রঙ চা
পর্বঃ০৭,০৮
লেখা – মাহফুজা_মনিরা
রাতের বেলা……
বারান্দার ঠান্ডা ফ্লোরে বরফের মতো জমে বসে আছে নিশুতি। ইফতি ভাতের প্লেট নিয়ে আসে।
নিশুতির ঠিক পাশ ঘেঁষে বসে।
———ভাত খাবিনা?
নিশুতি দু হাটুর উপরে মুখ রেখে বলে,
———ইচ্ছে করছে না ভাই। আজকে প্লিজ জোর করিস না।
ইফতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাতের প্লেট খানা দূরে সরিয়ে রাখে।
——–তুই কি তাহলে মনে মনে ডিসিশন নিয়েই নিয়েছিস এই বিয়েটা করার??
নিশুতি উত্তরে কিছু বলে না। চুপ করে থাকে।
ইফতি খানিকক্ষণ নিশুতির দিকে তাকিয়ে থেকে অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে তার।
আলগোছে চোখে জমা পানি মুছে নেয় ইফতি। তারপর গম্ভীরমুখে নিশুতির দিকে তাকিয়ে বলে,
———আমাকে কতটা ভালোবাসিস??
নিশুতি হাটু থেকে মুখ তুলে ইফতির দিকে তাকায়। মুখে শুকনো হাসি ফুটিয়ে বলে,
———যতটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না ততটা।
ইফতিও একটুখানি হাসে নিশুতির কথা শুনে।
——–তাহলে আমি একটা অনুরোধ করবি রাখবি??
——–হুম চেষ্টা করবো বল।
——–দাড়া আসতেছি।
নিশুতিকে বারান্দায় বসিয়ে রেখে ইফতি ভেতরের রুমে যায়। দু মিনিট পর একটা ছোট ব্যাগ হাতে নিয়ে আসে।
——–কি এটা ভাই?
নিশুতি ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
ইফতি আবারো নিশুতির পাশ ঘেঁষে বসে বলে,
———এটায় ১০ হাজার টাকা আছে। তুই এটা নিয়ে সিলেট চলে যা। কোনো একটা রিসোর্ট ভাড়া করে থাক। আরো যত টাকা লাগে আমি পরে পাঠিয়ে দিবো তোকে। তুই যা বোন,এখানে থেকে মরিস না এভাবে!!
নিশুতি আশ্চর্যের সপ্তম আসমানে পৌছায়।
অবাক হয়ে ক্ষীণ গলায় বলে,
——–এত টাকা তুই কই পেলি??
———কাকাকে ফোন করেছিলাম। কাকা দিয়েছে। আর বলছে তোকে সিলেট চলে যেতে বা চট্রগ্রাম। বা যেখানে ইচ্ছা। কাকার বাসায় গেলে আব্বু যদি ঝামেলা করে তাই তুই এমন জায়গায় যা যার কথা শুধু আমি আর কাকা জানবো আর কেউ না।
নিশুতি বেকে বসে।
———না না। আমি এভাবে যেতে পারিনা। পরে সবাই তোর উপরে অত্যাচার চালাবে।
———চালাবে না। আমি আম্মুর পেটের সন্তান। সে ঠিকি আমাকে বিশ্বাস করবে। তোর যাওয়া প্রয়োজন।
———না আমার যাওয়ার কোনো দরকার নেই।
ইফতি রাগী গলায় বলে,
———যাবি না??
———না।
ইফতি উঠে দাঁড়ায়। বারান্দার গ্রিলের কাছে এসে বলে,
———ওকে যাইস না। করিস কালকে ঐ বুইড়া কে বিয়া। আর ওর লগেই সংসার পাতিস। আমাকেও ভুলে যা। আমি যে তোর ভাই সেটাও ভুলে যা। তোর সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক নাই। যা তুই। যা ইচ্ছা কর।
ইফতি ভীষণ রেগে গেছে। নিশুতি মুচকি হাসে ইফতির কান্ড দেখে। কে বলবে এই ছেলে নিশুতির থেকে ৪ বছরের ছোট!!
