রহস্যেঘেরা শহর চট্টগ্রাম,পর্ব-৫
লেখক-শাহ্রিয়ার আবিদ
থিতলিকে ছেড়ে আসতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল৷ তারপরেও তার নিরাপত্তার খাতিরে সিলেট রেখে এসেছি৷ জানি না, কতদিন লাগতে পারে আমার এ-ই পার্সোনাল মিশনে৷
.
পরদিনই সিলেট থেকে আবার চট্টগ্রাম ফিরে এসেছি৷ এমন মনে হচ্ছে যেন আমি আমার মূল্যবান কিছু সিলেট রেখে এসেছি৷ আসলেই রেখে এসেছি আমার মেয়েকে৷ ঘরে এসে দরজা খুলতেই দেখলাম,
মিল্টন এক কোণে বসে আছে৷
-” কিরে মন খারাপ। ”
আমার সাথে কথা বলছে না।
-” কথা বলছিস না যে, রাগ করেছিস। ”
মিল্টনের মাথা চুলকিয়ে দিচ্ছি, সে বার বার আমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে৷
-” এ-ই দেখ তোর জন্য কি এনেছি। ”
ব্যাগ থেকে একটা ঝুনঝুনি লাল নীল আলো জ্বলে এমন একটা রাবারের বল তার দিকে ছুঁড়ে দিতেই সেটা লুফে নিল।
-” ঘেউ ঘেউ। ”
-” কি বললি, আমি খারাপ তোকে সাথে নিয়ে যাই নি। আরে, তোকে সাথে নিয়ে যাই নি বলেই তো তাড়াতাড়ি চলে এলাম৷ ”
-” ঘেউ ঘেউ৷ ”
-” আচ্ছা ঠিক আছে৷ ”
মিল্টন এসে আমার হাট ছেটে দিল৷ আমিও তার মাথা চুলকিয়ে দিলাম৷
.
ফ্রেশ হয়ে নিলাম৷ আমার কিছু কাপড় প্যাক করে নিলাম সাথে খাবারও নিয়ে নিলাম৷ মিল্টনকেও কাপড় পড়িয়ে দিয়েছি৷ গলায় বেল্ট বেঁধে দিলাম। যদিও বেল্টের প্রয়োজন হয় না৷ তারপরেও গলায় বেঁধে দিলাম৷ আমার চেয়েও সে বেশি খুশি৷ অনেকদিন পর সে আমার সাথে বের হচ্ছে। আমি আমার ব্যাগে রিভলবারটি নিয়ে নিলাম৷ ল্যাপটপ, মোবাইল চার্জার ক্যামেরা নিয়ে নিলাম ব্যাগে৷
.
রেঞ্জ রোভারের পেছনের সিটে বেগ রাখলাম। মিল্টনকেও সেখানে বসতে বললাম সে বসলো না৷ আমার সাথে সামনেই বসবে৷ বেশ বসুক তাহলে! ঘরে তালা মেরে শেষ বারের মতো সবকিছু দেখে নিলাম৷
রেঞ্জ রোভার চলছে আধ পাকা রাস্তায়। এখনো চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর পর্যন্ত এসেছি। যেতে হবে রাঙ্গামাটিতে৷ পৌঁছাতে সাধারণত দুই ঘন্টা লাগবে কিন্তু রাস্তা খারাপ হওয়াতে সময় দ্বিগুণ লাগবে৷ চারপাশে ধ্বংসের চাপ, এখনো সবকিছু ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়নি৷
অনেকদিন পরে আবার চট্টগ্রাম শহরের এ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। চারপাশটা যতই দেখছি মনের ভেতরে বিষন্নতা কাজ করছে, কোনো একটা অন্ধকার ভারি কিছু যেন বুকটা দখল করে নিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, বাস টার্মিনাল পার করে এসেছি। অবশেষে রাউজান উপজেলায় ঢুকে পড়লাম। রাউজান উপজেলা বেশ বড় এ উপজেলা শেষ হতেই কাপ্তাইয়ের কাছে চলে যাবো৷
.
-” ঘেউ ঘেউ। ”
-” হ্যাঁ, সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাবো বলেছিই। এমন মরুভূমির মতো জায়গায় না। সামনে অনেক সুন্দর। ”
-” ঘেউ ঘেউ। ”
-” হ্যাঁ, সত্যিই বলছি। ”
মিল্টনও বিরক্ত হয়ে উঠল মিতুল আর তান্ত্রিকের করা ধ্বংসলীলা দেখে৷ এদিকে আমার মোবাইলে ‘বিফ বিফ’ আওয়াজ হচ্ছে৷ এটা অফিস থেকেই সংকেত দিচ্ছে। আমি তাদের নির্দেশিত এলাকা পাড় করছি । আমি অফিসে আগেই জানিয়ে দিয়েছি আমি যে রাঙামাটি আসছি৷
.
এভাবে নিষ্প্রাণের মতো চলতে একঘেঁয়েমি লাগছিল। তাই গান বাজিয়ে দিলাম, ‘অর্ণবের’ “সে যে বসে আছে ” আমার খুব পছন্দের গান এটি প্রায়ই শুনি৷ মিল্টনও ‘ঘেউ ঘেউ ‘ করে গান গাইছে৷ তার অবস্থা দেখে হেসেই ফেললাম৷
কিছু দূর আসার পর দেখি মিল্টন বার বার বাইরে উঁকি মারছে, গাড়ির গতি কমিয়ে ফেললাম। একটা সময় সে ‘ঘেউ ঘেউ ‘ করতে শুরু করলো! কিছু একটা সে দেখেছে, নাহয় হঠাৎ এমন করার কারণ কি? আমিও আশপাশে চোখ বুলালাম কোথায় কিছুই তো দেখতে পেলাম নাহ্ !
