রঙে_বেরঙে,পর্বঃ৩
সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(৭)
মায়ের পরকীয়া সহ্য করতে না পেরে নিজ মা কে চাপাতি দিয়ে টুকরো টুকরো করে বাবাকে জন্ম দিনের উপহার দিয়েছে তার একমাত্র ছেলে।অন্ধ বাবার প্রতি মায়ের অবহেলা কিংবা মায়ের বাড়াবাড়ি রকমের সৌন্দর্য নিয়ে চিন্তিত ছিল কিশোর নাজমুল।গতকাল রাতে দোকান থেকে ফিরে এসে মা কে অন্যের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেললে তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নেয় মাকে খুন করার।
অন্ধ বাবাকে মসজিদে রেখে এসে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে মাকে গরম দুধের সাথে মিশিয়ে নিজ হাতে মাকে খাওয়ায় ছেলে।
মা যখন গভীর ঘুমে বিভোর তখন গরু জবাই করার ছুড়ি এবং চাপাতি দিয়ে খুন করে মা কে।
খবরটা পড়েই চশমা খুলে পাশে রাখলেন আনোয়ার হোসেন। পেশায় স্কুল শিক্ষক ছিলেন তিনি।অবসরে এসেছেন বছর দশেক হবে।মেয়ে দুটো বিয়ে দিয়েছে। তবে ছোটো মেয়ের কপালটা খুব ভালো না।
মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়ার পর থেকেই কষ্ট করতে হচ্ছে।বড় মেয়ের স্বামী বিদেশে থাকে।ছোটো মেয়ের স্বামী বিদেশ যাওয়ার জন্য টাকা জমা দিলেও ধরা খেয়ে বসে আছে।
টুকটাক ব্যবসা করে চলছে।মেয়েটার ঘরেও আল্লাহ্ দুইটা মেয়ে দিয়েছেন।তাদের নিয়ে টেনেটুনে সংসার চলছে কোনো রকমে। বাড়িতে ভালো একটা খাবার রান্না হলে মনটা দুমড়ে মুচড়ে উঠে।কে জানে মেয়েটা আজ কী রান্না করছে?কী তুলে দিবে দুই নাতনীর প্লেটে৷ শেষ মেষ তার ভাগে কিছু পড়বে তো?
মেয়েকে খুব একটা দিতেও পারে না সে। কোথায় থেকেই বা দিবে?তার বা এত সামর্থ্য কই? নাতনী দুটোর জন্য ইদানীং মনটা কেমন কেমন করছে।ভেবেছে আজকালের মধ্যে যাবে দেখতে।
এদিকে আরো ছোটো একটা মেয়ে ঘরে বড় হচ্ছে। তাকেও বিয়ে দিতে হবে৷ লেখা পড়ায় ভালো মেয়েটা।অনেক পড়ানোর ইচ্ছে।
পাশ করে ছেলেটা শুনেছে টুকিটাকি চাকরি করছে।কিন্তু মেঝ মেয়ের জীবন দিয়ে সে বুঝতে পারছে টুকটাক চাকরি না ব্যবসায় জীবন চলে না চলার মতোন।যেখানে প্রতিদিন সকালে উঠে চিন্তা করতে হয় আজকের পুরো দিনে সন্তানের মুখে চারটে খাবার তুলে দিতে পারবো তো?
গত পরশু এক লোক এসেছিলেন তার সাথে দেখা করতে। তখন তিনি পাশের জমিতে আগাছা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত।
ভদ্রলোক এসেছিলেন গাড়ি নিয়ে। সরাসরি নেমে গিয়েছিলেন চাষের জমিতেই।তপ্ত রোদে তার মুখশ্রী অল্প সময়েই লাল হয়ে উঠেছিল।
ভদ্রলোক এসেছিলেন তার একমাত্র মেয়ের সম্বন্ধ নিয়ে তার ছেলে নির্বেদের জন্য।
কিছু লুকোয়নি ভদ্রলোক। মেয়ের সকল কমতি এবং প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সরাসরি কথা বলেছেন তিনি।
অনেক কিছু ভেবে না করে দিতে চেয়েছিলেন আনোয়ার সাহেব কিন্তু নির্বেদের একটা ভালো ভবিষ্যৎ কিংবা অসহায় মেয়ের বাবার আবদার ফেলতে পারেননি তিনি।তাই ছেলেকে এক প্রকার বাধ্যই করেছে বিয়ে করতে৷
নিজ মাথায় তাকে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করিয়েছে মেয়েকে সে বিয়ে করবে।
সন্তান যতই অবাধ্য হোক না কেন বাবার মাথায় হাত রাখিয়ে যদি কোনো প্রতিজ্ঞা করানো হয় তবে সন্তান সে কথা নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে হলেও করে।
নির্বেদ এমনটাই করেছে।
ছেলেটার বিয়ের আসরে সে যায়নি।কারণ ছেলের মুখোমুখি হওয়ার সাহস তার নেই।সন্তানের ভালোর জন্য সে ছেলেকে বাধ্য করেছে বিয়েটা করতে। কারণ সে বিশ্বাস করে প্রেম ভালোবাসা বার বার হলেও ভালো ভবিষ্যৎ বারবার হাতছানি দেয় না।
(৮)
আনিকার সামনে রাখা ফুলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। তার মুখে ফুটে উঠেছে আধো বিরক্তির ছাপ।
আজ বিকেলে এসেছে ফুলগুলো।এই ফুলগুলোকে স্পর্শ করে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু এত দামী ফুল কোনো দিন কেনা হয়নি।
নির্বেদের কাছেও কখনো আবদার করেনি।তাদের ভালোবাসাটা এমন ছিল না। যেখানে আবদার থাকবে দামী বা উচ্চমূল্যের। তাদের সম্পর্ক ছিল পাশাপাশি বসে ঘরে বানানো পিঠা এক সাথে খাওয়া।
হোটেল বা রেস্টুরেন্টে তাদের প্রেম জমেনি।তাদের প্রেম জমেছিল ভীড়ে ভর্তি বাসের সিটে হাতে হাত রেখে।
আনিকা নির্বেদকে ভুলতে পারছে না। তার কাছে সব কিছু কেমন অসহ্য লাগছে।
ইচ্ছে হচ্ছে সবাইকে সে যদি মেরে ফেলতে পারতো!
