শুক্লাদ্বাদশী,Part-2,3
Arishan Nur (ছদ্মনাম)
Part-2
— তোদের বাসায় এই অপরিচিত যুবকটা কে রে? তোর প্রেমিক?
অচেনা এক কন্ঠস্বরে যখনি একজন নারী এই কথাগুলো বললো, আরোশ তড়িৎ গতিতে মেয়েটার কাছ থেকে নিজের বাঁধন ছিন্ন করে দূরে সরে এসে দাঁড়ায়।
সে অপরিচিত মেয়েটার দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলো। তারই বয়সী বোধহয় মেয়েটা!
লম্বা শ্যামলা পরনে কমলা শাড়ি, চুল খোপা করা।
মেয়েটা আবারো বলে উঠে, কি রে দুর্গা কথা বলছিস না কেন? কে হয় এই ছেলে তোর? কাকা কোথায়?
আরোশের বুকে কম্পন বয়ে গেল। মেয়েটার নাম কি দুর্গা?
আরোশ খেয়াল করলো, কমবয়সী মেয়েটা বলে উঠে, বাবা বাসায় নেই।
মধ্যবয়সী মেয়ে চটজলদি বলল, সর্বনাশ! ফাঁকা বাসায় একটা ছেলেকে ঢুকতে দিয়েছিস কেন? আমি না এসে অন্য কেউ চলে এসে এই দৃশ্য দেখলে কি হত ভাবতে পারছিস তুই? যা নিজের ঘরে যা! আর এই ছেলেকে বিদাই কর৷
আরোশ কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। এ তো দেখি বিরাট মসিবত! তাকে নাকি বের করে দিবে? বের করে দিলে সে যাবে কোথায়? এই দুটো মেয়ের কথোপকথন শুনে মনে হচ্ছে, সুদীপ সাহেব বাড়ি নেই। আরোশ আসবে এই খবর কেবল তিনি জানেন। আর এখন উনার অনুপস্থিতিতে সে কি করবে? সে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো।
কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিলো। ঠিক সেই সময় বাড়ির কর্তা সুদীপ মল্লিক এক ডজন সাগর কলা হাতে বাড়ি ফিরে এলেন। মুখটা তার কালো হয়ে আছে।
বাবার কালো মুখ দেখে দুর্গা চমকে উঠে। বাবার কি কিছু হয়েছে?
সে এগিয়ে যায় বাবার দিকে। সুদীপ মল্লিক দুর্গাকে দেখে মেকি হেসে বলে, মা! কলপাড় থেকে পানি এনে দে তো। পায়ে কাদা লেগেছে। পরিষ্কার করব৷
দুর্গা ছুট লাগায় কলপাড়ের দিকে।
আরোশ বড় বড় পা ফেলে সুদীপ মল্লিকের কাছে গিয়ে কথা বলতে লাগে। সে পেছনে না তাকিয়েই বুঝে ফেললো, মধ্যবয়সী মেয়েটা আড়ি পেতে তার কথা শোনার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে এজন্য সে আওয়াজ নিচু করে বলে, সুদীপ সাহেব! কেমন আছেন? আমাকে চিনতে পেরেছেন?
সুদীপ মল্লিক চশমার ফাঁক দিয়ে লম্বা ছেলেটাকে পর্যবেক্ষণ করলো। গায়ের রং ময়লাটে ধরনের। চেহারা রোদে জ্বলে গেছে।
ছেলেটা যে একসময় ফর্সা ছিলো তা সে দিব্যি টের পেয়ে গেল। কেমন শীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুক্ষ্ম ত্বকের অধিকারী ছেলেটাকে সে চিনলো না। তাই বলে উঠে, তুমি কি মোড়ল বাড়ির ছেলে?
