রংধনুর_রঙ_কালো,৭,৮

রংধনুর_রঙ_কালো,৭,৮
Sidratul Muntaz
পর্ব:৭

অরিন অন্বয়ের এপার্টমেন্ট থেকে বের হয়েই অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হলো। বাহিরে গাড়িসহ ইলহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে প্রায় আঁতকে উঠলো। তার বুকের বামপাশে ধুকপুকানির শব্দটাও যেনো থমকে গেল! ইলহান ঠিকই তাকে ফলো করতে করতে এতোদূর চলে এসেছে। এখন যদি ইলহান জিজ্ঞেস করে ‘তুমি এখানে কেনো?’ তখন অরিন কি জবাব দিবে? তাছাড়া অন্বয়ের সাথে যদি ইলহানের দেখা হয়ে যায়? তাহলে তো কেলেংকারী হবে। ইলহান নিশ্চয়ই অন্বয়কে চিনে ফেলবে। অরিনের কেনো যেনো মনে হচ্ছে এখন খুব বড় একটা ঝড় আসতে চলেছে। ইলহান তাকে ভুল বুঝবে। অন্বয়ের লেখা ডায়েরির কথাগুলো কোনোভাবে ইলহান জেনে যাবে। সে যদি এইসব তার বাবা-মাকে জানিয়ে দেয়? অন্বয়ের সাথে সাথে সবাই অরিনকেও ভুল বুঝবে। একসাথে সবাই তাদের তিরস্কার করবে। এইসব চিন্তা করেই ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল অরিন। ক্রমাগত গলা শুকিয়ে আসতে লাগলো তার। আর ইলহান সামনে এগিয়ে এলো। ভ্রু কুচকে একবার এপার্টমেন্টের দিকে তাকালো। তারপর পুনরায় অরিনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
” এইখানে কে থাকে? তুমি এখানে কি করছো অরিন?”
ইলহানের প্রশ্নে অরিন থতমত খেলো।তার অপ্রস্তুত দৃষ্টি ইলহানের কৌতুহল আরও বাড়িয়ে দিল। সে আরও কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলো,
” বলো?”
অরিন জবাব দেওয়ার আগেই ঘটনাস্থলে অন্বয় উপস্থিত হলো। সে ইলহানকে খেয়ালই করলো না। অরিনের হাত টেনে ধরে কাতর গলায় বললো,
” অরিন, প্লিজ আমার কথাটা একবার শুনুন। যাস্ট ফাইভ মিনিটস লাগবে।”
অরিন ভয়ে হিঁচকি তুলতে লাগলো। অন্বয় এসেছে খালি গায়ে, মাথায় ভেজা চুল নিয়ে। ওকে এই অবস্থায় দেখে অরিন এতো বেশি ঘাবড়ে গেল যে ওর সম্পূর্ণ শরীর কাঁপতে লাগলো। ভীত দৃষ্টিতে একবার ইলহানের দিকে সে তাকালো। ইলহান কি ভাববে এখন? তারা খারাপ কাজ করছিল এটাই কি ভাববে? অরিন মনে মনে আওড়ালো,” এ কোনো দুঃস্বপ্ন হয়ে যাক। হে আল্লাহ রক্ষা করো।” অন্বয়ও এতোক্ষণে খেয়াল করলো ইলহানকে। সে আগে তাকে দেখতে পায়নি। অরিন লক্ষ্য করলো ইলহানের চোখ-মুখ অন্যরকম হয়ে গেছে। চোয়াল শক্ত করে অন্বয়ের দিকে তাকালো সে। তার গলার মধ্যমণি উঠা-নামা করছে অনবরত। এই অবস্থা তখনি হয় যখন ইলহান খুব বেশি রেগে যায়। ইলহান দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকালো অন্বয়ের ধরে থাকা অরিনের হাতটির দিকে। অরিন সেটা বুঝে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু অন্বয় ছাড়লো না। জোর করে ধরে রেখেই বললো,
” ভয়ের কি আছে? আপনি তো তাকে ডিভোর্স দিচ্ছেন। তাহলে ভয় কেনো পাবেন?”
