রংধনুর_রঙ_কালো,৯,১০

রংধনুর_রঙ_কালো,৯,১০
Sidratul Muntaz
পর্ব:৯

অন্বয়ের সাথে একটা রেস্টুররেন্টের বাহিরের সাইডে বসে আছে অরিন। তাদের টেবিলের উপরে সাদা ছাতা। তাই গায়ে রোদ লাগছে না তেমন। গোল টেবিলের বরাবর চেয়ার দু’টিতে মুখোমুখি বসে দু’জন। ডানপাশেই বিশাল সমুদ্র। ঢেউয়ের আওয়াজ কানে আসছে হালকা-পাতলা। পরিবেশটা সুন্দর। কিন্তু আশেপাশে অর্ধনগ্ন মেয়েদের দেখতে দৃষ্টিকটু লাগছে অরিনের কাছে। সে খুবই অস্বস্তিবোধ করছে। তাই বার-বার শুধু নড়েচড়ে বসছে। অন্বয় তার মনের জমানো কথাগুলো অরিনকে এই নিয়ে তিন-চারবার বলে ফেলেছে। এখন আবারও বলছে। একই কথা সে এতোবার কেনো বলছে অরিন তা বুঝতে পারছে না। হয়তো সে চাইছে অরিন তার কথা শুনে কিছু পজিটিভ রেসপন্স করুক। কিন্তু সত্যি বলতে অরিনের এসব কথা শুনতেই ভালো লাগছে না। বরং সে একটা কথা ভেবে হতভম্ব হয়ে যাচ্ছে। শ্যানিনের মতো বিশ্বসুন্দরীকে রেখে অরিনের মতো কৃষ্ণকলিকে অন্বয়ের মনে ধরলো? তাছাড়া অরিনকে দেখে কি অবিবাহিত মনে হয়? হতেই পারে। কানে দুল,নাকে ফুল কিছুই তো নেই তার। বিশ বছর বয়সেও সে নাক ফুঁটো করেনি। এতে তার আফসোসও নেই। নাকফুল জিনিসটা অরিনের অসহ্য লাগে। শায়িখ সাহেব অথবা নুসাইবার চেহারার সাথেও অরিনের চেহারার কোনো মিল নেই। তাহলে অন্বয় কিভাবে অরিনকে শায়িখ সাহেবের কন্যা ভেবে নিল? অবশ্য শ্যানিন আর অরিন একসঙ্গে দাঁড়ালে কেউ বলতে পারবে না যে তাদের মধ্যে কে ননদ আর কে ভাবী। শ্যানিনের মধ্যেই ভাবী ভাবী ভাব আছে। দীর্ঘকায় তার শরীর। আর অরিন একদম রোগা-পাতলা। অরিনকেই অল্পবয়সী মনে হয়। শ্যানিনকে দেখতে লাগে ম্যাচিউর গার্ল। আসলে ব্যাপারটা উল্টো। কিন্তু তাই বলে অন্বয় এতোবড় ভুল করবে? তাছাড়া এক দেখাতেই অন্বয় অরিনকে এতো পছন্দ করে ফেললো কিভাবে? অরিনের অবশ্য অন্বয়ের কথা তেমন বিশ্বাস হচ্ছে না। অন্বয়ের মতো পাগলামী ইলহানও কি কম করেছিল? কিন্তু শেষমেষ কি হলো? অন্বয় হঠাৎ বললো,
” আপনি কি এখনও রেগে আছেন মিসেস অরিন?”
