রংধনুর_রঙ_কালো,২৪

রংধনুর_রঙ_কালো,২৪

দরজা লাগানোর অদ্ভুদ শব্দে অরিন কেঁপে উঠলো। তার আত্মা ভেতর থেকে শুকিয়ে এলো। সে ক্রমাগত পিছিয়ে যেতে যেতে বিছানার কাছে গিয়ে ঠেকলো। তারপর বিছানা থেকেই বালিশ নিয়ে ইলহানের ওপর ছুঁড়ে মারল। ইলহান বালিশটা দক্ষভাবে ক্যাচ করলো। বালিশ হাতে নিয়েই অনুরোধের মতো বলল,’ অরিন, আমি শুধু একটু কথা বলবো। এমন করো না। আমার কথা শোনো। ‘
অরিন দ্রুত বেগে ডানে-বামে মাথা নেড়ে আবার একটা বালিশ ছুঁড়ে মারার জন্য উদ্যত হলো। ইলহান তখন বাধ্য হয়েই ধমক দিল।
‘ অরিন প্লিজ! আমার কথা শোনো!’ অরিন রুষ্ট কন্ঠে বলল,’ আমি তোমার কথা শুনতে চাই না। কোনো রুচি নেই তোমার সাথে কথা বলার। প্লিজ আমাকে যেতে দাও। বাবা মায়ের সামনে যা ইচ্ছা তাই করবে এমন যদি ভেবে থাকো তাহলে ভুল ভাবছো তুমি। বাড়াবাড়ি করলেই কিন্তু আমি বাসা থেকে বের হয়ে যাবো। তারপর তুমি মা-বাবাকে কিভাবে সামলাবে সেটা তোমার ব্যাপার। খবরদার ভুলেও আমার ওপর কোনো রকম জোর খাটানোর চেষ্টা করবে না। পরিণাম খুব খারাপ হবে।”
ইলহান হতাশার নিঃশ্বাস ছেঁড়ে বললো,’ আমি তোমার উপর জোর খাটাতে আসিনি অরিন। শুধু তোমার সাথে একটু কথা বলতে এসেছি। তুমি কি মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনবে প্লিজ?”
অরিন জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠা দৃষ্টিতে বললো,” না। তোমার কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। তুমি মিথ্যেবাদী, তুমি প্রতারক, তোমার সবকিছু ছলনাময়, ধোঁকাবাজ তুমি।”
ইলহান আহত আর্তনাদ নিয়ে বললো,” প্লিজ অরিন!”
অরিন হাত-পা ছুঁড়ে বললো,” আরেকটা কথা বললেও আমি সবকিছু ভেঙে ফেলবো।”
ইলহান কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আর্দ্র দৃষ্টিতে। তারপর বালিশটা বিছানায় ছুঁড়ে কণ্ঠে রাগ মিশিয়ে বলল,’ যা ইচ্ছা করো। আমার কাউকে কিছু বলার নেই। কাউকে কিছু বুঝানোর দরকারও নেই।’
ইলহান তীব্রবেগে হেঁটে বারান্দায় চলে গেল। আগের মতোই উচ্চ শব্দ করে বারান্দার দরজা আটকালো। অরিনের কলিজা নামক বস্তু ছ্যাঁত করে উঠলো। কাঁচের গ্লাসের দরজা ফেটে গেল নাকি? অরিন দরজা খুলে রুম থেকে বের হওয়ার সাহস পেল না। এই ঘটনার পর মা-বাবার মুখোমুখি হলেও লজ্জায় মাথা নুইঁয়ে রাখতে হবে। তার চেয়ে ঘরে মাথা নিচু করে বসে থাকাও ভালো। অরিন বিছানায় শান্ত হয়ে বসলো। মাথা ঠান্ডা করার জন্য চুল আঙুল দিয়ে কয়েকবার আঁচড়ে নিল। ইলহান একটু পরই বারান্দা থেকে বেরিয়ে এলো। অরিনের পাশে বসলো। অরিন ইলহানকে দেখে সোজা হয়ে আগের মতোই শক্তভাবে বসলো। ভাবটা এমন যেনো ইলহান তাকে কিছু করতে এলেই সে সব ধ্বংস করে দিবে। তাই প্রস্তুতি নিয়েই এভাবে