অরিন এই কথা শুনে চোখ বন্ধ করে ফেললো। মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলো। তার চোখের পাপড়িগুলো সমানতালে কেঁপে উঠছিল। ইলহান এইবার কি করবে আল্লাহ মালুম। হঠাৎ খুব ভয়ানক গর্জন শুনতে পেল অরিন।” ইউ বাস্টার্ড.. “,
তারপর একটা বিকট শব্দ। অরিন চোখ মেলে তাকালো। ইলহান অন্বয়ের চোয়াল বরাবর ঘুষি মেরে তাকে উল্টে ফেলে দিয়েছে। অরিনের থেকে কয়েক হাত দূরে ঠোঁটে জমাট বাঁধা রক্ত নিয়ে অন্বয় উল্টো অবস্থায় রাস্তায় পড়ে গেল। তার অর্ধনগ্ন শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। অরিন মুখে দুই হাত ঠেকিয়ে আতঙ্কে শব্দ করলো। এরপরের ঘটনা ছিল আরও ভয়ানক। অন্বয় আচমকা উঠে দাঁড়ালো এবং ইলহানকেও একইভাবে চোয়াল বরাবর ঘুষি মারলো। কিন্তু ইলহান উল্টে মেঝেতে পড়লো না। সে নিজের গাড়ির উপর গিয়ে পড়লো। অরিন দেখলো ইলহানের লাল টুকটুকে ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছে। তার চেহারা এতোটাই ভয়ানক হয়ে উঠেছে যে তাকে এখন রক্ত চোষকের মতো মনে হচ্ছে। যেনো সে কোনো প্রেতাত্মা। এইমাত্র কারো রক্ত শুষে এসেছে৷ এরপরের পরিস্থিতি কতটা লোমহর্ষক হতে পারে সেটা চিন্তা করেই অরিন ভেতর থেকে শিউরে উঠলো। অন্বয় দ্বিতীয়বার অরিনের হাত ধরে বললো,
” মিসেস অরিন, আপনি আমার সাথে ভেতরে চলুন।কাউকে ভয় পাবেন না।”
অরিন সহসা অন্বয়ের গালে ঠাসিয়ে চড় মারলো। অন্বয় হতভম্ব হয়ে গেল অরিনের আক্রমণে। অরিন চোখ-মুখ শক্ত করে বললো,
” আপনার সাহস কিভাবে হয় আমার হাসব্যান্ডের গায়ে হাত তোলার?”
অন্বয় নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারলো না। বিহ্বল কণ্ঠে বললো,” মিসেস অরিন? আপনি এই কথা বলতে পারলেন? দোষ কি আমার একার? আপনার হাসব্যান্ড নিজেই আগে আঘাত করেছেন আমাকে। আমি তো শুধু.. ”
ইলহান আগের চেয়েও দ্বিগুণ হিংস্রতা নিয়ে তেড়ে আসতে চাইলো অন্বয়ের দিকে। অরিন দুইহাতে ইলহানকে থামিয়ে অনুরোধ করে বললো,” প্লিজ ইলহান, দোহাই লাগে আর সিন ক্রিয়েট করো না। প্লিজ চলো আমরা বাসায় যাই?”
ইলহান অরিনের কথায় থামলো কিন্তু অন্বয়ের দিকে ‘খেয়ে ফেলবে’ এমন ধরণের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এদিকে অরিনের ব্যবহারে অন্বয় পুরোপুরি অবাক। অরিন কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অন্বয়কে বললো,
” কাজটা আপনি একদম ঠিক করেননি অন্বয়সাহেব।”
অন্বয় চমকে যাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল। অরিন ইলহানের হাত ধরে গাড়িতে উঠলো। আর অন্বয় পেছন থেকে ছটফট করে বলতেই থাকলো,
” মিসেস অরিন, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ। আমার লাস্ট কথাটা শুনে যান। প্লিজ একবার থামুন। অরিন!”