অরিন মিষ্টি করে হেসে বললো,” জ্বী না। আপনার উপর আমার কোনো রাগ নেই। কিন্তু কালরাতের ওই ঘটনায় আমি একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছি। আপনি ইলহানের সামনে আমার হাত না ধরলেও পারতেন। আর তাকে ওইভাবে আঘাত করা আপনার উচিৎ হয়নি।”
অরিনের মলিন মুখের দিকে চেয়ে নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অপরাধী মনে হলো অন্বয়ের। সে দুঃখিত গলায় বললো,
” আই এম স্যরি। আমি বুঝতে পারিনি আপনি এজন্য এতো কষ্ট পাবেন। কথা দিচ্ছি এইরকম আর কখনও হবে না। আমি আর কখনও আপনার হাসব্যান্ডের গায়ে হাত তুলবো না। কিন্তু একটা বিষয় আপনাকে মানতেই হবে। দোষ কিন্তু আপনার হাসব্যান্ডের। তিনিই প্রথমে আমার গায়ে হাত তুলেছেন। আমি শুধু প্রতিবাদ করেছি।”
” কিন্তু এর আগে আপনি আমার হাত ধরেছেন। এটা আপনার ভুল ছিল। এজন্যই সে আমাদের ভুল বুঝেছে।”
অন্বয় তাচ্ছিল্যভরা হাসি দিয়ে বললো,” আপনি কি বুঝাতে চাইছেন আপনার হাসব্যান্ড জেলাস? তিনি আপনাকে ভালোবাসেন? এটা ভালোবাসা না অরিন। এটা হিপোক্রিসি। নিজে একশোটা মেয়ের হাত ধরে ঘুরবে আর আপনি সাহায্যের জন্য কারো হাত ধরলেই দোষ? ”
অরিন মাথা নিচু করে বসে রইল। অন্বয়কে সে লজ্জায় বলতে পারছে না যে কালকের ওই ঘটনার জন্য বাসায় কতবড় ঝামেলা হয়ে গেছে। পরিবারের সবার কাছে অরিন এখন চোখের কাঁটা। এই ভয়টাই তো পেয়েছিল সে। নয়তো ইলহান তাকে ভালোবাসে এমন ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বসে থাকার মতো বোকা সে নয়। হঠাৎ করেই অরিনের নজর গেল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাশ রঙের গাড়িটির দিকে। ইলহান গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে সাদা-নীলের মিশেলে একটা টিশার্ট, কালো প্যান্ট। চোখে সানগ্লাস থাকলেও বোঝা যাচ্ছে সে অরিনদের দিকেই তাকিয়ে আছে। অরিনের সাথে চোখাচোখি হতেই ইলহান পকেটে হাত গুঁজে অন্যদিকে তাকালো। অরিন তাকে এতোক্ষণ লক্ষ্য করেনি। এখন দেখতে পেয়েই একটু জ্বালাতে ইচ্ছে করছে। অরিন চট করেই টেবিলে থাকা অন্বয়ের ডানহাতের উপর নিজের হাতটা রাখলো। অন্বয় চমকে উঠলো। বিস্ময়ে অভিভূত হলো। মিসেস অরিন তার হাত ধরেছে? একটা অদ্ভুত ভালো লাগায় অন্বয়ের মন ভরে গেল। অরিন সামান্য হেসে মিষ্টি গলায় বললো,
” স্যরি অন্বয়সাহেব, কালরাতে আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করা আমার একদম উচিৎ হয়নি। কিন্তু আমি ভয় পেয়েছিলাম। ইলহানকে না। আমি আমার পরিবারকে ভয় পেয়েছিলাম। ইলহান যদি আমাদের ব্যাপারটা বাবা-মায়ের কাছে ভুলভাবে প্রেজেন্ট করে সেই ভয়।”
অন্বয় হাসিমাখা কণ্ঠে বললো,” আমি সেটা বুঝতে পেরেছিলাম মিসেস অরিন। ইটস ওকে। বিশ্বাস করুন কিচ্ছু মনে করিনি আমি।”
অরিন আরও ভালো করে অন্বয়ের হাতটা চেপে ধরে বললো,” থ্যাংকস।”
