রংধনুর_রঙ_কালো,২৫,২৬

রংধনুর_রঙ_কালো,২৫,২৬
Sidratul Muntaz
২৫

অরিন হেলতে-দুলতে ইলহানের কাছে এসে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাকে ঘুম থেকে তুললো। সবগুলো চিঠি ইলহানের বিছানায় ছড়িয়ে দিল। মদের বোতল থেকে মদ মুখে নিল তারপর ইলহানের কানের ভেতর গাড়গিল শুরু করলো। ইলহান দুই সেকেন্ডের মধ্যে ধড়মড় করে জেগে উঠলো। তার হাতের কনিষ্ঠ আঙুল সয়ংক্রিয়ভাবে কানের কোটরে ঢুকে গেল। জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে সে কান থেকে তরল বের করতে উদ্যত হলো। অরিন কি পাগলামি শুরু করেছে এইসব? মাঝরাতে মেয়েটার কি হলো? তার হাতে মদের বোতল কি করে আসলো? ইশশ, বারান্দা থেকে এনেছে নিশ্চয়ই! নেশা হয়ে গেছে নাকি? অরিন সোজামতো দাঁড়াতেও পারছে না। লতানো ডালের মতো একবার এদিক ঝুঁকে পড়ছে তো আবার অন্যদিক। ইলহান হাত ধরে টেনে অরিনকে বিছানায় বসিয়ে স্থির করলো। মদের বোতল ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে নিতে বললো,” মাঝরাতে এইসব কি করছো? ড্রিংক হাতে নিয়েছো কেনো? পাশের রুমে মা-বাবা আছে। তারা জেনে ফেললে কি হবে?”
অরিন নেশাজড়িত অবস্থায় ডানে ঘাড় কাত করে এক আঙুল ইলহানের গালের উপর রেখে টেনে টেনে বললো,” কি আর হবে? যা হওয়ার তাই হবে! আমাকে বাসা থেকে বের করে দিবে! আমি চলে যাবো যেখানে খুশি! মাতাল বউ তো কেউ পছন্দ করে না তাই না?”
অরিনকে বাচ্চাদের মতো সুরে সুরে কথা বলতে শুনে ইলহান ঢোক গিললো। থমকানো কণ্ঠে বললো,
” আজ থেকে আমার মাতাল বউইই সবচেয়ে বেশি পছন্দ। ”
অরিন ভ্রু কুচকালো। রেগে জিজ্ঞেস করলো,” এই, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?”
” খুব ভালোবাসি।”
মুগ্ধ কণ্ঠে বললো ইলহান। অরিন ইলহানের কলার ধরে কাছে টেনে বললো,
” ভালোবাসলে কষ্ট দিলে কেনো?”
ইলহান আহত হলো। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিচু কণ্ঠে বললো,” জানি না।”
অরিন ধাক্কা মেরে ইলহানকে সরিয়ে বললো,” প্রতারক তুমি।”
” এটা জানি।”
” আমি তোমাকে ঘৃণা করি।”
” আমি বিশ্বাস করি না।”
অরিন নিচের দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগলো। ইলহান বিছানা থেকে নেমে ফ্লোরে একদম অরিনের বরাবর বসলো। তার পা দু’টো কোলে নিয়ে উরু চেপে ধরে বললো,” তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার অধিকারটুকুও হয়তো আমার এখন আর নেই। সব হারিয়ে ফেলেছি আমি। তাই ক্ষমা আর চাইবো না। কিন্তু অন্তত আমার জীবন থেকে তুমি চলে যেও না অরিন। যেখানেই থাকো, যেভাবেই থাকো, অন্তত আমার কাছাকাছি থেকো প্লিজ! তুমি একেবারে ছেঁড়ে গেলে আমি মরে যাবো। আমার জীবন থেমে যাবে। তারপর ঝড় এসে সবকিছু বিলীন করে দিবে। হয়তো আমি তিলে তিলে নিঃশেষ হবো। নয়তো এক নিমেষেই! স্ত্রী হিসেবে তোমাকে সারাজীবন পাওয়ার স্বপ্নটা আমার আর পূরণ হবে না। সেই স্বপ্ন দেখার সুযোগটাও আমি হারিয়েছি। অন্তত..”
