শুভ্র_রঙের_প্রেম
পর্বঃ১১
#রুবাইদা_হৃদি
চোখের পাতায় ভারী অনুভব নিয়ে চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করেও তীব্র মাথা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলাম৷ নিজেকে প্রচন্ড ভারী অনুভব হচ্ছে৷ মৃত্যুর পর বুঝি এমন অনুভূতি হয়??
আশেপাশের পরিবেশ হিমশীতল! কোথায় যেন একটা কাক উচ্চস্বরে ডেকে চলেছে৷ শরীরের প্রত্যেকটা উপশিরা জানান দিলো আমি বেচে আছি৷
পিটপিট করে চোখ খুলে সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে আমি একদম অবাক হলাম না৷ অসুস্থ শরীর নিয়েই চেয়ারে হেলান দিয়ে থাকা মানুষটাকে দেখেই ঝাপিয়ে পরলাম তার বুকে৷ হঠাৎ এমন হওয়ার সে হকচকিয়ে গিয়েও নিজেকে সামনে নিলো৷ চারদিকে নীরবতা! সেই নীরবতা ঠেলে আমি ফুঁপিয়ে কেদে উঠলাম৷
–‘ এই মেয়ে কাঁদছো কেন! রিলাক্স আমি আছি তো৷ ‘ তার শীতল কন্ঠের ভরসার আওয়াজ আমার কানে পৌছালো না৷ আমি একনাগাড়ে কেদেই চলেছি৷ আমার মনে হচ্ছে,বহুদিন, বহুবছর পর বন্ধি থেকে মুক্ত হয়েই সর্বপ্রথম নিজের একান্ত আপন মানুষের সানিধ্য পেয়েছি৷ তার হাতদুটো এখনো আমাকে আঁকড়ে ধরে নি৷ আমি অনবরত কেঁদেই চলেছি৷ মাথায় চিনচিনে ব্যথা প্রকট আকার ধারণ করলেও আমার মনে হচ্ছে,আমি পরম শান্তির স্থানে আছি ৷ সে আমার মাথায় হাত রেখে আদুরে স্বরে বলল,
–‘ তুমি ভীতু সেটা তো জানা ছিলো না৷ পাবলিক প্লেসে অচেনা ছেলেকে থাপ্পড় মারতে যার হাত কাঁপে না আর আজ সে কাঁদছে?? এইটা বড় অন্যায়৷ ‘
আমি জবাব দিলাম না ৷ মনের ভেতরের জমে রাখা ভয় গুলো নিমিষেই উধাও হয়ে যাচ্ছে৷ কাল ঝাপসা চোখে দেখা ব্যাক্তিটি সত্যি ছিলো আর সে এখন আমার সামনেই আছেন৷ ভোতা অনুভূতি গুলো নাড়া দিয়ে গেলেও আমি তাকে একদম ছাড়ছি না৷ অন্য সময় হলে হয়তো ছিটকে দূরে চলে যেতাম তবে এখন আমার একমাত্র ভরসার মানুষ যে সে!
–‘ উনার জ্ঞান ফিরেছে? যাক আলহামদুলিল্লাহ ! প্রেশার চেক করতে হবে সাথে এই ইঞ্জেকশন টা দিতে হবে৷ ‘
–‘ আই উইল ম্যানেজ৷ আপনি ওইগুলো রেখে বাইরে যান৷ ‘
–‘ স্যার আমার ডিউটি এইটা৷ ‘
–‘ আর আমার ডিউটি হচ্ছে এই মেয়েটাকে আগলে রাখা৷ ‘
নার্সের কথা শুনে স্নিগ্ধ স্যার বললেন৷ নার্স স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মুচকি হেসে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বললেন,
–‘ ম্যাম অনেক লাকি৷ ‘ নার্সের কথা শুনে আমার কান্না থেমে গেলো৷ কি বললেন উনি?? এতোক্ষণে ঝিমিয়ে থাকা মস্তিষ্ক জানান দিলো, আমি ভুল করেছি৷ তাড়াতাড়ি মাথা উঠাতে গেলেই হাতের স্যালাইন সহ মাথা পর্যন্ত ব্যথায় টনটন করে উঠে৷ মুখ দিয়ে ” উফ ” শব্দটা বের হতেই স্নিগ্ধ স্যার আতংকিত গলায় বললেন, ‘ কি হয়েছে?? ব্যথা করছে? ‘
–‘ ন..না! ‘ আমি মাথা উনার বুকে রেখেই বললাম৷ উঠানোর শক্তি পাচ্ছি না একদম৷ চোখ বন্ধ করে নিজের বাড়াবাড়ি ধরণের বোকামি ভাবতেই মরে যেতে ইচ্ছা হলো৷ উনি একহাতে আমার বাহুতে ধরতেই আমি সচেতন গলায় বললাম,’ আমার মাথা ব্যথা করছে! ‘
–‘ বালিশে শুইয়ে দেই তোমাকে৷ এই ইঞ্জেকশন টা দিলেই ব্যথা কমে যাবে৷ ‘
