রংধনুর_রঙ_কালো,২
Sidratul Muntaz
অরিন মুখ উজ্জ্বল করা হাসি দিল। ইলহানের চেহারা দেখে একটুও বোঝা গেল না যে ভেতরে ভেতরে কতটা খারাপ অবস্থা হয়েছে তার। ভয়াবহ শঙ্কায় বক্ষপিঞ্জর জমে বরফে রূপান্তর হয়েছে। অজস্র এলোমেলো প্রশ্ন ইলহানের মস্তিষ্কে ক্ষীপ্ত মৌমাছির ঝাঁকের মতো কিলবিল করছে। কিন্তু ইলহান কোনো প্রশ্ন করলো না অরিনকে। খুব সহজেই নিজেকে সামলে সহজ স্বাভাবিক হাসি দিল ইলহান। সেই হাসিতে কৃত্রিম আনন্দমিশ্রিত। ইলহান তেড়ে এসে শক্তভাবে অরিনকে জড়িয়ে ধরলো। এর আগে অরিন মেঝে থেকে ইলহানের মোবাইলটা কুড়িয়ে নিয়েছিল। মোবাইলের ডিসপ্লে হালকা ফেটে গেছে। অরিন কথা বলার আগেই ইলহানের হঠাৎ আক্রমণে থতমত খেলো। ইলহান এইভাবে এসে জড়িয়ে ধরবে অরিন কল্পনা করেনি। ভেবেছিল ইলহান ভীষণ অবাক হবে। এটা-সেটা প্রশ্ন করবে। কিন্তু এখন ওকে অবাক কম, খুশি বেশি মনে হচ্ছে। অরিনও ইলহানের পিঠ জড়িয়ে ধরে হেসে উঠলো। কতদিন পর, কতদিন প্রিয়তমের উষ্ণ পরশে শরীর-মন আবার নতুন করে আবেশিত হচ্ছে। প্রাণটা প্রশান্তিময় শীতল স্পর্শে জুড়িয়ে যাচ্ছে। ইলহানের হৃৎস্পন্দনের শব্দে আর পরিচিত শারীরিক সুভাষে অরিন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তার বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না যে এতোদিন ইলহানকে ছেড়ে সে কতটা তৃষ্ণার্ত ছিল! ইলহানও নিশ্চয়ই অরিনের অনুপস্থিতি একইভাবে অনুভব করেছে। তাইতো এইভাবে চেপে ধরে আছে নিজের সাথে। যেনো কোথাও হারিয়ে যেতে দিবে না অরিনকে। কিন্তু ইলহান অরিনকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো চিন্তা করছে বিভিন্ন বিষয়। ছাদে সোফিয়া আছে। হঠাৎ নেমে আসলে কি হবে? ইলহানের সেলফোনটাও এখন অরিনের হাতে। সেই সেলফোনের ওয়ালপেপারে তার আর সোফিয়ার একটা ঘনিষ্ট ছবি আছে। অরিন যে-কোনো মুহুর্তে সেটা দেখে ফেলতে পারে। ইলহান উড়ন্ত আত্মা নিয়ে অরিনকে আরও ভালো করে চেপে ধরলো। ভয়ে তার অবস্থা নাজেহাল। অরিন কিভাবে এখানে আসলো? কেনো আসলো? তার উদ্দেশ্য কি? অরিন আদুরে কণ্ঠে বললো,
” এইবার ছাড়ো তো ইলহান, অনেক হয়েছে। আমাকে ভেতরে আসতে দাও। আর তোমার ফোনটা যে হাত থেকে পড়ে গ্লাস ফেটে গেল? কি হবে এবার?”
অরিন কথা শেষ করার আগ-মুহুর্তেই ইলহান তার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল। অরিন বিস্ময়ে চিৎকার করলো,
” আরে, আরে!”
