রঙ চা পর্বঃ১৫,১৬

রঙ চা
পর্বঃ১৫,১৬
লেখা – মাহফুজা_মনিরা

——–নিশু
নিশুতি পেছন ফিরে তাকায়। তার চোখে স্পষ্ট পানি। প্রায়াণের কলিজা টা আবার ধক করে উঠে। উফ,এই কলিজা টাও না। কাজে অকাজে ধক ধক করে!! ডিজগাস্টিং!!
প্রায়াণ বুকে হাত চেঁপে ধরে নিশুতির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দুর্বল গলায় বললো,
———কাঁদছো কেনো? কি হইছে?
নিশুতি প্রায়াণের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। চাপা কান্নার আওয়াজে চারিপাশ ভারি হয়ে উঠে। প্রায়াণ আকস্মিক ঘটনায় হতবাক। শুধু নিশুতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে মৃদু ভাবে। একটা সময় নিশুতির কান্না আপনা আপনি কমে আসে। নিশুতি মাথা তুলে তাকায়। চোখের পানি আর নাকের পানিতে প্রায়াণের শার্ট ভিজে একাকার। প্রায়াণ খাপছাড়া দৃষ্টিতে নিশুতির দিকে তাকায়। নিশুতি স্মিত হেসে বললো,
———সরি।
প্রায়াণ আঙুলের ডগা দিয়ে নিশুতির ফোলা চোখ দুজোড়ার আশপাশ মুছতে মুছতে বলে,
———কাঁদছিলে কেনো?
নিশুতি ফোপাঁতে ফোপাঁতে বললো,
———স্বপ্নে আম্মুকে দেখছিলাম। সেই এক্সিডেন্ট, সেই আম্মুর মৃত লাশ এসব…তাই।
প্রায়াণ বুঝতে পারে নিশুতি তাহলে এতক্ষণ তার মায়ের কথা আওড়াচ্ছিল। অজানা একটা প্রশান্তিতে বুক ভরে যায়। সেই প্রশান্তি সে প্রকাশ করে না। ব্যথাতুর কণ্ঠে বলে,
———-একদিন সবাইকেই চলে যেতে হবে নিশুতি। কেউ আগে যায়,কেউ পরে। বাট যায় তো! তাহলে? এভাবে কান্না করলে হবে? হবে না। বরং নামাজ পড়ো। মায়ের জন্য দোয়া করো।
নিশুতি শরীর কাঁপছে। সে দাড়াতে পারছে না একটুও। ধপ করে ঠান্ডা ফ্লোরেই বসে পড়ে৷ প্রায়াণ নিশুতিকে টেনে ধরে,
———-ঘরে চলো। ঠান্ডা ভীষণ।
নিশুতি হালকা কণ্ঠে বললো,
———-এখানেই কিছুক্ষণ বসো না।
প্রায়াণ কথা বাড়ায় না। চুপ করে নিচে বসে। নিচে বসতেই তার গা শিউরে উঠে। উফ! কি ঠান্ডা! কি শীতল!
তবুও প্রায়াণ রাও করে না। নিশুতির পাশ ঘেঁষে বসে চুপচাপ। দুজনেই চুপ। নিশুতিই হালকা আওয়াজে বলতে শুরু করে,
———-সেদিন নভেম্বর এর এরকমই একটা শীতের রাত ছিল। আম্মু নানা বাড়ি যাবে। আরজেন্ট! আমার আবার ফাইনাল পরীক্ষা সামনেই। আমি বললাম,কয়দিন পরে যাও। আমিও সাথে যাবো তোমার তখন। আম্মু মানলো না। আর আমি অতটুকুন একটা মেয়ে,আমার কথা শুনবেই বা ক্যান! বাবার অফিস থেকে ছুটি পেলো না। মা একাই রওনা হলো রাতের বাসে। তখন আবার অবরোধ। ঢাকা শহরের অবস্থা ভালো না। একটা আতংক চারিদিকে। আমি রাত জেগে পড়ছিলাম৷ তবুও মনে একটা চাপা ভয় কেমন জানি। রাত ৩ টার দিকে চোখ লেগে আসে। কেউ ফোন করছিল বাবার নাম্বারে। আমি আধো ঘুমেই শুনলাম বাবা ডাকছে আমায়। বললো,বাহিরে যাচ্ছে। আমি যেন দরজা আটকে রাখি। আর কোথাও বের না হই। সকাল বেলা বাবা ফিরে আসে। কি যে ক্লান্ত তার চেহারায়! কি যে দুর্বলতা তার কণ্ঠে। আমার আর সেদিন স্কুল যাওয়া হলো না। আমি উদগ্রীব কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা কি হয়েছে? বাবা এতটুকুই বলতে পারলো,ঢাকা পার হতে না হতেই কারা যেন আম্মুদের বাসটায় আগুন লাগিয়ে দিছিল। আম্মু বের হতে পারেনাই বাস থেকে। বাসের ভেতরে জ্বলে পুড়ে….
নিশুতি আর বলতে পারে না। ঢুকরে কেঁদে উঠে। প্রায়াণ থতমত খায়। তার চোখেও পানি ছলছল। প্রায়াণ নিজেকে সামলায় তারপর নিশুতির দু’গাল চেপে ধরে বলে,
———আমাদের সব থেকে প্রিয় মানুষ টাকে আল্লাহ একটু তাড়াতাড়িই নিয়ে যায়। এটা একধরনের পরীক্ষা। তুমিও এই পরীক্ষা টাই দিচ্ছো মনে করো। তাই নিজেকে শক্ত করো। তোমার আম্মু যেখানেই থাকুক,ভাববা তোমার সাথেই আছে। আর তুমি যদি এভাবে কান্না করো সে তো কষ্ট পাবে তাইনা? তাই কাঁদবে না। একদম কাঁদবে না। শুনছো?
নিশুতি ঠোঁট চেঁপে বলে,
———হুম।
প্রায়াণ নিশুতির মুখ টা উঁচু করে তুলে বলে,
———আর একটুও কাঁদলে আমি তোমাকে পিট্টি দিবো কিন্তু।
নিশুতি ছলছল চোখেই ঠোঁট উল্টায়। রিনরিনে কণ্ঠে বলে,
——–কচু দিবেন।
প্রায়াণ চোখ গরম করে বললো,
——–আবার আপনি?
নিশুতি জিহ্ব কেটে বললো,
——–মানে কচু দিবা। আর সাথে চিংড়ি মাছও দিও হু? কচু উইথ চিংড়ি মাছ,ভাজি করে খাবো। উমমম কুব ট্যাশ!
নিশুতির বলার ভঙ্গি দেখে প্রায়াণ হো হো করে হেসে ফেলে।
বাকি রাত টুকু তাদের গল্পতেই কেটে যায়। ফজরের আজান কানে আসতেই নিশুতি বলে,
——–অযু করেন। আজকে দুজনে একসাথে নামাজ পড়বো। পড়বেন?
প্রায়াণ বললো,
———এখনো আমার বউ হও নাই ম্যাডাম। যখন হবেন তখন একসাথে পড়বো। আমি রিসোর্টের মসজিদে গিয়ে পড়ে নিবো। আপনি রুমেই পড়েন। আর আমাকে আর একবার আপনি করে বললে খাবেন মাইর।

