রূপবানের_শ্যামবতী #১৭তম_পর্ব #এম_এ_নিশী

#রূপবানের_শ্যামবতী
#১৭তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী

~শুভ বিবাহ~

স্বল্প সময়ের মধ্যে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। আরজু বেগম নিজের বিয়ের শাড়িটিই মেয়েকে পরিয়ে দিয়েছেন। তবে অরুর জন্য গড়িয়ে রাখা কিছু গয়না ছিলো এবং নিজের কিছু গয়না সহ সাজিয়ে দিয়েছেন মেয়েকে। গ্রামের মেয়ে, বউরা সকলেই অরুনিকাকে ঘিরে রয়েছে। অনেকের অনেক রকম মন্তব্য। কেউ কেউ তো বিশ্বাস করতেই পারছে না অরুনিকার মতো মেয়ে ওত্তো সুন্দর বর পাবে। কেউ কেউ হিংসার বশীভূত হয়ে নাক মুখ সিঁটকে খোঁচামারা কথা বলে যাচ্ছে। তবে এদের মধ্যে শুভাকাঙ্ক্ষীও অনেকে রয়েছে যারা সত্যি মন থেকে খুশি হয়েছে।

এদিকে এই গ্রাম সহ আশপাশ থেকেও বিভিন্ন গ্রামের মানুষজন দলে দলে আসতে শুরু করেছে এই অদ্ভুত বিয়ে দেখতে। সকলের মুখে মুখে রটে গিয়েছে “এক অসম্ভব সুন্দর রূপবান এসেছে অরুনিকার মতো শ্যামামেয়েকে বিয়ে করতে।”
সকলেই এই রূপবানকে এক নজর দেখার জন্য ভিড় করছে।
বাইরের বারান্দায় পাটি বিছানো। সেখানে বর সহ বাকি পুরুষ সদস্যরা বসেছেন। গুরুজনেরা সামনে পেতে রাখা চেয়ারে বসে আছেন। কাজি সাহেব কাবিননামা ঠিকঠাক করছেন।
আর এরইমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে বন্ধুদের খুনশুটি। ঈশান হুট করেই আহরারের কোমরে গুঁতো দিয়ে বলছে,

–কিরে নতুন বর। এমনে বইসা আছস ক্যা? মুখে রুমাল দে।

রাদিফও সায় জানিয়ে বলে,

–ঠিক ঠিক। বাংলা সিনেমায় দেখেছিলাম বরেরা মুখে রুমাল চেপে বিয়ে করতে যেতো। নে নে তুইও রুমাল চাপ।

আহরার চাপা ধমকে বলে ওঠে,

–চুপ কর শা লা রা। একদম ভেজাল করবিনা। শান্তিমতো বিয়েটা করতে দে।

দাইয়ান বিদ্রুপ করে বলে ওঠে,

–এ্যাহ শান্তিমতো বিয়া করবা সোনা। যেই এডভেঞ্চার মারাইয়া বিয়া করতাছো তুমি শান্তি শব্দ ভুলে যাও। বউ নিয়া বাড়ি যাও তারপর বুঝবা।

ঈশান বিরক্তির স্বরে বলে,

–আরে বিয়ের পরের কথা পরে। আগে ওর মুখে রুমাল চাপা দরকার। দাইয়ান ওর পকেট থেইকা রুমাল বাইর কর তো।

যেই কথা সেই কাজ। দাইয়ান জোর করে আহরারের পকেট হাতড়ে রুমাল বের করলো। আর সেই রুমাল তিনবন্ধু মিলে আহরারের মুখে ঠেসে ধরার চেষ্টা করতে থাকে। বেচারা আহরার চেয়েও যেন আটকাতে পারছে না। কি এক মুসিবত!
ঈশান বলছে,

–নে শা লা বর, মুখে রুমাল দে, দেএএএ!

রাদিফ, দাইয়ানও সুর মিলিয়ে বলে ওঠে,

–দে, দেএএএ!

