রংধনুর_রঙ_কালো,২৯,৩০
Sidratul Muntaz
২৯
“আপনি তো পুরো জাত হারামি হয়ে গেছেন মি. অন্বয়!”, সোফিয়ার ঠাট বাক্য শুনে অন্বয়ের মুখ কঠিন হয়ে এলো। সে ফোনটা ভালো মতো কানের সাথে চেপে ধরে কঠিনভাবে বলল,” আপনার চেয়ে হারামিগিরি আমি কম করেছি। ”
” তাই নাকি?” সোফিয়া গাঁ জ্বালানো হাসি দিচ্ছে। অন্বয়ের মেজাজ তিরিক্ষ হয়ে উঠল। খিটমিট করে সে বলল,” আপনি কি কাজটা করবেন? নয়তো আমি ফোন রাখলাম।”
” আহা, এতো দাম দেখাচ্ছেন কেন? সুন্দর করে বললেই তো হয়। আমি ছাড়া এখন আপনার অন্যকোনো উপায়ও নেই। অযথা দাম দেখিয়ে কি লাভ বলুন?”
” ঠিকাছে সুন্দর করেই বলছি। আমি চাই না মিসেস অরিন আর মি. মাহদী কখনও এক হোক। সেই ব্যবস্থাই আপনাকে করতে হবে। এতে শুধু আমার লাভ নেই। আপনার নিজেরও লাভ আছে। আপনিই তো চেয়েছিলেন যাতে মিসেস অরিন ইলহান মাহদীর জীবন থেকে চলে যায়। এটা তো আপনার জন্যই ভালো তাই না? ইনফ্যাক্ট আমাদের দু’জনের জন্যই ভালো। আমি মিসেস অরিনকে নিয়ে ফিরে যাবো বাংলাদেশে। আর আপনি এখানে মি. মাহদীকে নিয়ে হ্যাপি থাকবেন। ডিল?”
” খুব সুন্দর প্রস্তাব। আপনার বুদ্ধিও আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় অরিন চলে গেলেও ইলহান ওর পিছু ছাড়বে না। যদি সে নিজেও বেংলাডেশে চলে যায়?”
” এটা নিয়ে আপনি ভাববেন না। চাইলেও ইলহান মাহদী আর কখনও অরিনকে খুঁজে পাবে না।”
” কথা দিচ্ছেন?”
” হ্যাঁ দিচ্ছি।”
” ঠিকাছে। তাহলে আপনিও নিশ্চিন্ত থাকুন। যা চাইছেন সেটাই হবে। কিন্তু অরিন কি এতো সহজে বোকা হবে?”
” এটা নিয়েও আপনি ভাববেন না৷ আমি যা বলবো মিসেস অরিন সেটাই বিশ্বাস করবেন। তিনি এখন নিজের চেয়েও বেশি আমাকে বিশ্বাস করেন কি-না!”
” এতো নিশ্চিত কিভাবে হচ্ছেন আপনি? যদি বুঝে ফেলে?”
” বললাম তো বুঝবে না। ইংরেজিতে সেই নীতিবাক্যটা শুনেছেন? স্ট্রাইক দ্যা আয়রন হোয়াইল ইট ইজ হট। মিসেস অরিন এখন ঠিক বিগলিত লোহার মতোই। তাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই বোঝানো যায়।”
” বাহ, আপনি নিজেও কিন্তু বিশ্বাসঘাতক হয়ে যাচ্ছেন।”
” মাঝে মাঝে বিশ্বাসঘাতক হতে অন্যায় নেই৷ তাছাড়া কোন মনিষী যেনো কখন বলেছিল? এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লভ এন্ড ওয়ার।”
” তাহলে তো কথাটা আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ”
” অবশ্যই।”
সোফিয়া খিলখিলিয়ে হাসছে। অন্বয় ফোন রেখে অরিনের ঘরে এলো। অরিন টেনশনে এপাশ-ওপাশ করছে। ঘরের এ মাথা থেকে ওই মাথা শুধু হেঁটে বেড়াচ্ছে। তাকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। অন্বয় বলল,” এতো টেনশন করবেন না মিসেস অরিন। ভালো কিছুই হবে ইনশাল্লাহ। আমার মন বলছে, সব আগের মতো ঠিক হয়ে যাবে।”
অরিন চোখ-মুখ লাল করে বলল,” আপনি সোফিয়ার সাথে কথা বলেছেন?”