সে এমনভাবে হাত ধরেছে যাতে ইলহান তাদের হাতবন্ধন স্পষ্ট দেখতে পায়। অরিন আড়চোখে তাকিয়ে ইলহানের মুখের অভিব্যক্তি দেখার চেষ্টা করলো। ইলহান চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলেছে। সে হনহন করে হেঁটে এদিকেই আসছে। এতে অরিনের প্রাণপাখি ভয়ে ছোট হয়ে গেলেও সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার অবিরাম চেষ্টা করলো। ইলহানকে দেখেও না দেখার ভাণ করে অন্বয়ের সাথে খোশগল্পে ব্যস্ত রইল অরিন। কিন্তু এর পরিণতি হলো ভয়াবহ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ইলহান এসে অন্বয়ের কালো শার্টের কলার ধরে তাকে টেনে-হিঁচড়ে সড়কের মাঝখানে নিয়ে এলো। তারপর বুকে লাথি মেরে রাস্তায় ফেললো। একের পর এক কিল-ঘুষি বিরামহীন দিতে লাগলো। ইলহানের উন্মাদের মতো আচরণে প্রত্যেকে আতঙ্কিত হয়ে উঠলো। রাস্তার মাঝে জট সৃষ্টি হলো। চলন্ত গাড়িগুলো গতি থামিয়ে ভীড় জমালো। মেয়েরা ভয়ে চিৎকার শুরু করেছে। ডানে-বামে দৌড় লাগাচ্ছে একেকজন। কিছু ছেলে ইলহানকে থামানোর চেষ্টায় কাছে এগিয়ে এলো। কিন্তু কেউ তেমন সুবিধা করতে পারলো না। ইলহানকে থামানো যেনো অসম্ভব কাজ। অরিন অন্বয়ের যে হাতটি ধরেছিল ইলহান সেই হাত মুঁচড়ে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করলো। এতে অন্বয়ের আর্তচিৎকারে পুরো শহর কেঁপে উঠলো। সমুদ্রের ঢেউ থেমে গেল। অরিন বেসামাল হয়ে ক্রমাগত পিছিয়ে যেতে লাগলো। অদ্ভুত বিষয় হলো, অন্বয় একদমই ইলহানের গাঁয়ে হাত তুলছে না। অথচ চাইলেই সে নিজেকে রক্ষা করতে পারতো। তাও একবারও সে ইলহানকে আঘাত করলো না কেনো? অরিনের এরপর কিছু মনে নেই। অতিরিক্ত উত্তেজনায় সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে একটা স্বল্প পরিচিত রুমে আবিষ্কার করলো অরিন। যেই রুমের এক কোণে হাত থেকে গলা অবধি ব্যান্ডেজ নিয়ে বসে আছে অন্বয়। শুধু হাতে না, কপালে, গালে, মাথায় আরও বিভিন্ন জায়গায় ব্যান্ডেজ। ব্যথায় চোখ-মুখ কুচকে রেখেছে সে। তার ছোট চোখগুলো আরও ছোট দেখাচ্ছে। গালের একপাশ ফুলে আছে। এই অবস্থাতেই সে হালকা গলায় অরিনকে প্রশ্ন করলো,
” মিসেস অরিন, আপনি উঠেছেন?”
এইটুকু শব্দ উচ্চারণ করতেই যেনো তার ভীষণ কষ্ট হলো। অরিনের খুব খারাপ লাগছে অন্বয়ের অবস্থা দেখে। কিন্তু এর পরমুহুর্তেই তার ইলহানের কথা মনে হলো। একলাফে বিছানা থেকে উঠে অরিন অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” ইলহান কোথায়?”
অন্বয় মনে মনে একটু আহত হলো। তার কি অবস্থা জিজ্ঞেস না করে মিসেস অরিন প্রথমেই স্বামীর খোঁজ করছেন? একটা ম্লান হাসি দিয়ে অন্বয় বললো,
” উনি ভালো আছেন। কিন্তু আপনি মনে হয় ভালো নেই। মারামারি দেখে ভয়ে সেন্সলেস হয়ে গেছিলেন। সেন্স ফেরার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমিও আর ডাকিনি। প্রায় নয়ঘণ্টা ধরে আপনি এখানে শুয়ে আছেন।”
” আমি নয়ঘণ্টা ধরে এইখানে শুয়ে আছি? ইলহান কিছু বলেনি? ঝামেলা করতে আসেনি?”
” সে আসবে কিভাবে? সে তো হাজতে। পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে তাকে।”
অরিনের মাথায় যেনো বিস্ফোরণ হলো।
” কি? ইলহান হাজতে?”
” আমার এই অবস্থা করার পরেও মানুষ তাকে ছেড়ে দিবে ভেবেছেন? অস্ট্রেলিয়ার আইন অনেক স্ট্রিক্ট। বাংলাদেশের মতো না। বিশমিনিটের মধ্যেই পুলিশ চলে এসেছিল। নয়তো আজকে আমি মার্ডার হয়ে যেতাম।”
অন্বয় এমনভাবে হেসে কথা বলছে যেনো এটা কোনো মজার ঘটনা। অরিন অস্থির ভাব নিয়ে বললো,
” নয়ঘণ্টা ধরে ইলহান হাজতে? আমি থানায় যাবো।প্লিজ অন্বয়সাহেব আমাকে থানায় নিয়ে চলুন।”
” এতোরাতে যাওয়ার কি দরকার মিসেস অরিন? এখন গেলেও আমাদের ঢুকতে দিবে না। আমরা না হয় সকালে যাবো?”