আমি জবাব দিলাম না৷ আলতো হাতে আমাকে শুইয়ে দিতেই চোখ মেলে উনার দিকে তাকালাম৷ নেভি ব্লু শার্ট ভিজে আছে জায়গায় জায়গায়৷ চোখ গুলো অসম্ভভ লাল৷ মনে হচ্ছে,সারা রাত ঘুমোন নি৷ ঠোঁট একদম শুকিয়ে গেছে৷ কঁপালে চুল গুলো অগোছালো ভাবে লেগে আছে ৷ গালের মাঝ বরাবর কালো কুচকুচে তিল টা আজ লাল বর্ণ ধারণ করেছে৷ আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম তিল টা সত্যিই লাল৷ শতশত ভাবনার মাঝে আমি অস্ফুটস্বরে বললাম, ‘ আপনার গালের তিল টা লাল রাঙা! ‘
উনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন৷ হাতে থেকে ইঞ্জেকশন টা আমার অজান্তেই দিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
–‘ অন্য রঙের হলে বুঝি ভালো লাগতো?? ‘
–‘ না না! এইটাই সুন্দর৷ ‘ আমি নিজের কথায় নিজেই লজ্জায় মিইয়ে গেলাম৷ চোখ নামিয়ে ফেলতেই হঠাৎ করেই মনে হলো ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে৷ সেই সাথেই তীব্র ব্যথা হুর হুর করে হাত বেয়ে উঠলো৷ ভয় পাওয়া কন্ঠে বললাম,
‘ ইঞ্জেকশন কেন দিলেন আমার বুঝি ব্যথা লাগে না? ‘
আমার কথা শুনে হাতের জিনিস গুলো টি টেবিলের উপর রেখে বললেন,
–‘ তুমি ঢাকা থেকে এতো দূর কেন এসেছিলে?? ‘
আমি উনার কথা শুনে আবার ফুঁপিয়ে উঠলাম৷ কাল রাতের কথা মনে হতেই নিজেকে আবার অসহায় লাগতে শুরু হলো৷ স্নিগ্ধ স্যার চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন৷ কান্নার শব্দ আর নিশ্বাসের ফোসফাস আওয়াজে ভারী হয়ে উঠলো৷ আমি কাঁদছি আর সে দেখছে৷ রাগ হলো কোথায় সান্ত্বনার বাণী দিবেন তা নয় উনি তাকিয়ে আছেন ৷ আমি কান্না মাখা আর রাগ মিশ্রিত গলায় বললাম,
–‘ বাসায় যাবো আমি৷ ‘
আমার কথার উত্তর না দিয়ে এখনো তাকিয়ে আছেন৷ আমি মুখ ঢেকে ফেলতেই নড়েচড়ে বসলেন উনি৷ বেডের মধ্যে হাত দিয়ে আমার দিকে ঝুকে এসে শীতল কন্ঠে বললেন,
–‘ রাত এগারোটা সময় ঢাকা ছেড়ে ওই নির্জন জায়গায় কেন এসেছিলে? ‘
উনার কন্ঠে কিছু একটা আছে৷ যা আমাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিলো৷ কান্না থামিয়ে সরাসরি উনার চোখের দিকে তাকাতেই ধমকের সুরে বললেন,
–‘ আন্সার দাও! ‘
–‘ রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম৷ ‘
–‘ এক্সপ্লেইন করো৷ ‘
উনি আবার চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বললেন৷ আমি অসহায় চোখে তাকিয়ে কাঁপা গলায় নিজের বোকামির কথা গুলো বলতেই উনি উঠে দাঁড়ালেন৷ তারপর হঠাৎ করে আমার একদম সামনে এসে চোখে চোখ রেখে রাগী কন্ঠে বললেন,
–‘ এই মেয়ে এই! তুমি কি পাগল? না ছোট বাচ্চা৷ ‘
–‘ আমি সত্যিই বুঝতে পারি নি৷ ‘
–‘ চুপ একদম চুপ! এমন ভুল কে করে?? একমাত্র তোমার মতো ওভার স্মার্ট মেয়েরাই করে৷ যাদের নিজেদের কোনো উপস্থিত বুদ্ধি নেই৷ ‘
চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরলো৷ পাশে থাকা চেয়ার জোরে পা দিয়ে লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিলেন উনি৷ আমি ভয়ে আরো সিটিয়ে গেলাম৷ মুখ ফুটে কোনো কথা বের হলো না আর ৷
আমি চুপ করে তাকিয়ে আছি৷ অনেকটা সময় পর আমি সাহস নিয়ে বললাম, ‘ বাসায় বা হলে যাবো৷ ‘
–‘ যাও! ‘
উনার সোজাসাপটা কথায় রেগে উঠলাম আমি৷ আরে ভাই বাচিয়েছিস আবার রাগও দেখাচ্ছিস? কিসের রাগ দেখাচ্ছিস! আমি কে তোর?