বসেছে। ইলহান কথা বলার জন্য মুখ খুলতেই অরিন জোর করে দুইহাত দিয়ে কান চেপে ধরলো। ইলহান আর বললো না। বিরক্ত চোখে কতক্ষণ ফ্লোরে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে উঠে চলে গেল। দরজা খুলে একদম রুম থেকে বেরিয়েই গেল। অরিনের চোখ থেকে অশ্রু ঝরলো কয়েক ফোঁটা। এই জল তীব্র ক্রোধ মেশানো অশ্রুজল। তার এখন চিৎকার করে শায়িখ-নুসাইবার সামনে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘ মা শুনুন, বাবা আপনিও শুনে রাখুন। আপনাদের একমাত্র ছেলে আমাকে কত জঘন্যভাবে ঠকিয়েছে! ছয়মাস ধরে বিদেশে থেকে সে কি করেছে শুনবেন? সুন্দরী বিদেশিনীর সাথে লিভিং করেছে। তার বিছানায়, তার পাশে, তারই কাছে অপরিচিত একটা মেয়ে দিনের পর দিন আমার জায়গা দখল করে থেকেছে। সে ওই মেয়েকে এতোই মর্যাদা দিয়ে ফেলেছে যে সে এখন প্রেগন্যান্ট। আপনাদের ছেলে বাবা হচ্ছে। কিন্তু মা আমি হচ্ছি না। মা হচ্ছে সেই অপরিচিত মেয়েটি। কিন্তু সেই মেয়েও আপনার ছেলেকে ধোঁকা দিচ্ছে জানেন? রিভেঞ্জ অফ নেচার বলে একটা কথা আছে না? সেটাই সত্যি হয়েছে। ওই মেয়ে প্রেগন্যান্ট সাজার নাটক করে আপনাদের ছেলেকে বিয়ে করে ফেলবে। ইলহান যেই দায়ে ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে সেই দায়টাই তো মিথ্যে! মিথ্যে বলে কাউকে বিয়ে করা কি ধোঁকা দেওয়া নয়? আমিও চাই বিয়ে হোক। ওদের বিয়েটা হয়ে যাক। ইলহান যেভাবে আমাকে ঠকিয়েছে একইভাবে সে নিজেও ঠকে যাক। সে বুঝুক, ঠকে যাওয়া কত কষ্টের! সবচেয়ে বিশ্বাসী মানুষটা যখন হাত ছেড়ে দেয় তখন কেমন লাগে! কতটা যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বেড়াচ্ছি আমি! ক্ষণে ক্ষণে মরছি শুধু! তাকে বুঝতেই হবে! সে বুঝুক!”

রাতে ঘুমানোর সময় অরিন বালিশের নিচে ছুঁড়ি নিয়ে শুলো। ছুঁড়িটা সে রান্নাঘর থেকে খুব সাবধানে লুকিয়ে এনেছে। ইলহানকে শাসিয়ে রাখার মূলমন্ত্র এটা। রাতে সে ভালো-মন্দ কিছু করলেই অরিন ঠিক ছুঁড়িটা ওর পেটে গেঁথে দিবে। আজকে সারাদিন ইলহানের আচরণে অরিন রাগে ঢোল হয়েছে। সব রাগ একসাথে জমা হয়ে আছে তার মস্তিষ্কে। ইলহান কিছুক্ষণ আগেও অরিনের সাথে গম্ভীর হয়ে ছিল। কিন্তু যখন ওরা ডিনারের জন্য বসেছিল তখনই অরিন দেখলো ইলহান আবার আগের মতো হাসি-তামাশা শুরু করেছে। অরিনের গাঁয়ে মরিচ ডলে দেওয়ার মতো জ্বালাময়ী কথা আওড়ে যাচ্ছে। অরিনের রাগ আগুনের মতো বাড়তে লাগলো তখন থেকেই। ইলহান ইতোমধ্যে ঘরের আলো নিভিয়ে অরিনের পাশে শুয়ে পড়েছে। প্রথম কয়েক মিনিট কোনো কথা হয়নি তাদের। নিঃশব্দ রুমজুড়ে একমাত্র শব্দের উপস্থিতি ঘড়ির টিকটিক আওয়াজটুকু। একটু পর ইলহান অরিনের দিকে ঘুরে বললো,” ছড়া শুনবে অরিন?”