নিশুতিও উঠে দাঁড়ায়। ইফতির পাশে দাঁড়িয়ে ইফতির হাত থেকে টাকার ব্যাগ টা নিয়ে বলে,
———-কতদিন লুকিয়ে থাকতে হবে?
ইফতি বোনের দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে বলে,
———যতদিন না এদিকের সব ঠিক হচ্ছে ততদিন।
নিশুতি ইফতিকে জড়িয়ে ধরে। খুব শক্ত করে।
———আমি সিলেট যাবো ভাই। একা একা কিভাবে যাবো বল তো! আমি তো এর আগে কখনো স্কুলেও একা যাইনি!
ইফতি বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
——–পারবি তুই। এখন অনেক বড় হয়েছিস। আমি যদি যাই তবে এদিকে কে সামলাবে! তুই ডাইরেক্ট গাবতলি যাবি। ওখান থেকে সিলেটের বাসে সোজা সিলেট।
নিশুতি নিচুস্বরে বলে,
———আচ্ছা।
.
.
ছোট্ট একটা ব্যাগে প্রয়োজনীয় কিছু জামা কাপড় নেয় নিশুতি। ফোনের সিমকার্ড বদলে একটা নতুন সিমকার্ড নেয়। যার নাম্বার শুধুমাত্র ইফতি আর তার কাকাই জানবে। অন্য কেউ না।
ব্যাগের একদম তলায় টাকা গুলো লুকিয়ে নেয় নিশুতি। তারপর পা টিপে টিপে মেইন ডোর খুলে বাহিরে আসে তারা।
ইফতিকে আবারো জড়িয়ে ধরে নিশুতি। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। নিয়তি আজ কোথায় এনে দাড় করিয়েছে তাকে!
ইফতি নিশুতির দুগালে হাত চেঁপে ফিসফিসিয়ে বলে,
———সাবধানে যাস। আমি পরে ফোন করবো তোকে। আর রাস্তায় কোথাও দাড়াবি না। বুঝে শুনে যাস আপু।
নিশুতি ইফতির ছোট ছোট চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে বলে,
——–আমি তোর থেকে চার বছরের বড়! আমি পারবো বুঝছোস? পাকনা বুড়া!
ইফতি হাসে। হাত নেড়ে বোনকে বিদায় দেয়। নিশুতিও হাত নেড়ে সিড়ির দিকে পা বাড়ায়।
.
.
ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এক মনে সিগারেট ফুঁকছিল প্রায়াণ। হঠাৎ তার চোখ পড়ে নিচের রাস্তায় ছোট্ট একটা মেয়ের দিকে। প্রায়াণ এক নজর তাকায়। তারপরেই সাথে সাথে সিগারেট ফেলে দেয় হাত থেকে। এক দৌড়ে নিচে চলে যায় সে। মেয়েটা তখন সেই রাস্তার মাথা অব্দি চলে গিয়েছে।
প্রায়াণ দৌড় লাগায়।
ভীষণ জোরে দৌড় লাগায়।
ঠিক নিশুতির সামনে বরাবর গিয়ে থামে।
হুট করে প্রায়াণ কে দেখে নিশুতির পিলে চমকে যায়।
নিশুতির আপাদমস্তক প্রায়াণ কে দেখে বলে,
——-আপনি!!
প্রায়াণ হাপাতে থাকে। মুখে কিছু বলতে পারছে না সে।
নিশুতি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে প্রায়াণের দিকে তাকিয়ে থাকে।প্রায়াণের ঘন শ্বাস ধীরে ধীরে কমে আসলে সে বলে,
———তুমি কোথাও যাচ্ছো এত রাতে???
নিশুতি কিছু না বলে হাটা লাগায়। এই ব্যাপারে কাউকে কিছু না জানানোই ভালো।
প্রায়াণ ও নিশুতির পিছু ধরে।
——-বলো কোথায় যাচ্ছো?
——–যেখানেই যাই। আপনার কী!