এই কথা গুলো বলতে পারলে শান্তি লাগতো৷ কিন্তু আপাদত চুপ আছি৷ কারণ একা তো আর যেতে পারবো না ৷
–‘ আপনি কোথায় ছিলেন এই দুইদিন?? ‘
–‘ জেনে কি করবে?? আমাকেও নিয়ে ও এইভাবে চেনা পথে হারিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছো বুঝি? ‘
উনার গা জ্বালানো কথায় বিরক্ত লাগলেও দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,’ ফর্মালিটি পালন করছি স্যার! আমরা ফর্মালিটি ও জানি না৷ ‘
–‘ জড়িয়ে ধরাও বুঝি ফর্মালিটি?? ‘ উনার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালাম আমি৷ এর কথার পৃষ্ঠে কি জবাব দিবো ভেবে পেলাম না ৷
হাজার ভেবেও জবান খুজে না পেয়ে গা এলিয়ে শুয়ে রইলাম৷ মহা বজ্জাত! ধুরন্ধর ব্যাক্তি৷ এই লোকের সাথে থাকা মানেই সেকেন্ডে সেকেন্ডে অপদস্ত হওয়া৷
___________________________
টানা বারো ঘন্টা জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম৷ ভেবেই শিউরে উঠলাম৷হসপিটাল থেকে বের হওয়ার আগে সেই নার্সটা বললেছেন আমাকে৷ তারমানে গোটা একটা দিন আমি নিরুদ্দেশ৷ ভেবেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে৷ চারদিকে আবার ঘণ কালো অন্ধকার! কাছে কোথাও এশারের আজান দিচ্ছে৷
আমি আসুস্থ শরীরে দাঁড়িয়ে আছি হসপিটালের পার্কিং এরিয়া তে৷
মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে হলে ফিরলেও নানা কথার সম্মুখীন হতে হবে আবার বাসায় ফিরলে কি জবাব দিবো সেটা ভেবেই জ্বর বোধহয় বেড়ে গেলো৷
–‘ ঢাকায় যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই৷ রাস্তাঘাট সব বন্ধ৷ ‘ পাশেই একজন ফোনে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে৷ উনার কথা শুনে দুনিয়া ঘুরে উঠলো৷ বলেন কি?? মাথা ঘুরছে৷ সব অকাজ আর বিপদ বুঝি একদিনেই আসার ছিলো??
নিজেকে সামলাতে না পেরে পরে যেতেই নিলে শক্ত পুরুষালি হাত কোমর আঁকড়ে ধরলো৷ আমি তাকিয়ে দেখলাম স্নিগ্ধ স্যার৷ রাগী ভাবে তাকিয়ে বললেন,
–‘ পরে যাওয়ার তো ভালোই অভ্যাস বানিয়েছো৷ না আমকে দেখলেই তোমার পরে যাওয়া রোগে ধরে?? ‘
আমি উনার কথা শুনে মিনমিনে গলায় বললাম,
–‘ স্যার ঢাকা আর যাওয়া হবে না৷ ‘
আমার কথা শুনে উনি ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুঁটিয়ে বললেন,
–‘ ভালোই হলো এখানেই সংসার পেতে সংসারী হয়ে যাই কি বলো?? ‘
আমাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে একহাতে ধরলেন উনি৷ আমি পাশ ফিরে তাকিয়ে অবাক চোখে বললাম, ‘ বউ তো জোগাড় করতে হবে! ‘
–‘ তুমি থাকলে আশেপাশে, বউয়ের আর কি দরকার পরে! ‘
চলবে…!
~”লেখে একদম শান্তি পাই নি৷ পড়ার চাপ বেড়েছে আমার৷ আজ না দিলে গুছিয়ে দিতাম কাল৷ অগোছালো হয়েছে জানি৷ ভুল ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন৷ ‘