— না।
ছেলেটার জবাব এতোটাই শক্ত ছিল যে সে পুনরায় ছেলেটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো যেন সে ভুল বলায় ঘোর অপরাধ হয়েছে। সে মস্তিষ্কে জোর দিচ্ছে কিন্তু নাহ কিছুতেই মনে করতে পারছে না যে ছেলেটা কে? তিনি কৌশলে বললেন, তাহলে নিশ্চয়ই রায় বাড়ির ছেলে?
আরোশ মুখ শক্ত রেখে বলে উঠে, কাওছার ভাইয়ের সঙ্গে আপনার কথা হয়নি?
সুদীপ মল্লিক কাওছারের কথা শুনে চমকে উঠে। চোখে মুখে একধরনের প্রফুল্লতা গ্রাস করে ফেলে।
সে তাড়াহুড়ো করে বলে, তুমি আরোশ?
— জি।
— আমার বিশ্বাস-ই হচ্ছে না তুমি আমার বাড়িতে এসেছো বাবাজান।
— আসার তো কথা ছিল।
— তবুও। আসো ভেতরে আসো।
আরোশ লক্ষ্য করলো, বয়স্ক এই লোকটার চেহারায় আনন্দ ভাব ফুটে উঠেছে। কাউকে আনন্দিত হতে দেখলে আরোশের ও আনন্দ লাগে৷
তখনি দুর্গা একটা কলসিতে করে পানি এনে ধাম করে মাটিতে ফেলে বলে, বাবা, এই যে পানি। পা ধুয়ে ঘরে আসো। বাইরে প্রচন্ড গরম৷
সুদীপ মল্লিক কলসি থেকে পানি ঢেলে পায়ে লেগে থাকা কাদা ধুয়ে ফেলে দুর্গার উদ্দেশ্য বলে উঠে, ভাত বেড়ে ফেল।
— এখন?
— হ্যা।
দুর্গা অবাক না হয়ে পারলো না। পাত্রপক্ষের বাসা থেকে বাবা না খেয়ে ফিরেছে? বিকেল পাচটা তো বাজেই। এক বেলায় বাবা ভাত খেতে চাচ্ছেন কি জন্য?
তিনি আবারো বলে উঠে, দুইজনের জন্য খাবার বেড়ে দে।
— আচ্ছা।– কথা শেষ করে দুর্গা বাসার ভেতরে ঢুকতে গেলেই রোজিনা আপার তীক্ষ্ম নজরের ভাগীদার হলো।
দুর্গা মৃদ্যু হেসে বলে, আপা ভাত খাবি?
রোজিনা মুখ বাকিয়ে বলে উঠে, রাখ তোর ভাতের কথা। এই ছেলেটা কে রে? আমার একে কেমন যেন উদ্ভট লাগছে?
দুর্গা বলে উঠে, তোমার উদ্ভট লাগছে? আমার তো বানরের মতো লেগেছে।
রোজিনা আপা মুখ বাকিয়েই বলতে লাগে, গ্রামের কোন খরব রাখিস তুই?
দুর্গা বলে উঠে, কেন কি হলো আবার?
— দুই গ্রাম পর রাখাল পাড়ায় পাকিস্তানী বাহিনী ক্যাম্প বানাচ্ছে। সাত দিন পর নাকি চৌদ্দ জন পাক সেনা টহলে আসবে।
দুর্গা আতকে উঠে বলে, বলো কি আপা! দুই গ্রাম মানে আমাদের খুব কাছাকাছি তো।
— হ্যা রে।
— এখন কি হবে আপা আমাদের?
— জানি না রে। শুনলাম আমাদের গ্রাম থেকে নাকি পাকিস্তানি বাহিনীদের সাহায্য করছে৷
— কে?
— জানি না। শোন তুই সাবধানে থাকবি৷ ঘর থেকে বেরুবি না এক্কেবারে। বুঝেছিস?
— তুমিও বের হবে না আপা।
রোজিনা স্মিত হেসে বলে, আমার চিন্তা করতে হবে না। জানিস?
— কি?