অরিন ইলহানের ঠোঁটে আঙুল ঠেকালো। ইলহানের কণ্ঠ আটকে গেল। অরিন মুখ দিয়ে শব্দ করলো,
” শশশ!”
তারপর আঙুল ইলহানের ঠোঁট থেকে সরিয়ে নিজের ঠোঁটে রাখলো। আবারও শব্দ করলো,
” শশশ!”
এরপর এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। অরিনের ভাব-ভঙ্গি এখন পুরো আট- দশ বছরের ছোট বাচ্চাদের মতো মনে হচ্ছে। ইলহানের হৃদযন্ত্রের আর্তনাদ এতে আরও হু হু করে বাড়ছে। চারদিকে এখন শুধু হাহাকার! এক নিষ্পাপের প্রাণ বাঁচাতে আরেকটি নিষ্পাপকে ইলহান গলা টিপে হত্যা করছে না তো? অরিন কখনও ইলহান-সোফিয়ার অবৈধ সন্তানকে মেনে নিয়ে ইলহানের সাথে সংসার করবে না। তাই অরিনকে পেতে হলে ইলহানকে তার অনাগত সন্তানের কথা ভুলতে হবে। কিন্তু তা অসম্ভব! ওই বাচ্চাটির কান্নার বিষাক্ত প্রতিফলন ইলহানের হৃদয়ে ধাক্কা দেয়। বিবেকবোধ জেগে উঠে। আবেগ তাড়িত হয়। বাবা হিসেবে সে পারবে না সন্তান ত্যাগ করতে। পারবে না নিজের মতো আরেকটি অস্তিত্বহীন শিশুর বিভীষিকাময় জীবন নিশ্চিত করতে। কিন্তু প্রেমিক হিসেবে? সে কি পারবে তার প্রেয়সীর হাত ছাঁড়তে?ইলহান এতো মহান প্রেমিক নয় যে প্রেয়সীর সুখের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিবে। সে হলো প্রতারক প্রেমিক। ছদ্মবেশী, স্বার্থপর। স্বার্থের খেলা খেলতে খেলতে আজ এমন এক জায়গায় এসে স্বার্থগুলো আটকে গেছে, যেখানে আক্ষেপ ছাড়া অন্যকিছুই অবশিষ্ট নেই। মানুষ অন্যায় করে, পাপে বুদ হয়। তখন একটাবারও চিন্তা করে না পরিণামের কথা। প্রকৃতি তার আপন নিয়মে সবকিছু ফিরিয়ে দিতে জানে। যদি কোনোভাবে কেউ পাপ করার আগে পরিণতির ভয়াবহতা বুঝতো তাহলে সেই পাপ থেকে নিজেকে যে ভাবেই হোক বাঁচিয়ে রাখতো। দিনশেষে আফসোস এইজন্য যে, পাপ করার আগে কেউ পরিণতির কথা চিন্তাই করে না। পাপের সাগরে ডুবে থাকা অবস্থায় পরিণতিটা তাদের কাছে অবাস্তব মনে হয়। ইলহানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। কোনো একদিন যে সে অরিনের কাছে ধরা পড়বে, অরিন তাকে ছেঁড়ে যাবে তারপর তাকে অর্ধমৃতের ন্যায় ধুঁকে ধুঁকে বাঁচতে হবে। এই সত্যিটা ইলহান ভালো করেই জানতো। কিন্তু তার অবচেতন মন এই চরম সত্যিটাকেই উপেক্ষা করেছিল। তখন তার হৃদয় ছিল পাপের শক্ত বেষ্টনী দ্বারা আবৃত। এখন মনে হয় সেই বেষ্টনী উন্মুক্ত হয়েছে। অরিনকে হারানোর পর সে উপলব্ধি করেছে একটা পাপের জন্য তার জীবনে কতবড় ক্ষতি হয়ে গেল! কিন্তু এই উপলব্ধি এখন এসে লাভ কি? পাপমোচনের সময়টাও যে ফুরিয়ে গেছে! বুকভরা আক্ষেপ নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু কত সহজ! কিন্তু মরতেও তার মানা। ইলহানের হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছে হয় চিৎকার করে কাঁদতে, সবকিছু ভাঙতে। অতীতে ফিরে গিয়ে জীবনের নষ্ট সময়গুলো মুছে দিতে। অরিনকে নিয়ে নতুনভাবে বাঁচতে৷ তাদের সুখের সংসারে স্বর্গ নামিয়ে আনতে। কিন্তু স্বর্গে থাকার মতো ভালো কাজ তো সে করেনি৷ তার জন্য নরকই শ্রেয়। যেমন এখন সে পুড়ছে নারকীয় দহনে!