” জ্বী বলেছি।”
” সে আমাদের সাহায্য করতে রাজি হয়েছে?”
” হ্যাঁ হয়েছে। আমি তাকে হুমকি দিয়ে রাজি করিয়েছি।”
” কিসের হুমকি দিয়েছেন?”
” সে যে আপনাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল এটা ইলহান মাহদীকে জানিয়ে দেওয়া হবে। এভাবে হুমকি দিয়েছি।”
অরিন একটু থমকে বলল,
” কিন্তু ইলহান তো এই কথা আগে থেকেই জানে।”
” হ্যাঁ। কিন্তু ইলহান যে জানে সেটা তো সোফিয়া জানে না।”
অরিন জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে বলল,” জেনে গেলে কি হবে?”
” কিছুই হবে না। আপনি অতিমাত্রায় টেনশন করছেন। পানি খান।”
অন্বয় খাটের এডজাস্ট টেবিল থেকে পানি ঢেলে অরিনকে। অরিন পানি খাওয়ার আগেই ফোন আসলো। ইলহানের নাম্বার। অরিন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো অন্বয়ের দিকে। অন্বয় ইশারায় বলল ফোন ধরতে। অরিন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,” হ্যালো।”
” তুমি বাসায় কবে আসবে অরিন?”
” বললাম না কাল আসবো?”
ইলহান কণ্ঠে কাতরতা ঢেলে বলল,” কালকেই কেনো? আজকে কেনো নয়? এক্ষুণি কেনো নয়?”
” আমার একটু সময় দরকার ইলহান।”
” তুমি কি এখনও দ্বিধাগ্রস্ত? এখনও কি মন থেকে আমাকে ক্ষমা করতে পারোনি?”
” সেরকম না। আসলে আমার এমনিতেও স্বাভাবিক হওয়ার জন্য একটু সময় লাগবে।”
” তুমি বাসায় চলে আসো৷ শুধু বাসায় আসো। আমি তোমাকে ডিস্টার্ব করবো না। তুমি তোমার মতো অন্য ঘরে থেকো। প্রয়োজনে আমরা বাসা দুইভাগ করবো। একভাগে তুমি থাকবে, অন্যভাগে আমি। তোমার সমস্যা হবে না অরিন। প্লিজ চলে এসো!”
” তোমার এতো তাড়া কিসের ইলহান? বলছি তো আমি কাল আসবো। এতোদিন অপেক্ষা করেছো আর একটা দিন অপেক্ষা করতে পারবে না? দেখো তুমি যদি আরেকবার ফোন করে আমাকে জ্বালাও তাহলে আমি আর কখনোই আসবো না।”
অরিন আচমকা ফোন কেটে দিল৷ তার গলা চড়ে গেছে। কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে সে অন্বয়কে প্রশ্ন করল,” সোফিয়া কখন যাবে ইলহানের বাসায়?”
” আজকে রাত আটটায়।”
অরিন দেয়াল ঘড়িতে তাকালো। বিকাল চারটা বাজে। আরও চারঘণ্টা। সে কিভাবে অপেক্ষা করবে এতো উৎকণ্ঠা নিয়ে? আজকে ইলহানের চরিত্রের চূড়ান্ত পরীক্ষা হবে৷ সোফিয়াকে যদি ইলহান ছুঁয়ে ফেলে তাহলে অরিন আর কোনোদিন ইলহানের কাছে ফিরে যাবে না। কিন্তু যদি সে সোফিয়াকে তাড়িয়ে দেয় তাহলে হয়তো অরিনের আর কোনো দ্বিধা থাকবে না ইলহানকে আগের মতো ভালোবাসতে।
ইলহান অনিচ্ছা সত্ত্বেও সোফিয়াকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছে। কারণ এসেই সোফিয়া ভীষণ কান্নাকাটি করছিল। আগে কখনও ইলহান তাকে কাঁদতে দেখেনি। দাড়োয়ানের সামনে মেয়েটার এমন আচরণে এক প্রকার বিব্রত হয়ে পড়েছিল সে। তাই তাকে ভেতরে এনে দরজা আটকে সবার প্রথমেই বলল,” কি বলতে চাও তারাতাড়ি বল। তারপর বিদায় হও। তোমার চেহারা আমি সহ্য করতে পারছি না।”
” কেন ইলহান? কেনো সহ্য করতে পারছো না আমাকে?”