— শফিক নাকি যুদ্ধে যাবে৷
কথাটা খুব ধীর গলায় বলে রোজিনা আপা।
দুর্গা চোখ গোল গোল করে অবিশ্বাসের সুরে বলে, আমাদের শফিক ভাই?
— তো আর কে? এই গ্রামে ওর মতো পাগলাটে আর কেউ আছে?
দুর্গা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো রোজিনার কথায়৷
রোজিনাকে দেখে মনে হচ্ছে, শফিক যুদ্ধে নাম দিবে শুনে সে খুব খুশি।
দুর্গা বলে উঠে, আপা যুদ্ধ কিভাবে করে?
রোজিনা ভ্রু কুচকে বলে, তোর এসব জেনে কি লাভ? শোন! ভুলেও বাসার বাইরে যাবি না। ঘরে থাকবি। অপরিচিত কারো ডাকে সাড়া দিবি না।
— আচ্ছা।
রোজিনা আবারো কি যেন ভাবলো, তারপর বলে উঠে, জানিস! শফিক বললো, মুক্তিযোদ্ধারাও নাকি আসবে আমাদের গ্রামে।
দুর্গার চোখ মুখ ঝিলিক মেরে উঠলো। মূহুর্তে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে আসে। সে কম্পিত গলায় বলে, মুক্তিযোদ্ধারা আসবে?
— শুধু কি আসবে নাকি! পাকিস্তানি দের নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে দেখে নিস! খেলা তো মাত্র শুরু রে!
দুর্গার ছোট্ট সহজ-সরল মনে গেঁথে গেল “মুক্তিযোদ্ধা” শব্দটা। আচ্ছা এই শব্দটা এতোটা পবিত্র কেন? কেন মুক্তিযোদ্ধা দের কথা ভাবলে তার চোখে পানি চলে আসে। দুর্গা মনের ক্যানভাসে মুক্তিযোদ্ধার ছবি আঁকার চেষ্টা চালানো। তার মনের মুক্তিযোদ্ধাটার পরনে প্যান্ট-শার্ট। মাথায় গামছা বাধা। রোদে মুখ, হাত পুড়ে গেছে। বেশ লম্বা। রাইফেল হাতে তাড়া করছে দুষ্টু পাকিস্তানি দেরকে।
তার ভাবনার সুতো ছিন্ন হলো বাবার ডাকে। বাবা বলে উঠে, দুর্গা মা! কই হাওয়া হলি! ছেলেটা অপেক্ষা করছে। ভাত নিয়ে আয়।
দুর্গা সমস্ত চিন্তা বাদ দিয়ে দুপুরের ভাত আর কাঁচা কাঠালের তরকারি নিয়ে উঠানের দিকে হাঁটা দিলো৷
সুদীপ মল্লিক অতিরিক্ত উত্তেজনা নিয়ে আরোশকে বলে উঠে, বাবাজি, নাও চারটে ভাত খাও।
আরোশের প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। সকালে একটা কলা খেয়েছে। এরপর এখন বেলা ডুবলো বললেই চলে কিন্তু পেটে একটা দানা ও জোটেনি। খাবারের ঘ্রাণ নাকে আসতেই ক্ষুধা মশাই যেন পেটের ভেতর হরতাল শুরু করে দিলো।
দুর্গা প্লেট এগিয়ে দিতেই সে কোন দিকে না তাকিয়ে গোগ্রাসে ভাত গিলতে লাগলো। কাঠালের তরকারি ও যে এতো অমৃত হয় তা জানা ছিল না আরোশের।
দুর্গা ছেলেটাকে এভাবে খেতে দেখে বেশ বিরক্ত হলো। সে বলল, আস্তে ধীরে খান। আপনার ভাত কেউ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে না।
বাচ্চা মেয়েটার মুখে এমন কথা শুনে আরোশ বেশ লজ্জা পেল৷ অপমানিত বোধ করল। এই জন্য খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
সুদীপ মল্লিক দুর্গাকে ধমক দিয়ে বলে, বড়দের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে নেই৷ সম্মান দিয়ে কথা বলবে।
দুর্গা বিড়বিড়িয়ে বলে।,সম্মান না ছাই! হুহ, উনি হলো গিয়ে একটা লম্পট ধরনের দুষ্টু লোক। ওনার তো মেয়ে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না।
সুদীপ মল্লিক বলে উঠে, কিছু বললে নাকি?