প্রায়াণের রাগ লাগে। নিশুতির বাহু চেপে নিশুতিকে সটান করে দাড় করায়। নিশুতি অবাক হয়।
প্রায়াণ বাজখাঁই গলায় বলে,
———এই মেয়ে কি সমস্যা তোমার?? তুমি আমার সাথে এরকম কেন করতেছো? তোমাকে বেশি ভাও দেখাই দেখে তুমি ইগনোর করতেছো??
নিশুতি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে প্রায়াণের দিকে।
প্রায়াণ বলে চলে।
———আমার জন্য কত্ত মেয়েরা পাগল তুমি জানো? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া হাও মাচ গার্ল ফল ফর মি?? নো ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া!! তবুও আমি তোমার উপর মরি। তোমার সাথে কথা বলতে,তোমার সাথে দেখা করতে আমি পাগলের মতো হয়ে যাই। আর তোমার সেটা চোখে বাধে না??? সেদিন রাতে ফোনে আমাকে যা বলছো এরপর থেকে আমার কি অবস্থা জানো? আমি খাই না,ঘুমাই না কিচ্ছু করতে পারিনা। শুধু তোমার মুখ টা আমার চোখের সামনে ভাসে। তোমাকে ভেবে ভেবে আমি রাত দিন পার করি। আর তুমি আমার সাথে এরকম করছো নিশু???
ইয়েস আই লাভ ইউ। ডু ইউ হেয়ার দ্যাট?? আই লাভ ইউ নিশুতি….আই লাভ ইউ….
খালি নির্জন রাস্তায় প্রায়াণের আই লাভ ইউ কথা টা তীরের মতো এসে বাধে নিশুতির কানে।
নিশুতির কান লাল হয়ে যায় লজ্জায়। কেউ তাকে মনে মনে এত ভালোবাসতো! আর সে তার এত কাছে ছিল তবুও নিশুতির বুঝে আসলো না কেন!
প্রায়াণ নিশুতির বাহু ছেড়ে দেয়। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে,
———তুমি কোথায় যাচ্ছো বা না যাচ্ছো তাতে আমার অনেক কিছু আসে যায়। আর তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করছি। ইচ্ছে হলে বলবা,না হলে বলো না। তবে একটা কথা বলবো নিশুতি??
নিশুতি ছোট্ট করে বলে,
——–হুম।
——–তোমার আমাকে ভালোবাসতে হবে না। নিয়ম মাফিক টাইম দিতে হবে না। আমার পছন্দের সব করতে হবে না। শুধু আমার কাধে মাথা রেখে তোমার কষ্ট গুলো ব্যক্ত করিও।
নিশুতির চোখের কোণা থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোটা।
নিশুতি নিচের দিকে তাকিয়ে বলে,
——–আপনার সাথে সেদিন ছাদে কথা বলছিলাম সেটা আম্মু দেখে ফেলছিল। সে ভাবছে আপনার আমার মধ্যে কিছু আছে। আর তাই আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিল। এমনকি কালকে আমাকে দেখতেও এসেছিল পাত্রপক্ষ।
প্রায়াণ নিশুতির দিকে মুখ ঘুরিয়ে অবাক হয়ে বলে,
———-হোয়াট??
———-হুম। ছেলে বুড়ো। বয়স ৪০ এর বেশি। তার সাথেই বিয়ে ঠিক করে দিয়েছে আমার। আজ রাত পার হলে কাল আমার বিয়ে সেই বুড়োর সাথে। আর তাই আমি পালিয়ে যাচ্ছি।
প্রায়াণ নিশুতির কাধে হাত রেখে বলে,
———কোথায় যাবা??
———জানিনা। যেদিকে দুচোখ যায়। তবে ঠিক করেছিলাম সিলেট যাবো। ইফতি আর কাকাই যেতে বলেছে। আর তাই যাচ্ছি।
প্রায়াণ কপালে হাত দিয়ে ভাবে কিছু। নিশুতিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
———একা যাবা?
———হুম।
প্রায়াণ পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে ফোন লাগায়। নিশুতি বলে,
———কাকে ফোন দিচ্ছেন? আমার আব্বু আম্মু কে বলিয়েন না প্লিজ!