নিশুতি কথার প্রসঙ্গ পাল্টায়। চোখ বড়বড় করে বললো,
———রিসোর্টে মসজিদও আছে??
———তো আবার কী? এটা যেন তেন রিসোর্ট না। অনেক নামী দামী রিসোর্টের মধ্যে একটা। আর অনেক খাটি মুমিনও আসে তাদের ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে। তো তারা কোথায় নামাজ পড়বে? এখানে সব ব্যবস্থা আছে। সউউউউউব।
নিশুতি এক ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
———ওহ আচ্ছা!
তারপর দুজনেই উঠে যায়। প্রায়াণ বাহিরে চলে যায়। আর নিশুতি ওয়াশরুমের দিকে। অযু সেড়ে নামাজ আদায় করে নেয় নিশুতি। মোনাজাতে বারবার এটাই প্রার্থনা করে যেন এই সময় গুলো আজীবনের মতো থমকে যায়। প্রায়াণ নামের এই ছেলেটার সাথে আজীবনের মতোন যেন সে থাকতে পারে। সুখে থাকতে পারে।
নিশুতি মোনাজাত শেষে উঠে দাঁড়ায়। জায়নামাজ ভাজ করে আবার তার ব্যাগে ভরে নেয়। ভাগ্যিস বাসা থেকে জায়নামাজ টা মনে করে এনেছিল!
তারপর বসে অপেক্ষা করতে থাকে প্রায়াণের।