দুর্গা মেকি হেসে বলে, বাবা পাত্রপক্ষরা ক বললো?
সুদীপ মল্লিক উদাসিতা ভরা কন্ঠে বলে, নাকজ করে দিয়েছি এই প্রস্তাব।
দুর্গা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। স্বপ্ন লাগছে সবকিছু। মূহুর্তের মধ্যে সকল দুঃখ, কষ্ট কর্পূরের ন্যায় উবে গেল। ভগবান নিশ্চয়ই তার প্রার্থনা শুনেছে৷
চলবে।
শুক্লাদ্বাদশী
Part-3
Arishan Nur (ছদ্মনাম)
জৈষ্ঠ্যমাসের শুরু। ঠাঠা রোদ। মাথার উপর সূর্য লম্বাভাবে কিরণ দিচ্ছে। গরমে অস্থির মানুষ-জন। কিন্তু দুর্গার মধ্যে অন্য এক অস্থিরতা। গ্রীষ্মের প্রখরতা তাকে গ্রাস করতে পারছে না। তার মন অন্যদিকে, অন্যজনের কাছে পড়ে আছে। সে অনেকক্ষণ ধরে উঠানের সামনের ফাঁকা জায়গাটাতে পায়চারি করছে। উশখুশ করছে সে। মনটা পড়ে আছে একেবারে ধানের গোলার পাশের মুরগির খামারের মতো ছোট্ট ঘরটায়। ওই ওত টুকুন ছোট্ট ঘরটাতেই তো মাস্টার মশাই থাকছে৷ হু! মাস্টার মশাই-ই তো সাতদিন আগে আসা সেই বানরের মতো দেখতে ছেলেটার পরিচয় এখন!
বাবার দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের ছেলে হয়। ঢাকায় থাকে। বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে৷ যখনই দুর্গার কান শ্রবণ করলো, ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ার –তার বুকের মধ্যে কারা যেন হাতুড়ি পেটাতে লাগলো। দুর্গা এইসব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতেই লজ্জায় লাল-নীল-বেগুনি হয়ে গেল। আচ্ছা সে কি লোভী কোন মেয়ে? ইঞ্জিনিয়ার জন্য দুর্গার মনে তার জন্য বিশেষ কিছু একটা অনুভূতি কাজ করছে। কি সেই অনুভূতি নাম জানা নেই তার!
এমনই সময় বড় বড় পা ফেলে মাস্টার মশাই ঘর থেকে বেরুলো। দুর্গার হাত-পা ইতিমধ্যে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।
আরোশ দুর্গার সামনে এসে দাঁড়ালো। এই।চঞ্চল চটপটে মেয়েটার সঙ্গে আজকে পাক্কা সাত দিন পর আরোশের সাক্ষাৎকার। তাও শিক্ষক বেশে! মেয়েটার পড়ানোর দায়িত্বের বোঝা তার ঘাড়ে এসে চেপেছে।
দুর্গা তাকে দেখে বলে উঠে, আপনি কি আমাকে সত্যি সত্যি পড়াবেন নাকি?