প্রায়াণ জবাব দেয়না নিশুতির কথার। ওপাশ থেকে কেউ ফোন ধরতেই প্রায়াণ বলে,
——–হ্যালো আম্মু। আমি আমার বন্ধুদের সাথে আরজেন্ট ট্রিপে যাচ্ছি। এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবা না। আমি তোমাকে সব পরে বলবো। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে আমি কই তবে বলবা আমি আমার স্পোর্টস টিম থেকে বরিশাল গেছি। ওকে?? রাখছি আম্মু।
নিশুতি হা হয়ে শোনে প্রায়াণের কথা গুলো। প্রায়াণ কল কেটে আবার কাকে জানি কল করে!
একটু দূরে গিয়ে কিছু একটা বলে কাউকে। তারপর ফোন রেখে নিশুতির পাশে এসে দাঁড়ায়।
নিশুতি ভ্রু কুঁচকে বলে,
——–আপনি ট্রিপে যাচ্ছেন মানি? আপনি আন্টিকে কি বললেন??
প্রায়াণ মুচকি হেসে বলে,
——–কিছুইনা। চলো সিলেট যাবা না?
নিশুতি অবাক হয়ে বলে,
——–আপনিও যাবেন??
প্রায়াণ মাথা দোলায়।
নিশুতি বাধা দেয়।
———না না। আপনি যাইয়েন না। কেউ যদি জানে আরো প্রবলেম হবে। সো প্লিজ…
প্রায়াণ নাছোড়বান্দা। সে একা কিছুতেই ছাড়বে না নিশুতিকে।
——–তুমি সিলেট গেছো এর আগে? ওখানে কি পরিমাণে জ্বীন ভূতের আস্তানা তার আইডিয়া আছে তোমার? একা একা তো থাকাই যায় না! জ্বীনে এসে ঘাড় মটকে দেয়।
নিশুতি নাক মুখ কুঁচকে বলে,
———সত্যি??
প্রায়াণ বুক ফুলিয়ে ভাব নিয়ে বলে,
——–তো আবার কী? এই জন্যেই আমি যাবো তোমার সাথে। তোমার সেফটির জন্য। তোমার সাথে প্রেম করতে না ওকে??
নিশুতি আর কিছু বলে না। বিনাবাক্যে রাজী হয়ে যায় সে। ঝামেলা হলে হোক,কিন্তু সে জ্বীনের ঝামেলায় পড়তে চায় না। ছোট বেলা থেকেই সে এসবে ভীষণ বিশ্বাসী এবং ভীতুর ডিম ও।
প্রায়াণ নিশুতিকে নিয়ে গাবতলি যায় রিকশায়। নিশুতি টিকেট কাউন্টারের দিকে হাটা দিলে প্রায়াণ বলে,
——–টিকেট কাটতে হবে না। চুপচাপ এখানে দাঁড়িয়ে থাকো।
নিশুতি কোনো কথা না বলে চুপ করে প্রায়াণের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। নিশুতি জ্বীনের ব্যাপারটা নিয়ে যে ভীষণ ভয় পেয়েছে তা তার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। প্রায়াণ মৃদু হাসে।
প্রায়াণ ভাবতেই পারছে না নিশুতির মতো এই যুগের একটা মেয়েও জ্বীন ভূতে এত বিশ্বাসী!! আর প্রায়াণের কথা এক ঝটকায় বিশ্বাস করেও নিলো! প্রায়াণ মুখ টিপে টিপে হাসে।
খানিকবাদে একটা গাড়ি এসে থামে ওদের সামনে। গাড়ি থেকে একটা ছেলে বেরিয়ে প্রায়াণের সাথে হ্যান্ডশেক করে প্রায়াণের হাতে চাবি দেয়। তারপর চলে যায়।
প্রায়াণ নিশুতিকে বলে গাড়িতে উঠে বসতে। নিশুতি বিনাবাক্যে উঠে বসে। প্রায়াণ নিশুতির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে তারপর গাড়ি স্টার্ট দেয়।
.
.