অরিন বালিশটা চেপে ধরলো। ইলহান আবার কোনো ফালতু মশকরা করলেই সে ছুঁড়ি হাতে নিবে। ইলহান অরিনের অনুমতির অপেক্ষা না করেই ছড়া বলতে লাগলো,” অভিমানে লাল হয় আমার মিষ্টি ময়না, এতো বলার পরেও সে কথা শুনতে চায় না।
সে কি জানে? তাকে ছাড়া আমার একটা দিনও যায় না!
সে আমার প্রাণের ময়না।
মায়া মায়া চোখে সে, অতুলন মায়াবী কন্যা।
আমার বুকের মধ্যিখানে, অনুভূতির বন্যা!
কিন্তু সে আমার একটা কথাও শুনতে চায়না!”
ইলহান এইবার অরিনকে পেছন থেকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে বললো,” মায়াবী কন্যা কি আমার কথা শুনবে না? না শুনলেও জোর করে শোনাবো। তাকে শুনতেই হবে। ভালোবাসতে না দিলেও জোর করে ভালোবাসবো। তাকে ভালোবাসতেই হবে!”
অরিন বালিশে হাত ঢুকিয়ে দিল ছুঁড়িটা নেওয়ার জন্য। কিন্তু ছুঁড়ি হাতে আসছে না। কোথায় গেল? অরিন বালিশ হাঁতড়ে খুঁজতে লাগলো। ইলহান পেছনে থেকে ওকে জড়িয়ে ধরেই রেখেছে। তার চুলে মুখ ঘষছে। অরিন শুধু একবার ছুঁড়িটা পেয়ে যাক, আজকেই ইলহান খালাস হবে। ইলহান হঠাৎ হেসে বললো,” কি খুঁজছো? এইটা?”
অরিন তাকিয়ে দেখলো ছুঁড়ি ইলহানের হাতে। রাগে-দুঃখে চিল্লাতে ইচ্ছে করলো। সে খপ করে ছুঁড়িটা ধরতে যাবে তার আগেই ইলহান সরিয়ে ফেললো। আহ্লাদী স্বরে বললো,” কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়। আগে দাও, তারপর পাবে।”
অরিন ঝট করে উঠে বসলো৷ তারপর তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেল। ঝড়ের গতিতে গিয়ে আগে ঘরের আলো জ্বালিয়ে নিল। তারপর ক্রোধে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বললো,” আমি এখনি বাসা থেকে বেরিয়ে যাবো।”
ইলহান এতোক্ষণ হাসছিল। এই কথা শুনে সিরিয়াস হলো। বললো,” আরে অরিন, আমি তো মজা করছিলাম। আচ্ছা স্যরি, স্যরি, আর মজাও করবো না।তোমার ছুঁড়ি তুমিই নাও৷ আমি আর ধরবো না।”
অরিন ছোঁ মেরে ইলহানের হাত থেকে ছুঁড়িটা কেড়ে নিল। ইলহান আর কিছু না বলে শান্তভাবে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল্ল। অরিন আলো নিভিয়ে ইলহানের পাশে এসে শুলো। এরপর আর কেউ কিছু বলেনি। আবছা অন্ধকার রুমে ভয়ানক নিস্তব্ধতা। অরিনের হঠাৎ খুব দুঃখ অনুভব হলো। তার এতো অদ্ভুত কেনো লাগছে সে জানে না। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। ইলহান নিশ্চয়ই এতোক্ষণে ঘুম। অরিন লাইট জ্বালিয়ে ইলহানের চেহারা দেখার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ ঘুমিয়ে আছে সে কিন্তু একটা আশ্চর্য বিষয় খেয়াল করলো অরিন। ইলহানের চোখের কোনে অশ্রুপ্রবাহ জমে শুকিয়ে সাদা হয়ে আছে। এর মানে কি ঘুমানোর আগে সে কেঁদেছিল? ধূর, তা হবে কেনো? সে কেনো কাঁদবে? কাঁদার কথা তো অরিনের। ইলহানের তো এখন সুখের দিন। সারাদিন সে যেইসব কাহিনী করে তাতে একটুও মনে হয় না যে তার ভেতরে কোনো কষ্ট আছে। অরিন উঠে বারান্দায় চলে গেল। এই বারন্দায় ছোট্ট একটা বিছানা আছে। অরিন তো ভুলেই গেছিল এই বিছানাটির কথা। কষ্ট করে ইলহানের সাথে থাকার দরকার কি? এই বিছানাতেই সে ঘুমাতে পারে। অরিন ক্লান্ত শরীর বিছানায় ছেড়ে দিতে চাইলো। কিন্তু ঘটরঘটর একটা শব্দে সে প্রায় কেঁপে উঠলো আর লাফিয়ে বিছানা থেকে সরে গেল। এই বিছানার তোষকের নিচে কিছু আছে নাকি? অরিন বিছানার চাদর উল্টেই হতবাক হয়ে গেল। অনেকগুলো মদের বোতল। বেশির ভাগই খালি। কয়েকটা অর্ধপূর্ণ কিন্তু একটাও ইনটেক নেই। অরিন চলে যাওয়ার পরে কি ইলহান এখানে আরও কিছুদিন থেকেছিল? তাই তো মনে হচ্ছে। নাহলে এসব কে খাবে? অরিন যখন এই বাসায় ছিল তখন তো এইগুলো ছিল না। সে চলে যাওয়ার পরেই এগুলো আনা হয়েছে। অরিনের এখন খুব ড্রিংক করতে ইচ্ছে করছে। কতদিন সে ড্রিংক করে না। অরিন সবগুলো বোতল নামিয়ে মেঝেতে রাখলো। তারপর আরও এক দফা চমকাতে হলো তাকে। বিছানার নিচে প্রায় শ’খানিক কাগজের টুকরো। নষ্ট কাগজ গুঁজে বল বানিয়ে এখানে ফেলে রাখা হয়েছে। ইলহান কি মদ খাওয়ার পাশাপাশি কাউকে চিঠি লিখে? কাকে লিখে? একটা চিঠিও কি সে লিখে শেষ করতে পারেনি? সব চিঠি দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে রেখেছে কেনো? অরিন একটা কাগজের ভাজ খুললো। হাতের লেখা ইলহানেরই। কিন্তু লেখাগুলো খুব এলোমেলো। একটাও লাইন ঠিক নেই। প্রায় সব লেখাই লিখে একটানে কেটে দেওয়া হয়েছে৷ তবুও পড়া যাচ্ছে। অরিন একটা একটা করে পড়া শুরু করলো। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলো না। মনে হচ্ছে চিঠিগুলো ধারাবাহিক। একটার পর অন্যটা লেখা হয়েছে৷ তাই আগেরটা না পড়লে পরেরটা বোঝা যাবে না। অরিন খুব মাথা খাটিয়ে চিঠিগুলো ধারাবাহিকভাবে সাজানোর চেষ্টা করলো।
১.
” কারো সামনে যদি শুধুই দু’টো রাস্তা থাকে, একটা মরে যাওয়া অন্যটা বেঁচে থাকা। তাহলে সে কোন রাস্তায় যাবে? সবাই হয়তো বেঁচে থাকার রাস্তাতেই হাঁটবে। কারণ প্রত্যেকে চায় বেঁচে থাকতে। কিন্তু আমি মরে যাওয়ার রাস্তা বেছে নিয়েছি। এক কথায় নিজের জন্য মৃত্যুকূপ খুঁড়েছি। হাহ!”
২.
” নরম, তুলতুলে, ছোট্ট পুতুল। পা টিপিয়ে টিপিয়ে সুন্দর করে হাঁটে৷ মেয়েটার মাথাভর্তি ঘন চুল। ছোট্ট, কালো রঙের পনিটেইল পেছনে দুলে। কি আদুরে! কি সুন্দর! আহারে! সোনালীকায় মেয়েটির নাম হবে মায়াকন্যা। সে হবে আমার সোনালী সম্পদ। তার নরম মুখের দিকে চেয়ে মরতেও কোনো আপত্তি নেই।”
৩.