ইলহান শীতল গলায় বললো,” কিচ্ছু হবে না। তুমি ছাড়া আপাতত সবকিছু মূল্যহীন।”
একথা বলেই সে অরিনের কোমড় ধরে কোলে নিয়ে নিল। অরিন শক্ত করে কাঁধ চেপে ধরলো ইলহানের। অবাক হয়ে খুব জোরে হাসতে লাগলো। ইলহানের আচরণে সে শুধুই অবাক হচ্ছে। ছেলেটা একদম আগের মতোই পাগল রয়ে গেছে। অরিন ভেবেছিল এই ছয়মাসে একটু হলেও ম্যাচিউর হবে গরুটা। কিন্তু না, এ পুরো সাইকো! ইলহান পা দিয়ে দরজা বন্ধ করে অরিনকে ভেতরের একটা রুমে নিয়ে গেল। যেতে যেতে আঁড়চোখে মোবাইলটা দেখলো। ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে তো? নাহলে শুধু এই মোবাইলের জন্যই ইলহানকে খুব বাজেভাবে ধরা খেতে হবে। ড্যাম! অরিনকে বিছানায় বসিয়ে ইলহান জুতো খুলে দিতে দিতে বললো,
” আমার এতো খুশি কেনো লাগছে অরিন? তোমাকে খুব মিস করছিলাম। মাত্রই ফোন হাতে নিয়েছিলাম তোমাকে ফোন করার জন্য। আর দেখো, তুমি আমার সামনে চলে আসলে। এটাই কি ভালোবাসার জোর?”
অরিন হাসিমুখে বললো,
” আমি কিভাবে চলে আসলাম জিজ্ঞেস করবে না? আমার হঠাৎ আগমনে তুমি অবাক হওনি?”
ইলহানের আপাতত মাথাই কাজ করছে না দুশ্চিন্তায়। সে হাসতে হাসতে বললো,
” আসলেই তো, কিভাবে আসলে? আর তুমি কি একা এসেছো? বাবা, মা, শ্যানিন.. কেউ আসেনি তোমার সাথে?”
অরিন ইলহানের মাথায় একটা চাপড় মেরে বললো,
” গরু, এতোক্ষণে খেয়াল করলে যে আমি একা?”
ইলহানের বিস্ময় বেড়ে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
” তুমি একা কিভাবে এসেছো অরিন? কোনো অসুবিধা হয়নি?”
অরিন বিছানার উপর উঠে দাঁড়ালো। তারপর ইলহানের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
” একা আসিনি মিস্টার। আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে এসেছি। নতুন বিয়ে হয়েছে তো, হাসব্যান্ড নিয়ে হানিমুন করতে অস্ট্রেলিয়া আসবে। আমাকেও অফার করলো। ব্যস! সুযোগের সদ্ব্যবহার করে চলে আসলাম তোমার কাছে!”
ইলহান গুমোট কণ্ঠে বললো,” তুমি ফ্রেন্ডের সাথে এসেছো? আবার তার হাসব্যান্ডও ছিল? আমাকে জানালে না কেনো? আমিই গিয়ে নিয়ে আসতাম।”
” সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম তাই জানাইনি৷ কেনো? না জানিয়ে এসে কি ঝামেলায় ফেলে দিলাম তোমায়?”
ইলহান অরিনের দুইহাত পেছনে চেপে ধরে বললো,” ঝামেলায় তো এখন তুমি পড়বে মিসেস অরিন মাহদী।”
দুষ্টুমি কণ্ঠে এই কথা বলে অরিনের নাকে চুমু দিল ইলহান। অরিন নাক মুছে বললো,
” এই খবরদার! তোমার নামের সাথে আমার নামের পদবী যোগ করবে না। আমি মিসেস অরিন মাহদী না। মোসাম্মাৎ অরিন জোয়ার্দার। মুসলিম মেয়েদের বিয়ের পর নাম বদলানোর নিয়ম নেই। স্বামীর নামের সাথে মিলিয়ে স্ত্রীর নাম ডাকা হারাম।এটা জানো না?”
” আসলেই জানতাম না। ঠিকাছে, এখন থেকে আর বলবো না। খুশি?”
” বাসাটা অনেক সুন্দর। আচ্ছা, আমি কিভাবে তোমার বাসা চিনলাম সেটা জিজ্ঞেস করবে না?”
” চেনার কি আছে? তোমাকে কি আমি বাসার এড্রেস বলিনি আগে?”
” কিছুই বলোনি। তুমি যে এতোবড় বাড়িতে থাকো এটাই তো আমি জানতাম না।”
” কি বলো! আমার তো মনে হয় আমি তোমাকে বলেছিলাম। আসলেই কি বলিনি কখনও? ”
” উহুম। একদম বলোনি।”
ইলহান চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইল। একটু পর হেসে বললো,” ও আচ্ছা, মনে ছিল না হয়তো। পরে আস্তে-ধীরে বলবো সব। তুমি ফ্রেশ হও ততক্ষণে। আর খেয়েছো কিছু? ক্ষিদে পায়নি?”