অরিন উচ্চ কণ্ঠে প্রতিবাদ করলো,” আমি এখনি যেতে চাই।”
অন্বয় বিস্মিত চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর বললো,” ঠিকাছে৷ অপেক্ষা করুন আমি তৈরী হয়ে আসছি।”
রাত দশটা বাজেই অন্বয় অরিনকে নিয়ে থানায় রওনা হলো। হাজতে বন্দি ইলহানকে দূর থেকে দেখলো অরিন। দুই হাঁটু ভাজ করে গম্ভীর ভঙ্গিতে মেঝেতে বসে আছে। অরিন এক দৌড়ে বাহিরে চলে এলো। অন্বয় অরিনের পেছন পেছন বের হলো। অরিন মুখে হাত ঠেকিয়ে কাঁদছিল। সে কখনও কল্পনা করেনি এমন পরিস্থিতি দেখতে হবে। সব দোষ তার। কি দরকার ছিল অন্বয়ের সাথে দেখা করতে আসার? তার হাত ধরার? শুধু শুধু অন্বয় মার খেলো আর ইলহানকে হাজতে যেতে হলো। অন্বয় পেছন থেকে শব্দ করলো,
” মিসেস অরিন, আপনি কি কাঁদছেন?”
অরিন চোখের জল মুছে জিজ্ঞেস করলো,” এইখানে সে কতদিন থাকবে?”
” কমপক্ষে তিনমাস তো থাকতেই হবে।”
অরিন হু হু করে কেঁদে উঠলো। হঠাৎ অন্বয়ের পা জড়িয়ে ধরে বললো,” প্লিজ অন্বয়সাহেব, আপনি তাকে হাজত থেকে বের করুন।”
অন্বয় অত্যাশ্চর্য হয়ে বললো,” আরে, আরে, এটা কি করছেন? আপনি আমার পায়ে কেনো ধরছেন?”
” আপনার পায়ে পড়ি ওকে হাজত থেকে বের করে দিন। আপনি তো একজন ব্যারিস্টার। আপনি চাইলে সব করতে পারবেন আমি জানি।”
” কিন্তু তাই বলে একজন অপরাধী তার অপরাধের শাস্তি পাবে না?”
” আমি কিচ্ছু জানি না৷ আপনি আমার হাসব্যান্ডকে হাজত থেকে বের করে দিন মি. অন্বয়।”
অন্বয় ক্ষণকাল চুপ থেকে বললো,” আপনি আমার পায়ে ধরে এইভাবে কেঁদে কিছু চাইবেন আর আমি সেটা দিবো না তাই কি হয়? আপনার হাসব্যান্ড কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যাবেন। আপনি শান্ত হোন।”
অরিন চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ালো। চোখেমুখে ফুটে উঠলো কৃতজ্ঞতার হাসি। মৃদু গলায় সে উচ্চারণ করলো,” থ্যাংকস। ”
অন্বয় টলমলে চোখে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। পুলিশ স্টেশনের সদর দরজার কাছে গিয়ে একটু থেমে পেছন ফিরে পুনরায় অরিনের দিকে তাকালো অন্বয়। আগের সেই কৃত্রিম হাসি বজায় রেখেই বললো,” আজকে আপনি প্রমাণ করে দিলেন মিসেস অরিন, আপনি একজন খাঁটি বাঙালী নারী। যাদের মূলশক্তি, স্বামীভক্তি।”
অন্বয় কথাটা কটাক্ষ করেই বলেছে সেটা বুঝতে পেরেও অরিন চুপ করে রইল। একটু পর ইলহান সত্যি সত্যি হাজত থেকে বেরিয়ে এলো। অরিন আর অন্বয়কে একসাথে দেখে সে গরমচোখে তাকালো। তারপর গাড়িতে উঠে গেলো। অন্বয় বললো,
” আপনার হাসব্যান্ড তো আপনাকে না নিয়েই চলে যাচ্ছেন মিসেস অরিন। আপনি যাবেন না তার সাথে?”