রাত প্রায় ১ টা।
নির্জন রাস্তায় গাড়ি ছুটে চলছে তার আপন গতিতে। নিশুতি একদম চুপচাপ বসে আছে। একটা প্রশ্নও করছে না!
প্রায়াণ বারবার নিশুতির দিকে তাকাচ্ছে। আর গাড়ি ড্রাইভ করছে।
নিশুতি সামনের দিকে তাকিয়ে বলে,
——-আমি মোটেও ভূতে বিশ্বাসী না। জ্বীন আছে আমি মানি কিন্তু তাদের এত খাইয়া কাম নাই যে আইসা আইসা মানুষের ঘাড় মটকাবে তাও সিলেটে!! আমি নিজেও জানিনা কেন আপনার সাথে যাচ্ছি বা কেন আপনাকে সাথে নিচ্ছি! হয়তো একা একা বোর হতাম তাই! আর এই গাড়িটা আপনার বন্ধুর সেটাও জানি। ফোনে কথা বলার সময় শুনেছি। আর এখন আমরা সিলেট যাচ্ছি সেটাও বুঝতে পেরেছি। বিছানাকান্দি যাইয়েন তো। খুব ইচ্ছা ওখানে যাওয়ার। কী নিয়ে যাবেন তো??
প্রায়াণ অবাক হয়ে শুনছিল নিশুতির কথা। মেয়েটা এত বুদ্ধিমতী!
প্রায়াণ ছোট্ট করে বলে-
——-হুম।
——–এবার সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালান। আমাকে দেখার অনেক টাইম পাবেন আজকের পর থেকে…
প্রায়াণ থতমত খেয়ে সামনের দিকে তাকায়। আর নিশুতি মুখ টিপে টিপে হাসে।
চলবে…..
রঙ চা
পর্বঃ০৮
লেখা – মাহফুজা মনিরা
ভোর বেলা ওরা বিছানাকান্দি পৌঁছায়। নিশুতি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। প্রায়াণ গাড়ির ইঞ্জিন অফ করে এক দৃষ্টিতে নিশুতির দিকে তাকিয়ে থাকে।
প্রায়ান কোনোদিনও ভাবেনি এভাবে একান্তে নিশুতির সাথে থাকার সুযোগ মিলবে কোনোদিন! ভাগ্য মানুষ কে কোথা থেকে কোথায় টেনে নিয়ে যায় তা ভাগ্য নির্মাতা ছাড়া আর কেউই বলতে পারেনা। প্রায়াণ সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে যেন এই মেয়েটাকে সবদিক থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে সে।
তারপর হালকা গলায় ডাকে,
——–নিশুতি..
নিশুতি নড়ে উঠে। কিন্তু পুরোপুরি ঘুম ভাঙে না। প্রায়াণ আবারো ক্ষীণ আওয়াজে ডাকে,
———এই নিশুতি..
নিশুতি “উম উম” করে। প্রায়াণকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। তারপর সিটের অন্যদিকে ঘুরে আবার ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়।
প্রায়াণ হেসে কুটিকুটি হয় নিশুতির অবস্থা দেখে। কে বলবে এই মেয়ের বয়স ১৯ কি ২০! একদম ৬-৭ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে যেন! প্রায়াণের ইচ্ছে করে নিশুতির খোলা কপালে তার অধর স্পর্শ তুলে দিতে।
নিশুতির বাহুতে একটা গুতো মারে প্রায়াণ।
নাহ! কোনো হুশ নেই তার। ভুস ভুস করে ঘুমাচ্ছে নিশুতি। প্রায়াণ মৃদু হেসে নিশুতির কপালের কাছে মুখ নেয় তার। তারপর….
১ সেকেন্ড…. ২ সেকেন্ড…. ৩সেকেন্ড……
প্রায়াণ নিশুতির কপালে নিজের অবাধ্য ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দেয় কিন্তু খুব আলতো করে। পাছে নিশুতির ঘুম না ভেঙে যায়!
নিশুতি টের পায় কিনা কে জানে! কিন্তু সে সামান্য নড়েও না। আগের ন্যায় ঘুমে কাতর!