ইলহান দুই হাতে অশ্রু মুছে সামনে তাকিয়েই দেখলো অরিন নেই। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার কাছে দাঁড়িয়ে চূড়ান্ত প্রমত্ততা শুরু করেছে। ইলহান একটানে বিছানার চাদর উঠিয়ে অরিনের গাঁয়ে জড়িয়ে দিল। অরিন বললো,”তুমি বিশ্বাস ভেঙেছো, তুমি মিথ্যে বলেছো, তুমি পরনারীর নেশায় নিজেকে ডুবিয়েছো। কলুষিত করেছো তোমার দেহ, মন। খুন করেছো আমার ভালোবাসা। তুমি খুনী, তুমি অপরাধী, তুমি নিকৃষ্ট, তুমি পাপী! তবুও তোমার জন্য কান্না পায় আমার! তোমার চিঠিগুলো পড়তে পড়তে আমি হাপুস করে কেঁদে ফেলি! তোমার তীব্র আর্তনাদ আমার হৃদয় নাড়িয়ে দেয় এখনও! বড্ড বোকা আমি। তোমাকে অন্ধের মতো ভালোবেসে বড় ভুল করেছি। এই ভুলের মাসুল কিভাবে দিবো আমি? বলো না কিভাবে দিবো?”
ইলহান অরিনের মুখ চেপে ধরে ব্যথাতুর কণ্ঠে বলতে গেল” চুপ করো অরিন। প্লিজ চুপ করো!একদম চুপ।”

শায়িখ-নুসাইবা যেদিন অস্ট্রেলিয়া এসেছিলেন সেদিন রাতেই অরিন-ইলহানের বিয়ের প্রথম এনিভার্সেরি ছিল। অভিশপ্ত বিবাহিত জীবনের পূর্ণ একবছর! এখন তো ডিভোর্স নিতে কোনো বাঁধা নেই। ইলহানও নতুন সংসার শুরু করতে যাচ্ছে। অরিনও হাঁপিয়ে উঠেছে। বিষাক্ত এই সম্পর্কের যন্ত্রণা বহন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ইলহানকে সরাসরিই ডিভোর্সের কথা জানিয়ে দিল অরিন। তারা এই মুহুর্তে বারান্দায় পাশাপাশি চেয়ার পেতে বসে আছে। এখন সন্ধ্যা। পুরো রুম জুড়ে আলোকসজ্জা ও ফুলসজ্জা। নির্দিষ্ট সময়ে ম্যারেজ ডে পালন করা যায়নি তাই আজ পালিত হচ্ছে। সব ব্যবস্থা করেছেন শায়িখ- নুসাইবা। সকাল থেকে রান্না-বান্না নুসাইবা নিজের হাতে করেছেন। বাড়ি ডেকোরেশনের জন্য মানুষ আনা হয়েছিল। তারা অরিন-ইলহানের রুম সুন্দর করে সাজিয়েছে। শ্যানিন মাঝে মাঝে ভিডিওকলে আয়োজন ব্যবস্থার তদারকি করেছে। অরিন তার বাবা-মায়ের সাথে ভিডিওকলে অনেকক্ষণ কথা বলেছে। সবাই কত সুখী। সবার মনেই শান্তি। যত অশান্তি শুধু অরিনের। ইলহানও যে খুব ভালো আছে তা নয়। আগামীকাল শায়িখ-নুসাইবা বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছেন। তখন অরিনও আর এই বাড়িতে থাকবে না। চলে যাবে তার নিজ ঠিকানায়। তারপর যথাসময়ে পরিবারকে তারা ডিভোর্সের কথা জানাবে। ইলহানের সোফিয়াকে বিয়ে করতেও আর কোনো বাঁধা থাকবে না। কিন্তু ইলহান তো এটা চায়নি৷ সে চেয়েছিল তার বিয়েতে বাঁধা আসুক। হয় বিয়ে ভেঙে যাক নয় সে মরে যাক! যে জীবনে অরিন নেই সে জীবন অর্থহীন। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই অতি সত্যি কথাটি ইলহান বুঝতে পেরেছে অরিনকে হারানোর পর। আচ্ছা, সব প্রিয় জিনিস কি এভাবেই হারিয়ে গিয়ে নিজের গুরুত্ব বুঝিয়ে দেয়? অরিন সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে নির্বিকার গলায় বললো,
” আমাদের ডিভোর্স কবে হচ্ছে?”