এই কথা বলে সোফিয়া ইলহানের গালে হাত রাখলো। ইলহান তীব্র রাগে ফেটে উঠল। এক ঝটকায় সোফিয়ার হাত সরিয়ে বলল,
” কারণ তুমি ভালো করেই জানো। কি বলতে এসেছো ভালোয় ভালোয় বলে দ্রুত এখান থেকে বের হয়ে যাও। আমার মাথা গরম হওয়ার আগেই।”
” যদি না বের হই?”
” তোমাকে মেরে এখানেই পুঁতে রাখবো। কেউ জানতেই পারবে না মডেল সোফিয়া কিভাবে উধাও হলো।”
ইলহানের কণ্ঠে ভয়ংকর এক শীতলতা ছিল। সোফিয়ার গাঁ এক মুহুর্তের জন্য ছমছম করে উঠলো। ইলহান জীবনে কখনও মানুষ খুন করেনি। কিন্তু তার বাবা পিঁপড়ার মতো মানুষ মারতেন। সেই বৈশিষ্ট্য হঠাৎ ইলহানকেও পেয়ে বসবে না তার কি গ্যারান্টি আছে? সোফিয়া নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল। এখন ভয় পেলে চলবে না। সে এইখানে যে কাজের জন্য এসেছে সেই কাজটা তো করতেই হবে। সোফিয়া কোমলভাবে বলল,” ঠিকাছে, যদি এতোই ইচ্ছা থাকে মেরে ফেলার তাহলে মেরেই ফেলো। তোমার সাথে সারাজীবন বাঁচতে না পারলাম অন্তত তোমার হাতে মরতে চাই।”
ইলহানের ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো।
” তুমি কি এইসব বলতেই এখানে এসেছো? জরুরী আলাপের বিষয়টা কি তাহলে মিথ্যে?”
সোফিয়া একটু সময় নিয়ে বলল,” অরিনকে ফোন করেছিলাম। সে বলল তোমাদের মধ্যে নাকি সব ঠিক হয়ে গেছে। অরিন নাকি কাল তোমার কাছে ফিরে আসছে। আবার নতুন করে তোমাদের সংসার শুরু হবে। তোমরা বেংলাডেশে ফিরে যাবে। আর কখনও কি অস্ট্রেলিয়া আসবে?”
” জানি না।”
“তোমাদের নতুন জীবনের জন্য আমার পক্ষ থেকে অভিনন্দন। ভালো থেকো তোমরা। আমি আর কখনও তোমাদের বিরক্ত করতে আসবো না।”
ইলহান মনে মনে অনেকটা চমকে গেল৷ সোফিয়ার মুখে এমন ধরণের কথা একেবারেই অবিশ্বাস্য। কিন্তু চেহারায় হতভম্ব ভাবটা প্রকাশ করতে চাইলো না ইলহান। গম্ভীর গলায় বলল,” থ্যাংকস। ”
সোফিয়া এবার ইলহানের একটু কাছে এসে বলল,” কিন্তু আমার একটা ইচ্ছে আছে। বলতে পারো তোমার কাছে শেষ আবদার।”
ইলহান কিছুটা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করল,” কি?”
” আজকে রাতটা কি আমি এখানে থাকতে পারি? শেষবারের মতো? আর কখনও হয়তো চাইলেও দেখা হবে না। শুধু আজকে রাতের স্মৃতি নিয়ে আমি আমার পুরো জীবন এক নিঃশ্বাসে কাটিয়ে দিতে পারবো। বিশ্বাস করো।”
ইলহানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো। রাগে টগবগ করে উঠলো শরীরের রক্ত। এজন্যই তাহলে সোফিয়ার হঠাৎ পরিবর্তন? সে আসলে চাইছেটা কি?