” সোফিয়ার কোলে আমার সন্তান আসবে? বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি তো কখনও এমন চাইনি। যাহা চাই তাহা পাই না, যাহা পাই তাহা কেনো চাই না? পৃথিবীর নিয়মগুলো মাঝে মাঝে খুব বিরক্তিকর হয়। আবার মাঝে মাঝে অনেক সুখকরও হয়। যেমন অরিনের সাথে আমার বিয়ে হওয়া। এই বিয়েটা না হলে ভালোবাসার আসল সংজ্ঞা সারাজীবন অজানাই থেকে যেতো৷ ভাগ্যিস বিয়ে হয়েছিল! অরিনকে ধোঁকা দিয়ে নিজেই বোকা হয়ে গেলাম৷ বোকার মতো সত্যিই কাউকে ভালোবাসলাম। কিন্তু আমাকে কি ভালোবাসা মানায়? আমার জন্ম হয়েছে দুনিয়ার সর্বসুখ উপভোগ করতে। ভালোবাসা তো কষ্টের কাজ। এই কাজ আমি কেনো করবো? আমার বদ্ধমূল এই ধারণা পাল্টে দিল অরিন নিজেই। সে বুঝিয়ে দিল আমাকে, ভালোবাসায় অবশ্যই সুখ আছে। অপরিসীম সুখ! কিন্তু সেই সুখে কোনো শান্তি নেই!”
৪.
” সবাই তো কিছু না কিছু ভুল করে। আমি তো ফেরেশতা নই আবার শয়তানও নই। আমি মানুষ। তাই আমার দ্বারা ভুল হওয়া বাঞ্চনীয়। তেমনই এক বাঞ্চনীয় ভুল আমি করে ফেলেছি। যা হয়ে গেছে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল, অরিনকে ভালোবাসার ভুল। যদি তাকে ভালো না বাসতাম, তাহলে আমার জীবনটা কত শান্তির হতো! ধরা পড়ার ভয় থাকতো না। প্রতিরাতে দুঃস্বপ্নে অরিন গম্ভীর মুখে আমায় এসে বলতো না,’ ইলহান তোমার আমার সম্পর্ক আজ থেকে সমাপ্ত হলো। তুমি ধোঁকাবাজ, প্রতারক।’ আমি প্রতিরাতে ধড়মড় করে জেগে উঠতাম না। তারপর অরিনকে পাশে পেয়ে তার বুকে মাথা গুঁজে শুয়ে থাকতাম না। ভেতরে আতঙ্ক নিয়ে দিনের পর দিন বেঁচে থাকতাম না। যদি ভালো না বাসতাম, এসব কিছুই আমি করতাম না। কিন্তু আমি করেছি, সবই করতে হয়েছে। কারণ আমি ভালোবেসেছি।দুঃস্বপ্নগুলো সত্যি হলো৷ এতো লুকিয়ে কি লাভ হলো? অরিন তো সব জেনেই গেল৷ তাকে হারানোর যে চিরাচরিত ভয়ে আমি সদা আড়ষ্ট থাকতাম সেটাও সত্যি হয়ে গেল! আমার বন্দ্বী খাচার পাখি এখন মুক্ত হতে চায়৷ তাকে মুক্তি না দিয়ে উপায় আছে? কিন্তু তার মুক্তি মানেই তো আমার অর্ধ মৃত্যু!”
৫.