অন্বয় তাদের গাড়ির পেছনে দৌড়ে আসতে লাগলো। ইলহান যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি চালিয়ে জায়গা ত্যাগ করলো। অরিন ভয়ে চুপসানো মুখ নিয়ে বসে রইল। একবার ইলহানের ঠোঁটের রক্তাক্ত জায়গাটা স্পর্শ করতে চাইল হাত দিয়ে। ইলহান ঝারি মেরে অরিনের হাত সরিয়ে দিল। অরিন আহত দৃষ্টিতে তাকালো৷ ইলহান বললো,
” সত্যি করে একটা কথা বলবে অরিন?”
অরিনের হার্টবিট বেড়ে গেল। সে আন্দাজ করতে পারছে ইলহান কি ধরণের প্রশ্ন করবে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” কি?”
” তুমি সত্যি ডিভোর্স চাও আমার কাছে? এজন্যই ব্যারিস্টার অন্বয়ের কাছে গিয়েছিলে?”
অরিনের ভয় এবার কমলো কিছুটা। এর মানে ইলহান তাকে সন্দেহ করেনি। ডিভোর্সের কথা শুনেই সে ক্ষীপ্ত হয়েছে। কিন্তু তাহলে সে অন্বয়ের গায়ে কেনো হাত তুললো? শুধুই কি রাগ থেকে? নাকি অন্বয় তার হাত ধরেছিল বলে? ইশশ, ইলহান যদি এসব কথা কোনোভাবে বাসায় জানায় তাহলে আজীবনের জন্য অরিনের চরিত্রে দাগ লেগে যাবে। সবাই কি ভাববে তার সম্বন্ধে? সে কি কাউকে বুঝাতে পারবে যে এইখানে তার কোনো দোষ নেই? ইলহান তীব্র কণ্ঠে বললো,
” আমার কথার জবাব দাও অরিন?”
অরিন জবাব দিতে নিয়ে কেঁদে ফেললো। কান্নারত অবস্থাতেই বললো,
” তো আর কি করবো আমি? যে সম্পর্কে সত্যি’র কোনো বালাই নেই সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে কি লাভ? আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না ইলহান। দিনের পর দিন তুমি আমাকে মিথ্যে বলে ঠকাচ্ছো। কোন মেয়ে সহ্য করবে এইসব? আমি এই কষ্ট আর নিতে পারছি না। হয় তুমি আমাকে ডিভোর্স দাও নয়তো আমাকে মেরে ফেলো। তবুও এভাবে ঠকিয়ো না প্লিজ।”
ইলহান কোনো জবাব দিল না। চোয়াল শক্ত করে গাড়ি চালাতে থাকলো। স্পিড বাড়িয়ে দিল। অরিন আতঙ্কে জমে গেল। একহাত দিয়ে গাড়ির জানালা এবং অন্যহাত দিয়ে নিজের সিট চেপে ধরলো। সে ঠিকমতো বসে থাকতে পারছে না। ইলহান এতো জোরে কেনো গাড়ি চালাচ্ছে? যেকোনো মুহুর্তে এক্সিডেন্ট হতে পারে। অরিন অনুনয়ের স্বরে বললো,” ইলহান,প্লিজ আস্তে। আমার ভয় লাগছে।”
ইলহান শুনলো না অরিনের কথা। সে ক্রমাগত স্পিড বাড়াচ্ছে। অরিন ভয়ে কান চেপে ধরলো। আশেপাশের সবকয়টি গাড়ি পেছনে ফেলে তাদের গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছে। অরিন একাধারে আল্লাহ, আল্লাহ করতে লাগলো৷ হঠাৎ তার মনে হলো জায়গাটা অপরিচিত। তারা সঠিক জায়গায় যাচ্ছে না। অরিন কৌতুহল মেটাতে প্রশ্ন করলো,” এটা তো বাসার রাস্তা না। আমরা কোথায় যাচ্ছি ইলহান?”