অরিন কঠিন গলায় বললো,” সে চলে যাক। আমি যাবো না।”

চলবে

-Sidratul Muntaz

#রংধনুর_রঙ_কালো
১০.

অরিন অন্বয়ের সাথে তার এপার্টমেন্টে চলে এসেছে। অরিন নিজেই আসতে চেয়েছিল। অন্বয়ের ক্ষমতা ছিল না তাকে নিষেধ করার। তাছাড়া অরিনকে আশ্রয় দেওয়া তার কাছে মহানন্দের ব্যাপার। সোফায় বসে মাথার ব্যন্ডেজ একহাতে খোলার চেষ্টা করছিল অন্বয়। অরিন এগিয়ে এসে বললো,” আমি হেল্প করি?”
অন্বয়ের অনুমতির অপেক্ষা না করেই অরিন ব্যন্ডেজ খুলে দিতে চাইল। অন্বয় সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,” ইটস ওকে। আমি পারবো।”
তার উচ্চারিত এই দু’টি বাক্যে গাঢ় অভিমানের স্পর্শ ছিল। যা অরিন একটু হলেও টের পেয়েছে। অন্বয় ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যন্ডেজ খোলার চেষ্টা করলো। অরিন হঠাৎ বললো,
” একটা প্রশ্ন করি অন্বয়সাহেব?”
” করুন।”
” ইলহান যখন আপনাকে আক্রমণ করেছিল তখন আপনি আত্মরক্ষা করলেন না কেনো?”
” আত্মরক্ষা কিভাবে করতাম?”
” কিভাবে করতেন মানে? চাইলেই কি আপনি তাকে পাল্টা আঘাত করতে পারতেন না?কিন্তু আপনি নির্বিকার ছিলেন। আমি খেয়াল করেছি।”
অন্বয় ফিক করে মৃদু হাসি দিল।
” আপনি হয়তো ভুলে গেছেন মিসেস অরিন। আমি আপনাকে কথা দিয়েছিলাম, কখনও আপনার স্বামীর গায়ে হাত তুলবো না।”
অরিন হতচকিত হয়ে বললো,” আপনি কি পাগল? এজন্য সে আপনাকে মেরে ফেললেও আপনি চুপ করে থাকবেন নাকি? কিচ্ছু বলবেন না তাকে?”
অন্বয় আয়না দিয়ে অরিনের চেহারার দিকে চেয়ে স্থির দৃষ্টিতে বললো,” জ্বী না।”
অরিন ঠিক অন্বয়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,” আপনি অদ্ভুত। ”
তারপর দুইহাত ঘষতে ঘষতে একা একা বিরবির করে বললো,” সব দোষ আমার। তখন ওইভাবে আপনার হাত ধরাই উচিৎ হয়নি। যদি হাত না ধরতাম তাহলে এইসব কিছুই হতো না। আপনাকেও রাস্তার মাঝে মার খেতে হতো না। আই এম রিয়েলি ভেরি স্যরি অন্বয়সাহেব।”
অন্বয় সামান্য হাসলো। মনে মনে বললো, ” শুধুমাত্র আপনি হাত ধরেছিলেন বলেই আমি ইলহান মাহদীকে হাজতে নিতে পেরেছি। নাহলে সেটাও করতাম না। আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে ভরসা করতে শুরু করেছেন। তাই আমি যেটাই করবো আপনি আমাকে সাপোর্ট করবেন। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম অরিন। তখন আমি বুঝতেই পারিনি শুধু ইলহান মাহদীকে জ্বালানোর জন্য আপনি আমার হাত ধরেছিলেন। ভরসা করে ধরেননি। এটা কখন বুঝলাম জানেন? যখন নিজের স্বামীকে হাজত থেকে বের করার জন্য আপনি আমার পায়ে পড়ে গেলেন।”
মুখে অন্বয় ভিন্ন কথা বললো,” রাস্তার মাঝে মার খেয়ে কিন্তু আমার তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। বরং নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।”
অন্বয় ঠোঁট টিপে হাসার চেষ্টা করলো। অরিন অনুতপ্ত কণ্ঠে বললো,” ইলহানকে হাজত থেকে বের করার জন্য আমি আপনাকে অনুরোধ করতাম না। কিন্তু আমি ভয় পেয়েছিলাম বিশ্বাস করুন! ইলহান যদি বাসায় বলে দিতো, আমি তাকে অবজ্ঞা করে আপনার সাথে মেলামেশা করছি এমনকি তাকে হাজতে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছি তাহলে অনেক বড় সমস্যা হতো। তাছাড়া মা-বাবা মানে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের ছেলের ব্যাপারে খুব বেশি সেন্সিটিভ। তারা যদি জানতে পারতেন ইলহান আমার জন্য জেলে গেছে তাহলে আমাকেই ভুল বুঝতেন। পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারতো। এসব ভেবেই আমি..”