প্রায়াণ নিশুতির চোখে মুখে আছড়ে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দেয় আঙুল দিয়ে। তারপর ঘড়ি দেখে।
ভোর পেরিয়ে সকাল হয়ে আসছে প্রায়…গাড়িতে এভাবে থাকা ঠিক না। একটা রিসোর্টে উঠা দরকার দ্রুতই..
প্রায়াণ গাড়ি স্টার্ট দেয়। একটানে একটা রিসোর্টের সামনে গিয়ে থামে গাড়ি। এবার জোর গলায় ডাকে নিশুতিকে প্রায়াণ। নিশুতি ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে।
রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলে,
——-কি সমস্যা? ঘুমাতেও দিবেন না নাকি! ডাকছেন কেন??
প্রায়াণ অবাক হয়। ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
——-সারা রাত ঘুমাতে ঘুমাতে আসছো! আর এখনো ঘুম হয়নাই?? আর আমি যে সারারাত ড্রাইভ করে আসলাম,সেটা কী?
নিশুতি থতমত খায়। এভাবে বলা টা ঠিক হয়নি তার…
নিশুতি জানালা দিয়ে বাহিরে মুখ করে নিচু গলায় বলে,
——–সরি।
——–হুম। এবার ঠিকঠাক হয়ে নাও। আমরা বের হবো।
নিশুতি অবাক হয়। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে তার। বলে,
——-কোথায় বের হবো?
——-গাড়িতেই আজীবন পার করে দেওয়ার ইচ্ছে নাকি তোমার?? সামনে দেখো। রিসোর্টে যাবো।
নিশুতি গাড়ির সামনের কাঁচ ভেদ করে বাহিরে তাকায়। কয়েক কদম এগোলেই একটা রিসোর্ট মাথা উঁচু করে শাহী ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর আগে কখনো রিসোর্ট দেখেনি নিশুতি। দেখবেই বা কোত্থেকে! সে তো এর আগে ঘুরতেও বের হয়নি কখনো!!
নিশুতি মুগ্ধ নয়নে সেদিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে,
——-কি সুন্দর রিসোর্ট!
প্রায়াণ শুনতে পায় তা।
পেছনের সিট থেকে নিশুতির ব্যাগ হাতে তুলে নিয়ে বলে,
——-আরো এমন অনেক কিছু আছে যা দেখে তুমি অজ্ঞান হয়ে যাবা। বুঝছো? এবার চলো।
.
.
দুজনের জন্য দুটি রুম নেওয়ার উচিত থাকলেও প্রায়াণ একটি রুমই নেয়।
রুমে ঢুকে নিশুতি প্রায়াণের সামনে দাঁড়িয়ে সোজাসাপটা বলে,
——-আপনি এক রুম কেন নিলেন?? আমার সাথে থাকার প্ল্যান আছে নাকি??
প্রায়াণ রুমের চাবি ডিভানের উপর রেখে বলে,
——-আরে যদি একা এক রুমে থাকতা আর যদি জ্বীন আসতো তখন?? ভয় পেতা না?
নিশুতি প্রায়াণের সামনে এসে বিরক্ত মুখে কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়ায়। প্রায়াণ জিহ্বে কামড় কাটে। নিশুতি তো আগেই বলেছে যে সে জ্বীন ভূতের এসবে এত বিশ্বাসী না!!
প্রায়াণ ধরা পরে যাওয়া চোরের মতো মুখ করে নিশুতির দিকে তাকায়। নিশুতি মুখে বিরক্তি নিয়েই বলে,
——-ঠিক আছে একরুমেই থাকুন আমার সাথে কিন্তু ডোন্ট ডেয়ার টু কাম ক্লোজ টু মি ওকে??
প্রায়াণ এপাশ ওপাশ মাথা দুলিয়ে বলে,
——-ওকে ওকে।
.
.