ইলহান ঢোক গিললো। ইদানীং কথা বলতে গেলে খুব বেগ পেতে হয় তার। কারণ বেশিরভাগ সময় তার গলা ভেঙে আসে। ইলহান ভ্রু কুচকে বললো,” এতো জলদি ডিভোর্স কেনো?”
অরিন উত্তপ্ততর কণ্ঠে শব্দ করলো,” কারণ তোমার বউ হিসেবে থাকাকে আমি ইনসিকিউরড মনে করছি।”
” এখানে ইনসিকিউরিটির কি হলো?”
” গতরাতে এতো ভয়ানক অন্যায় করেও তুমি জিজ্ঞেস করছো ইন্সিকিউরিটির কি হলো?”
” ভয়ানক অন্যায় আমি করিনি। ভয়ানক কাজ তুমি করেছো। ইন্সিকিউরড তো আমার ফিল করা উচিৎ। কবে আবার তুমি নেশার ঘোরে.. ”
ইলহানের কথা শেষ হওয়ার আগেই অরিন খেঁকিয়ে উঠলো,
” আমি না হয় নেশাগ্রস্ত ছিলাম। তাই বলে তুমি সুযোগ লুফে নিবে ?”
” তো কি করবো? মানুষ তো আমি। ফেরেশতা তো আর না।”
অরিন আচমকা চড় বসিয়ে দিল ইলহানের গালে। ইলহান গালে হাত রেখে অরিনের দিকে তাকালো। হৃষ্টচিত্তে বললো,” গতরাতে এইটাই সবচেয়ে বেশি মিস করেছিলাম। অরিন তুমি কি জানো, তোমার চুমু আর চড় দুটো আমার কাছে সেইম। তোমার অনুপস্থিতিতে আমি দুটোই খুব মিস করি!”
অরিন আক্রোশ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বেহায়াপনার একটা সীমা থাকা দরকার। এর কোনো সীমাও নেই। রাগে অরিনের চোখে পানি চলে আসলো৷ তার ছোট্ট শরীর কাঁপছে। বারান্দার কার্নিশের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ইলহানকে তুলে এই জায়গা থেকে ফেলে দেওয়া যায় না? কিন্তু সেটা তো অসম্ভব। সে কি এই পিঁপড়ার মতো শরীর নিয়ে দৈত্যটাকে তুলতে পারবে? বরং দৈত্যটা চাইলেই পারবে তার পিঁপড়ার মতো শরীরটা তুলে এইখান থেকে ফেলে দিতে। এই ভেবে রাগ আরও বেড়ে গেল অরিনের। রাগে কান্না পাচ্ছে। দেয়ালে মাথা ঠুঁকে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। ইলহান গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মাত্র একরাতের ভুল নিয়ে অরিনের এতো আফসোস কেন? এই রাতের কথা তো অরিনের কিছু মনেও থাকবে না। কিন্তু ইলহানের মনে থাকবে। সারাজীবন মনে থাকবে। বরং এই একটি রাতের চমৎকার স্মৃতি, মিষ্টি অনুভূতিগুলোই হবে তার বেঁচে থাকার মাধ্যম। ইলহান শীতল গলায় বললো,” অরিন, ডিভোর্সটা না করলে হয় না?”