আরোশ বিরক্তি ভাব আড়াল করে বলে, মিথ্যা মিথ্যা পড়ানো গেলে মিথ্যা ভাবেই পড়াতাম।
দুর্গার কান লাল হয়ে আসলো। সে জড়তায় কুচকে গেল।
— পড়ার টেবিলে গিয়ে বসো। আমি আসছি৷
দুর্গা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আরোশ তা দেখে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে, পড়ালেখার ব্যাপারে হেলাফেলা আমার পছন্দ না। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নিও।
দুর্গা একবার চোখ তুলে তাকালো। এরপর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেলে। ইশ! সামান্য জ্বরেই বেচারা শুকিয়ে গেছে৷ এ কয়েকটা দিন বেচারা জ্বরে ভুগেছে। এতেই যেন তার ওজন দুর্গার চোখে দুই কেজি কমে গেছে। ঠোঁটে জ্বর ফোড়া উঠে লাল হয়ে আছে ঠোঁটের নিচের দিকটা।
আরোশ বলে উঠে, শোন দুর্গা তুমি কোন চ্যাপ্টার পারো বা পারো না সেই সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই কিন্তু তুমি নিজে তো জানো, কিসে তুমি দুর্বল। আমাকে জানিয়ে দিবে সেইসব চ্যাপ্টার বেশি সময় নিয়ে পড়াবা।
তার মুখে দুর্গা নিজের নাম শুনে মনে মনে খুব খুশি হলো। যাক মাস্টার মশাই অন্তত তার নাম তো জানেন!
আরোশ নরম সুর তুলে বলে, উঠানেই বসি কি বলো?
— আচ্ছা৷
— বই আনো। রসায়ন আর ইংরেজি বই আনো।
দুর্গা বিনাবাক্য ব্যয় করে ছুট লাগালো নিজের বই-খাতা আনার জন্য। তা দেখে মৃদ্যু হাসে আরোশ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দুর্গা দুই হাত ভর্তি বই নিয়ে ফিরলো৷ আরোশ তাকে উঠানে বসতে বলে। উঠানের মাঝে দুইটা বেতের মোড়া পাতা আছে সেখানেই মুখোমুখি বসলো দুইজনে। আরোশ দুর্গার হাত থেকে বইগুলো নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগে৷
আর এইদিকে দুর্গা ফাঁক-ফোকড় দিয়ে আরোশকে এক প্রকার লুকিয়ে দেখতে লাগলো। যতোবার আরোশের মুখমন্ডল দেখছে সে, ততোবারই চোখের মণি জ্বলজ্বল করে উঠছে। লুকিয়ে দেখতে গিয়েও ধরাও খেল দুর্গা। মাস্টার মশাই তার দিকে তাকালেন এবং দুর্গাকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে বলে, কিছু বলবে?
দুর্গা যেন এই প্রশ্ন পিলে চমকে উঠে। সে আমতাআমতা করে বলে, আ,,,আমি অংক বড্ড কাঁচা।
আরোশ স্মিত হেসে বলে, আচ্ছা বুঝলাম। কালকে থেকে অংক রোজ এক ঘন্টা করে পড়াব। গনিত হলো বিজ্ঞানের রাণী। বিজ্ঞান গনিত ছাড়া অচল।
দুর্গা মনে মনে বলে, আমার মনও আপনাকে রাজা বানিয়েছে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। আমিও আপনাকে ছাড়া অচল — শেষ কথা বলতেই দুর্গা আবারো চমকে উঠে। ছিঃ ছিঃ কিসব ভাবছে সে। ভাগ্যিস মাস্টার মশাই তার মনের কথাগুলো শুনে নি। শুনলে নিশ্চয়ই তাকে বেহায়া উপাধি দিয়ে দিত।
মানুষকে যদি মনের কথা শোনার ক্ষমতা দেওয়া হতো, তবে দু’দন্ডের মধ্যে বিশ্ব তচনচ হয়ে যেত।
রসায়ন বই হাতে নিয়েই আরোশ প্রশ্ন করে, বলো তো বাফার দ্রবণ কাকে বলে?
দুর্গা চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। এরপর মনে করার চেষ্টা করলো। কিন্তু পাজি, দুষ্টু মন সে তো আর পড়ার মধ্যে নেই। দুর্গা বিগত দিনে পড়া সবকিছুই ভুলে গেছে। বাফার-ডাফার দ্রবণ-ফ্রবণ কি তাও আর মনে নেই তার।
আরোশ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল উত্তরের আশায়। দুর্গার মুখে যেন কেউ আঠা লাগিয়ে দিয়েছে। মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ ও বের হচ্ছে না।
আরোশ কিছুটা রাগী গলায় বলে, পারো না?