সোফিয়ার প্রেগন্যান্সির কথা জানতে পেরে সেদিন প্রথমবারের মতো আমার বুকে বিরাট এক ধাক্কা লাগলো। সেই ধাক্কা থামিয়ে দিল সময়, স্রোত, সবকিছু! আমার কাছে তখন দু’টো অপশন। আমার অরিন, আমার বাচ্চা। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ নিষ্পাপ দু’টি সম্পদ। কার জীবন বাঁচানো উচিৎ আমার? অরিনকে বাঁচাতে গেলে বাচ্চাটিকে মারতে হবে৷ আবার বাচ্চাটিকে বাঁচাতে গেলে অরিনকে ছাড়তে হবে। অরিন নিশ্চয়ই আমাকে ছেড়ে দিব্যি বেঁচে থাকবে। কিন্তু বাচ্চাটি কি পারবে বাবা ছাড়া বাঁচতে? আমি তো পারিনি। তাহলে এখন আমি কাকে বেছে নিবো? অরিনকে নাকি বাবুকে? কাউকে ফেলতে পারলাম না। দুজনকেই বেছে নিতে হলো। কিন্তু বিনিময়ে নিজেকে বিসর্জন দিতে হলো। অরিন আমাকে ছেঁড়ে চলে গেল। ভালোই আছে সে। কিন্তু আমি যে ভালো থাকতে পারলাম না। অর্ধমৃতের মতো বাঁচতে হচ্ছে আমাকে। অরিন কি তাহলে আমার অর্ধআত্না ছিল? তাকে ছাড়া বেঁচে থাকা মানেই কি মরে মরে বেঁচে থাকা?”
৬.
” সোফিয়া বলেছে, আমাদের বিয়ে না হলে সে বাচ্চা এবোর্শন করবে। বাবা হয়ে নিজের সন্তানকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা তো করতে পারি না৷ তাই সোফিয়াকে বিয়ে করতে রাজি হলাম। এক কথায় নিজের মরে মরে বেঁচে থাকা নিশ্চিত করলাম।”
৭.
” যে কথা কাউকে কখনও বলতে ইচ্ছে করেনি তা আজ হঠাৎ লিখতে ইচ্ছে করছে। লিখবো নাকি? থাক লিখি, আই হেইট ইউ। আই হেইট ইউ সোফিয়া। তুমি আমার কোমল হৃদয় নিয়ে শুরু থেকেই খেলেছো। প্রথম থেকেই তুমি আমাকে নষ্ট হতে বাধ্য করেছো। আমি তো তোমার কাছে অপশনের মতো ছিলাম তাই না? যদি তুমি অন্য পুরুষের সাথে লিভিং না করতে আমিও কি অন্যমেয়েদের কাছে কোনোদিন যেতাম বলো? তোমার জন্যই আমি স্বচরিত্রে দাগ লাগিয়েছি। এজন্য তোমাকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করবো না ভেবেছিলাম। কিন্তু যখন অরিন আমার জীবনে এলো, আমি নির্বিচারে তোমায় ক্ষমা করে দিলাম। কারণ তুমি যদি আমার চরিত্র নষ্ট না করতে তাহলে অরিনকে আমি পেতাম না। এংকারের সাথে বাজি লেগে অরিনকে জিততে চাইতাম না। ওর মতো পবিত্র রত্ন কোনোদিন আমার জীবন আলোকিত করতে আসতো না। ভাগ্যিস তুমি আমাকে ধোঁকা দিয়েছিলে সোফিয়া। নয়তো আমি অরিনকে কিভাবে পেতাম বলো? কিন্তু যে জিনিস একসময় তুমিই আমার জীবনে আনতে বাধ্য করেছিলে এখন সেটাই কেনো আমার থেকে কেড়ে নিতে চাইছো? আমি তো বাঁচতে শিখে গেছিলাম। তাহলে এখন তুমি আবার আমায় মৃত্যুকূপে ঠেলে দিতে চাইছো কেনো? তুমি কি কোনোদিন আমায় বাঁচতে দিবে না সোফিয়া? আবারও বলছি, আই হেইট ইউ সোফিয়া। আই হেইট ইউ।”

অরিন চিঠিগুলো পড়তে পড়তে প্রায় দুই বোতল মদ শেষ করে ফেললো! এখন তার অবস্থা বেসামাল। সবকিছু ঘুরছে৷ সে নিজেও হাওয়ায় ভাসছে। কোনোমতে এলোমেলো পা ফেলে বারান্দা থেকে বেরিয়ে রুমে আসলো।

চলবে
– Sidratul Muntaz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here