এ যেন রীতিমতো এক যুদ্ধক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বেশিক্ষণ চালাতে পারলো না। কাজী সাহেবের ডাকে থেমে যেতে হলো তাদের। এবার বিয়ে পড়ানো শুরু হবে।

সকলের সম্মতিতে কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন। এবার আহরার বুঝতে পারলো তার ভেতরেও প্রচন্ড অস্থিরতা শুরু হয়েছে। ভেতর কাঁপছে। হাত পা ও কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভত হচ্ছে। কি অদ্ভুত। কাজী সাহেবের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দমালা আহরার মন দিয়ে শুনলো। ঠিক যেই মুহূর্তে অরুনিকাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে কবুল বলতে বলেন এক অদ্ভুত আবেশে চোখ বুজে আহরার অরুনিকার মুখটু্কু কল্পনায় ভাসিয়ে তোলে। ঠোঁটের কোণে আবেশীয় হাসি ফুটিয়ে উচ্চারণ করে সেই পবিত্র শব্দদ্বয়, “আলহামদুলিল্লাহ কবুল”।
পরপর তিনবার একইভাবে “কবুল” বলা সমাপ্ত করে কাজী সাহেব এবার কাবিননামায় আহরারের সিগনেচার নিয়ে চলে গেলেন অরুনিকার কাছে।

কাজী সাহেবের উপস্থিতি টের পেয়ে সকলেই চুপচাপ। জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা অরুনিকা এবার যেন কাঠকাঠ হয়ে রইলো। একটুও নড়নচড়ন নেই। নিঃশ্বাসটাও ঠিকমতো নিচ্ছে না। যেন ওইটুকু নড়াচড়াও করা বারণ। হাত পা ঘেমে গিয়েছে তার। থেকে থেকে কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। এখনো সে বুঝে উঠতে পারছেনা তার সাথে কি হচ্ছে?
কাজী সাহেব বলে যাচ্ছেন। কথাগুলো কতেটা সে শুনছে তা জানেনা। কিন্তু যখন শুনলো আহরার খানকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে সে রাজি কিনা তখনই এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করলো সে। “আহরার” আর “স্বামী” শব্দ দুটো ভেতরে গিয়ে বারি খাচ্ছে তার।
কবুল বলার জন্য আদ্রিকা ঠেলতে শুরু করেছে।

–কি হলো বুবু? চুপ করে আছো কেন? কবুল বলে দাও।

সকলেই তাগাদা দিতে লাগলো কবুল বলার জন্য। এদিকে কাঁপুনি বেড়ে গিয়েছে অরুনিকার। অস্থিরতায় বারবার হাত মুঠো করছে আবার খুলছে। গলা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গিয়েছে তার। বারবার ঢোক গিলছে। চেয়েও যেন মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারছেনা সে। মায়ের দিকে তাকাতেই মা আশ্বাস দিলেন চোখের ঈশারায়। নিজেকে কিছুটা শান্ত করে ধীরভাবে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে উচ্চারিত করে, “আলহামদুলিল্লাহ কবুল”।
পরপর তিনবার ” কবুল” বলানো হলে সকলেই সমস্বরে উচ্চারণ করে “আলহামদুলিল্লাহ”। কাজী সাহেব বলেন, “বিবাহ সুসম্পন্ন”।

সমস্তটায় কর্ণগোচর হয় বাইরে বসা আহরারের। অরুনিকার প্রথমবার কবুল বলাটা কানে এসে লাগতেই পরম তৃপ্তিতে চোখ বুজে নেয় আহরার। “বিবাহ সুসম্পন্ন” কথাটুকু শুনে সে মনে মনে বলে ওঠে,
“অাজ অরুনিকা আহরারের স্ত্রী রূপে স্বীকৃতি পেলো। পরিপূর্ণভাবে অরুনিকা আহরারের হলো। সারাজীবনের জন্য অরুনিকা বাঁধা পড়লো আহরারের জীবনের সাথে। অরুনিকা তার স্ত্রী।”
ভাবতে ভাবতেই মৃদু শব্দ করে হাসলো সে। সেই হাসি নিয়েই বিরবিরিয়ে বলতে থাকে,
“অরু, আমার বউ!”
__________________

বিয়ে শেষে এবার বিদায়ের পালা। অরুনিকা তার দাদার কাছে যায়। জসিমউদদীন নাতনিকে দুহাতে বুকে জড়িয়ে নেন। হু হু করে কাঁদতে শুরু করে অরু। কাঁদতে কাঁদতে বলে,

–দাদুভাই, ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া কোরো। অনিয়ম করবেনা কিন্তু শরীর খারাপ করবে।