-” কিরে কি হয়েছে, এমন করছিস কেনো! ”
-” ঘেউ ঘেউ।”
-” কিহ্, মিথ্যা কথা৷ তুই ভুল দেখেছিস। ”
-” ঘেউ ঘেউ। ”
-” এটা একেবারে বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে যাচ্ছে না৷ ”
-” ঘেউ ঘেউ। ”
-” তুই নিশ্চিত তুই সত্যি দেখেছিস? ”
-” ঘেউ ঘেউ। ”
-” মেনে নিলাম তোর কথা সত্যি। কিন্তু এখন কি করবো? ”
-” ঘেউ ঘেউ। ”
-” পারবো না, তুই যা৷ আমি এখানে এসব করতে আসিনি আমি মিতুলের খোঁজে এসেছি৷ ”
-” ঘেউ ঘেউ। ”
-” তোর মতো নাকি যে মেয়ে দেখলেই হিরোগিরি শুরু করে দিবো৷ ”
-” ঘেউ ঘেউ। ”
-” কিহ্ এটাই নিয়ম। এখান থেকে একবার বাসায় যায় তারপর তোর নিয়মকানুন সব বের করে ফেলবো। তুই বেশি লুচ্চা হয়ে গেছস৷ ”
মিল্টনের সাথে এভাবে কথা বলে বেশ মজা পাই আমি। মিল্টন আবার বাইরের দিকে তাকিয়ে, ঘেউ ঘেউ করে উঠলো৷ এবার আমিও দেখতে পেলাম বিষয়টা৷ দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম, সাথে মিল্টনও নেমে পড়েছে৷
.
মেয়েটা একা একা কিছু একটা তোলার চেষ্টা করছে। আমি আর মিল্টন দৌঁড়ে গেলাম তার কাছে৷ মেয়েটার বয়স কুড়ি থেকে ঊনিশ হবে ৷ আমি আর মিল্টনকে এভাবে আকস্মিক দৌঁড়ে যেতে দেখে মেয়েটি ঘাবড়ে গেল৷
-” ভয়ের কিছু নেই, আমরা আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি৷ বেশ কিছুক্ষণ যাবত দেখছি আপনি কিছু একটা উপরে তোলার চেষ্টা করছেন৷”
মেয়েটির উদ্দেশ্যে বললাম, তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখনো ভয় পাচ্ছে আমাদের৷
-” তাইশা লোকটা কে? ”
এবার আমি আর মিল্টন ভয় পেয়ে গেলাম । এটা কোন ধরনের ব্যাপার! আশেপাশে মানুষ নেই কিন্তু কথা বলছে! জানতে চাইছে কে ওখানে! আমার হাত আপনাআপনি কোমরে গোঁজা রিভলবারের উপর চলে গেল। মিল্টন পাশ থেকে ‘ঘেউ ঘেউ ‘ করে উঠলো। সেও ঘাবড়ে গেলো!
.
মেয়েটা অল্প কিছুক্ষণ পর হাত দিয়ে ইশারা করে দেখাল একটা ড্রেইনের মুখের উপর৷ আর সেটা বড় একটা পাথর দিয়ে চাপা দেয়া৷
-“তাইশা তোমার কি কোনো সমস্যা হয়েছে? ”
আবার বলে উঠলো কন্ঠস্বরটা! খেয়াল করলাম ওটা পাথর চাপা দেয়া বড় ড্রেইনের মুখ থেকে আসছে। বুঝতে আর বাকি রইলো না৷ কি করতে হবে সেটাও বুঝে গেছি৷ রিভলবারের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলাম৷ ড্রেইনের মুখ চাপা দেয়া পাথরটাকে ধাক্কা দিতে শুরু করলাম৷ কিন্তু সহজে নড়ছে না, বেশ ভার!
.
পাথরটা অল্প করে বেশ খানিকটা সরিয়েছি এখন ভেতরে থাকা ছেলেটার চেহারা দেখতে পাচ্ছি৷ একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছি৷ খানিক্ষন জিরিয়ে আবার ধাক্কা দিতে শুরু করলাম৷ তবে এবার আমি একা নই আমরা তিনজন মিল্টন আর মেয়েটি সহ৷
.
অবশেষে পাথরটি সরাতে সক্ষম হলাম, আর আমি এতক্ষণ যা বড় ড্রেইনের মুখ মনে করেছি সেটা আসলে ড্রেইন নই সুড়ঙ্গের মুখ! অবাক হওয়া ছাড়া বিকল্প কিছুই ছিলো না৷ এখানে সুড়ঙ্গ এলো কোত্থেকে? আর ছেলে আর মেয়েটি কে? কি করছে তারা দুজন এখানে ?
এদিকে আমি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টাই। আর ওদিকে বদের হাড্ডি মিল্টন মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে৷
মনে মনে বললাম, ” তুই আর শোধরাবি নাহ্৷”
চলবে…