” পেয়েছে তো। কিন্তু আগে গোসল করবো। অনেক টায়ার্ড লাগছে। ইট ওয়াজ আ লং জার্নি।”
ইলহান আলতো করে অরিনের চুলে হাত বুলিয়ে দিল। তার মনে আছে সে অরিনকে আগে কিছুই বলেনি। তাকে কোনো পাগলে পায়নি যে অরিনকে বাসার ঠিকানা জানিয়ে দিবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে অরিন ঠিকানা পেল কোথায়? কিভাবে জানলো সে ইলহানের আসল অবস্থান? অরিনকে সরাসরি কোনো প্রশ্ন করা যাচ্ছে না। ইলহান যদি এখন বলতো সে অরিনকে বাসার কথা জানায়নি তাহলে নিশ্চয়ই অরিন বলতো কেনো তাকে জানানো হয়নি৷ ইলহান এমন বিলাসবহুল বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও অরিন কেনো সেটা জানতে পারবে না। এই প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে গেলে ইলহানকে হিমশিম খেতে হবে। সে কোনোভাবেই সন্দেহে পড়তে চায় না। বরং অরিনের অগোচরে খোঁজ নিতে হবে। আসলে কোথায় কি হচ্ছে? ইলহান চমৎকার হাসি দিয়ে অরিনের দুই গাল চেপে ধরে বললো,
” অরিন, আমি যে কত্ত খুশি হয়েছি তোমাকে বুঝাতে পারবো না। থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।”
” কেনো?”
” সকাল সকাল এতো দারুণভাবে আমাকে সারপ্রাইজড করার জন্য।”
অরিন হেসে ফেললো। ইলহান চিন্তিত মন নিয়ে রুম থেকে বের হলো। বের হওয়ার আগে দরজা বাহিরে থেকে লক করতে ভুললো না। ভোরবেলার স্বপ্নটা তাহলে সত্যি হয়ে যাচ্ছে। ইলহান আজ স্বপ্ন দেখেছিল সোফিয়ার জায়গায় অরিন শুয়ে আছে তার পাশে। পরম আদরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু অরিনের চোখমুখ অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। সেই ভয়ংকর দৃষ্টি দেখেই ইলহানের ঘুম ভেঙে যায়। আজ তো সোফিয়ার জায়গায় অরিনই ইলহানের পাশে থাকবে।
অরিনের মনটা এখন ফুরসুরে লাগছে। সে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে মোবাইল হাতে নিল। কিছুক্ষণ আগেও অসহ্য সন্তাপের দহনে তার বুকটা পুড়ে যাচ্ছিল। এখন মনে হচ্ছে সেই উত্তপ্ত জায়গায় কেউ বরফ ছুঁইয়ে দিচ্ছে। শান্তি শান্তি লাগছে। তবে ইলহানকে অরিন একটা মিথ্যে বলেছে। কোনো বান্ধুবির সাথে আসেনি সে। এসেছে অন্বয়ের সাথে। ইলহানের মা-বাবা অর্থাৎ অরিনের শ্বশুর-শাশুড়ি এ বিষয়টা জানেন না। অন্বয় গোপন রাখতে বলেছিল। অরিন তার এক ক্লাসমেট ও তার হাসব্যান্ডকে শায়িখ সাহেব ও নুসাইবার সাথে দেখা করিয়েছিল। তাদের সাথে অস্ট্রেলিয়া যাবে এই বলে শ্বশুর-শাশুড়িকে ম্যানেজ করেছিল। তারা অরিনকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। ভাগ্য ভালো যে কেউই অরিনের সাথে আসতে চায়নি। অরিন বলেছিল ইলহানকে সারপ্রাইজ দিতে যাচ্ছে৷ তাই বাসা থেকে এখনও কেউ ইলহানকে এ বিষয়ে জানায়নি। অরিন মোটেও ইলহানকে সন্দেহ করে অন্বয়ের সাথে এতোদূর আসেনি। সে শুধু অন্বয়কে বুঝাতে চায় যে তার স্বামী কোনো প্রতারক নয়। ইলহান তার স্ত্রীকে প্রচন্ড ভালোবাসে। কালো রঙ নিয়েও ইলহানের কাছে সে-ই সবচেয়ে স্পেশাল, সবচেয়ে যত্নের। তাছাড়া নিজের মনের শান্তির জন্য হলেও অরিনকে এখানে আসতেই হতো। অন্বয়কে ফোন করলো অরিন। অন্বয় বলেছিল মিনিটে মিনিটে আপডেট জানাতে হবে৷ নয়তো সে টেনশনে থাকবে। অরিন এখন অন্বয়কে বুঝিয়ে বলবে যে টেনশনের কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ ইলহানের কাছে সে সবসময় সুরক্ষিত!