জসীমউদ্দিন নাতনির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জবাব দেন,

–তুমিও নিজের যত্ন নিও দাদুমনি। ভালো থেকো। খুব সুখী হও।

বলতে বলতে চোখ মোছেন তিনি। অরুনিকা তার চাচার কাছে আসে। চাচার চোখেও অশ্রু টলমল। জাহেদও অরুনিকার মাথায় হাত রেখে বলেন,

–তোর জীবনে এবার থেকে যেন শুধু সুখ আর সুখই হয় মা। দুঃখ যেন তোকে আর ছুঁতে না পারে।

–সবাইকে দেখে রেখো চাচা।

সেলিনার কাছে এসে দাঁড়াতেই সেলিনা বুকে টেনে নেন অরুনিকাকে। ধরা গলায় বলেন,

–মা রে হয়তো অনেক উল্টোপাল্টা কথা অনেকসময় বলে ফেলেছি তোকে। সেসব মনে রাখিসনা। আমি মন থেকে চাই তুই ভিষণ সুখী হ।

চাচীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এবার মায়ের কাছে যায় অরু।
আরজু বেগম নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টায় আছেন।
তিনি ঈশারায় আহরারকে ডাকলেন। আহরার এগিয়ে আসতেই অরুনিকার হাত তার হাতে তুলে দিয়ে বলেন,

–আমার এই মেয়েটা সবচেয়ে লক্ষী অথচ ওকে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে, অনেক অপমানিত হয়েছে জীবনে। জন্মের পর থেকেই নানাজনের কাছে নানা কথা শুনতে হয়েছে। শুধুমাত্র ওর গায়ের রংটার জন্যই। এই যে তোমার হাতে তুলে দিলাম। সব দায়িত্ব এবার তোমার। আর যেন ওকে সেইসব কষ্টের দিনগুলো ফিরে পেতে না হয়। তুমিই দেখো বাবা।

আহরার কোনো জবাব দিতে পারলোনা। তার আগেই অরু হাওমাও করে কাঁদতে শুরু করলো। আরজু বেগমও আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারলেন না। তিনিও কাঁদছেন। তার কলিজায় বেঁধে রাখা সম্পদ, তার নাড়িছেঁড়া ধন আজ পর হয়ে যাচ্ছে। চাইলেও মেয়েকে আর এভাবে পাওয়া হবে না তার। মাকে শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে হাহাকার করে কাঁদছে অরু। আদ্রিকাও এসে একপাশ থেকে জড়িয়ে নেয়। সেও কাঁদছে সমান তালে। মা, মেয়েদের এমন ক্রন্দনরত দৃশ্য সকলকে ব্যথিত করছে। সকলের চোখেই অশ্রুর ভিড়।
আহরারের বুকটা ফেটে যাচ্ছে অরুকে এভাবে কাঁদতে দেখে। তার ইচ্ছে করছে সমস্ত চোখের পানি গায়েব করে দিতে। কান্না নামক শব্দটিকেই চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। অরুনিকার মন থেকে সকল কষ্ট নিমিষেই দূরীভূত করে দেওয়ার তীব্র ইচ্ছে গ্রাস করছে তাকে। মনে মনে বলে ওঠে, “এমনভাবে আর কখনোই তোমাকে কাঁদতে দেবো না অরু, কখনোই না।”

সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আহরার এবার অরুনিকাকে নিয়ে চললো তার বাড়ির উদ্দেশ্যে।
তার বাবার আনা গাড়িতেই তারা বসলো। আয়াজ ড্রাইভ করছে পাশেই আফতাব সাহেব বসেছেন। পেছনে আহরার আর অরুনিকা।
অদ্ভুত অনুভূতিতে ছেয়ে আছে অরুনিকার মন। সে জানে না সে কোথায় যাচ্ছে। তবে আহরারের প্রতি তার একটা বিশ্বাস কাজ করছে। এটুকু সে বুঝেছে এই মানুষটা আর যাই হোক তাকে একা করে যাবে না।
হুট করে লুকিং গ্লাসে চোখ পড়তেই দেখতে পায় আহরার তার দিকেই তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। বিব্রত হয়ে পড়ে সে। আরো জড়োসড়ো হয়ে গুটিয়ে নেয় নিজেকে। আহরারের ঠোঁটের কোণে খেলে যায় সূক্ষ্ম হাসি। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারিদিক। সিটে গা এলিয়ে দেয় ক্লান্ত আহরার। চোখ বুজে রেখেছে। সেদিকে একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি বাইরে ফেলতেই শিউরে উঠলো অরু। আলগোছে তার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়েছে আহরার। অন্ধকারে কারো বোঝার উপায় নেই। অরুনিকা কিছু বলেনা। স্থির হয়ে ওভাবেই বসে থাকে।
গ্রাম ছেড়ে শহরের রাস্তায় উঠলো তাদের গাড়িটি। কিছুদূর যেতেই অরুনিকার শরীর খারাপ করতে শুরু করলো। হাঁসফাঁস করতে থাকে সে। কিন্তু কাওকে কিছু বলছে না। তার অস্বাভাবিক নড়াচড়াতে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে আহরার। ব্যতিব্যস্ত হয়ে অরুনিকাকে প্রশ্ন করে,