প্রায় ৬ঃ৩০ বেজে গেলেও প্রায়াণ আসে না। নিশুতির কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। এতক্ষণ তো লাগার কথা না! একবার দরজা খুলে লোনের এদিক ওদিক দেখে নিশুতি। কোথাও প্রায়াণের টিকি টাও দেখা যাচ্ছে না। নিশুতি অস্থির মনে আবার রুমে এসে বসে। বিছানায় উঠে পা দোলাতে থাকে অনবরত। ভীষণ মেজাজ গরম হচ্ছে তার। আজকে আসুক বেয়াদব টা। দেখে নিবে সে একদম।

ঘড়ির কাটা যখন ৮ টা পার করে,নিশুতির তখন প্রাণ যায় যায় অবস্থা। প্রায়াণ তাকে ফাকি দিয়ে পালিয়ে গেলো নাকি! নাহ এমন ছেলে তো প্রায়াণ না। নিশুতি একবার বারান্দায় ছুটে যায়। আবার রুমে ফিরে আসে। আবার বারান্দায় ছুটে যায়,আবার রুমে ফিরে আসে। চোখ দুটো লাল হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। জ্বলছে ভীষণ। নিশুতি সিদ্ধান্ত নেয়,এবার বাইরে গিয়েই খুঁজবে প্রায়াণ কে। যেই ভাবা সেই কাজ। ওড়না দিয়ে ভালো করে মাথাটা মুড়িয়ে নেয়। তারপর দরজা খুলতেই দেখে প্রায়াণ দাঁড়িয়ে। নিশুতির বুক থেকে একটা পাথর নেমে যায় আস্তে ধীরে। কিন্তু রাগের আগুন টা বাড়তে থাকে ধীরেধীরে। নিশুতি কিছু না বলে চুপ করে রুমে ফিরে এসে বসে। প্রায়াণ আসে পিছুপিছু। নিশুতির পাশে এসে দাড়াতেই নিশুতি বললো,
———কোথায় ছিলেন?
নিশুতির কণ্ঠে স্পষ্ট ঝাঁঝ।
প্রায়াণ কাইকুই করে বললো,
——–আমি নামাজ শেষ করে জায়নামাজের পাটিতেই ঘুমিয়ে গেছিলাম।
নিশুতি অবিশ্বাস্য চোখে প্রায়াণের দিকে তাকায়। প্রায়াণ ইনোসেন্ট মার্কা হাসি হাসে। সেই হাসি নিশুতির সমস্ত রাগ,সমস্ত ঝাঁঝ কমিয়ে একদম শূন্যের কোঠায় নামিয়ে দেয়। উফ! এই ছেলের হাসিতে কী এমন জাদু আছে কে জানে।
নিশুতি প্রকাশ করে না কিছু। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাগী গলাতেই বলে
———তো এখন আসছেন কেন? ওখানেই থাকতেন। রুমে যে কেউ অপেক্ষা করছে সেটা তো আর আপনার বুঝতে হবে না।
প্রায়াণ নিশুতির সামনে হাটু গেড়ে বসে বললো,
———-সরি।
নিশুতি অন্যদিকেই মুখ ঘুরিয়ে থাকে। প্রায়াণ আবারো বললো,
———-সরি। তুমি যা শাস্তি দিবা,তাই মাথা পেতে নিবো। পাক্কা।