অরিন ঘুরে তাকালো। খুব আক্রমণাত্মক হয়ে বললো,” না। হয় না! এতোকিছুর পরেও আমি তোমার সাথে থাকবো এটা তুমি কি করে ভাবলে?”
” আমার সাথে থাকতে হবে না। তুমি আলাদাই থেকো। শুধু মনে একটা সান্ত্বনা থাকবে যে আলাদা থাকলেও আমাদের বিচ্ছেদ হয়নি।”
” বিচ্ছেদ আমাদের হতেই হবে। এটা ফাইনাল। তুমি আমাকে ডিভোর্স না দিলে আমি ফ্যামিলিতে সব জানাতে বাধ্য থাকবো।”
” এর মধ্যে ফ্যামিলিকে কেনো টানছো? ওদের অন্তত শান্তিতে থাকতে দাও। আমাদের মতো তাদেরকেও কেনো কষ্ট পেতে হবে?”
” আমিও চাই সবাই শান্তিতে থাকুক। কিন্তু তুমি আমাকে ডিভোর্স না দিলে আমি সেটা আর চাইবো না।”
ইলহান চেয়ার ছেড়ে উঠে অরিনের সামনে এসে দাঁড়ালো। আলতো করে ওর চেহারা ছুঁয়ে দিতে চাইলো। অরিন সাথে সাথে ওকে থামিয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে বললো,” খবরদার!”
ইলহান হাত নামিয়ে নিল। একরাশ হতাশা নিয়ে ভেঙে আসা কণ্ঠে জানতে চাইল,” ডিভোর্সের পরেও কি যোগাযোগ থাকবে আমাদের?”
” কেনো থাকবে? কিসের জন্য থাকবে? ”
ইলহান নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আকুতি নিয়ে বললো,
” এমনি। যোগাযোগ রেখো!”
” যোগাযোগ ছিন্ন করার জন্যই তো ডিভোর্স নিচ্ছি। তাহলে আবার যোগাযোগ কেনো রাখবো?”
” মানবতার জন্য! ”
ইলহানের গলায় কম্পন। অরিন স্তব্ধ হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর খুব জোরে হাসতে শুরু করলো।
” মানবতা! ওরে আল্লাহ!”

চলবে

– Sidratul Muntaz

#রংধনুর_রঙ_কালো
২৬.

বাহিরে শীতল বাতাস। শীতকাল আসতে বেশি দেরি নেই। তবে মেলবোর্নের আবহাওয়ায় এখন বৃষ্টির প্রভাব বেশি। অরিন বারান্দার কোণ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিক এখন শব্দশূন্য। ইলহান ঘুমিয়ে পড়েছে বহুক্ষণ আগে। অরিন আজকে বারান্দাতেই শুয়েছে। তার ঘুম আসছে না। আগামীকাল একটা নতুন দিন শুরু হবে। বাবা-মা বাংলাদেশে ফিরে যাবেন। অরিনও এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আর কোনোদিন আসা হবে না। ইলহান সোফিয়াকে বিয়ে করে নিবে। এর আগে ইলহানের সাথে তার ডিভোর্সটাও হয়ে যাবে। তারপর অরিন কোথায় যাবে? কি করবে? অন্বয়ের সাথে বাংলাদেশে ফিরে যাবে? মা-বাবা, ভাইয়া সবাই যখন জানবে অরিন ডিভোর্স নিয়েছে তখন তাদের রিয়েকশন কেমন হবে? কষ্ট পাবে? আচ্ছা সবাই কি ডিভোর্সের জন্য অরিনকেই অপরাধী মনে করবে? অপরাধটা কি শুধুই অরিনের? সে অবহেলিত জীবন নিয়ে বাঁচতে চায়নি। এটা তো কোনো অপরাধ নয়।