–কি হয়েছে অরু? কোনো সমস্যা?

–কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে।

–আয়াজ একটু সাইড করে গাড়ি থামা তো।

আফতাব সাহেবের কথায় আয়াজ রাস্তার পাশে গাড়ি থামালো। পিছু ফিরে আফতাব সাহেব বলে উঠেন,

–বউমার শরীর খারাপ লাগছে বোধহয়। অরুনিকা মা তুমি বরং গাড়ি থেকে নেমে একটু হাঁটাহাঁটি করো ভালো লাগবে।

আহরার নেমে পড়ে গাড়ি থেকে। দরজা খুলে দিয়ে অরুনিকাকেও নামায়। জায়গাটা কিছুটা ফাঁকা রয়েছে। গাছগাছালিতে ভরা। বেশ সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। মন প্রাণ জুড়িয়ে দেওয়ার মতোই। অরুনিকা প্রাণভরে শ্বাস নিলো।
এদিকে গাড়ি থেকে পানি আনতে গিয়ে আহরার দেখে পানি নেই। আয়াজকে কিছুটা বকাবকি করে সে অরুনিকাকে এসে বলে,

–অরু, তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমি দেখি আশেপাশে কোথাও পানি পাওয়া যায় কিনা। একটু পানি খেয়ে, হাত-মুখ ধুলে কিছুটা রিল্যাক্স লাগবে।

অরু মাথা নাড়িয়ে সায় জানাতেই আহরার চলে যায় পানির খোঁজে। আয়াজ গাড়ি চেক করছে। সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। আফতাব সাহেব অরুনিকার পাশে এসে দাঁড়ান। অরুনিকা সংকোচে পড়ে যায়। আঙুলের নখ খুঁটতে থাকে সে। আফতাব সাহেব হেসে ফেলেন অরুনিকার জড়তা দেখে। তাকে সহজ করার জন্য বলে ওঠেন,

–শোনো মা অরুনিকা, একদম আমাকে শ্বশুর ভাববেনা বুঝেছো। বাবা ভাববে বাবা। আমি কিন্তু তোমার বাবা হই।

অরুনিকা চোখ তুলে তাকায় শ্বশুরের দিকে। তার নিজের বাবার কথা বড্ড মনে পড়ছে। আজ যদি তার সাথে তার বাবা থাকতো কেমন হতো সবকিছু? ভাবতে ভাবতেই বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। আফতাব সাহেব অরুর মাথায় এক হাত রেখে কোমলস্বরে বলে ওঠেন,

–মা, তোমাকে কিছু কথা বলি। তোমাকে দেখেই মনে হয় তুমি বেশ নরম মনের মানুষ। তাই শ্বশুর হিসেবে নয় বাবা হিসেবে তোমায় কিছু পরামর্শ দিবো। এই যে তুমি একটা বাড়িতে বউ হয়ে যাচ্ছো। সেই বাড়িটি কিন্তু যৌথ পরিবার। আর কি জানো, একটা যৌথ পরিবারের সব সদস্য কিন্তু একই রকম হয়না। মনমানসিকতার পার্থক্য থাকে। এখানে সবকিছু নিয়ে যেমন বেশি নাড়াঘাঁটা করা উচিত নয় তেমনি সবকিছুকে প্রশ্রয় দেওয়াও উচিত হবেনা। বাকিটা তুমি নিজ জ্ঞানে পরিস্থিতি বুঝেই বিবেচনা করে নিও। কিন্তু দিনশেষে আমার ছেলেটাকে সুখী কোরো। কারণ যে মানুষটার ভরসায়, যার হাত ধরে তুমি ওই বাড়িতে যাচ্ছো সেই মানুষটাকে তুমি সর্বদা তোমার পাশে পাবে। আর এই বুড়ো বাবাটাও কিন্তু তোমার সাথে আছে, তাই ভয় পেও না কখনো। নিজের মনকে দূর্বল হতে দিও না।