ইলহান থমথমে কণ্ঠে বললো,” এদিকে আমার কাজ আছে।”
ইলহান একটা এনিমেল মার্কেটের সামনে গাড়ি থামালো। বের হওয়ার আগে গাড়ির দরজা লক করে গেল যাতে অরিন বের হতে না পারে। অরিন প্রশ্ন করলো,” কোথায় যাচ্ছো?” ইলহান পেছন ফিরেও তাকালো না। জবাবও দিল না। অরিন আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো এইরকম এই জায়গায় ইলহানের কি কাজ থাকতে পারে? একটু পর খাঁচায় বন্দি প্রায় আট-দশটা বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে ইলহান গাড়িতে প্রবেশ করলো। খাঁচাটা পেছনের সিটে রাখলো। রঙ-বেরঙের বাচ্চাগুলোকে দেখতে চমৎকার সুন্দর! পারশিয়ান ক্যাট। প্রত্যেকটির চোখে অসম্ভব মায়া। গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিতে ইচ্ছে করে। অরিন জিজ্ঞেস করলো,
” এগুলো দিয়ে কি করবে?”
” আগে বাসায় চলো তারপর বলছি।”
এরপর পুরো রাস্তা দু’জন নিশ্চুপ রইল। অরিন পেছনে তাকিয়ে বার-বার বাচ্চাগুলোকে দেখছিল। কি আদুরে, কি সুন্দর! ইলহান এপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি থামিয়ে খাঁচাটা হাতে নিল। অন্যহাত দিয়ে অরিনের হাত ধরলো। তারপর লিফটে করে অষ্টমতলায় তাদের বাসায় আসলো। ইলহান সরাসরি কিচেনে ঢুকে গেল। খাঁচা থেকে বাচ্চাগুলোকে বের করে ডাইনিং টেবিলে রাখলো। তারপর ইয়া বড় একটা ছুড়ি এনে সবচেয়ে সুন্দর বিড়ালের বাচ্চাটির গলা কাটতে লাগলো। অরিন ভীষণ জোরে একটা চিৎকার দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো।
” ইলহান কি করছো এটা?”
ইলহান থেমে গেল। অরিন তাক লেগে চেয়ে রইল। তার মাথা থেকে পা অবধি কাঁপছে এমন ভয়ংকর দৃশ্য দেখে। ইলহান বললো,” ডিনার রেডি করছি। আজকে এগুলোই আমাদের ডিনার হবে যদি না তুমি সত্যি কথা বলো।”
অরিন ভ্রু কুচকে ফেললো,” কিসের সত্যি?”
” ব্যারিস্টার অন্বয়ের সাথে তোমার সম্পর্ক কি? খবরদার মিথ্যে বলবে না। কারণ তুমি যতবার মিথ্যে বলবে এই নিষ্পাপ বাচ্চাগুলো ততবার প্রাণ হারাবে।”
অরিন স্তব্ধ হয়ে গেল। তার মানে ইলহান ঠিকই তাকে ভুল বুঝেছে। কিন্তু তাই বলে সে এইরকম করবে? এতোটা জঘন্য সে?এতোটা নির্দয়?

চলবে

-Sidratul Muntaz

#রংধনুর_রঙ_কালো
৮.