নিশুতির মাথায় বুদ্ধি খেলে উঠে। সে আঁড়চোখে প্রায়াণের দিকে তাকিয়ে বলে,
———-পাক্কা?
প্রায়াণ মাথা নাড়িয়ে বললো,
———হুম।
নিশুতি দুষ্টুমি হাসি হাসে। উঠে গিয়ে তার এই কয়দিনের ব্যবহৃত জামা গুলো বের করে। তারপর প্রায়াণের একহাত টেনে বাথরুমে নিয়ে যায় তাকে। জামা কাপড় গুলো বালতিতে ফেলে বলে,
———দোকান থেকে ডিটারজেন্ট পাউডার নিয়ে আসেন। এইগুলা ধুবেন এক্ষুনি। এটাই আপনার শাস্তি।
প্রায়াণ হতবিহ্বল।
চোখ নিভু নিভু থেকে বড় হয়ে গোল টমেটো হয়ে গিয়েছে তার। নিশুতি সে চোখের ভাষা বুঝে। মাথা এপাশ ওপাশ দুলিয়ে ঢঙ্গি গলায় বলে,
———মোটেও মজা করছি না আমি। এটাই শাস্তি আপনার। এবার যান,গিয়ে ডিটারজেন্ট পাউডার নিয়ে আসেন।
প্রায়াণ আহত গলায় বলতে নেয়,
——-নিশ….
——–চুপ।
নিশুতি ধমকে উঠে।
———একদম চুপ। কোনো কথা শুনবো না।এটাই শাস্তি….
.
.
নিশুতি বাথরুমের সামনে “দ” ভঙ্গিতে বসে আছে। প্রায়াণ সেন্টু গেঞ্জি পড়ে আছে এখন। নিশুতির প্রথম প্রথম লজ্জা লাগলেও এখন আর লজ্জা লাগছে না। মাঝে মাঝে গলা খাকারি গিয়ে বলছে,
———দ্রিম দ্রিম শব্দ হয়না কেন? জোরে জোরে খাচেন কাপড় গুলো। যদি পরিষ্কার না হয় তো আবার ধোয়াবো।
প্রায়াণের রাগে শরীর জ্বলছে। নিশুতির জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে দু কানের তলা বাজিয়ে দিতো শিউর। কিন্তু নিশুতিকে কিছুই বলতে পারছে না আর কখনো পারবেও না বোধহয়। এইজন্যেই তো মানুষ বলে,বাঘ ও বাঘিনীর সামনে বিড়াল হয়ে যায়।

প্রায়াণ এবার শব্দ তুলে আছাড় মারে কাপড় গুলো। নিশুতি আবার ধমকে উঠে।
——–এটা হোটেল।মানুষ কি বলবে? এতো শব্দ করছেন কেনো? আস্তে আস্তে…

প্রায়াণ চোখ পাকিয়ে তাকায় নিশুতির দিকে। নিশুতি মুখ টিপে টিপে হাসে। প্রায়াণ মনে মনে ভাবে,আজকের রাত টা হোক,এই হিসেব সে নিয়েই ছাড়বে নিশুতির থেকে…

চলবে…

রঙ চা
পর্বঃ১৬
লেখা – মাহফুজা_মনিরা

একটা চেনা কণ্ঠ শুনতেই নম্রতা পেছন ফিরে তাকায়। দেখে বাইক নিয়ে শান দাঁড়িয়ে। বাইক টাকে সাইড করে নম্রতার সামনে এসে বললো,
———হায় নম্রতা।
নম্রতা ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দেয়,
———হ্যালো।
তারপর হাতঘড়িতে চোখ নিবদ্ধ করে। শান একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায়। নম্রতার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা আর কি! নম্রতা হাতঘড়ির থেকে চোখ তুলে শানের দিকে তাকায়। শান দায়সারাভাবে হাসে একটু।

———কোথায় যাবেন?
শানের প্রশ্ন।

নম্রতা উত্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
———-ভার্সিটি। আজকে এক্সাম আছে। ঘুম থেকে উঠতে লেইট হওয়ায় ভার্সিটির বাস মিস করছি। এখন লোকাল বাসের অপেক্ষায় আছি অথচ দেখুন না,কোনো খবর নেই বাসের!

শান ও উত্তর দিকে তাকিয়ে বলে,
———হুম তাই তো দেখা যায়। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করবো আপনাকে?

এবার নম্রতা শানের দিকে তাকায়। একদম চোখের দিকে। শানের বুকের ভেতরটা কেমন যেন মুচড়ে উঠে। এতটা শান্ত চাহনির কোনো মেয়েকে তার এই প্রথম দেখা!
নম্রতা মৃদু গলায় বলে,
———-হুম বলুন।
শান নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
———-নদীর পাড়ে আসেন না যে!
———-ওহ! আসলে টাইম পাই না। আবার জব শেষে বাসায় গিয়ে স্টাডি করতে হয়। এক্সাম তো!