রাত আটটা বাজতে বেশি সময় নেই। সোফিয়া নিশ্চয়ই বেরিয়ে পড়েছে এতোক্ষণে। অরিনের এই অবস্থায় খুবই ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে সে কোনো আসামী। এই মুহুর্তে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। এখনি সিদ্ধান্ত জানানো হবে তার ফাসি হচ্ছে নাকি যাবজ্জীবন? অরিন শুকনো গলায় ঢোক গিলে চোখেমুখে মালিশ করতে করতে বলল,
” আচ্ছা অন্বয় সাহেব, সোফিয়া যদি ধোঁকা দেয়? যদি কোনো ছলচাতুরী করে? ওকে তো আপনি চেনেন।”
” কিরকম ছলচাতুরীর কথা বলছেন? এখানে ছলচাতুরী করার কোনো চান্সই নেই। আপনি নিজের চোখে সবকিছু দেখতে পাবেন। সোফিয়া ওই বাড়িতে প্রবেশ করার সাথে সাথেই তার লকেটে যুক্ত ডিজিটাল ক্যামেরার মাধ্যমে ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভেসে উঠবে সেখানকার দৃশ্য।”
অরিন ল্যাপটপের পর্দায় তাকালো। যে কোনো পরিস্থিতি সহ্য করার জন্য নিজের মনকে প্রস্তুত করে নিল। একটু পরেই ল্যাপটপে ভেসে উঠলো ইলহানের মুখ। সোফিয়াকেও দেখা যাচ্ছে। সে হয়তো তার লকেট এমন কোনো জায়গায় রেখেছে যাতে রুমের পুরো দৃশ্যটা ঠিকঠাক চোখে পড়ে। জায়গাটা ইলহানের বেডরুম। সিন সরাসরি বেডরুম থেকেই কেনো শুরু হলো? কথা ছিল সোফিয়া বাড়ির সম্মুখ দরজার কাছাকাছি আসতেই ওরা সবকিছু দেখতে পাবে। অরিন এই বিষয়ে অন্বয়কে প্রশ্ন করতে চেয়েও করল না। অন্বয় ওর পাশে নেই। এই ঘর থেকে অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে সে। এখন যে দৃশ্য শুরু হবে সেটা অন্বয়ের দেখা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। অরিনের আত্মা ভেতর থেকে দ্রিম দ্রিম শব্দ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কিছু হতে পারে না। সোফিয়া এখন ইলহানের সামনে পুরোপুরি উন্মুক্ত। ইলহানকে দেখে একটুও মনে হচ্ছে না যে সে মোহবিষ্ট। অরিনের কেনো যেনো ভেতর থেকে একটা অপ্রতিরোধ্য বিশ্বাস চলে আসলো যে ইলহান এবার সোফিয়াকে প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্তু অরিনকে অবাকের চূড়ান্ত সীমায় পতিত করে সে সোফিয়ার আহবানে সাড়া দিল! অরিনের মস্তিষ্কের সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছিল। হৃদ দরিয়ায় শুরু হলো জলোচ্ছ্বাস। এক ধাক্কায় টেবিলের ল্যাপটপ ভেঙে ফেলল সে। দিলো একটা বিকট চিৎকার। দরজার বাহিরে থেকে অন্বয় স্পষ্ট শুনতে পেল অরিনের আহাজারি। তার ঠোঁটে ফুটল তৃপ্তির এক ঝলক হাসি। সোফিয়া সফল হয়েছে!
চলবে
– Sidratul Muntaz
#রংধনুর_রঙ_কালো
৩০.
ওই ঘটনায় অরিন এতো বেশি আহত হয়েছিল যে ঘরে ঢুকে সারারাত দরজা বন্ধ করেই কাটিয়ে দিল। অন্বয়ের সাথে একটা কথাও বলল না। কিন্তু কথা না বললেও কি? অন্বয় সবকিছু জানে। তার পরিকল্পনা অনুযায়ীই সব হয়েছিল। অরিন খুব ভোরে রুম থেকে বের হয়ে অন্বয়কে জানালো সে এই এপার্টমেন্টে আর থাকতে চায় না। ইলহানের সাথে সবরকম যোগাযোগ বন্ধ করার জন্য সে স্থান পরিবর্তন করবে৷ ফোন নাম্বার বদলে ফেলবে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সমস্ত আইডি ডিলিট করে ফেলবে। এক কথায় ইলহান যেনো আর কোনোভাবেই তাকে খুঁজে না পায় সেই ব্যবস্থা করবে। অরিন ভোরে যখন অন্বয়ের রুমে এসে এতোকিছু বলছিল তখন অন্বয় খেয়াল করেছিল অরিনের চেহারার ফ্যাকাশে