মাথা নিচু করে সমস্ত কথা মন দিয়ে শুনলো অরু। সে জানেনা তার শ্বশুরমশাই কেন এই কথাগুলো বলেছেন তবে এটুকু বুঝলো ভবিষ্যতে এই জ্ঞানগুলো তার কাজে আসবে।

–আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছো তো মা?

মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানায় অরু।

–শ্বশুর – বউমাতে কি কথা চলছে?

আহরারের কন্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকায় দুজন। পানির বোতল নিয়ে এসেছে সে। আফতাব সাহেব খানিকটা শাসনের সুরে বলেন,

–পানি উৎপাদন করে নিয়ে আসলি নাকি? এতো টাইম লাগে?

–আশেপাশে দোকান ছিলো না বাবা। কিছুটা দূরে গিয়ে পেলাম। নাও অরু। পানিটা খাও।

আফতাব সাহেব গাড়িতে গিয়ে বসেন। আয়াজও কিছুক্ষণ হাওয়া খেয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। অরুর পানি খাওয়া হলে হাতে মুখে মাথায় কিছুটা পানি ছিটিয়ে নিলো। আহরার বলে,

–এখন একটু ভালো লাগছে?

অরু মাথা নাড়ায়।

–গুড। তাহলে যাওয়া যাক।

দুজনে এসে গাড়িতে বসতেই গাড়ি ছুটতে শুরু করে।

ঘন্টা খানেকের মধ্যেই তারা এসে পৌঁছে যায় খান ভিলাতে। গাড়ি থেকে নামতেই একরাশ ভয় এসে জেঁকে বসে অরুর মনে। বাড়িতে আরো কতোজন আছে তা সে জানেনা। শ্বশুরমশাই বললেন যৌথ পরিবার। নিশ্চয়ই আরো অনেক মানুষ আছে। তারা কি সকলেই অরুনিকাকে মেনে নিবেন?
নাকি আহরারের মতো ছেলে অরুনিকার মতো একটা মেয়েকে এভাবে বিয়ে করায় কোনো বড় সড় ঝড় উঠবে? আহরার অরুনিকার হাত ধরে রেখেছে শক্ত করে। আয়াজ কলিং বেল বাজাচ্ছে। অরুনিকার বুকে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ মনে হচ্ছে কলিং বেল ছাপিয়ে যাবে। হাত-পা কাঁপছে তার। আহরার পাশ ফিরে তাকায়। হাতটা আরো শক্ত করে ধরে ভরসা দিয়ে বলে ওঠে,

–আমি আছি তো অরু। রিল্যাক্স।

দরজা খুলে যায়। ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে আমেনা। বহু বছর ধরে এ বাড়িতে কাজ করছে সে। ছোট্ট বেলা থেকে এখানেই মানুষ।
আয়াজ ভেতরে ঢুকে সোজা গিয়ে সোফায় বসে পড়ে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি নেই যেন তার আর।
আমেনা আফতাবের উদ্দেশ্যে বলে,

–ছোডো ছাছা আফনে আহরার ভাইয়ের লগে ক্যামনে আইলেন?

–বাড়ির সবাই কই আমেনা। যা তো সবাইকে ডেকে নিয়ে আয়।

তখনি আমেনার চোখ যায় আহরারের পেছনে আড়াল হয়ে থাকা অরুনিকার দিকে।

–ওমাগো, আহরার ভাইয়ের পিছে ওইডা ক্যাডা?

দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে অরু আহরারের পেছনে লুকিয়ে গিয়েছিলো। আমেনার কথা শুনে আহরার অরুনিকার হাত ধরে টেনে সামনে আনলো। কিন্তু আমেনার কথার জবাবটা আফতাব সাহেবই দেন,

–ও হলো তোর নতুন ভাবি। আহরারের বউ। যা সবাইকে ডেকে আন জলদি।

বলতে বলতে আফতাব ভেতরে ঢোকেন। আর আহরারকে বলেন অরুনিকাকে নিয়ে ওখানেই দাঁড়াতে। আফতাব সাহেবের কথা শুনে আমেনা কিছুক্ষণ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে তারপরই ছুট লাগায় সবাইকে খবর দিতে আর মনে মনে বলতে থাকে, “বড় ম্যাডাম জানলে আইজ বাড়িত কি যুদ্ধডায় না লাগবো, বাবাগো।”

এদিকে আফতাব সাহেব ভেতরে এসে একজন সার্ভেন্টকে বললেন, মিষ্টি সাজাতে। সার্ভেন্ট একটা ডিশে মিষ্টি সাজিয়ে আফতাবের হাতে দিতেই তিনি তা নিয়ে দরজার কাছে আসেন।

–বাড়িতে নতুন বউ এলো। আমার একমাত্র ছেলের বউ। মিষ্টিমুখ না করিয়ে কি ভেতরে আনা যায়?

আফতাব সাহেব যত্ন করে অরুকে মিষ্টি খাইয়ে দিলেন। তারপর বললেন,

–এইবার বউমা ঘরে ঢোকো। আর আলোকিত করে দাও পুরো বাড়ি।

আহরার ভেতরে প্রবেশ করে এক হাত বাড়িয়ে রেখেছে অরুনিকার দিকে। সেদিকে তাকিয়ে অরুনিকা পরপর কয়েকবার ফাঁকা ঢোক গিলে। কাঁপা কাঁপা হাতটা আহরারের দিকে বাড়িয়ে দিতেই আহরার তা ধরে নেয়। ভেতরে নিয়ে এলো অরুনিকাকে।
ততক্ষণে সেখানে ফারজানা, তাসফিয়া, আহিয়া এসে হাজির। আহরারের সাথে বউ সাজে অরুনিকাকে দেখে সকলেই বিস্ময়ে থ হয়ে চেয়ে আছে।

ওদিকে আমেনা সবাইকে খবর দিয়ে এবার আসে গুলবাহারের ঘরের সামনে। মনে মনে “আল্লাহ আল্লাহ ” জিকির করতে করতে দরজাটা ফাঁক করে সে। গুলবাহার এশার নামাজ সেরে এই সময়টাই তসবিহ পাঠে ব্যস্ত থাকেন। তাকে তখন বিরক্ত করা মানা। কিন্তু আজ যা ঘটেছে তাকে তো ডাকতেই হবে। আমেনা দরজার ফাঁক দিয়েই মুখ বাড়িয়ে মিনমিন স্বরে বলতে থাকেন,

–বড় ম্যাডাম! আফনেরে ছোডো ছাছা ডাকে।

গুলবাহারের রাগ হয় ভিষণ। আমেনার মুখে দুটো বারি লাগাতে ইচ্ছে হয় তার। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু বলেন না। এমনিতেও তিনি এখন কারো কথা শুনবেননা। তসবিহ পাঠ শেষ হলে তারপর।
আমেনা কোনো জবাব না পেয়ে ইতস্তত করতে থাকে। বুঝতে পারছে এখন কেউ মরে গেলেও গুলবাহার কথা শুনবেন না বা জবাব দিবেননা। কিন্তু সে যেই খবরটা দিতে এসেছে তা কারো মরার খবরের চেয়েও ভয়ংকর। তাই জবাব না পাওয়া সত্ত্বেও আমেনা কথাটা বলেই দেয়,

–বড় ম্যাডাম আহরার ভাই তো বিয়া কইরা ফালাইছে। নতুন বউরে নিয়া আইছে।

ঝট করে চোখ খুলে তাকান গুলবাহার। মাথা ভনভন করে ওঠে তার। চেঁচিয়ে বলে ওঠেন,

–কিইই! কি বললি আমেনাআআআ?

গুলবাহারের চিৎকার শুনে আমেনা নিজেই “ওবাবাগো!” বলে দৌড় লাগায়।

–আমেনাআআআ, তুই কি বললি আবার বওওওলললল।

গুলবাহার চেঁচাতে থাকেন। কিন্তু ততক্ষণে আমেনা ভোঁ দৌড়ে পগারপার।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here