শান বুঝ ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললো,
——–ওহ আচ্ছা।
অথচ তার মন বলছে এই কারনে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে পরিবেশ উপভোগ করাটা মিস দেওয়ার মতো মেয়ে নম্রতা না। এর পেছনের কারন অন্য। কিন্তু সেটা কী! শান আর আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করেনা।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান বললো,
——–এক্সাম না মিস হয়ে যায় আপনার!
——–হুম। তাই তো মনে হচ্ছে।
নম্রতার কণ্ঠে স্পষ্ট চিন্তা।

শান নম্রতার কাছাকাছি আরেকটু সরে এসে বলে,
———আপনি কিছু মনে না করলে আমার বাইকে আসতে পারেন। আমি আপনাকে পৌঁছে দি।

নম্রতা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় শানের দিকে। শান থতমত খায়। আমতা আমতা করে বলে,
———আপনার এক্সামের কথা ভেবেই বললাম!

নম্রতা চোখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ কি যেন ভাবে। এরপর শানের দিকে ফিরে বললো,
———-আচ্ছা চলুন।

শান প্রথমে অবাক হলেও পরে খুশি হয়। বলে,
——–হুম আসুন।

শান বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দেয়। তার পেছনে চড়ে বসে নম্রতা। দুজনের মাঝে দূরত্ব আছে বেশ খানিকটা। তবুও যেন শানের শান্তি। এভাবে যদি সারাটা জীবন নম্রতাকে বাইকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারতো!

ওরা বাইকে করে যাওয়ার সময় ব্যাপারটা জালাল শেখের নজরে পড়ে। সে কিঞ্চিৎ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। ভাবতে থাকে ছেলেটার কথা। তার ছেলের হবু বউ অন্য এক ছেলের বাইকের পেছনে। ব্যাপারটা মোটেও শোভনীয় নয়। জালাল শেখ মনে মনে ভাবেন,এই ব্যাপারটা তাকে একটু ঘেটে দেখতে হবে।
.
.
ফোন বাজতেই নিশুতি প্রায়াণ কে উদ্দেশ্য করে বললো,
———আমি ফোনের কাছে যাচ্ছি। ভালো ভাবে কাপড় গুলো ধোয়া চাই। নাইলে আবার ধোয়াবো কিন্তু…
প্রায়াণ উত্তরে একটা মুখ ভেংচি ছুড়ে দেয় নিশুতির পানে। নিশুতি সেটা দেখেও এড়িয়ে যায়। মনে মনে ভাবে,ইফতির ফোন নিশ্চয়ই। কিন্তু না,তার কাকা নাসির হোসেনের ফোনকল।

নিশুতি বারান্দায় গিয়ে ফোন রিসিভ করে।

——–আসসালামু ওয়ালাইকুম কাকা।

———ওয়ালাইকুম আসসালাম।।কেমন আছো মা?

———আলহামদুলিল্লাহ কাকা। ভালোই আছি।

———টাকা পয়সা লাগবে কিছু?

———নাহ লাগবেনা কাকা।
নিশুতি মনে মনে বলে,তোমার দেওয়া ১০ হাজার টাকার পুরোটা এখনো আমার কাছে আছে। একটা টাকাও খরচ করতে দেয়নি প্রায়াণ।

———হ্যালো নিশু মা।

নিশুতি সম্বিত ফিরে পায়।
দ্রুত বললো,
———-হ্যাঁ কাকা শুনছি তো। বলেন।

———–এদিক টা নর্মাল হয়ে গেছে একদমই। তুমি চাইলে এখন ফিরে আসতে পারো। মেয়ে মানুষ একা একা আর কতদিন থাকবা এত দূরে!

নিমিষেই নিশুতির মনটা ছোট হয়ে যায়। ফিরে যাওয়া! মানে প্রায়াণের থেকে আবার দূরে চলে যাওয়া! এই কয়দিন প্রায়াণের সাথে থাকতে থাকতে, তাকে ছাড়া বা তার থেকে দূরে থাকাটা নিশুতির মন মানতে চাইছে না কিছুতেই।

———হ্যালো! কিছু বলছিস না কেনো নিশু?

নিশুতি হালকা কণ্ঠে বললো,
———হুম আসবো কাকা।

———তাহলে আজ কালকের ভেতরেই চলে আয়।

——–আচ্ছা।

——–রাখছি মা। ভালো থাক।

নিশুতি আর বায় বলে না। ফোনের লাইন কেটে দেয়। ইতিমধ্যে প্রায়াণের কাপড় ধোয়া শেষ হয়। সে ধোয়া কাপড় গুলো চিপে বালতিতে করে বারান্দায় নিয়ে আসে। একটা একটা করে ঝাড়ছে আর দড়িতে নাড়ছে। নিশুতি বারান্দার গ্রিলের উপর থুতনি রেখে উদাসী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
সব কয়টা কাপড় নাড়তে দেওয়া শেষে প্রায়াণের নজর পড়ে নিশুতির উপর। সে সেন্টু গেঞ্জির এক কোণায় হাত মুছতে মুছতে নিশুতির পাশে এসে দাড়ায়। চিন্তিত হয়ে বলে,
———কি? এখনো রাগ কমেনি আমার উপর? মন খারাপ করে আছো যে!

নিশুতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। প্রায়াণের দিকে তাকিয়ে বলে,
———কাকা ফোন দিয়েছিল। বললো আজ কালকের ভেতরেই ঢাকা চলে যেতে।

কথাটা শুনে নিশুতির থেকেও বেশি কষ্ট হয় প্রায়াণের ভেতরে। এত তাড়াতাড়ি তাদের এই লাভিং জার্নি টা শেষ হয়ে যাবে নাকি!

প্রায়াণ নিজের দুমড়ে মুচড়ে উঠা হৃদয়ের কথা নিশুতির কাছে প্রকাশ করে না। দায়সারাভাবে বললো,
——–তুমি কি বললা?
——–বলেছি যে আচ্ছা।
——–ওহ!
প্রায়াণের কিছু বলার মতো নেই আর। আজ হোক বা কাল,একদিন তো যেতেই হবে তাদের ঢাকা ফিরে। তখন হয়তো সম্পর্ক থাকবে,কিন্তু এভাবে না। এতো কাছাকাছি পাশাপাশির সম্পর্ক হয়তো থাকবে না। আর ভবিষ্যতে হবে কী না তার কী নিশ্চয়তা?

প্রায়াণ বারান্দা থেকে ভেতরের রুমে আসে। ডিভানের উপর থাকা পানির বোতল নিয়ে কিছু পানি খায়। তারপর বোতল হাতেই বিছানার উপর বসে। নিশুতি বিছানার পাশেই দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। পা দিয়ে টাইলসে খোচাচ্ছে। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি খেলে উঠে।
দৌড়ে প্রায়াণের সামনে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে বললো,
——–দুদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই না চলুন! ইফতিকে বলি? ও কাকাকে রাজী করিয়ে ফেলবে পাক্কা। এরপর দুটোদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই?

প্রায়াণের ভালো লাগে আইডিয়াটা। উল্লাসিত গলায় বললো,
———হুম ঘুরা তো যায়ই। আর এতো সুন্দর জায়গায় এসেছো অথচ ঘুরবা না! কেমন না?

নিশুতি খুশিতে ডগমগ হয়ে বললো,
——–হুম হুম। আমি এক্ষুনি ইফতিকে ফোন করছি।
.
ইফতি সবেমাত্র সকালের নাস্তা সেরে ছাদে উঠেছে স্নুপিকে নিয়ে। নিশুতি আর প্রায়াণের অবর্তমানে সেই স্নুপির মালিক। ঠিক এমন সময় নিশুতির ফোন।

———হ্যাঁ বোন শুভ সকাল।
———শুভ সকাল ভাই।।কি করিস।
———ছাদে। হাটাহাটি।
———ওহ শোন না। একটা কথা রাখবি?
———আগে বল।
———কাকা ফোন করে বললো আজ কালকের ভেতরেই চলে আসতে। আমি দুটোদিন সিলেট শহরের বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে চাই। সো তুই যদি একটু কাকাকে রাজী করাতি!এরকম সুযোগ তো বারবার আসবে না।

ইফতি গম্ভীর গলায় বললো,
——–প্রায়াণ ভাইয়ের সাথে ঘুরবি?

নিশুতি ইতস্তত করে বললো,
——–হুম।
ইফতি আর বাধা দিলো না। দায়সারাভাবে বললো,
———ওকে। আমি কাকাকে বলবোনি।
নিশুতি খুশিতে ডগমগ হয়ে বললো,
———লাভ ইউ ব্রো। রাখি রে বায়।
নিশুতি ফোন রেখে দেয়। ইফতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যেই প্রায়াণের জন্য নিশুতির বাসা থেকে পালাতে হলো,সেই প্রায়াণকেই আজ নিশুতি ভালোবাসে। সেটা নিশুতি না বললেও, ইফতি স্পষ্ট বুঝতে পারছে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here