রূপ। সারারাত সে না ঘুমিয়ে কেঁদেছে তা দেখলেই বোঝা যায়। এতোকিছুর পরেও ইলহানের ক্ষমাপ্রার্থনার পর অরিন মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে সে ইলহানকে ক্ষমা করবে। কিন্তু গতরাতের ওই ঘটনায় তার মন দ্বিতীয়বার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। ইলহান ক্ষমার অযোগ্য এটা আবারও প্রমাণিত হলো। যদিও সবকিছু ছিল একটা ভ্রম। অন্বয় আর সোফিয়ার পূর্ব পরিকল্পনা। যে পরিকল্পনার কথা কেউ কোনোদিন জানবে না। শুধু অন্বয় আর সোফিয়া ছাড়া। অন্বয় অরিনের কথামতো কাজ করল। সে জানতো সকাল হলেই ইলহান এখানে চলে আসবে অরিনকে ফিরিয়ে নিতে। অন্বয়ের কিঞ্চিৎ আশংকা, ইলহান এসে সামনে দাঁড়ালে, ক্ষমা চাইলে অরিনের মন আবার গলে যাবে। মেয়েদের মনের কথা তো বলা যায় না। তাছাড়া অরিনও চাইছিল না ইলহানের সাথে তার দেখা হোক। তাই সিদ্ধান্ত হলো ভোরবেলাই ওরা এপার্টমেন্টের সমস্ত পেমেন্ট মিটিয়ে এখান থেকে বের হয়ে যাবে। ট্যাক্সি ভাড়া নেওয়া হলো। অন্বয় আর অরিন পেছনে বসলো। ড্রাইভার বাবা বসলো সামনে। ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে। গাড়ি চলছে আর অরিন শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাহিরের দিকে। অন্বয় জানে, তার জন্যই অরিন আজ এতো কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু এতে তার কিছু করার নেই। ইলহানের মতো মানুষের সাথে সে তার ব্ল্যাক পার্লকে সারাজীবন থাকতে দিতে পারে না। এর জন্য যদি ব্ল্যাক পার্লকে একটু কাঁদাতে হয় তাও ভালো। কাঁদুক ব্ল্যাক পার্ল। কেঁদে-কেটে সব ভুলে যাক। ইলহান যতই ভালো মানুষ হয়ে যাক না কেনো, যতই অনুতপ্ত হোক না কেনো, তার মতো চরিত্রহীন কীট কখনোই অরিনকে ডিজার্ভ করে না। তাছাড়া নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে সুখে রাখার মতো মহানুভবতা অন্বয়ের নেই। সবাইকে সে তখনি সুখে থাকতে দিবে যখন সে নিজে সুখী হবে। আর তার কাছে সুখ মানেই মিসেস অরিন। এই সুখ পাখিকে খাচায় বন্দী করার জন্য যদি তাকে হিংস্র শিকারী হতে হয় তাও সে হবে। যে কোনো মূল্যে অরিনকে সে নিজের করে ছাঁড়বে।
অরিন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল,” স্টপ দ্যা কার। প্লিজ স্টপ দ্যা কার।”
সাথে সাথেই গাড়ি থামানো হলো। অন্বয় প্রশ্ন করল,” কি হয়েছে মিসেস অরিন?”
একটা সুবিশাল স্টুডিও ভবনের প্রকান্ড পোস্টারে অরিনের নজর আটকে গেছে। কারণ ছবিটা সোফিয়ার। বেগুনি স্লিভলেস টপ পড়ে সে ডানগালে এক হাত ঠেকিয়ে বসে আছে চেয়ারে। দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। অরিনের দুই চোখ পানিতে টইটম্বুর। সোফিয়ার সৌন্দর্য্য দেখে তার কেনো কান্না পাচ্ছে? কেনো নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে? জীবনে প্রথমবার নিজের গায়ের রং, অযোগ্যতা, জৌলুস হীনতা নিয়ে অরিনের বড্ড, বড্ড বেশি আফসোস হচ্ছে। নিজের মনের এই অযৌক্তিক অনুভূতির কারণ অরিন জানে না। তাকে ওইভাবে সোফিয়ার ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অন্বয় একটু ঠাট্টার মতো বলল,” বেস্ট ফ্যাশন আইকন, মডেল সোফিয়া রিভেরা। এখানেই হয়তো তার স্টুডিও। একবার যাবেন নাকি?”
অরিন একটু চমকে গেল। অপ্রতিভ স্বরে বলল,” আমি গিয়ে কি করবো ওখানে?”