এইযে সে এতোবার করে ডিভোর্সের কথা ইলহানকে বলেছে। কই, ইলহান তো একবারও বললো না,” চলো না অরিন, ডিভোর্সের চিন্তা আমরা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলি। আমাদের সম্পর্কটা তো শুধু কাগজে- কলমে সীমাবদ্ধ না। আমাদের তো চিরবন্ধনের সম্পর্ক, হৃদয়ের সম্পর্ক, আত্মিক সম্পর্ক! শুধু কাগজে একটা সাইন করেই কি তুমি নিজের হৃদয় থেকে আমার অস্তিত্ব মুছে ফেলতে পারবে? বললেই হলো? সবকিছু চুলোয় যাক, সমুদ্রে ভেসে যাক, শুধু আমরা আবার এক হয়ে যাই। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। তোমার বিশ্বাস ভেঙেছি, বার-বার মিথ্যে বলেছি, তোমাকে ঠকিয়েছি, কিন্তু এইবার তো বুঝতে পেরেছি! এখন শুধু ভালোবাসবো। আর কখনও ঠকাবো না। যদি ঠকাই, তাহলে তুমি নিজহাতে আমার শিরচ্ছেদ করবে৷ আমি কিচ্ছু বলবো না। আমাকে ক্ষমা করো অরিন। এ পৃথিবীতে অনেক নারী সংস্পর্শে গিয়েছি আমি। কিন্তু বিশ্বাস করো, তারা কেউই আমার শরীর ছাড়া অন্যকিছু ছুঁতে পারেনি। শুধু তুমি পেরেছো। আমার মনের মালিকানা দখল করে নিয়েছো। আমি শুধুই তোমাকে ভালোবেসেছি। সারাজীবন তাই বাসবো।”
অরিনের দুইচোখের কোণায় অশ্রুপাত ধেয়ে চললো। সে মুখে হাত দিয়ে নিঃশব্দে অনেকক্ষণ কাঁদলো। ইলহান তাকে এসব কিছুই বলেনি। এমনকি তার কাছে শেষবারের মতো ক্ষমাও চায়নি৷ নিজের ভুলের জন্য একবারও সরাসরি অনুতপ্ততা প্রকাশ করেনি। সোফিয়াকে বিয়ে করার ইচ্ছা ইলহানের ষোলআনা। হোক বাচ্চার জন্য, কিন্তু বিয়ে তো সে অন্য নারীকেই করতে যাচ্ছে। এমন দিন কোনো মেয়ের জীবনে না আসুক। জীবিত অবস্থায় নিজের স্বামীর অন্য নারীর সাথে বিয়ের দৃশ্য দেখার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। অরিনকে যেই যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে সেই যন্ত্রণা এ পৃথিবীতে যেনো আর কেউ না পায়।অরিন খোলা আকাশের দিকে দৃষ্টি মেললো। সকাল কখন আসবে? কিংবা আদৌ আসবে কি? এই ঘোর অন্ধকারের রাত ছাঁপিয়ে তার জীবন নতুন ভোর দেখবে কি? কালো রঙধনুর রঙের মেলা আবার রঙিন হয়ে ধরা দিবে কি?