ইলহানের চিৎকারে কম্পিত হলো অরিনের দেহ।
” টেল মি অরিন? হোয়াট কাইন্ড অফ রিলেশন বিটউইন ইউ এন্ড মি.অন্বয়? টেল মি দ্যা ট্রুথ! ডোন্ট ডেয়ার টু লাই।”
অরিন সত্যি স্বীকার করলো। আতঙ্কিত অবস্থায় সবকিছু বলে ফেললো। একটা মিথ্যা বানাতে গেলে আরও দশটা মিথ্যা বলতে হয়। তাই অরিন সমস্ত কথাই সত্যি বললো। ইলহান উপহাসের স্বরে বললো,
” ওয়ান্ডারফুল! প্রথমে তুমি আমার বাবা-মাকে মিথ্যে বলেছো। তারপর এইখানে এসে আমাকেও মিথ্যে বলেছো। মিথ্যেটা কি? তুমি নাকি তোমার ফিমেল ফ্রেন্ড আর তার হাসব্যান্ডের সাথে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছো। অথচ তুমি এসেছো তোমার সো কল্ড বয়ফ্রেন্ড মি. অন্বয়ের সাথে! তাও কিজন্য? আমাকে সন্দেহ করে? এখন তো আমার মনে হচ্ছে তোমাকেই সন্দেহ করা উচিৎ।”
ইলহান ডাইনিং টেবিল পেরিয়ে অরিনের কাছে আসলো। অরিন মেঝেতে দুই হাঁটু পেছনে ভাজ করে বসেছিল। ইলহান খানিক অরিনের মুখের দিকে ঝুঁকে শীতল কণ্ঠে বললো,
” এখন যদি আমি বলি, সবকিছু একটা এক্সকিউজ? আসলে তোমার সাথে মি. অন্বয়ের অবৈধ সম্পর্ক চলছে। তাই আমার নামে মিথ্যে এলিগেশন আনতে চাইছো তুমি। আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার বাহানা এইসব। যাতে মি. অন্বয় আর তোমার সম্পর্কে আর কোনো বাঁধা না থাকে। ঠিক বলেছি না?”
অরিনের চেহারা কঠিন হয়ে এলো। সে ইলহানের গালে চড় মারার জন্য হাত উঠালো কিন্তু সাথে সাথে ইলহান সেই হাত মুচড়ে ধরলো। অরিন ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। ইলহান বললো,
” অনেক হয়েছে আর না। আমাকে চড় দেওয়ার অধিকার তুমি হারিয়ে ফেলেছো। আমি আর সহ্য করবো না এইসব। আমার সাথে বিট্রে করার শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে ইউ ব্লাডি শিট!”
ইলহান রুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অরিন থমকে গেল ইলহানের কণ্ঠে গালি শুনে। নিস্তব্ধ চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মুখ বিকৃত করে বললো,
” তুমি যেমন নোংরা, তোমার চিন্তা-ভাবনাও নোংরা।”
ইলহান উঠে ঘর কাঁপানোর মতো উচ্চশব্দ করে বললো,” হ্যাঁ এখন তো আমি নোংরাই হবো। আমার চিন্তা-ভাবনাও নোংরা হবে। কারণ আমাকে ছাঁড়ার একটা বাহানা চাই তোমার। যেভাবেই হোক আমাকে খারাপ প্রমাণ করতে হবে। কারণ আমাকে তোমার আর ভালো লাগছে না। এজন্যেই তো আমাকে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছো না। অন্বয়সাহেব নিষেধ করেছে তাই না?”
অরিনের কান গরম হয়ে গেল। দুইহাতে কান চেপে সে বললো,” ছি ইলহান তুমি খুব খারাপ।”
ইলহান শক্ত হাতে অরিনের গাল চেপে ধরলো। চোয়াল শক্ত করে বললো,” খারাপের দেখেছো কি? আমি এখন তোমাকে বুঝাবো খারাপ কি জিনিস। যাস্ট ওয়েট এন্ড সী।”
ইলহান হনহন করে বেডরুমের দিকে গেল। কি হতে চলেছে ভেবে অরিনের শিরা-ধমনীর রক্ত চলাচল স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে একমনে শুধু আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। এ কেমন বিপদে পড়লো সে? অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন ইলহান আসলো না তখন অরিন নিজেই বেডরুমে দেখতে গেল। ইলহান ল্যাপটপ হাতে বিছানায় বসে কি যেনো করছে। অরিন ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলো। ইলহান শায়িখ সাহেবকে ভিডিওকল দিচ্ছে। কিন্তু তিনি ধরছেন না। অরিন চেঁচিয়ে উঠলো,
” ইলহান কি করছো তুমি?”
ইলহান নিজের ঠোঁটে আঙুল ঠেঁকিয়ে বললো,” শশশ, এখন একটা শব্দও যদি করো বিড়ালের বাচ্চাগুলো সবকয়টি প্রাণ হারাবে। তাদের নির্মম মৃত্যু নিজের চোখে দেখতে পারবে অরিন?”