” আমার মনে হয় এখন সোফিয়া স্টুডিওতে থাকতে পারে। যদি তাকে পাওয়া যায় তাহলে ছোট্ট করে একটা ধন্যবাদ জানাবেন। সে তো আমাদের কম উপকার করেনি। কাল যদি সে সাহায্য না করতো তাহলে আজকে আপনি আবারও প্রতারিত হতে যাচ্ছিলেন।”
অরিন মিনিট দুয়েক ভাবলো। আসলেই তো, সোফিয়া অবশ্যই একটা ধন্যবাদ ডিজার্ভ করে। ইলহানের আসল রূপ অরিনের সামনে টেনে বের করার জন্য সোফিয়াকে একটা ধন্যবাদ নিশ্চয়ই দেওয়া উচিৎ। অরিন সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে স্টুডিওর উদ্দেশ্য হাঁটা ধরলো। অন্বয়ও তার পেছন পেছন গেল। ট্যাক্সি ড্রাইভার আর বাবা গাড়িতেই বসে রইল।
নিজের কালো রূপ নিয়ে অরিনের মনে একটু আগে যে হীনমন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, স্টুডিওতে ঢোকার পর তা আরও শতগুণ বৃদ্ধি পেল যেনো। কারণ গেইটেই একটা মেয়ে অরিনকে আচমকা দেখে এমন ভান করল যেনো সে খুব ভয় পেয়েছে। তারপর নাক-মুখ কুচকে পাশেরজনকে বিরবির করে কিছু একটা বলতে বলতে চলে গেল। শুধু তাই নয়, যেই অরিনকে দেখছে সেই কিভাবে যেনো তাকাচ্ছে। অরিন যেনো চিড়িয়াখানা থেকে আগত কোনো অদ্ভুত প্রাণী। অন্বয় ক্যামেরাম্যানদের কাছে সোফিয়ার খোঁজ করল। জানা গেল সোফিয়া এখন স্টুডিওতে নেই। সে সকাল দশটায় আসবে। এতোক্ষণ অপেক্ষা করা সম্ভব না। অন্বয় তাই সোফিয়াকে ফোন করল। এদিকে একজন বত্রিশ-পয়ত্রিশ বছর বয়সী মহিলা অরিনের দিকে তখন থেকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। তাই দেখে অস্বস্তিতে অরিনের দম আটকে আসছে। ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হলো সে জীবনেও কালো মানুষ দেখেনি। কি আশ্চর্য! তার এইভাবে তাকিয়ে থাকা অরিনের জন্য হেনস্তা জনক। এটা কি তিনি বুঝতে পারছেন না? সোফিয়াকে মোবাইলেও পাওয়া গেল না। অন্বয় বলল তারা অন্যসময় দেখা করতে আসবে এখন চলে যাওয়াই ভালো। অরিন অন্বয়ের সাথে স্টুডিও থেকে বের হওয়ার সময় সেই সুন্দরী ভদ্রমহিলা যিনি এতোক্ষণ অরিনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন তিনি ডেকে উঠলেন। অরিনকেই ডাকছেন তিনি। অরিন আর অন্বয় একটু থামলো। ভদ্রমহিলা অরিনের কাছে এসে মুখে বিস্তর হাসি ফুটিয়ে ইংরেজিতে বললেন,
” আপনি মি. ইলহান মাহদীর ওয়াইফ না? আমি আপনাকে এংগেজমেন্ট পার্টিতে দেখেছিলাম। হ্যালো, আমি এলেক্স।”
অন্বয় আর অরিন দুজনেই একটু অপ্রস্তুত হলো। এংগেজমেন্ট পার্টি বলতে তিনি কি বুঝাতে চাইছেন? ইলহান আর সোফিয়ার এংগেজমেন্ট পার্টি? যেখানে অরিন মাতাল হয়ে পাগলের মতো হাঙ্গামা করেছিল? অরিনের অস্বস্তির মাত্রা আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল এবার। এলেক্স বললেন,” মিসেস মাহদী, আমি কি আপনার সাথে আলাদা করে একটু কথা বলতে পারি? আপনার কি সময় হবে?”