ইলহান মেঝে থেকে ভাঙা সেলফোনটা কুড়িয়ে নিল। তারপর সাবধানে সিড়ি ভেঙে ছাদের দিকে অগ্রসর হলো। সোফিয়া তখনি নিচে নেমে আসছিল। ইলহান দুইহাতে থামালো তাকে।
” কি হলো?”
” নিচে যাওয়া যাবে না৷ উপরে চলো।”
” কেনো?”
ইলহান তর্ক না করে একহাতে কাঁধে তুলে নিল সোফিয়াকে। সোফিয়া আশ্চর্য হয়ে গেল। একনাগাড়ে বলতে লাগলো,
” এইসব কি করছো ইলহান? আবার তোমার পাগলামি শুরু হয়েছে?”
ইলহান সোফিয়াকে ছাদে এনে রাখলো। পকেট থেকে রুমাল বের করে নিজের কপালের ঘাম মুছতে শুরু করলো। তার চেহারার আতঙ্কই বলে দিচ্ছে কতটা বিপজ্জনক অবস্থায় আছে সে। ওকে দেখে সোফিয়া বুঝলো নিশ্চয়ই সিরিয়াস কিছু হয়েছে। ইলহানের গালে হাত রেখে সোফিয়া প্রশ্ন করলো,
” বেইবি, হোয়াট’স রং উইদ ইউ?”
ইলহান জোরে কয়েকবার হাফ ছেড়ে বললো,” ব্লেন্ডার হয়ে গেছে অনেকবড়। বাংলাদেশ থেকে আমার বউ চলে এসেছে।”
” হোয়াট? বেংলাডেশ থেকে? মানে তোমার ওই ব্ল্যাক গার্ল?”
” তুমি এখন আমার সাথে নিচে যেতে পারবে না। অরিন যতদিন থাকবে ততদিন তুমি..”
” নো,নো,নো!”
ইলহান কি করতে যাচ্ছে বুঝতে পেরেই সোফিয়া চেঁচিয়ে উঠলো। ইলহান ওর চিৎকারের তোয়াক্কাও করলো না। হাত ধরে টেনে স্টোররুমে ঢুকিয়ে বললো,
” মাত্র কয়েকটাদিন ম্যানেজ করো সোফি, প্লিজ। আমি যত দ্রুত সম্ভব অরিনকে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো। ততদিন তুমি একটু এডজাস্ট করে নাও। বিনিময়ে তুমি যা চাইবে তাই পাবে।”
” সত্যি যা চাইবো তাই দিবে?”
” হ্যাঁ। ”
সোফিয়া কাছে এসে ইলহানের কলার টেনে ধরে বললো,
” উইল ইউ ম্যারি মি?”
ইলহান থমকে গেল এই প্রশ্নে। নিষ্পলক চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর জানালো,” ভেবে বলবো।”
সোফিয়ার হাত ছাড়িয়ে ইলহান যখন চলে যাচ্ছিল তখনই তার চোখ দু’টো ছলছল করে উঠলো। কোথায় সেই আগের ইলহান? এতোটা বদলে গেল কেনো? ইলহান ভীষণ বিরক্তি নিয়ে নিচে নামছে। ওয়েস্টার্ন কান্ট্রির মেয়েরাও যে এতোটা বিয়ে-পাগল হতে পারে সোফিয়াকে না দেখলে ইলহান বিশ্বাস করতে পারতো না। ইদানীং দিন-রাত শুধু বিয়ে বিয়ে করে ইলহানের লাইফটা স্পয়েল করে দিচ্ছে সোফিয়া। এরকম চলতে থাকলে সোফিয়ার সাথেও ব্রেকাপ করতে হবে। ইলহান দ্বিতীয় তলায় থামলো বেডরুমটা গুছানোর জন্য। এইখানে অরিন ঢুকলে কেয়ামত হয়ে যাবে।
অন্বয় অধৈর্য্য হয়ে বললো,” আপনাকে আর কি বুঝাবো অরিন? আপনার হাসব্যান্ড অবশ্যই মিথ্যে বলেছে। নাহলে সে যে মেলবোর্নে এতোবড় বাড়িতে একা থাকে এটা কখনও আপনাকে জানাবে না কেনো?”