নির্বেদ নামের অর্থ তো যার সুবিচারক। কিন্তু সে তার ভালোবাসার সাথে এমন কেন করলো?
“আসবো?”
দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা পিয়ালের দিকে তাকিয়ে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো আনিকা।পিয়াল বিষয়টা বুঝে বলল,
“আমার বোনের কোনো দোষ নেই।”
“ওমন মেয়েকে বাঁচিয়ে রেখেছো কেন?বিষ দিয়ে মেরে ফেলো।”
“মানছি যা হয়েছে খারাপ হয়েছে কিন্তু তাই বলে তুমি আমার বোনকে মরতে বলতে পারো না।”
“নয় বছরের সম্পর্ক মানে বুঝো?আমার সব সে আর তাকেই তোমার বোনের জন্য নিয়ে নিলে?শুধু টাকার জোরে?”
“আমরা জানতাম না বাবা কাকে পছন্দ করেছে।”
“হয়েছে। থামো ওকে নিয়ে আজ সাফাই গাইছো?মিলিয়ে নিও এই তোমার বোন এক দিন তোমার জীবনেও অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। আজ যেমন আমি হাসপাতালে কষ্ট পাচ্ছি তোমার আপনজন মৃত্যুর মুখে থাকবে তখন আমার কথাগুলো মনে পড়বে তোমার। খুব করে মনে পড়বে। আমার আজকের কথাগুলো।”
(৯)
পুরো বিকেল অনেক কিছু চিন্তাভাবনা করে শেষ অবধি নিজের কাছে হেরে গিয়ে নির্বেদ কল দিলো আনিকাকে।
অপর পাশ থেকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো আনিকা।হঠাৎ নির্বেদের মনে হলো পৃথিবীর সব’চে অসহায় পুরুষ সে নিজে। তার অসহায়ত্ব অশ্রু রূপে ঝাপসা করে দিলো দৃষ্টি। নিজেকে শক্ত করে সে বলল,
“এখন কেমন আছো?”
“আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আমার তো কিছুই চাই না তুমি ফিরে এসো।”
“যে নিজেকে ভালোবাসে না সে আমাকে কী করে ভালোবাসবে?”
“তুমি না এলে সত্যি আমি মরে যাবো।”
“তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।আমি শুধু বলতে চাচ্ছি মরে যাওয়া সাহসিকতা নয়।বেঁচে থেকে কাপুরুষদের দেখিয়ে দিতে হয় তাদের ছেড়ে যাওয়ার পরেও বেঁচে থাকতে জানি এটাই সাহসিকতা।”
“কী হয়েছে তোমার কেন এমন করলে?নিজেকে কাপুরষ বলছো?”
“যে যা স্বীকার করে নিতে কোনো আপত্তি নেই।আজ থেকে আমাদের যোগাযোগ হবে না।”
“মনে পড়ে একদিন বলেছিলাম তোমার ক্যারিয়ার হবে,টাকা হবে শুধু আমি থাকবো না।কথাটা সত্যি হলো।”
“নিজের খেয়াল রেখো।”
ফোন রেখে নির্বেদ রুমে ফিরে দেখলো প্রণয়ী তার সরু সরু আংগুল দিয়ে ধীরেধীরে কিছু মেলানোর চেষ্টা করছে। কাছে গিয়ে দেখলো সে ওয়ার্ড গেম খেলছে। শব্দের সাথে নতুন অক্ষর দিয়ে নতুন শব্দ বানাচ্ছে সে।
আনিকার সাথে কথা বলে এমনিতেই তার কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে ছিল প্রণয়ীকে দেখে যেন বিস্ফোরকের কাজ করলো।
ইচ্ছেকৃত ভাবে পা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিলো বোর্ড। প্রণয়ীর চুলের গোড়ায় হাত চালিয়ে সজোরে টান দিয়ে বলল,
“বউ হয়েছো বরের সেবা করবে না?যাও চা নিয়ে এসো।পাঁচ মিনিটের মধ্যে৷ না হলে গতকালের কথা মনে আছে?”
প্রণয়ী নির্বেদকে প্রচন্ড ভয় পেতে শুরু করেছে। সে দ্রুত ছুটতে চাইছে। ছটফট করতে থাকা প্রণয়ীকে হঠাৎ ছেড়ে দিলো নির্বেদ।প্রণয়ী ধপাস করে নিচে পড়ে হাতে ব্যথা পেলেও দ্রুত ছুটে চলেছে দরজার দিকে।
তার দিকে তাকিয়ে নির্বেদ বলল,
“তোমায় আমি এতটা কষ্ট দিবো যতটা কষ্ট দিলে যারা আমাকে বাধ্য করেছে তোমাকে বিয়ে করতে তারাই আমাকে অনুরোধ করবে ছেড়ে দিতে।”
চলবে।