অরিন স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল,” জ্বী না। আমার সময় নেই।”
এই কথা বলে সে অন্বয়ের হাত ধরে বেরিয়ে এলো স্টুডিও থেকে। অন্বয় বলল,” ভদ্রমহিলা কি বলতে চায় একবার শুনে নিলেই পারতেন।”
অরিন অনীহা প্রকাশ করল,”ওই মহিলার তাকানো আমার পছন্দ হয়নি। তার কথাও আমি শুনতে চাই না।”
অন্বয়ের অস্ট্রেলিয়ায় একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। সেই কাজের জন্য তাদের আরও বেশ কিছু দিন অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে হলো। কিন্তু অরিন থাকলো সম্পূর্ণ গাঁ ঢাকা দিয়ে। ইলহানের দৃষ্টিসীমার বাহিরে। ঘর থেকেও বের হওয়া বন্ধ করে দিল। তাছাড়া অরিন ঠিক করেছিল বাংলাদেশে ফিরেই সে তার মা-বাবাকে সবকিছু জানাবে৷ যেনো ইলহানকে ছেড়ে আসার জন্য তাকে কেউ দোষারোপ করতে না পারে। তারপর আনুষ্ঠানিকভাবে ইলহানের থেকে ডিভোর্স নিবে সে। ইলহান যদি না চায় তাহলে তার মা-বাবা এই ব্যাপারে কিছুই জানবে না। তারা জানবেন অরিনের সিদ্ধান্তে ডিভোর্সটা হয়েছে। কিন্তু অরিনের মা-বাবা আসল সত্যিটাই জানবেন। আর বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে ইলহানের সাথে একদম যোগাযোগ করবে না। কিন্তু কিভাবে যেনো ইলহান অরিনের ঠিকানা পেয়ে গেল। একদিন সন্ধ্যায় সে অরিনের এপার্টমেন্টে এসে বিরাট হাঙ্গামা শুরু করল। অরিনের নাম ধরে চিৎকার শুরু করল। অরিন কঠিন গলায় অন্বয়কে বলল,” ওকে চলে যেতে বলুন অন্বয় সাহেব। আমি ওর চেহারা দেখতে চাই না।”
অন্বয় ইলহানকে কিছু বলতে এলে সে এক ঘুষিতে অন্বয়ের চোয়াল থেতলে দিল। অন্বয় আহত অবস্থায় ঘরে চলে গেল। এদিকে ইলহান গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেই যাচ্ছে।
” কেনো তুমি এমন করছো অরিন? তোমার তো আমার কাছে ফিরে আসার কথা ছিল। তুমি কেনো আসলে না সেদিন? আর আসবেই না যখন আমাকে মিথ্যে আশ্বাস কেনো দিয়েছিলে? মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে পালিয়ে কেনো গেলে? তোমাকে খুঁজে খুঁজে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তুমি কি এখন ওই ব্যারিস্টারকে ভালোবাসো অরিন? তোমরা কি লিভ টুগেদার করছো? ”
এই জঘন্য অপবাদ শুনে অরিন আর চুপ থাকতে পারল না। বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তারপর চিৎকার করে বলল,” আমি যাই করি তাতে তোমার কি? তোমার জীবনে হাজার নারী থাকতে পারলে আমার জীবনে একজন পুরুষ থাকতে পারবে না কেনো?”
ইলহান রাগে ক্রোধে নিজের গাড়ির গ্লাস নিজেই ভেঙে ফেলল। বৃষ্টি হচ্ছিল তখন। চারদিক ধোঁয়াশা, অন্ধকারাচ্ছন্ন। ক্ষীপ্ত আবহাওয়ায় ইলহানের ক্ষীপ্ত মেজাজ অনেকটাই ফিকে মনে হচ্ছিল। অরিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখল ইলহানের ধ্বংসলীলা। একটু পর ভেতরে গিয়ে বারান্দার গ্লাস টেনে দিল। যাওয়ার আগে বলল,” তুমি চলে যাও ইলহান। আমি আর কখনও তোমার কাছে ফিরবো না।”
ইলহান খুব জোরে চিৎকার করল,” আমার অপরাধটা কি অরিন? প্লিজ একবার বের হও। তোমার সাথে আমি কথা বলতে চাই। আগে আমার সব প্রশ্নের জবাব তোমাকে দিতে হবে। এভাবে তুমি আমাকে এড়িয়ে যেতে পারো না। ওই অন্বয় তোমার ব্রেইনওয়াশ করে রেখেছে, তাই না? তুমি তার কথা শুনেই আমার সাথে দেখা করছো না। অরিন তুমি যদি আজকে না আসো আমি সারারাত এখানেই এভাবে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে থাকবো৷ দেখি তুমি কতক্ষণ দরজা বন্ধ করে থাকতে পারো।”