এয়ারপোর্টে শায়িখ-নুসাইবাকে সিঅফ করতে অরিন-ইলহান একসাথেই এসেছে। একসাথে হয়তো এটাই তাদের শেষযাত্রা। অরিন এয়ারপোর্ট থেকে আর বাসায় যাবে না। সরাসরি চলে যাবে তার ভাড়াকৃত হোটেলে। এরপর ডিভোর্সের ঝামেলা মিটে গেলে সে বাংলাদেশে ফিরে যাবে। এই অভিশপ্ত দেশের মাটিতে আর কোনোদিন পা রাখবে না। কোনোদিন না! নুসাইবা অরিনের গালে হাত রেখে স্নেহভরা কণ্ঠে উপদেশ দিলেন,
” ভালো থাকিস মা। নিজের যত্ন নিবি। আর একদম ওই বাঁদরকে লাই দিবি না। ছেলেটা এইখানে এসে অনেক বিগড়ে গেছে। ওকে টাইট দিয়ে রাখবি। কোনো ঝামেলা করলেই আমার কাছে বিচার দিবি। নো কম্প্রোমাইজ। ”
অরিন সামান্য হাসলো। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। জীবনের সেরা কম্প্রোমাইজটা তো সে করেই ফেলেছে। একটু পরেই একটা খুব বিরক্তিকর কান্ড ঘটলো। ইলহানের মা-বাবা চলে যাচ্ছেন শুনে সোফিয়াও এয়ারপোর্টে এসে হাজির। তারপর সবার সামনে পা ধরে টানাটানি শুরু করলো। শায়িখ সাহেবের পা ধরে সে ছাড়তেই চাইছে না। শায়িখ সাহেব যথেষ্ট বিব্রত হলেন।
” আরে, এই মেয়ে। তোমার কি হয়েছে? পাঁয়ে ধরে রেখেছো কেনো?”
সোফিয়া অশ্রুসজল চোখে বললো,” আপনারা চলে যাচ্ছেন আন্টি-আঙ্কেল? আমার খুবই খারাপ লাগছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে৷ তাই ছুটে এসেছি আপনাদের দোয়া নিতে। আপনারা না থাকলেও আপনাদের দোয়া আমার সাথে থাকবে। অন্তত এই ভেবে আমি একটু খুশি হতে পারবো। আমাকে দোয়া করে দিন আঙ্কেল। অনেক দোয়া করে দিন।”
নুসাইবা এতোবেশি বিরক্ত হলেন যে সেই জায়গা থেকে তৎক্ষণাৎ সরে গেলেন। অরিনকেও ইশারায় ডাকলেন তাঁর সঙ্গে যাওয়ার জন্য। অরিন তার শ্বাশুড়িমায়ের সাথে গেল। নুসাইবা চেয়ারে বসে অরিনকে বললেন,” ঢং দেখেছো মেয়েটার? শোনো অরিন, এই মেয়েকে কিন্তু তুমি ইলহানের সাথে একটুও মিশতে দিবে না। এই মেয়ে চূড়ান্ত বিপজ্জনক। এইসব বিষয়ে তুমি অনেক বোকা। আমি খেয়াল করেছি। এই মেয়েটা প্রথমদিন থেকেই আমাকে আর তোমার বাবাকে পটানোর চেষ্টা করছে। ইলহানের সাথেও কেমন রসিয়ে রসিয়ে কথা বলে। গাঁয়ের উপর ঢলে পড়ে। ছি, ছি! এই অরিন, তুমি নিজের স্বামীকে হাতে রাখতে পারো না? এই ধরণের মেয়ের সাথে মিশতে দাও কেনো? আজকে বাসায় গিয়ে ইলহানের সাথে এ বিষয়ে অবশ্যই ঝগড়া করবে। ভালো করে ইলহানকে বুঝিয়ে দিবে ও যদি এই মেয়ের সাথে মিশে তাহলে তুমি আর ওর সাথে থাকবে না। এরকম ঝগড়া মাঝে মাঝে একটু করতে হয় বুঝেছো? এই ধরণের মেয়েরা হচ্ছে কালসাপ। মানুষের সংসার ভাঙার জন্য ফণা তুলে বসে থাকে। তাই সাবধান করে দিলাম তোমাকে। খবরদার! এই মেয়েকে কখনও বাসায় ঢুকিতে দিও না কিন্তু।”
অরিন নুসাইবার কথার কোনো সরাসরি জবাব দিল না। নিজের মনেই বলে গেল,” সংসার ভাঙতে আর কিছু বাকি নেই মা। আপনার ধারণা একদম সঠিক হয়েছে। সোফিয়ার জন্যই আমাদের সংসার ভেঙে গেছে। কিন্তু একহাতে কি তালি বাজে মা? সোফিয়ার তো একার কোনো দোষ নেই। আপনার ছেলেও যে সমানভাবে দোষী! আর তাকে শাসনে রাখার কথা বলছেন? সেই অধিকারটুকুও তো সে আমাকে কোনোদিন দেয়নি।”
সোফিয়ার সাথে তার পারসোনাল এসিসট্যান্ট টুয়ার্ড এসেছিল। অরিনের চিনতে অসুবিধা হয়নি। এটাই সেই ছেলে যাকে সোফিয়া বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল অরিনকে হত্যা করার জন্য। এই কথা যদি এখন ইলহানকে অরিন জানিয়ে দেয় তাহলে কি হবে সোফিয়ার? আসলে কিছুই হবে না। ইলহান তার বাচ্চার মাকে কখনও কিছু বলবে না!