অরিন জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। সে যা ভাবছে ইলহান কি সত্যি তাই করবে?
” বাবা আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছো?”
অরিন হাঁটু ভাজ করে মেঝেতে বসে পড়লো। লজ্জায় তার হাঁটু কাঁপতে লাগলো। মুখ ঢেকে ফেলতে ইচ্ছে করলো। না চাইতেও অরিনকে শুনতে হলো ইলহান তার বাবার সাথে কি ধরণের কথা বলছে। এই পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সবকিছু ইলহান তার বাবাকে জানাচ্ছে। মাও এসে শুনতে লাগলেন। ইলহানের যতটুকু ভুল ধারণা ছিল সবটুকু ভুল সে তার বাবা-মাকেও বুঝিয়ে ফেললো। অরিনের মনে চাইলো মাটিতে মিশে যেতে। গলায় ফাঁস লাগাতে অথবা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে। এতোটা লজ্জা ইলহান তাকে দিতে পারলো? ফোন রাখার আগে ইলহান একবার জিজ্ঞেস করলো,
” তোমাদের বউমা’র সাথে কথা বলবে না?”
নুসাইবা খ্যাক করে উঠলেন,” ওই মেয়ের মুখও দেখতে চাই না আমি। কথা তো দূর।”
তারপর ঠাস করে ফোন কেটে গেল। ইলহানের চোখেমুখে তৃপ্তি। অরিনকে অপমান করতে পেরে নিশ্চয়ই তার খুব ভালো লাগছে। শান্তি হয়েছে সে এইবার? কিন্তু অরিনের যে ভেতর থেকে সবকিছু পুড়ে যাচ্ছে। শ্যানিন যখন এইসব জানবে তাকে কি ক্ষমা করতে পারবে? কেউ কি বিশ্বাস করবে যে অরিনের এইখানে কোনো দোষ ছিল না। তবে ভুল অবশ্যই ছিল। সবাইকে মিথ্যে বলে অন্বয়ের সাথে তার বিদেশে আসাই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। দ্বিতীয় ভুল ইলহানের কাছে ধরা খাওয়া। এখন সবাই তার বিরুদ্ধে চলে গেল। ইলহানের অন্যায়গুলো অরিন আর কাউকে বলতে পারবে না। বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। সবাই ভাববে অরিন নিজের পিঠ বাঁচাতে ইলহানকে দোষ দিচ্ছে। কি থেকে কি হয়ে গেল এইসব! অরিনের চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইলো। ইলহান ল্যাপটপ রেখে অরিনের কাছে এলো। এক হাঁটু ভাজ করে অরিনের বরাবর বসলো। অরিন ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে ইলহানের দিকে তাকালো। ইলহান আলতো করে অরিনের কপালের একপাশ স্পর্শ করলো। অরিন একরাশ ঘৃণা নিয়ে ইলহানের হাত সরিয়ে দিল। ইলহান হেসে দিয়ে বললো,
” ভয় নেই। আমি তোমাকে টাচ করবো না। তোমার মতো মেয়েকে টাচ করতেও আমার ঘৃণা লাগবে। আই হেইট ইউ অরিন। আই যাস্ট হেইট ইউ।”
শান্ত কন্ঠে এসব বলে ইলহান রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রাতটা সে ড্রয়িংরুমেই কাটালো। অরিনের চেহারা দেখতেও বেডরুমে এলো না। আর অরিনের রাত কাটলো বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে। সকালে অরিনের ঘুম ভাঙার আধঘণ্টার মাথায় অরিন মায়ের ফোন পেল। অরিনের মা হালিমা ফোন করে তাকে একগাঁদা কথা শোনালেন। কান্নাকাটি করলেন। অভিশাপ পর্যন্ত দিলেন। অরিন কাঁদতে কাঁদতে মাকে বললো,” বিশ্বাস করো মা। ওই লোকের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি তোমাদের জামাইকে ঠকাইনি।”
” তাহলে তুই আমাদের মিথ্যে বলে ওই ছেলের সাথে অস্ট্রেলিয়া কেনো গেলি? এতোবড় নাটক কেনো করলি?”