দুর্গা এবারে সরাসরি তার দিকে তাকালো। এতে কিছুটা ঘাবড়ালো আরোশ। মেয়েটা এভাবে চোখে চোখ রাখে কেন? প্রায়ই এমন করে! যখনই এই মেয়েটা তার চোখে চোখ রাখে তখনিই আরোশের কেমন যেন অস্থির লাগে।
দুর্গা মাথা নেড়ে বলে, উহু।
— পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না?
— লাগে।
— তাহলে পড়ো না কেন?
দুর্গা এর উত্তর না দিয়ে ফটাফট বলে উঠে, জানেন আমি ডাক্তার হতে চাই।
— গুড।
— আমাদের গ্রামে আমি আর বিল্লাল কেবল সাইন্স নিয়েছি। আর টুম্পা, জবা, পারুল ওরা আর্টস নিয়েছে। জয়নবের তো বিয়ে হয়ে গেছে তাই কলেজ আসা বাদ দিয়েছে। রঞ্জু ম্যাট্রিক পাশ করতে পারে নি,,,,,,
— হয়েছে থামো এবার।তোমার কাছে হিস্ট্রি জানতে চাই নি।
দুর্গা ফিক করে হেসে ফেলে। আরোশ মুগ্ধ না হয়ে পারলো না। আঁকাবাঁকা হাসিটার মধ্যে একটা যাদু আছে সম্ভবত। কেবল ঘোর লেগে যায়। সে নিজেকে সংযত করে বলে, বাফার দ্রবণ মানে হলো, যে দ্রবণে সামান্য দুর্বল অম্ল বা ক্ষার যোগ করার পরও দ্রবণের pH- মান
অপরিবর্তিত থাকে তাকে বাফার
দ্রবণ বলে! বুঝলে?
দুর্গা মাথা ঝাকালো যার অর্থ সে বুঝেছে।
আরোশ সামনের পৃষ্ঠার পড়া গুলো বুঝাতে লাগে । একবারও মনের ভুলেও দুর্গার দিকে তাকালো। সে বুঝে গেছে এই মেয়েটা সর্বনাশা তার জন্য।
‘জীবন থেকে সর্বানাশীকে দূরে রাখতে হয়।’
দুর্গা হুট করে প্রশ্ন করে বসে, pH মানে কি?
আরোশ হতাশ না হয়ে পারলো না। আরে যে pH মানেই জানে না, তাকে বাফার দ্রবণ বুঝিয়ে লাভ কি? সে কটমট করে দুর্গার দিকে তাকিয়ে বলে, pH কি তা জানো না?
দুর্গা ঢোক গিলে বলে, ভুলে গেছি।
— নিজের নাম মনে আছে?
— হ্যাঁ।
— বাবার নাম আছে মনে থাকে?
দুর্গা অবাক হয়ে বলে।,থাকবে না কেন?
— ভাত খাওয়ার কথা ভুলে যাও?
— ভাত খাওয়ার কথা কেউ ভুলে নাকি?
আরোশ বই টা নিচে ধাম করে ফেল বলে।,তাহলে pH কাকে বলে সেটা কেন ভুলে গেলে?
দুর্গা অসহায় চোখে বলে, কি জানি? কিন্তু রেডিওতে বলা প্রতিটা কথা আমার মনে থাকে!বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিটা লাইন মুখস্ত। শুনবেন?
— না।
— আচ্ছা আপনাকে কি বলে ডাকবো?
আরোশ হচকচিয়ে গেল। এই মেয়েটা এমন উদ্ভট কেন? পড়তে এসেছো পড়ো তা না দুনিয়ার কথার ঝুলি নিয়ে বসবে।
সে অল্প কথায় বলে, ভাই বলে ডাকবে।
দুর্গা মুখ ফসকে বলে দেয়, অসম্ভব ।
আরোশ ভারী অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, অসম্ভব কেন?