অরিন ইলহানের গর্জনের কোনো তোয়াক্কাই করল না। একটা সময় সে ঘুমিয়ে পড়ল। ভোরে ঘুম ভেঙে দেখল সবকিছু অসম্ভব নিরব। বৃষ্টি থেমে গেছে, থেমে গেছে ইলহানও। অরিন বারান্দায় এসে দেখল ইলহান নেই। তার গাড়িও নেই। এর মানে চলে গেছে সে। ভেতরে ভেতরে হাঁফ ছাড়ল অরিন। বিছানায় এক ধ্যানে অনেকক্ষণ বসে রইল। আজ খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছে সে। দুঃস্বপ্নটার কথা ভাবতে ভাবতে অরিনের চোখ ভিজে এলো৷ এতো বাজে স্বপ্ন সে কেনো দেখলো? নামায পড়ে আল্লাহর কাছে সে প্রার্থনা করল যেনো এই স্বপ্ন কোনোদিন সত্যি না হয়। ঘরে বসে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছে। অরিন চিন্তা করল এখন একটু হাঁটতে বের হবে। কিন্তু মনে আশংকা সৃষ্টি হলো। যদি বের হলেই ইলহানের সাথে দেখা হয়? হলেও কি? সে নিশ্চয়ই অরিনকে তুলে এখানে থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। বরং অরিন মনের তৃপ্তি মিটিয়ে ইলহানকে দু’টো চড় দিতে পারবে গতরাতের সেই অশোভন আচরণের জন্য। অরিন গাঁয়ে শাল জড়িয়ে হাঁটতে বের হলো। অনেকটা দূর যাওয়ার পর সে লক্ষ্য করল ইলহানের গাড়িটিকে। উল্লেখ্য যে, তখনও বাহিরে আলো ফোটেনি। সূর্য্যিমামা অর্ধজাগ্রত। সেই আধো আলোয় অরিন গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ভেতরে ইলহান শায়িত। তাকে দেখে অরিন শরীরের সমস্ত কোষ নিয়ে আঁতকে উঠলো। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো বিকট চিৎকার। ইলহানের মাথা থেকে পা পর্যন্ত রক্তে রাঙা। সে জীবিত নাকি মৃত বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো হিংস্র পশু তার সমস্ত শরীর কামড়ে খেয়েছে। অরিন চিৎকার করতে করতে এপার্টমেন্টে ফিরে এলো। উন্মাদের মতো অন্বয়ের রুমের দরজায় করাঘাত করতে লাগল। এমনভাবে সে অন্বয়কে ডাকছে যেনো মনে হচ্ছে তার গাঁ থেকে কেউ চামড়া টেনে ছিলে ফেলছে। আর সে আর্তনাদ করছে। অন্বয় জেগেই ছিল। হতচকিতভাবে দরজা খুলল। অরিন কাঁপতে কাঁপতে বলল,
” অন্বয় সাহেব, অন্বয় সাহেব..”
আর কিছু বলার আগেই তার কণ্ঠ থেমে এলো। অন্বয় দুইহাতে অরিনের দুই বাহু জাপটে ধরে বলল,” কি হয়েছে মিসেস অরিন? বলুন আমাকে।”
অরিন থেমে থেমে বলল,” ইলহানকে কারা যেন মেরে আহত অবস্থায় তারই গাড়িতে ঢুকিয়ে রেখেছে। তার সারা শরীরে রক্ত। বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে বোঝা যাচ্ছে না। আপনি কিছু করুন অন্বয় সাহেব।”
অরিন কথা বলতে বলতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মেঝেতে। দুই হাত মুখে ঠেকিয়ে কাঁদতেই লাগল৷ অন্বয়ের কপালে ভাজ সৃষ্টি হলো। অরিনের কথা শুনে সে রীতিমতো শুকিয়ে গেছে। ড্রাইভার বাবাকে তো নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল গাড়িটাকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখতে৷ যেনো কাকপক্ষীও টের না পায়। তাহলে অরিন সেই গাড়ির হদিশ পেল কি করে? হ্যাঁ অন্বয়ই ইলহানকে আহত করেছে। এতোদিনের সব অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছে সে। কিন্তু অরিনের কাছে ধরা পড়তে হবে একথাও সে ভাবেনি। অন্বয়ের বুকে ধ্বক ধ্বক আওয়াজ হচ্ছে। অরিন কি কিছু বুঝে ফেলবে? অন্বয় খুব কষ্টে মুখ খুলল,
” চলুন তো, দেখে আসি কি হয়েছে।”
চলবে