প্রায়াণ চুপ করে বিছানায় বসে আছে। নিশুতি ফ্রেশ হতে গিয়েছে ওয়াশরুমে। নিশুতি বের হয়ে বলে,
——-এবার আপনি যান।
প্রায়াণ নিশুতির কথায় নড়েচড়ে উঠলেও বসেই থাকে। ওয়াশরুমে যায় না।
নিশুতি ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে প্রায়াণের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
——-কি ব্যাপার যাচ্ছেন না কেন? কোনো প্রবলেম??
প্রায়াণ ক্ষীণ স্বরে বলে,
——–না।
নিশুতি এসে প্রায়াণের সামনে দাঁড়ায়। কপাল কুঁচকে নিছক মজার ছলে বলে,
——–পিরিয়ড হয়েছে নাকি? এভাবে কুঁকড়ে বসে আছেন কেন??
প্রায়াণ চোখ বড়বড় করে তাকায়। মাথা চক্কর দিচ্ছে তার। মেয়েটা এত পাজি কেন??
নিশুতি প্রায়াণের গায়ে ধাক্কা মেরে বলে,
——-আরে মজা করছি। বলেন না। কি হইছে??
প্রায়াণ নিচুগলায় বলে,
——-আমি তো কোনোকিছু নিয়ে আসি নি। জামা কাপড় বা গামছা! কিছুই না। জামা কাপড় তো পরে কিনে নিতে পারবো কিন্তু গামছা টা তো…
নিশুতি বুঝতে পারে। নিজের আধো ভেজা গামছা টা প্রায়াণের দিকে তুলে ধরে বলে,
——-আমার চুলের পানিতে হালকা ভিজে গেছে। এটা চলবে??
প্রায়াণ উল্লাসিত কণ্ঠে বলে,
——–দৌড়োবে।
প্রায়াণ নিশুতির গামছা হাতে ওয়াশরুমে চলে যায়। নিশুতি মুচকি হেসে ব্যাগ থেকে যাবতীয় জিনিস পত্র বের করে। কেন জানি প্রায়াণ ছেলে টাকে ভালোই লাগে তার!
.
.
.
শারমিন হোসেনের চিৎকারে ঘুম ভাঙে আজহার হোসেনের। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে উঠে বসে তিনি। গলা চওড়া করে ডাকে শারমিন কে। শারমিন হোসেন কাছে আসতেই চেঁচিয়ে বলে,
——-সকাল সকাল কি শুরু করছো বলো তো! চিল্লাছো কেন??
শারমিন হোসেন বিছানায় বসে বিলাপ পেরে বলেন,
——–তোমার ঐ ডাইনি মেয়ে। সারা বাসায় কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আজকে ওর বিয়ে আর ও যদি পালিয়ে থাকে তখন??
আজহার হোসেন বিছানায় শুয়ে বলেন,
——–যতসব ফালতু চিন্তা!! দেখো ছাদে আছে বোধহয়।
———নেই। আমি সব খুঁজেছি। কোথাও নেই।
এবার আজহার হোসেন আর শান্ত থাকতে পারেন না। লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসেন। গলা চওড়া করে ইফতি কে ডাকে। ইফতি জানে তার এইধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। তাই সে আগে থেকে প্রস্তুত ছিল।
চোখ ডলতে ডলতে এসে বলে,
——-কি আব্বু? ডাকছো যে! এত সকাল সকাল।
আজহার হোসেন ছেলের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলেন,
——-নিশুতি কই??
ইফতি অবাক হওয়ার ভান করে বলে,
——-আপুর রুমে দেখো।
——–সে তার রুমে নেই। সে কোথাও নেই। সে বাসা ছেড়ে পালিয়েছে। আমি সিউর তুই জানোস ও কই আছে। বল ও কই??
ইফতি অবাক হওয়ার ভান করে বলে,
——–হোয়াট!! কি বলছো এসব?? আপু পালিয়েছে মানি??? আপু নেই???
আজহার হোসেন রাগ চাপিয়ে বলেন,
——–না।
এবার ইফতি হাউমাউ টাইপ কাঁদা শুরু করে। চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি বের হয় কিনা সন্দেহ! কিন্তু তার বিলাপ দেখে কে…!