দুর্গা নিজেও পুনরায় পিলে চমকে উঠে। নিশ্বাস ভারী হতে লাগে। কি বলবে উত্তরে? সে নিজেই তো উত্তর জানে না। কেবল এতোটুকুই বুঝে, লম্বা করে এই রোগা পাতলা ছেলেটা আর যাই হোক ভাই ডাকা যাবে না। ভাইয়া হলেও কথা ছিল।
ভাই আর ভাইয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। ভাই বলে যাকে ডাকা হয় তার সঙ্গে ভাই-বোনের এক পবিত্র সম্পর্ক থাকে। সবাইকে ভাই বলে ডাকা যায় না! ভাই একটা আপন শব্দ। আচ্ছা শব্দও আবার আপন হয়?
তখনি মেইন গেটের বাহির থেকে দুর্গা শুনতে পেল রোজিনা আপা তার নাম ধরে ডাকছে। সে এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে আপার কাছে দৌড়ে গেল।
আরোশ এই কয়েকদিনে রোজিনাকে ভালো মতোন চিনে গেছে। রোজিনা মেয়েটা যে বাঁচাল প্রকৃতির তাও বুঝে গেছে। এটাও বুঝে গেছে এই রোজিনা নামক মেয়েটা দুর্গাকে কোন কারণে খুব স্নেহ করে। দুই বাড়ি পরেই এই মেয়ের বাড়ি। আরোশ উঠে দাঁড়ালো। আজকে আর দুর্গাকে পড়াবে না।মেয়েটা অভদ্রতা করেছে। কিভাবে তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পড়া রেখে উঠে গেল? গল্প করতে দৌড়ে গেল। আরোশ তার শিক্ষক হয়। কিন্তু সম্মান দেখালো না।
সে ফোস করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে নিজের ঘরে ফিরে আসে। আকারে খুবই ছোট ঘরটা। তবুও একাকিত্ব আছে এই ঘরে। এই ঘর থেকে সহজে দুর্গার রুম দেখা যায় না। একটা চৌকি ছাড়া আসবাবপত্র বলতে আর কিছু-ই নেই। তবে বিশাল বড় একটা জানালা আছে। সেই জানালা দিয়ে সুবিশাল আকাশ দেখা যায়। আরোশের জন্য এ-ই যথেষ্ট। সে চৌকিতে আয়েশ করে বসে। এই বাসায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই জ্বরে আক্রান্ত হলো সে।টানা পাঁচ দিন
জ্বর-সর্দি- টনসিলে ভুগে একাকার অবস্থা। অবশ্য কালকেই সে সুস্থ হয়েছে। তবু্ও আজ আর গতকাল মিলিয়ে পাক্কা দুই দিন খুব করে বিশ্রাম নিয়েছে সে।নিজের সুটকেস থেকে একটা বই বের করলো। ইংরেজি সাহিত্যের বই। এমনি হাতে ধরে বসে রইল সে।পড়ছে না। দুর্গা মেয়েটা এখনো তার আসল পরিচয় জানে না। সে নিজেই সুদীপ মল্লিক কে মানা করে দিয়েছে জানাতে। এইজন্য মেয়েটা তার নামটাও জানে না। দুর্গাকে সত্যি সত্যি কিছু না জানানোর জন্য সুদীপ মল্লিকের জন্য তার সম্মানটা বেড়ে গেল। লোকটা খুব সাদা-সিধে। গ্রামের সহজ-সরল গৃহস্থ পরিবারের কর্তা সে।এই বাড়ির কর্তাগিন্নি নাকি দুর্গার দুই বছর বয়সেই টাইফয়েডে মারা গেছে।
তখনি মাগরিবের আযান পড়লো আরোশ নামাজ পড়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। ওযু করতে কলপাড়ে যেতে হবে তাকে। সাবধানে ওযু করতে হবে তাকে। দুর্গার চোখে না পড়লেই হলো। মেয়েটা বড্ড দুষ্টু চটপটে স্বভাবের। কাকে কি বলে দিবে কে জানে? তার চেয়ে দুর্গার থেকে সত্য আড়াল করে রাখাই ভালো।
_________________
রোজিনা আর দুর্গা এখনো গল্প করছে।
রোজিনা ভাষণ দেওয়ার মতো ভঙ্গি করে বলে, জানিস শফিক পাগলটা কি করেছে?