” বুঝতে পেরেছি। এখন এসব কথা থাক। আপনি সারাদিন কিছু খাননি। আপাতত ডিনারের ব্যবস্থা করি?”
অরিন মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিল। অন্বয় মনে মনে ভাবলো,” আপনি কাউকে ভয় পাননি মিসেস অরিন। যদি সত্যিই পরিবারের ভয় আপনার থাকতো তাহলে ইলহান মাহদীকে অবজ্ঞা করে আমার সাথে সকাল-সকাল দেখা করতে আসতেন না আপনি। তার সামনে আমার হাত ধরার সাহস করতেন না। আপনি আসলে নিজেকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছেন। হয়তো ইলহান মাহদীকে আপনার অবচেতন মন এখনও ভালোবাসে। হয়তো আপনি নিজেও বুঝতে পারছেন না। এজন্যই এতোসব যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন। আসলে আমরা যেটা করতে চাই সেই বিশেষ কাজটির পক্ষে অযথাই যুক্তি খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। ঠুনকো যুক্তিগুলোকেও আমাদের কাছে অনেক শক্ত মনে হয়। নিজের স্বামীকে ওই অবস্থায় দেখে মেনে নিতে পারেননি আপনি। এজন্যই এতোটা উতলা হয়েছেন। এখনও নিজের ভালোবাসার কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আপনার হয়নি। আপনি কি জানেন মিসেস অরিন? আপনার সমস্ত কঠোরতা, গর্জন উপরে উপরে। কিন্তু ভেতর থেকে আপনার অন্তর এখনও ভেজা মেঘের মতো নরম।”
” অন্বয় সাহেব।”
অরিনের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেল অন্বয়।
” জ্বী মিসেস অরিন?”
” একটা সাহায্য করতে পারবেন আমাকে?”
” কি ধরণের সাহায্য? আমাকে মাটিতে শুতে হবে?”
” আরে নাহ।”
হেসে ফেললো অরিন।
” আমি আসলে চাইছি আপনি আপনার ড্রাইভার ‘বাবা’ ভাইকে পাঠিয়ে আমার জিনিসগুলো ইলহানের এপার্টমেন্ট থেকে নিয়ে আসবেন।”
অন্বয় ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,” কেনো? ওইখানে আর ফিরে যাবেন না আপনি?”
” না।”
অরিনের গলায় কাঠিন্যতা। অন্বয় জানতে চাইলো,” কেনো?”
” আমি তার সাথে আর থাকতে চাই না। সবকিছু বাদ। অন্তত আমাকে অপদস্ত করা আর আপনার গায়ে হাত তোলার জন্য ওকে আমি ক্ষমা করতে পারবো না।”
” আপনাকে অপদস্থ করেছে মানে? তিনি কিভাবে আপনাকে অপদস্ত করেছেন? আমাকে খুলে বলুন অরিন!”
অরিন চোখে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে গতরাতের কাহিনীগুলো অন্বয়ের সাথে শেয়ার করলো। অন্বয় কোনো ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই বললো,” এজন্য দুঃখ পাবেন না মিসেস অরিন। যারা আপনাকে ভুল বুঝেছে তারা একসময় ঠিক আফসোস করবে। কিন্তু আপনি হাল ছাড়বেন না। ইলহান মাহদীর ভালোমানুষির মুখোশ আপনিই তার পরিবারের সামনে টেনে খুলবেন।”
” না। আমি এসব কিছুই চাই না। সে যা করছে তার শাস্তি আমি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলাম। একদিন সে ঠিকই তার পাপের শাস্তি পাবে। আমি ওর মতো কীটকে মেরে হাত কলঙ্কিত করতে চাই না। আমি শুধু ওর থেকে সেপারেশন চাই। একজন চরিত্রহীনের সাথে থাকার কোনো মানেই হয় না।”
” তাহলে আপনি এখন কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?”