” হয়তো জানিয়েছিল। আমারই মনে নেই।”
” এখন আপনিও মিথ্যা বলছেন। আপনি নিজেও খুব ভালো মতো জানেন সে আপনাকে এ বিষয়ে আগে কখনও কিছু বলেনি। ”
” হয়তো ভুলে গেছিল।”
” আপনার মতো বুদ্ধিমতীকে এতো সরলতা কখনোই মানায় না অরিন। এমন একটা বিষয় কেউ ভুলে যেতে পারে? আপনি তার ওয়াইফ, অর্ধাঙ্গিনী। তার জীবনের সাথে আপনার জীবন জড়িত। তাহলে কেনো আপনাদের মধ্যে লুকোচুরি থাকবে? আপনার হাসব্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার কোথায় থাকে, কি করে, কার সাথে মেশে আপনি এইসব খোঁজ-খবর রাখবেন না কেনো? অবশ্যই আপনার সবকিছু জানার অধিকার আছে।”
” জানতেই তো এসেছিলাম। তবে আমি তেমন কিছু পাইনি। আমার মনে হয় না যে ইলহান ইচ্ছাকৃত আমার থেকে কিছু গোপন করেছে। আর খুনের বিষয়টা? আপনি আরও ভালো করে তদন্ত করুন অন্বয় শিকদার। আপনার ইনভেস্টিগেশনে ঘাটতি আছে। আসল অপরাধীকে খুঁজে না পেয়ে আমার স্বামীর উপর দোষ চাপাতে আসবেন না। আমি তার বিষয়ে আগে যা জানতাম এখনও তাই জানি।”
অন্বয় কোমরে হাত রেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো। তারপর শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,
” কি জানেন আপনি? বলুন তার এতো সম্পতির উৎস কি? সে রাতারাতি কিভাবে নরমাল স্টুডেন্ট থেকে ধনী হয়ে গেল?”
” এই কারণটা আমি আপনাকে বলতে পারবো না৷ এটা আমাদের পারিবারিক ব্যক্তিগত বিষয়।”
” ঠিকাছে। না বলেন। কিন্তু আপনি এইটা বলুন, বাড়িতে প্রবেশ করার পরেও কি আপনার কিচ্ছু অদ্ভুত মনে হয়নি?”
” আমি এখনও সম্পূর্ণ বাড়ি ঘুরে দেখিনি।”
” তাহলে দ্রুত ঘুরে দেখুন। একটা না একটা প্রমাণ অবশ্যই পাবেন। অপরাধী কখনও নির্ভুল হতে পারে না।”
” আপনি বার-বার আমার স্বামীকে অপরাধী বলবেন না প্লিজ। আমি এখনও তার মধ্যে অপরাধ খুঁজে পাইনি।”
অন্বয় ফোন রেখে দিল। অরিন কক্ষ থেকে বের হতে নিয়ে দেখলো বাহিরে থেকে দরজা লাগানো। অদ্ভুত! অরিন দরজায় সশব্দে টোকা দিতে শুরু করলো। টোকা শুনে ইলহান দ্রুত নিচে এসে দরজা খুলে অরিনের সামনে হাসিমুখে দাঁড়ালো। অরিন জিজ্ঞেস করলো,
” বাহিরে থেকে দরজা বন্ধ করলে কেনো?”
” বন্ধ করিনি। এই দরজায় লক সিস্টেমে প্রবলেম। মাঝে মাঝে অটো লক হয়ে যায়।”
ইলহানকে দেখে কেনো মনে হচ্ছে যে সে মিথ্যে বলছে? তার মুখের হাসিটাও নকল লাগছে। অরিন সন্দেহী দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললো,
” তোমার শরীর থেকে শ্যাম্পুর গন্ধ আসছে। ফিমেল ব্র্যান্ড!”