দুর্গা উৎসাহ দেখিয়ে বলে, কি করেছে শফিক ভাই?
— পাগলটা মাটি খুঁড়ছে।
— সেকি কেন?
— পাক বাহিনীদের ওই গর্তে ফেলে নাকি পিটাবে। দেখ কান্ড!
দুর্গা কি যেন একটা ভেবে বলে, আপা তুমি শফিক ভাইকে খুব ভালোবাসো তাই না?
রোজিনা লজ্জায় নতজানু হয়ে গেল এবং বলে।,যাহ! ওই পাগলকে ভালোবাসব কোন দুঃখে!
দুর্গা মিস্টি হেসে বলে, আপা ভালোবাসা কাকে বলে?
রোজিনা চোখ বড় বড় করে বলে, তোর ভালোবাসা কাকে বলে তা জেনে লাভ কি?
— সেদিন যুদ্ধ সম্পর্কে ও কিছু বললে না আজকে ভালোবাসা সম্পর্কে ও কিছু বলছো না!
— তোর এসবে কাজ নেই।
— তাহলে আমার কাজটা কোথায়?
— দেখ, ভালোবাসা, যুদ্ধ দুটোই একই জিনিস। এইসব নিয়ে ভাববি না। ভালো কথা ওই ছেলেটা তোদের বাড়িতেই থাকবে এখন থেকে?
— হ্যাঁ।
— সে কি বোবা? কথা।বলতে দেখলাম না একদিন ও!
দুর্গা ফিক করে হেসে ফেলে এবং বলে।,বোবা না গো। বিজ্ঞানের মানুষ। জ্ঞানী কথা বলে সবসময়। জানো উনি ইঞ্জিনিয়ার। তাও আবার ঢাকা থাকে।
— বাপ রে! আচ্ছা যাই রে তুই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে যাস।
দুর্গা মাথা নাড়লো। আপা যেতেই সে উঠানে এলো। মাস্টার মশাই নেই। নিজের ঘরে চলে গেছে। সে বই-খাতা নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
রাতে খাওয়ার সময় আর মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। দুর্গা রাতে খেয়ে বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
নিশুতি রাত। চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ।সারা গ্রাম ঘুমিয়ে আছে। ঘুম নেই কেবল চারজন যুবকের। চারজনের পরনেই প্যান্ট-শার্ট। তারা বিড়ালের মতো বিনা শব্দ করে এগুচ্ছে। তাদের নিশ্বাসের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। খানিক সময়ের ব্যবধানে রাখাল পাড়ার আকাশ-পাতাল, জমিন বিকট শব্দে কেঁপে উঠে। নিশাচর পাখি গুলো কলরব শুরু করে। বিকট শব্দে জেগে যায়, ঘুমন্ত পাখি, দুটো কাক আকাশে উড়াউড়ি করে কাকা ধ্বনি তুলছে। রাখাল পাড়ার আকাশে ধোয়া উড়ছে। গ্রামবাসী এখনো ঠাওর করতে পারি নি কি ঘটে গেল৷ কেউ টের পাওয়ার আগেই সেই চার জোড়া পা প্রস্থান করে।
তাদের মধ্যে একজন বলে উঠে, জয় বাংলা। তাকে অনুকরণ করে বাকিরাও বলে, “জয় বাংলা”
চলবে।