” আমি কিছুদিন অস্ট্রেলিয়াতেই থাকবো। কিন্তু যতদিন থাকবো, ইলহানের থেকে দূরে থাকবো। অন্যকোথাও নিজের মতো করে। আমার কার্ডে যে পরিমাণ টাকা আছে তাতে কমপক্ষে একবছর অস্ট্রেলিয়াতে আরামে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। তাছাড়া আমিও দেখতে চাই সে আর কি কি করতে পারে। আরও কতটা খারাপ হতে পারে।”
অন্বয় মনে মনে হাসলো এবং বললো,” আপনি নিজেও জানেন না অরিন। যতই মুখে মুখে এসব কথা বলেন না কেনো আপনার অবচেতন মন এখনও ইলহান মাহদীর সান্নিধ্য কামনা করে। আপনি মনে-প্রাণে ঠিকই চাইছেন যেনো আপনার স্বামী শুধরে যায়। সবকিছু ছেড়ে আপনার কাছে ফিরে আসে। এই অসম্ভব ইচ্ছে আপনার তখনি ভেঙে যাবে যখন আপনি নিজের চোখে ইলহান মাহদীর নিকৃষ্ট রূপ দেখবেন। আমি চাই সেইদিন খুব জলদি আসুক।”
অন্বয়ের ড্রাইভার বাবা’কে পাঠানো হলো অরিনের জিনিসপত্র ইলহানের এপার্টমেন্ট থেকে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু বাবা ফোন করে জানালো,
” স্যার, উনি কিছুই দিতে চাইছেন না। শুধু বলছেন যার জিনিস তাকে এসে নিয়ে যেতে হবে। অন্যকারো হাতে তিনি মাল দিবেন না।”
অরিন এই কথা শুনে সাথে সাথে অন্বয়ের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিল।
” হ্যালো বাবা ভাই, আপনি তাকে বলুন আমার জিনিস আমি চাইছি। তাকে দিতেই হবে। দিবে না কি আবার? জোর করে নিয়ে আসুন।”
ইলহান শব্দ করে বললো,” অপরিচিত কারো কাছে আমি জিনিস দিবো না। যদি নিজে এসে নিতে পারো তাহলে নিয়ে যাও। নয়তো আমি সব পুড়িয়ে ফেলবো।”
” কি?”
হুমকি শুনে হতভম্ব হলো অরিন। ইলহান এইসব কি শুরু করেছে? অরিন ফোন রাখতে রাখতে বললো,” অন্বয়সাহেব আপনি অপেক্ষা করুন। আমার জিনিস আমি নিজেই নিয়ে আসবো।”
” আমি কি আপনার সাথে আসবো?”
” দরকার নেই। আপনি গেলে ঝামেলা বাড়বে। তার চেয়ে ভালো রেস্ট করুন।”
” আমার রেস্ট করা নিয়ে আপনি চিন্তা করেছেন দেখে ভালো লাগলো।”
অরিন অন্বয়ের শেষ কথাটুকু শুনতে পেয়েছে কি-না বোঝা গেল না। সে হাতব্যাগ নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়েছে। অনেক ব্যস্ত সে। অন্বয়ের কথা শোনার সময় কই?
অরিন এপার্টমেন্টে ঢুকে লিফটে চড়ে অষ্টমতলায় এসে দেখলো তাদের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। অরিন খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই খট করে দরজাটা আটকে দেওয়া হলো। অরিন ঝট করে পেছনে তাকিয়েই ইলহানকে দেখতে পেয়ে বললো,
” আমার স্যুটকেস কোথায় রেখেছো? দিয়ে দাও চলে যাই।”
” দিচ্ছি। আগে ভেতরে চলো।”
” ভেতরে কেনো?”
ইলহান পেছন থেকে ঠেলতে ঠেলতে অরিনকে ভেতরে নিয়ে গেলো। এরপরের ঘটনা অরিনের কিচ্ছু মনে নেই। শুধু জ্ঞান ফেরার পর অরিন উপলব্ধি করলো তার হাতের সাথে ইলহানের হাত হ্যান্ডকাপ দিয়ে আটকানো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here