অরিন এই প্রশ্নের পিছে কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। উত্তর দিতে গেলেও সেটা মা বিশ্বাস করবেন না। খুব ভালো হতো যদি এর আগে তার সাথে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনাগুলোর কথা সে অন্বয়কে না জানিয়ে আগে তার পরিবারকে জানাতো। তাহলে একটু হলেও কেউ তার কথা বিশ্বাস করতো। কিন্তু এখন অরিন যা বলবে সবাই সেটা বানোয়াট ভাববে। কি করবে সে? রাগারাগি করে মা ফোন রেখে দিলেন। এইসব কথা কি বাবাও জেনে গেছে? ভাইয়াও কি জানে? পরিবারের সামনে মুখ দেখানোর জো আর রইল না। অরিন ঠিক করলো এখন থেকে সে আর কারো ফোন ধরবে না। এদিকে অন্বয় তাকে একনাগাড়ে ফোন করে যাচ্ছে। ম্যাসেজ দিচ্ছে। অরিনের মনে একটা অদ্ভুত ইচ্ছা জাগলো। সে তার স্যুটকেস থেকে একটা সুন্দর সাদা রঙের জামা বের করলো। সাদা রঙ বের করার কারণ ইলহানের পছন্দ। ইলহান অরিনকে সাদা জামায় দেখতে সবচেয়ে পছন্দ করে। সাজ-সজ্জার জিনিসপত্র বিছানায় রেখে অরিন গোসলে ঢুকলো। গোসল শেষ করে সাদা লেহেঙ্গাটা পরে ইচ্ছেমতো সাজলো। ভেজা চুল পিঠময় ছড়িয়ে দিল। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক দিল। কাজলে চোখ রাঙালো। ইলহান যেভাবে তাকে শাস্তি দিয়েছে অরিন তার দ্বিগুণ শোধ তুলবে এবার। সবাই তো সব জেনেই গেছে। তাহলে অরিনের আর ভয় কিসের? অরিন এখন আরও বেশি করে অন্বয়ের সাথে মিশবে। ইলহান দেখুক,জ্বলুক,পুড়ুক,মরে যাক। অরিনের কিচ্ছু যায়-আসে না। সে যেই ভয়ে অন্বয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল সেই ভয়টা তো এখন আর নেই! ইলহানকে ভয় পায় না অরিন। পরিবারের কাছে নিজের মান-সম্মান হারানোর ভয় পেয়েছিল। এখন সেই মান-সম্মান হারানোর ভয় যেহেতু নেই তাহলে অরিন কেনো ইলহানের কথা শুনবে? সে নিজের স্বাধীনমতো চলবে। অরিনকে সাদা পোশাকে বের হতে দেখে ইলহান সামনে এসে বাঁধা দিল।
” এক মিনিট, কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
” আমার কাজ আছে। সামনে থেকে সরে দাঁড়াও।”
” তুমি এইরকম ড্রেসে কোথায় যাচ্ছো? মি. অন্বয়ের সাথে দেখা করতে?”
” তাতে তোমার কি? তুমি তো আমাকে ঘৃণা করো। তাহলে আমি যার সাথেই দেখা করি তোমাকে কেনো সেই কৈফিয়ৎ দিতে হবে?”
ইলহান জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালো। ক্ষীপ্ত হয়ে অরিনের গাল চেপে ধরে বললো,” ঘৃণা করলেও তুমি আমার, ভালোবাসলেও তুমি আমার। তুমি শুধুই আমার।”
অরিনের মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটলো। সে হাত ভাজ করে বললো,” চমৎকার! আমি শুধুই তোমার। আর তুমি সবার তাই না? ফালতু কোথাকার!”
ইলহানকে ধাক্কা মেরে সামনে থেকে সরিয়ে অরিন বের হয়ে গেল। ইলহান তৎক্ষণাৎ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। সে অন্বয়কে খুন করবে। প্রয়োজনে ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে। তাও সে অন্বয়কে খুন করেই ছাঁড়বে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here