সোফিয়া পেন্সিল হিল পড়ে এয়ারপোর্টে এসেছে। নিজের ইচ্ছামতো লাফ-ঝাপ করছে৷ কারণ শায়িখ সাহেব বাংলাদেশী পাঁচশো টাকার নোট সোফিয়ার হাতে তুলে দিয়েছেন। এইটা হলো দশমিনিট পাঁয়ে ধরে বসে থাকার পারিশ্রমিক। সোফিয়া জানে না এই নোটে কয় ডলার আছে। কিন্তু সে এমন ভাব করছে যেনো কোটি কোটি ডলারের নোট হাতে পেয়েছে। হয়তো অরিনকে জ্বালানোর জন্যই সে বার-বার টাকার নোটটা নিয়ে আশেপাশে ঘুরছে। কি অদ্ভুত মেয়ে! সে কি ভাবছে অরিন এই পাঁচশো টাকার জন্য সোফিয়াকে হিংসা করবে? যেখানে তার স্বামী সংসার সবকিছুই সে সোফিয়াকে দান করে দিয়েছে সেখানে একটা পাঁচশোটাকার নোট দেখিয়ে সোফিয়া তাকে লোভ লাগানোর চেষ্টা করছে? খুবই হাস্যকর ব্যাপার! সোফিয়া টুয়ার্ডকে নিয়ে এসেছিল শায়িখ-নুসাইবার সাথে এয়ারপোর্টে ফটোশ্যুট করার জন্য। এই ছবি তার ম্যাগাজিনে বের হবে। নুসাইবা ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতেই চাচ্ছেন না। সোফিয়া অনেক তোষামোদ করে রাজি করিয়েছে। টুয়ার্ড ছবি তোলার সময় ইলহান ফিসফিস করে বললো,” তোমার ম্যাডামের সমস্যা কি? সে কেনো লাফালাফি করতে এয়ারপোর্টে এসেছে? এই অবস্থায় ওর এতো হুড়োহুড়ি করা কি ঠিক হচ্ছে? মা-বাবা ফ্লাইটে উঠে গেলেই ওকে বাসায় নিয়ে যাবে।একদম বাসা থেকে বের হতে দিবে না। কোনো কেয়ার নেই মেয়েটার। শুধু দৌড়াদৌড়ি,লাফালাফি! আবার পড়েছে পেন্সিল হিল। হঠাৎ ঠাস করে পড়লেই তো সর্বনাশ!”
” আপনি এসব কি বলছেন স্যার? ম্যাম তো আজ সকালেই নয়শোবার স্কিপিং করেছেন। তখন কোনো সমস্যা হয়নি। এইটুকু লাফালাফিতে আর ম্যামের কি হবে?”
ইলহানের চক্ষু চড়কগাছ। ক্ষীপ্ত হয়ে বললো,” কি? প্রেগন্যান্ট অবস্থায় স্কিপিং? তাও নয়শোবার? আমি বুঝতে পারছি না তুমি পাগল নাকি তোমার ম্যাম পাগল?”
টুয়ার্ড ভ্রু কুচকে বললো,” স্যরি স্যার? কে প্রেগন্যান্ট? ম্যাম? স্যার আপনি কি জোক করছেন? ম্যাম কেনো প্রেগন্যান্ট হবেন? তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বাভাবিক!”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here