷ ‘
–‘ কিহহহহহ..! ‘ আমার কথা শুনে নীতি চিৎকার করে উঠলো ৷ আমার থেকে বেচারি শক পেয়েছে বেশি ৷ আমি ম্লানমুখে বললাম,
–‘ দোস্ত বুকে চিনচিন করছে ৷ ‘
–‘ তুই প্রেমে না পরেই ছ্যাঁকা খেয়ে বাঁকা হয়ে গেছিস! হায় আল্লাহ ৷ বাট দ্যা বিগ কোয়েশ্চন ইজ, তোর শুভ্র প্রেমিক কে?? ‘
আমি কাতর কন্ঠে বললাম, ‘ হঠাৎ করেই স্নিগ্ধ স্যারের উপর প্রেম প্রেম পাচ্ছে আমার ৷ ‘
–‘ ব্যাটা ইংরেজেরে হাজারটা বউ থাক উনাকে তোর হতেই হবে কিন্তু তোর শুভ্র প্রেমিকের কি হবে??সেটা ভেবে আমার দুঃখ দুঃখ পাচ্ছে৷ ‘
দুইজনেই হেসে ওঠা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম৷ কিছুক্ষণ চুপ থেকে পুরো দমে বসন্তকে বরণের জন্য বাসন্তী রঙের সুতোয় ডিজাইন করা সুতির সাদা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ছুটলাম মাঠে প্রান্তরে ৷ সকালের ঘটনা নিমিষেই মাথা থেরে বের হয়ে গেলো কোলাহলে গিয়ে।
চারদিকে হাজারো মানুষের ভীর ৷ ঝড়ে যাওয়া গাছের মাথায় উঁকি দিয়ে আছে সতেজ সবুজ কঁচি পাতা ৷ বসন্ত বসন্ত গন্ধে চারদিক ভরে উঠেছে ৷ বিশাল মাঠ জুড়ে রঙের মেলা৷ আমি, নীতি আর রাহাত ভীরের মধ্যেই আসর জমিয়ে দাঁড়িয়ে আছি গরম গরম চাঁ হাতে ৷ আমার অবাধ্য চোখ গুলো হঠাৎ করেই মানুষটাকে খুজে চলেছে ভীরের মাঝে৷ গরম চায়ে চুমুক দিতেই চাঁপা আর্তনাদ করে উঠলাম ৷ রাহাত আর নীতি ব্যাস্ত হয়ে, ‘ কি হয়েছে ‘ বলতেই অচিরে হেসে উঠে বললাম,
–‘ ঠোঁট পুড়ে গেছে ৷ তোরা থাক আমি একটু ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুঁয়ে আসি৷ ‘
ভীর ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছি ৷ ভালো ভাবেই পুড়েছে ঠোঁট৷ ভীষণ জ্বালা করছে এখন৷ কোলাহল থেকে বেরিয়ে আসতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস নেই আমি ৷ এইদিকে পুরোটা ফাঁকা৷ কোথাও কেও নেই ৷ আমি চারদিকে উনাকে খুজে চলেছি ৷ সে যে বিবাহিত ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে একদম ইচ্ছা হচ্ছে না আমার ৷ ক্যাম্পাসে নীরবতা নীরব আকারে বিরাজ করছে৷ আমি শান্ত পায়ে এগিয়ে চলেছি ৷
পাঁচটা ফাঁকা রুমের পরেই মেয়েদের কমন রুম ৷ এইদিকটা কেমন অতিরিক্ত নীরব৷ শুকনো পাতায় পারা লাগতেই নিনের পিলে চমকে উঠছে ৷ কেন আসতে গেলাম ভেবেই মেজাজ খারাপ হচ্ছে নীতিকে নিয়ে আসলেও পারতাম৷ শাড়ির কুঁচি ধরে দ্রুত পাঁ চালিয়ে চলেছি ৷ ল্যাব এরিয়া আসতেই হাতে টান লাগে ৷ আচমকা এমন হওয়ায় ভয় পেয়ে যাই ৷ ল্যাবরেটরির ভেতরে দেয়ালে পিঠে ঠেকতেই চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি চারদিকে ঘণ অন্ধকার ৷ কেও আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমার পাশে হাত রেখে ৷ আমি কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলাম, ‘ক-কে আপনি?? ‘
সামনে থাকা ব্যাক্তিটি আমার চুলের খোঁপা খুলে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
–‘ শুভ্র রাঙা পরী আমি তোমার শুভ্র প্রেমিক…! ‘
চলবে….
~” স্নিগ্ধ বিবাহিত,🤔 ইশ! ভুল-ক্রটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন~♪♥