ইলহানের মুখ চুপসে গেল। সে কিছু বলার আগেই অরিন তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে রুম থেকে বের হলো। ইলহান অপ্রস্তুতিতে পড়ে গেল। সোফিয়ার কোনো জিনিস যদি ভুলেও অরিনের চোখে পড়ে তাহলে সর্বনাশ! কি করা যায়? অরিনকে কি সে সেন্সলেস করে ফেলবে?
এ বাড়ির নিচতলার পুরোটা জুড়ে শুধু ড্রয়িং আর ডাইনিং রুম। সাথে একটা কমন রুমও আছে। যেটায় এতোক্ষণ ইলহান অরিনকে আটকে রেখেছিল। দ্বিতীয় তলায় কি আছে এখনও দেখা হয়নি। অরিন সিড়িতে যাওয়ার আগে খেয়াল করলো ডাইনিং টেবিলের উপর একটা অর্ধেক খাওয়া কফি মগ। সেই মগে হালকা লিপস্টিকের দাগ লেগে আছে। অরিনের ভেতরটা শিরশির করে উঠলো। শারিরীক শক্তি অর্ধেক ক্ষয়ে গেল। সে কোনোমতে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলো। এখন সে দ্বিতীয় তলায়। এই জায়গাটা অনেক সুন্দর। মাঝখানে ফাঁকা আর চারপাশে রুম। ফাঁকা জায়গাটি জুড়ে অনেক সুন্দর নীল নকশা। পা রেখে হাঁটতেও ভালো লাগছে। একদম বরাবর যেই রুম সেটাই সবচেয়ে বড়। বাকি রুমগুলোর দরজা বন্ধ। শুধু সেই রুমেই হালকা আলো জ্বলছে। দরজা একটু ভিঁড়ানো। অরিন লাফানো আত্মা নিয়ে সেই রুমে প্রবেশ করলো। বিছানা এলোমেলো। পুরো বাড়ি গুছানো থাকলেও এই রুমটা অগোছালো। অরিনের অন্ধকারভীতি আছে। এই রুমটা এতো অন্ধকার কেনো? সে দেয়ালের সুইচ হাতড়ে আলো জ্বালিয়ে নিল। চারদিক পর্দা দিয়ে আবৃত। অরিন পর্দা সরিয়ে দিল। তারপর সম্পূর্ণ রুমটা দেখে তার চোখ ছানাবড়া হওয়ার অবস্থা। সবকিছু ঝাপসা লাগছে৷ বুকের ভেতর অপ্রতিরোধ্য কম্পন শুরু হয়েছে।এই ঘরে ড্রেসিং টেবিল দু’টো। একটায় শুধু মেয়েদের কসমেটিক্স। কাঁচের আলমারিতে ইলহানের পোশাকের সাথে মেয়েলী পোশাক দেখা যাচ্ছে। এক কথায় পুরো রুম ছেয়ে আছে মেয়েলী গন্ধে। সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা অরিনের হৃদয় জ্বালিয়ে দিল তা হচ্ছে বিছানার ঠিক বাম পাশের মেঝেতে একটা লাল রঙের অন্তর্বাস পড়ে আছে। ইশশ! কত জঘন্য! মনে হচ্ছে সে অপরিচিত কোনো মহিলার বেডরুমে ঢুকে পড়েছে। এইটা যে তার স্বামীর রুম কোনোভাবেই তা মনে হচ্ছে না। অরিন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। সে মনে-প্রাণে চাইছে এটা যেনো কোনো দুঃস্বপ্ন হয়। অরিন হঠাৎ গায়েবী আওয়াজ শুনলো। অন্বয় যেনো উপহাস করছে তাকে। বিকট শব্দে হেসে বলছে,
” মিসেস অরিন, এখন কোথায় গেল আপনার এতো বিশ্বাস, ভালোবাসা, ভরসা? কত সহজেই সব ভেঙে টুকরো হয়ে গেল তাই না? আপনার স্বামী একজন নিকৃষ্ট, চরিত্রহীন, কলুষিত, নারীখাদক! এইবার বিশ্বাস হয়েছে আমার কথা? হা-হা-হা!”
চলবে