আজহার হোসেন মারতে উঠেন ইফতিকে।
——ঢং করবি না। আমি জানি তুই জানিস ও কোথায় আছে। চুপচাপ বলে দে সত্যিটা।
ইফতি মায়ের গলা জরিয়ে ধরে বলে,
——–মা তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করো নাকি? আমি সত্যিই জানিনা আপু কই৷ বিশ্বাস করো।
শারমিন হোসেন বিশ্বাস করেন ইফতির কথা। তিনি আজহার হোসেন কে ধমকে উঠেন।
——আহা ইফতি যখন বলছে ও জানে না। তার মানে ও হয়তো সত্যিই জানে না। এত চেঁচাচ্ছো কেন তবুও ওর সাথে??? আমি সিউর তোমার ভাইয়ের কাছে গেছে।
তাকে ফোন করে দেখো।
আজহার হোসেন শান্ত হন কিছুটা। বলেন,
——-হুম।
.
.
নিজের রুমে এসে দরজা আটকে দেয় ইফতি। সারারাতে অনেকবার ফোন করেছে নিশুতিকে। একবারও ধরেনি মেয়েটা। টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে ইফতির।
এখন আবার ফোন দেয়। দুইবার রিং হতেই ওপাশ থেকে নিশুতি বলে উঠে,
——হ্যালো ভাই।
——কোথায় ছিলি তুই হ?? কতবার কল দিছি সারা রাতে জানোস??
——-সরি ভাই। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম গাড়িতে।
ইফতি ঠান্ডা হয়। নরম গলায় বলে,
——–এখন কই আছিস?
——–বিছানাকান্দি। একটা রিসোর্টে। কিছুক্ষণ আগেই এসেছি।
——-ঠিক আছে নিজের খেয়াল রাখিস। টাকা যা লাগে আমাকে জানাবি
নিশুতি জবাব দেয় না। তার তো একটা টাকাও খরচ হয়নি এই পর্যন্ত! সব প্রায়াণই খরচা করছে৷
ইফতি বলে,
——-এখন রাখছি। নিজের খেয়াল রাখিস।
——-তুইও নিজের খেয়াল রাখিস ভাই।
ইফতি ফোন কেটে দেয়। ফোন টা আবার ব্যাগের ভেতর ভরে বিছানায় শোয় নিশুতি। সারারাত বসে ছিল গাড়িতে। পিঠ ব্যথা করছে তার।
.
.
প্রায়াণ শাওয়ার নিয়ে এসে দেখে নিশুতি বিছানায় বেতাল হয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘুমের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই তার। প্রায়াণ মৃদু হাসে। মেয়েটা এত ঘুম কই পাই! কে জানে…..
প্রায়াণ বারান্দায় গামছা টা শুকাতে দিয়ে এসে সোফায় শোয়। তারও এখন ঘুমিয়ে নেওয়া প্রয়োজন একটু। সারারাতে একবারের জন্যেও চোখের পাতা এক করতে পারেনি।
.
.
.
সন্ধ্যার আগে আগে ঘুম ভাঙে নিশুতির। মিটমিট করে চোখ খুলতেই দেখে এক জোড়া উৎসুক চোখ তার দিকে তাকিয়ে।
নিশুতি আড়মোড়া ভেঙে বলে,
———গুড মর্নিং।
প্রায়াণ মুচকি হেসে বলে,
———গুড ইভেনিং।
নিশুতির ঘুম উড়ে যায় চোখ থেকে। এখন বিকেল! আল্লাহ! এত ঘুমিয়েছে সে….!
নিশুতি উঠে বসে।
মিনমিনে গলায় বলে,
——-এতক্ষন ঘুমিয়েছি! বুঝতেই পারলাম না।
——-শরীর ক্লান্ত ছিল তাই ঘুমিয়েছো। ইটস ওকে।
নিশুতি প্রতিউত্তরে কিছু বলে না। ভালো করে লক্ষ্য করে প্রায়াণ কে। একটা কালো ট্রাউজারের সাথে কালো টি-শার্ট! উফ…ছেলেটাকে এত কিউট লাগছে কেন আজকে!
চলবে…..